যিলহজ্ব ১৪৩৫   ||   অক্টোবর ২০১৪

তুরস্কে, তুর্কিস্তানের সন্ধানে-২

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মাওলানা আব্দুল মালেক ছাহেব জানালেন, আগামীকাল সকাল আটটায় ভারতের বেসরকারী বিমান সংস্থা জেট এয়ার-এর ফ্লাইটে নয়া দিল্লীর উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা। সেখান থেকে ‘টার্কিশ এয়ারলাইন্স’-এর মাধ্যমে ইস্তাম্বুল।

আয়োজক সংস্থা থেকে বলা হয়েছে, নয়া দিল্লী পর্যন্ত নিজেদের দায়িত্বে টিকেট সংগ্রহ করতে; ইস্তাম্বুলে তারা সেটা পরিশোধ করবেন। মুদীর ছাহেব তখনই জেট এয়ারের তিনটি টিকেটের ব্যবস্থা করে ফেললেন অনলাইনের মাধ্যমে। তিনি যদি বলতেন, টিকেটের অন্তত কিছু অর্থ আমাকে যোগাড় করতে হবে, তাহলেও একটা দুর্বল বাহানা হাতে আসতো, কিন্তু এ বিষয়ে তিনি খুবই পাকা মানুষ!

***

বলতে গেলে এটা ছিলো আমার জীবনের প্রথম বিদেশযাত্রা। এর আগে সফর হয়েছে শুধু আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে। বাইতুল্লাহর সফরকে আর যাই হোক বিদেশ-সফর, বিদেশভ্রমণ, বা বিদেশযাত্রা বলার সুযোগ নেই। সেটা হলো আত্মার জগতে আত্মার সফর। তাতে আনন্দের মধ্যে যেমন আছে সুখ, তেমনি বড় থেকে বড় কষ্টের মধ্যেও থাকে আশ্চর্যরকম এক আত্মিক সুখ, যা মুমিনের হৃদয় ও আত্মাই শুধু অনুভব করতে পারে। এছাড়া দুনিয়ার আর যত রকম সফর আছে তাতে কষ্টের মধ্যে তো কষ্ট থাকেই, এমনকি আনন্দের মধ্যেও থাকে কিছু না কিছু কষ্ট। এ সত্য আমি অনুভব করেছি পাঁচ দিনের তুরস্ক সফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। তবে কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করতেই হবে যে, সফরের ঝক্কিঝামেলা নামে যে একটা জিনিস আছে, তা আমাকে পোহাতে হয়নি সামান্য পরিমাণেও। যা কিছু করার করেছেন মুদীর ছাহেব। আমাকে শুধু কষ্ট করে বিমানবন্দরে যেতে হয়েছে। বিমানে উঠতে হয়েছে, আর বিমান থেকে নামতে হয়েছে। শুধু এইটুকুর জন্য হলেও মানুষটিকে ভালো না বলার অন্তত আমার দিক থেকে কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ তাঁকে উত্তম বিনিময় দান করুন।

***

‘পাড়াপড়শীর ঘুম নেই’ বলে একটা কথা বাংলাদেশে প্রচলিত রয়েছে, যার বাস্তব প্রমাণ পেলাম আমার নিজের ক্ষেত্রে। সারাটা রাত আরাম করে ঘুমোলাম। ভোররাতে উঠে দেখি, আমি ছাড়া আর কারো চোখে ঘুম নেই। সবাই ভীষণ ব্যস্ত আমার সফরের আয়োজনে, বরং বলা ভালো, মহাআয়োজনে।

কার কাছ থেকে যেন এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে, তুরস্ক হলো ইউরোপের দেশ, আর ইউরোপ মানে বরফ, আর বরফ মানে শুধু হাড়কাঁপানো নয়, রীতিমত রক্ত জমিয়ে দেয়া শীত! সুতরাং গরম কাপড় যা আছে এবং যা নেই সব ভরা হয়েছে এবং এখনো ভরা হচ্ছে বড় একটা বাক্সে। অনেক বলে কয়ে কিছু বাদ দেয়া গেলো, তারপরো যা থাকলো তাতেও বাংলাদেশের দু’চারটে শীত সামাল দেয়া যায় আরামসে। কিন্তু তুরস্কে গিয়ে দেখা গেলো, শীতটা বাংলাদেশের চেয়ে বেশী কোনভাবেই নয়। সুতরাং যা বয়ে নিয়ে গেলাম, তাই বহন করে নিয়ে এলাম। শালটা ছাড়া আর কিছু খোলার দরকারই হয়নি।

তোমার আম্মু কোথায়? না, তিনি রান্নাঘরে রুটি সেঁকছেন, আর মুরগির কাবাব তৈরী করছেন। তার মধ্যে আবার ভাবছেন, দু’চারটে আলুপরোটা দিতে পারলে ভালো হতো!

তাই তো! মানুষটা পথেঘাটে কী না কী খাবে, অথবা না খেয়ে আধমরা হয়ে থাকবে! আবার  নাকি দিল্লী বিমানবন্দরে পড়ে থাকতে হবে পাক্কা দশঘণ্টা! তাই রুটি ও গোশ্ত এবং গোশ্ত ও রুটির[1] পুরো একটা বাক্স সঙ্গে দিতে হবে। দিলেনও। তাতেও যেন নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। শুরুতে, শেষে এবং মাঝখানে গুণে গুণে তিনবার বললেন, মনে করে খাবে কিন্তু! বিমান থেকে নেমে ঢাকনাটা খুলে রেখো, নইলে নষ্ট হয়ে যাবে। হাসতে হাসতে বললাম, ‘ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানি না, কথাটা কিন্তু সত্য নয়। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।’

এরপর যে কথাটা তিনি খুব করে মনে করিয়ে দিলেন, আর পুরো সফরে আমি বারবার ভুলে গেলাম সেটা হলো ওষুধ খাওয়া, আর ‘ইনসুলিন’ নেয়া। এমনকি ইনসুলিন ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের পুরো বাক্সটাই ফেলে এলাম হোটেলের কামরায়। মনে পড়লো ফেরার পথে নয়া দিল্লীতে এসে। যাক এসব কথা।

***

ফজরের নামাজের সময় দিলের অবস্থা হলো খুবই নরম। মুনাজাতে দরদর করে চোখ থেকে পানি ঝরলো। ‘হে আল্লাহ! ঘরে বলো, বাইরে বলো, তুমি ছাড়া আমার কোন সহায় নেই। হে আল্লাহ, তুমি আমাকে সাহায্য করো। সফরের জন্য নিয়তটা ছহী করে দাও। এ সফরকে তোমার দ্বীনের জন্য কবুল করো, আর সবকিছু সহজ করে দাও।’

মুনাজাতের আগ পর্যন্ত যে অস্বস্তি ও নিঃসঙ্গতাবোধ ছিলো, এখন তা বিলকুল দূর হয়ে গেলো। অন্তরে আশ্চর্য এক প্রশান্তি অনুভূত হলো। বিশ্বাস হলো, সফরে আল্লাহর মদদ ও নুসরত ইনশাআল্লাহ শামিলে হাল হবে। এবং আলহামদু লিল্লাহ সফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পদে পদে আমরা তিনজনই গভীরভাবে তা অনুভব করেছি। বিপদ এসেছে বড় বড় দাঁত বের করে, কিন্তু কামড় বসাবার আগেই সরে গেছে ‘আছ-ছাহিবু ফিস্-সফর’-এর দয়া ও অনুগ্রহে। কিছু নিজের চোখে দেখেছি, কিছু দেখিনি; কিছু বুঝেছি, কিছু বুঝিনি। আসলে বান্দার মিনতির লাজ আল্লাহ রক্ষা করেই থাকেন। কিন্তু বান্দা! তারপরো শোকরের কথা ভুলে যায়।

কেন ইচ্ছে হলো জানি না, তিনটি ছোট্ট বোতলে করে জমজম নিলাম, আর নিলাম তিনটে খেজুর, মদীনা শরীফের। একবার ইচ্ছে হলো, এহরামের লেবাসটা সঙ্গে রাখি, সাহস হলো না। তাই শুধু হাত বুলিয়ে আবার আলমারিতে রেখে দিলাম।

ফজরের পর আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এখন দু’হাত তোলা সম্ভব হয় না; এক হাত তুলেই দু‘আ করে দিলেন। এক হাতের দু‘আটুকুই দু’হাত ভরে নিলাম, আর মনে হলো, পুরো সফরে আমি এবং আমরা নিরাপদ হয়ে গেলাম!

স্ত্রী অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় জানালেন। সফরের দু‘আ পড়ে আমার বাইতুল্লাহ-সফরের চিরসঙ্গী ব্রিফকেসটি এবং আরেকটা বড় সুটকেস নিয়ে আল্লাহর নামে বের হলাম।

***

টিকেট ও পাসপোর্ট ভুলে যাওয়া আমার ‘একটি প্রিয় শখ’। ইচ্ছে না থাকলেও ভুলটা হয় এবং প্রত্যেক সফরেই হয়। গত রামাযানে বাইতুল্লাহর সফরে এ ভুলটা তিনবারের বেশী হয়েছিলো। ঘর থেকে বের হয়েছি, গাড়ীতে উঠেছি। ছেলে সঙ্গে ছিলো, ফোনটা তার হাতে ছিলো। (আলহামদু লিল্লাহ, এখনো সে জাওয়াল ব্যবহার করে না।) হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। স্ত্রী বললেন, তোমার টিকেট- পাসপোর্ট তো বাসায়! ফিরে গেলাম এবং উম্মে মুহাম্মাদকে অনেক অনেক ‘জাযাকাল্লাহ’ বলে পাসপোর্ট-টিকেট নিয়ে আবার রওয়ানা হলাম। এটা হলো প্রথমবার। গিয়ে উঠলাম উত্তরায় ছোট মেয়ের বাসায়। সেখানেই নামায পড়লাম, এহরাম ধারণ করলাম। আফনান এবং ওরই মত ছোট্ট দু’টি ছেলে-মেয়ে আমার সঙ্গে নামায পড়লো, আর মনে হলো, ইনশাআল্লাহ, এই মাসুম বাচ্চাদের বরকতে সফর মকবূল হবে। মেয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নীচে নেমে এলাম। এখন মনে নেই, আমার মনে পড়লো, না ছেলের; পাসপোর্ট-টিকেট আবার ফেলে এসেছি! এটা হলো দ্বিতীয়বার।

মক্কা শরীফ থেকে মদীনা শরীফ রওয়ানা হলাম। আমার প্রিয় ভাই পারভেজ, যিনি রামাযানের সফরে আমাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন, ঘর থেকে রাস্তায় নেমে কিছু দূর এসে জিজ্ঞাসা করলেন, পাসপোর্ট নিয়েছেন তো? সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো, অযু করার সময় তাকের উপর রেখেছি; ওখানেই রয়ে গেছে। আসল কথা না বলে, বললাম, একটু উপর থেকে আসি। তিনি বোধহয় বুঝলেন। তাঁর ঠোঁটের হাসি থেকে অন্তত তাই মনে হলো। এটা হলো তৃতীয়বার।

একই সফরে এমন ঘটনা আর না ঘটলেই ভালো হতো, কিন্তু ঘটলো আরো দু’বার। একবার আমি নিজেই জিজ্ঞাসা করলাম জেদ্দার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার পর, আমার পাসপোর্ট কোথায়? ভাই পারভেজ মৃদু হেসে বললেন, ঘরে ফেলে এসেছিলেন, আমি এনেছি। শেষবার; জেদ্দায় বিমানে ওঠার অপেক্ষায় বসে আছি। সময় হলো; যাত্রীদের আহবান জানানো হলো। বিমানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম, কিছু দূর গিয়ে দেখি, পাসপোর্ট-টিকেট হাতে নেই। ফিরে এসে দেখি, যেখানে বসে ছিলাম, সেখানেই পড়ে আছে। এ বিষয়ে আমার ঐ সফরটি সম্ভবত একটা রেকর্ড।

এবার অবশ্য এমন ভুলের সুযোগ ছিলো না। কারণ আমার পাসপোর্ট-টিকেট মুদীর ছাহেবের কাছে। তবু একটা ভুল হলো, কিছু ডলার সংগ্রহ করেছিলাম হাতখরচ মনে করে, আর কলম ও নোটবই নিয়েছিলাম সফরের সময় প্রয়োজনীয় নোট রাখার জন্য। এগুলো ছিলো হাতব্যাগের মধ্যে। হাতব্যাগটা যে, সঙ্গে নেয়া হয়নি, সেটা মনে পড়লো বিমানবন্দরে এসে। একারণে সফরের কোন নোট রাখা আর হয়নি। হযরত আবু আইয়ূব আনছারী রা.-এর মাযারে কত সুন্দর কবিতা লেখা ছিলো। সঙ্গে কাগজ-কলম থাকলে কত ভালো হতো! কিন্তু সেই ভালোটা হলো না।

অবশ্য এ সফরটা যে এদিক থেকে খুব একটা ‘নিরামিষ’ ছিলো তা নয়। ফেরার পথে ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে যেখানে মাগরিব আদায় করেছিলাম সেখানে পাসপোর্ট ও টিকেট ফেলে রেখেই রওয়ানা হয়েছিলাম। মাওলানা আব্দুল মতীন, আল্লাহ তাঁকে উত্তম বিনিময় দান করুন, তিনি তা দেখে তুলে নিয়েছিলেন। টিকেট ও পাসপোর্ট হারানো, আর ভুলে যাওয়ার আরো বহু চমকপ্রদ ঘটনা আছে আমার সঞ্চয়ে। লিখে লিখে অনেক দূর যাওয়া যাবে।

আচ্ছা, এসব কথায় আমার কী লাভ, আর পাঠকেরই বা কী উপকার! অবশ্য আল্লাহ যদি চান, সাধারণ থেকে সাধারণ কথা এবং তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ ঘটনা দ্বারাও উপকার হতে পারে। এমন একটা ভুলো মানুষ যে দীর্ঘ একমাস আল্লাহর ঘর সফর করে নিরাপদে ফিরে আসতে পারে তাতে কি আল্লাহ তা‘আলার কুদরত এবং দয়া ও রহমতের কথা স্মরণে আসে না!

***

বনানীতে এমন যানজট হলো যে, এর যেন আর শেষ নেই। যানজটের সঙ্গে মোটামুটি পরিচয় আছে; এটা কত প্রকার ও কী কী তাও জানা আছে, কিন্তু আজকের যানজটটা মনে হলো, ‘অন্য কিছু’! কারণ ‘সময় ও পরিস্থিতি’। কিছুটা অস্থিরতার সঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি, আর মনে মনে হাদীছের সেই দু‘আটি পড়ছি-

اللهم لا سهل إلا ما جعلته سهلا, وأنت تجعل الحزن إذا شئت سهلا

হে আল্লাহ, কোন কিছুই সহজ হয় না, তবে তুমি যা সহজ করে দাও। আর তুমিই তো কঠিনকে সহজ করো, যখন ইচ্ছা করো।

এবং আল্লাহ ইচ্ছা করলেন, অপ্রত্যাশিভাবেই জটটা খুলে গেলো এবং গাড়ী চলতে শুরু করলো। দেখতে দেখতে বিমানবন্দরের প্রবেশপথটা এসে গেলো, আর সেই অপূর্ব দৃশ্যটি দেখার সৌভাগ্য হলো! এহরামের শুভ্র পোশাকে হাজীছাহেবান বাসে বসে আছেন, আর বাসটি বিমানবন্দরে প্রবেশ করছে। সম্ভবত হাজীক্যাম্প থেকে হাজীছাহেবানকে আনা হয়েছে। তাদের বিমান উড়াল দেয়ার সময় হয়ে গেছে। এহরামের সাদা লেবাস হাজী দেখে বুকটা কেমন যে হুহু করে উঠলো! সামান্য একটু জটলার কারণে বাসটা কিছুক্ষণ থেমে ছিলো, আমার গাড়ীটাও আগে বাড়তে পারছে না, কিন্তু তাতে একটুও খারাপ লাগলো না, বরং সুযোগ পেয়ে তৃষ্ণার্ত চোখে ওদিকে তাকিয়ে থাকলাম। আহ, কত ভাগ্যবান এই মানুষগুলো! একটু পরে আমিও প্রবেশ করবো এই পথে বিমানবন্দরে, আমিও আরোহণ করবো বিমানে এবং উড়বো আকাশে, কিন্তু আমার আকাশ এবং তাদের আকাশ কি এক হবে! কত পার্থক্য দুই বিমানযাত্রার মধ্যে! তারা যাবেন কাবার পথে, আর ...!

হাজী ছাহেবান নীরব কেন? তালবিয়া পড়ছেন না কেন? কত ভালো হতো যদি একটু তালবিয়ার মধুর ধ্বনি শুনতে পেতাম! আশ্চর্য, মনে মনে আকাঙ্ক্ষা করলাম, আর আল্লাহ মেহেরবান তা পূর্ণ করে দিলেন! জটলামুক্ত হয়ে বাসটা চলতে শুরু করলো, আর সমস্বরে ধ্বনিত হলো-

লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইক ...।

সমবেত কণ্ঠে তালবিয়ার এ মধুর ধ্বনি অন্তরে কী যে এক সুখের কম্পন সৃষ্টি করলো, তা শুধু অনুভব করা যায়, বলে বোঝানো যায় না। হঠাৎ দেখি, আমিও তালবিয়া পড়তে শুরু করেছি। খুশিও লাগলো, কান্নাও পেলো। এ তালবিয়া তো তাদেরই কণ্ঠে শুধু শোভা পায়, যারা এহরামের নূরানি সাজে সজ্জিত! যাও হে আল্লাহর ঘরের আশেকান! যাও, উড়াল দিয়ে আল্লাহর ঘরে যাও, বড় ভাগ্যবান তোমরা। তোমাদের ঈর্ষা করি না, ‘গিবতা’ করি!

***

বিমানবন্দর পার হয়ে উত্তরায় মেয়ের বাড়ীতে গেলাম। হাতে সময় খুব কম, তবু গেলাম। নইলে মেয়ে কষ্ট পাবে। ও তো পথ চেয়ে আছে, যাওয়ার আগে আববুকে এক নযর দেখবে!

মেয়ের আমার বুদ্ধিটা ভালো! জায়নামায বিছিয়ে দিলো, তাই এশরাক পড়তেই হলো। আর এই ফাঁকে দস্তরখান বিছিয়ে ফেললো। ইচ্ছে না থাকলেও মেয়ের মনরক্ষার জন্য দু'লোকমা মুখে দিতে হলো।

বিদায়ের সময় মেয়ে আমার এমন এক কথা বললো যে, দিলটা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো, বললো, আববু, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কী, তুমি বাইতুল্লাহর মুসাফির, আল্লাহর ঘরেই যাচ্ছো!

চোখে পানি এসে গেলো। মনে মনে বললাম, তোমার কথাই যেন সত্য হয়, মা! তুর্কিস্তানের পথ ধরেও আল্লাহ যেন কা‘বাঘরে পৌঁছে দেন। আল্লাহর শানে কুদরতে অসম্ভব তো কিছু নেই।

***

সালমান তার গাড়ীতে করেই বিমানবন্দরে নিয়ে এলো। সোজা দু’তলায় এসে গাড়ী থেকে নামলাম। প্রথমেই যে দৃশ্যটি দেখলাম, প্রিয় পাঠক, একটু কল্পনার সাহায্য গ্রহণ করে দেখো না, বলতে পারো কি না, কী সে দৃশ্য! হাঁ, দেখলাম এহরামের সাদা লেবাস, আর হাজী ছাহেবানের নূরানি চেহারা। কিছু কিছু চেহারা তো এমন যে, দিনের বেলায় পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে করে। কেউ কেউ এখনো এহরাম ধারণ করেননি, তবু বোঝা যায়, তারা আল্লাহর ঘরের মুসাফির।

লোভ সম্বরণ করতে না পেরে কারো কারো কাছে খুব সঙ্কোচের সঙ্গে এগিয়ে যাই, আর দু’আ চাই। এহরামের লেবাসে আল্লাহর বান্দারা খুব দরাজদিল হয়ে যায়; প্রাণভরে দু‘আ দেয়। একজন দু’ফোটা চোখের পানিও দিলো (আল্লাহকে), আর বললো, ‘বাইরে সাদা দেখতাছেন, কিন্তু ভাইরে, ভিতরে সব কালা। দোয়া কইরেন, যেন্ সাদা হইয়া ফিরতে পারি।’

আল্লাহর আরেক বান্দা ব্রিফকেসটার দিকে তাকালেন, আর জিজ্ঞাসা করলেন, এহরাম কোনহানে পিনবেন, ভিত্রে গিয়া?

এমন প্রশ্নে তুর্কিস্তানের যাত্রীর তো অপ্রস্তুত হওয়ারই কথা। কিন্তু আল্লাহ মেহেরবান অপ্রস্তুত করলেন না, তার প্রশ্ন এড়িয়ে তারই ভাষা অনুসরণ করে বললাম, ভাইরে! দোয়া করেন, আল্লায় যেন্ কবুল করে। আল্লাহর সেই বান্দা গভীর আবেগের সঙ্গে দু‘আ করলেন, আর আমি আমীন, আমীন বললাম। তারপর তিনি বললেন, আচ্ছা, ইনশাআল্লাহ হারাম শরীফে দেখা হইব।

আমি বললাম, ইনশাআল্লাহ।

চোখ দু’টো একটু যেন ভিজে উঠলো। বাইতুল্লাহর সফরে আমার চিরকালের সঙ্গী ব্রিফকেসটার গায়ে আদর করে হাত বুলালাম, আর বললাম, দেখো তো, আল্লাহর বান্দারা ভাবছে, আমরা আল্লাহর ঘরে চলেছি! আচ্ছা, যদি বাইতুল্লাহর মুসাফিরদের কাতারে গিয়ে দাঁড়াই, আর সবার সঙ্গে হিজাযের জাহাযে উঠে যাই, কেমন হয়! আল্লাহর কুদরতে কত কিছু তো হয়; এমন কি হতে পারে না! একটি সুন্দর ভুল কি একটি সুন্দর ফুল ফুটাতে পারে না!

একটু পরেই সেই সুন্দর ভুলটি হলো আমাদের দ্বারা, তবে সুন্দর ফুলটি আর ফুটলো না। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

মুদীর ছাহেব এবং মাওলানা আব্দুল মালেক ছাহেব কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলেন। মাওলানা আব্দুল মতীনও এলেন। কুশলবিনিময়ের পর মশওয়ারা হলো, সফরে কাফেলার একজন আমীর থাকা জরুরি, আর আমীরের পূর্ণ ইতা‘আত আরো জরুরি; তাতে সফর নিরাপদ হয়, কামিয়াব হয় এবং বরকতপূর্ণ হয়।

মুদীর ছাহেব বললেন, আমীর তো নির্ধারিত আছে। আদীব হুযূর হবেন আমাদের আমীর।

আমি বললাম, আমীর হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই, অভিজ্ঞতাও নেই। উত্তম মামূর হওয়ার, আলহামদু লিল্লাহ, যোগ্যতাও আছে, অভিজ্ঞতাও আছে। তিনি মৃদু হেসে বললেন, এবার যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা দু’টোই একসঙ্গে হাছিল হয়ে যাক।

এধরনের কিছু কোমল বাক্য-বিনিময়ের পর শেষ পর্যন্ত সবার অনুরোধে তিনি কাফেলার আমীর হতে রাজী হলেন। আলহামদু লিল্লাহ।

বিমানবন্দরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। মাশাআল্লাহ! বাইরে তো একটা দু’টো বাস আসছে, আর ছোট ছোট গাড়ীতে একজন দু’জন করে হাজী ছাহেব আসছেন; এখানে দেখি সাদা, আর সাদা! যেন শুভ্রতার জোয়ার! হাজী ছাহেবানের বিরাট মজমা! শত শত, কিন্তু মনে হয় হাজার হাজার! নূর ও নূরানিয়াতের এমনই গুণ, ছোট মজমাকে মনে হয় বড়, বড় মজমাকে মনে হয় বিরাট, আর বিরাটকে মনে হয় বিশাল, আরবীতে যাকে বলে ‘জাম্মে গাফীর’!

আল্লাহর ঘরের মুসাফিরদের এই জাম্মে গাফীর চোখের সামনে দেখতে পেয়ে শুধু অভিভূতই হলাম না, আত্মহারাও হয়ে পড়লাম। ভিতরের ঢেউ যেন সবেগে বাইরে বের হয়ে আসতে চায়! এমন তো আর কখনো হয়নি! আসল কথা, আল্লাহর ঘরের সফর ছাড়া যাত্রীবেশে আর কখনো তো বিমানবন্দরে আসাও হয়নি; তাও আবার হজ্বের এই ভরা মৌসুমে!

মাওলানা আব্দুল মালিকের দিকে তাকালাম কিছুটা বুঝি শেকায়েতের নযরে। তিনিও দেখি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন আশেকানে বাইতুল্লাহর নূরানি মাজমার দিকে। তাঁর দৃষ্টিতে হাসরাত নেই, আফসোস নেই; আছে আশার ঝলক, স্বপ্নের ঝিলিক। ইচ্ছে হলো, মানুষটাকে মস্ত একটা বকুনি দিই। নিজে চলেছেন হিজাযের পথে, আমাকে ধরিয়ে দিয়েছেন তুর্কিস্তানের পথ! ইচ্ছে যদি করতেন, পারতেন না আমাকে সঙ্গে নিতে! আমার পাসপোর্ট তো তাঁর হাতেই ছিলো!

দিলটা শক্ত হতে গিয়ে একেবারে নরম হয়ে গেলো। আসলে ডাক তো আসে আল্লাহর কাছ থেকে। যার ডাক আসে সে যায়, যার ডাক আসে না সে থেকে যায়। তবে কোন অবস্থায় হতাশা মুমিনের জন্য নয়। মুমিন তো নীরবে সরবে ডাকতে থাকবে আল্লাহকে, যেন তার নামেও ডাক আসে। কখনো হাসবে, কখনো কাঁদবে, আর সেই ডাকের ইনতিযার করবে। এমন বান্দার জন্য একসময় না একসময় আল্লাহর পক্ষ হতে ডাক আসবে, আসবেই (ইনশাআল্লাহ)। যখন ডাক আসবে তখন সে খুশিতে হাসবে এবং আনন্দে কাঁদবে, আর সিজদায় লুটিয়ে পড়ে বলবে, লাব্বাইকা ইয়া রাব্ব, লাব্বাইক!

আরো ভাবলাম, আমাদের এ সফরও তো দ্বীনী সফর। আল্লাহর ঘরের জন্য নয়, স্বয়ং আল্লাহর জন্য। নিয়তটাকে পরীক্ষা করে দেখলাম, আলহামদু লিল্লাহ, দুনিয়ার কোন উদ্দেশ্য নেই। নিছক দেশভ্রমণও আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তুরস্কে আমরা তো চলেছি তুর্কিস্তানের সন্ধানে। ইসলামী উম্মাহর সেই মর্যাদাবান জনগোষ্ঠীকে কাছে থেকে দেখার জন্য যাদের রয়েছে উজ্জ্বল অতীত ও শানদার মাযী; কয়েক শ’ বছর যারা ছিলো ইসলামী খেলাফতের ঝান্ডাবরদার, মুসলিম জাহানের পাস্দার[2] এবং আল্লাহর ঘরের খেদমতগার; সর্বোপরি যাদের জাতীয় সত্তায় এখনো ধিকি ধিকি জ্বলছে জাযবায়ে ঈমান; দুনিয়ার তাগুতি শক্তির সর্বপ্রকার কৌশল, অপকৌশল সত্ত্বেও এখনো যাদের শিকড় প্রোথিত হিজাযের মাটিতে!

***

এই সব ভাবনায় আমি যখন বিভোর তখন আমীর ছাহেব ডাক দিলেন, আদীব হুযূর কোথায়? চমকে উঠে তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, চলেন ভিতরে যাই, সময় হয়ে গেছে। ভিতরে মানে, যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে, যেখানে নির্দিষ্ট বিমান সংস্থার কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস নিতে হয়।

আমরা সামনে অগ্রসর হলাম; সালমান আমাদের আগেই স্বচ্ছন্দে ভিতরে চলে গেলো। কিছু মানুষ আছে, যাদের চলন, বলন, চাহনি ও অভিব্যক্তিতে কিছু একটা থাকে; কী বলা যায় সেটাকে? আভিজাত্য? সহজ স্বাচ্ছন্দ্য? দরজায়, প্রবেশপথে কেউ তাদের প্রশ্ন করে না; ব্যক্তিত্বের দ্যুতি থেকেই যেন ফুটে ওঠে, তার প্রবেশাধিকার রয়েছে। নিজের ক্ষেত্রে দেখেছি, প্রবেশপত্র থাকা সত্ত্বেও আমার চেহারায় ওরা কী যেন দেখতে পায়, আটকে দেয়! মিনার তাঁবুতে একবার তো রাত তিনটায় একথা বলেও পার পাইনি যে, আমার ‘চুড়ি’ ভুলে ভিতরে রয়ে গেছে।

জ্বি হাঁ, আপনি নারী-পুরুষ যাই হোন, ‘মালুম’-এর পক্ষ হতে আপনার হাতে ফিতাজাতীয় একটা চুড়ি পরিয়ে দেয়া হবে। সেটাই প্রমাণ করে যে, আপনি হাজী এবং অমুক মালুমের হাজী। এটা ছাড়া আপনি তাঁবুতে ঢুকতে পারবেন না। আমাদের দেশের হাজী ছাহেবান অনেক সময় মাসলা জিজ্ঞাসা করেন, অযুর সময় চুড়িটা খুলতে হবে কি না? হজ্বের পর পর একজন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার চুড়িটা হারিয়ে গেছে, তাতে হজ্বের কোন ক্ষতি হবে কি না? বেচারাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, কালকে শেষ পাথর মেরেছেন তো, সমস্যা নেই। হজ্ব হয়ে গেছে।

তো সেই চুড়িটা হাতে নেই বলে মিনার তাঁবুতে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম, শেষে ইমাম ছাহেব এসে উদ্ধার করেছিলেন। এত কথা মনে পড়লো এজন্য যে, সালমান যাত্রী না হয়েও স্বচ্ছন্দে ভিতরে চলে গেলো, অথচ আমাকে আটকে দিলো; আর সালমান ফিরে এসে আমাকে ‘যাত্রী’ বলে সনদ দিয়ে পার করে নিলো। তাজ্জব কি বাত! বিপত্তিটা ঘটেছিলো এজন্য যে, আমার টিকেট ছিলো আমীর ছাহেবের কাছে, আর তিনি আগেই ভিতরে চলে গিয়েছিলেন। তিনি ভাবতে পারেননি যে, আমি বেচারা ‘ধরা পড়ে যাবো’!

প্রয়োজনীয় কাজ শেষ হওয়ার পর সবাই দাঁড়িয়ে আছি, নিরাপত্তা কর্মীর পোশাকে একজন কী যেন ভেবে সালমানকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি যাত্রী? সালমান তার দিকে তাকালো খুব স্বাভাবিক দৃষ্টিতে এবং হাসলো মৃদু স্বাভাবিক হাসি। তারপর বললো খুব মোলায়েম কণ্ঠে, আপনার কী মনে হয়? আল্লাহ জানেন, কী ছিলো তার চোখের দৃষ্টিতে, ঠোঁটের হাসিতে এবং কণ্ঠের উচ্চারণে, লোকটি ‘স্যরি স্যার’ বলে সরে গেলো। একটু পরে দেখি, একই লোক এক ভদ্রলোককে বলছে, কেন ঢুকেছেন, যান, বাইরে যান!

হয়ত তুচ্ছ বিষয়, কিন্তু এখানে লুকিয়ে আছে ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের এমন কিছু রহস্য যা উপলব্ধি করতে পারলে আমাদের জন্য মানুষের সঙ্গে চলা এবং মানুষকে ব্যবহার করা সহজ ও নির্ভুল হয়।

***

জেট এয়ারের কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিশাল কাউন্টার, আর ডেকোরেশন দেখেই আন্দায করা যায়, দাদারা বেশ জমিয়েই ব্যবসা করছেন। মুদীর ছাহেব আমাদের তিনজনের পাসপোর্ট ও টিকেট এগিয়ে দিলেন। কাউন্টারে কর্মরত ছিলেন একজন ভদ্রমহিলা, একজন ভদ্রপুরুষ। পুরুষটিকে সুদর্শন বলা যথেষ্ট, কিন্তু মহিলাটির জন্য, শুধু সুদর্শনা শব্দটি কম হয়ে যাবে।

আমাদের পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কথা আমরা কতটুকুই বা জানি, আর কতটুকুই বা বলতে পারি! উম্মতকে তিনি তালিম দিয়েছেন এবং উম্মতের তারবিয়াত করেছেন। এমন প্রজ্ঞাপূর্ণ ও বাস্তবানুগ তালিম-তারবিয়াতের উদাহরণ মানবজাতির সভ্যতা ও ধর্মের ইতিহাসে আর নেই। মানবের স্বভাব ও চরিত্রকে তিনি সংশোধন করেছেন, সেই সঙ্গে স্বভাব ও চরিত্রের দুর্বলতাকেও বিবেচনায় রেখেছেন। নারীর সুন্দর মুখ পুরুষের চিরকালের দুর্বলতা। তাই বলা হয়েছে পর্দার কথা এবং দৃষ্টি অবনত রাখার কথা। কিন্তু পুরুষচিত্ত এমনই দুর্বল যে, অনিচ্ছায় হলেও নারীর আবরণহীন সুন্দর মুখের প্রতি তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, হয়ে যায়। কেউ অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে এবং চোখের পেয়ালা পূর্ণ করে সৌন্দর্যের সুধা পান করতে থাকে। ভুলে যায় সবকিছু; পরিপার্শ্ব, এমনকি নিজের অস্তিত্ব। পক্ষান্তরে আল্লাহ যাকে তাওফীক দান করেন সে আল্লাহকে ভয় করে এবং আল্লাহর আদেশ মান্য করে দৃষ্টি অবনত করে ফেলে। কিন্তু প্রথম দৃষ্টিটার কী হবে? এ প্রশ্ন ছিলো আমার অনেক দিনের। যাঁদের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেছি, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, তাঁদের জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে হয়েছে, সাহস হয়নি; অথবা নিছক সঙ্কোচের কারণে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি। যেদিন পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীছটি জানলাম-

لك الأولى وعليك الثانيـة

সেদিন কী যে আত্মিক প্রশান্তি লাভ করলাম! সুবহানাল্লাহ! এমন স্বভাবমুখী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ তারবিয়াতের কথা জগতের কে কোথায় শুনেছে?! না কঠিন ধমক, না কঠোর তিরস্কার! কী কোমল, স্নিগ্ধ ও মমতাপূর্ণ উপদেশ! মাত্র দু’টি শব্দ لكعليك কিন্তু এর অন্তর্নিহিত মর্ম কত না গভীর! যে উপদেশের মধ্যে স্বভাবের দুর্বলতার প্রতি থাকে সদয় বিবেচনা সে উপদেশই তো পারে জীবনের মোড় পরিবর্তন করতে! তাতে অন্তরের গভীরে একটি আকুতি সৃষ্টি হয় সেই উপদেশ মান্য করার।لك الأولى وعليك الثانيـة[3]

প্রথম দৃষ্টিটি তোমার অনুকূলে, আর দ্বিতীয়টি তোমার প্রতিকূলে।

যবানে নবুয়তের ‘মিঠাস’ ও মাধুর্য কিছুই তো উঠে এলো না তরজমার শরীরে! কিন্তু এছাড়া আর কী তরজমা হতে পারে!

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তালিম ও তরবিয়াতের বড় নিরালা শান, মনে পড়ল সেই হাদীস যাতে রয়েছে বিদায় হজ্বের সফরের বর্ণনা। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটের পিঠে সওয়ার হয়ে চলেছেন মক্কার উদ্দেশ্যে। পথে জনৈকা নারী সামনে এসে হজ্বের মাসআলা জিজ্ঞাসা করলেন। উটের পিছনে নবীজীর রাদীফ[4] ছিলেন তাঁর চাচাত ভাই তরুণ ফজল বিন আববাস রা.। হাদীছের বর্ণনায়, মহিলাটি ছিলো অতি সুন্দরী। ফয্ল বিন আববাস রা. মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি লক্ষ্য করলেন। তিনি না ধমক দিলেন, না তিরস্কার করলেন, শুধু কোমল হাতে সস্নেহে ফয্ল বিন আববাস রা.-এর মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন।

***

আমার লেখার এই এক দুর্বলতা, প্রসঙ্গ থেকে দূরে চলে যাওয়া! ফিরে আসি জেট এয়ারের কাউন্টারে। ভদ্রমহিলা মধুর কণ্ঠে ‘সুস্বাগতম’ বলে হাসিমুখে পাসপোর্ট-টিকেট নিলেন। পাতা উল্টে উল্টে কিছুক্ষণ দেখলেন। তারপর পাশের ভদ্রলোকটির হাতে তুলে দিলেন। তিনিও কিছুক্ষণ উল্টে পাল্টে দেখলেন। উজ্জ্বল মুখে, বোঝা যায় কি যায় না, খুব হালকা একটা ছায়া পড়লো। মুখের হাসিটি অবশ্য অক্ষুণ্ণই ছিলো। পেশাদার বটে! ছবির সঙ্গে মুখ মিলিয়ে আমাদের তিনজনকে দেখলেন শীতল দৃষ্টিতে।

হয়ত আমার ভুল, তবে মনে হলো, সেই দৃষ্টিতে অবজ্ঞা ছিলো, ঘৃণা ছিলো। মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে শ্রমিক হিসাবে যখন আমরা যাই, এরূপ দৃষ্টির সম্মুখীন হতে হয়। সেটা সহ্য করা যায়, কিন্তু তুমি বাবু এভাবে তাকাবে কেন? বাণিজ্য ঘাটতি কত হাজার কোটি টাকা জানো? তোমাদেরই পত্রিকা হিসাব দিয়েছে, ভারত যে কয়টি দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স উপার্জন করে, তার মধ্যে প্রথম হলো আরব আমিরাত, আর পঞ্চম হলো বাংলাদেশ। তাহলে বাবু একটু সমীহের দৃষ্টিতে তাকাও না কেন?

যাকগে, ভদ্রলোকের মুখের ভাষাটি অবশ্য সংযত ছিলো। তিনি প্রশ্ন করলেন, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?

পাল্টা প্রশ্ন করা যেতো, জেট এয়ার যদি দিল্লী যায়, আমরা তাহলে কোথায় যেতে পারি? কিন্তু মুদীর ছাহেব হুঁশিয়ার মানুষ, বললেন, দিল্লী যাচ্ছি।

- আমি জানতে চাই, আপনাদের পরবর্তী গন্তব্য?

মুদীর ছাহেব এবারও শান্তভাবে সংক্ষেপে বললেন, ইস্তাম্বুল।

- কী উদ্দেশ্যে?

- একটি কন্ফারেন্সে যোগদান করতে।

- কিসের কন্ফারেন্স?

ভিতরে অশ্বস্তি বোধ করছি, রাগও হচ্ছে। হওয়ারই কথা। এসব প্রশ্ন কেন? মতলব কী লোকটার? তুমি বাপু দেখতে পারো, পাসপোর্ট, ভিসা, টিকেট ঠিক আছে কি না, ব্যস। আদার ব্যাপারী, জাহাযের খবরে তার কী কাজ? কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মাথা ঠাণ্ডা রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ, মুদীর ছাহেব এবারও সংক্ষেপে জবাব দিলেন।

সালমানের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে গেলো। হঠাৎ এগিয়ে এসে বিরক্তির স্বরে বলে বসলো, এসব প্রশ্ন তো আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। আমরা তো আপনার দেশে যাচ্ছি না। আপনার দায়িত্ব শুধু আমাদেরকে নয়া দিল্লী পর্যন্ত বহন করা।

আমি তো অবাক! বলে কি ছেলে!

ভদ্রলোক কিছুটা উষ্ণ কণ্ঠে বললেন, কিছু মনে করবেন না। আমি কিন্তু আপনাদের আটকে দিতে পারি। জেট এয়ারের নিরাপত্তার জন্য আমার সবকিছু জানার এবং যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করার অধিকার আছে।

দাদা সত্য কথাই বলেছেন। এই  লেবাস ও টুপি-দাড়ি দেখে যে কারোই সন্দেহ হতে পারে! পরিষ্কার বোঝা যায়, আমরা মাদরাসার মানুষ। আর আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিরাই তো সমানে বলে যাচ্ছেন, মাদরাসাগুলো হচ্ছে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রজনন-কেন্দ্র। দাদাদের আর কী দোষ? (প্রজনন শব্দটা যিনি ব্যবহার করেছেন, বলতে হয়, তার বেশ রসবোধ আছে! এতে ‘মাছের ডিমপাড়া’ একটা ভাব আছে।

ভদ্রলোক সম্ভবত আইনমন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। তো জানতে ইচ্ছে করে, আইন কি কাউকে প্রমাণ ছাড়া কথা বলার অধিকার দেয়, হোন না আইনের মন্ত্রী!)

সালমানের চেহারা দেখি লাল! কী একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলো। আমি তাড়াতাড়ি হাত ধরে তাকে পিছনে নিয়ে এলাম, কিছুটা তিরস্কারের স্বরে বললাম, এত দেশ সফর করেছো, এই সেদিন ইউরোপ ঘুরে এলে! এতটুকু অভিজ্ঞতা তো তোমার হয়ে যাওয়ার কথা যে, বিমান বা বিমানবন্দরের কারো সঙ্গে, আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে, অস্ত্রের বা আইনের শক্তি আছে এমন কারো সঙ্গে কখনো তর্কে জড়াতে নেই এবং কোন অবস্থাতেই উত্তপ্ত হতে নেই। কারণ ইচ্ছে করলেই সে শক্তির অপব্যবহার এবং আইনের অপপ্রয়োগ করে তোমাকে নাজেহাল করতে পারে।

সালমানকে সেদিন যা বলেছিলাম, আমার জীবনে এর বাস্তব অভিজ্ঞতা যেমন রয়েছে তেমনি অনেক মর্মান্তিক ঘটনার কথাও জানা আছে। বাইতুল্লাহর মুসাফির বইটিতে তেমনি একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেছি। আরেকটি ঘটনা দেখেছি জেদ্দা বিমানবন্দরে।

আমাদের বিমানের প্রায় সঙ্গে নেমেছিলো এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান। রামাযানের দিন। উভয় বিমানের প্রায় সবাই ওমরার যাত্রী। একজন, দু’জন ওখানে কর্মরত। দেশে ছুটি কাটিয়ে কর্মক্ষেত্রে ফিরছেন। তাদের মধ্যে সাধারণ শ্রমিক যেমন আছে তেমনি আছেন দু’একজন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু সামনে কাঁচঘেরা স্থানটিতে যিনি উপবিষ্ট তিনি তো একজন ছোটখাটো ‘বাদশাহ’। আমাদের পাশের বুথে ছিলো এয়ার ইন্ডিয়ার লাইন। ভদ্রলোক ইঞ্জিনিয়ার, মানে প্রকৌশলী, কিন্তু আচরণে মোটেই কুশলী ছিলেন না।

হয়ত রোযায় কাবু হয়ে পড়েছিলেন। একটু কড়া মেজাজেই ইংরেজিতে তাড়া দিলেন তাড়াতাড়ি করার জন্য। ইন্ডিয়ান বেচারা মার্কিন পাসপোর্টধারী হলেও না হয় কথা ছিলো। ‘ছোটে বাদশাহ’ কাঁচের ঘেরাউ থেকে ক্ষিপ্ত অবস্থায় বের হয়ে এলো এবং ভদ্রলোকের কলার ধরে টানাহেঁচড়া শুরু করে দিলো। আর মুখের ভাষা! ভাগ্য ভালো যে, বোঝা যাচ্ছিলো না কিছু।

এর মধ্যে দু’জন নিরাপত্তাকর্মী ছুটে এলো। বেচারা তখন ইংরেজি ছেড়ে ‘আনা মুহান্দিস’ বলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেন, আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ইন্ডিয়ানদের উদ্দেশ্যে অনুনয় করতে লাগলেন, ভাই, কুছ ক্যহো না তুম লোগ, কুছ ক্যরো না তুম লোগ।

কিন্তু কে করবে, আর কী করবে? আমার চোখে পানি এসে গেলো। কিন্তু কী করা যায় অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকা ছাড়া!

আমার সফরসঙ্গী হাজী দেলওয়ার ছাহেব বললেন, আপনি তো আরবী জানেন, যান না একটু, আল্লাহ-রাসূলের দোহাই দিয়ে বলেন না ছেড়ে দিতে।

তার কথায় সাহস হলো। আল্লাহর উপর ভরসা করে গেলাম। এই অধঃপতনের যুগেওصل على النبي النبي যে কেমন যাদুর মত কাজ করে তার অভিজ্ঞতা আগেই আমার হয়েছিলো। এখানেও সেটারই আশ্রয় নিলাম।

ভদ্রলোককে কোনার একটি কাঁচঘেরা ঘরে ঢুকানো হয়েছে। আমি ভিতরে প্রবেশ করে সালাম দিলাম। এহরামের লেবাস হয়ত তাদের বিরক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখলো। আমি বললাম-

يا قوم صلوا على النبي

বিশ্বাস করো ভাই! একসঙ্গে সবাই বলে উঠলো-

اللّهُمَّ صَلِّ وَسّلِّمْ عَلى النَّبِيِّ الْأَكْرَمْ

আমি বললাম, হে আমার মুসলিম ভাই, আমি দেখেছি, লোকটিরই দোষ এবং উপযুক্ত সাজাই তার প্রাপ্য। তবে সে তোমাদের মুসলিম ভাই এবং রোযাদার। ارحموه يرحمكم من في السماء (তার প্রতি দয়া করো, আসমানে যিনি আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।)

খোলাছা কথা, আল্লাহর রহমতে ভদ্রলোক ছাড়া পেলেন এবং সোজা হাঁটা দিলেন; আমার দিকে একবার ফিরেও তাকালেন না। হয়ত এত ভয় পেয়েছিলেন যে, কোন হুঁশ ছিলো না। কিন্তু কী দরকার ছিলো মাথাটা গরম করে এমন গর্দিশ ডেকে আনার?! এরকম আরেকটি ঘটনা মনে পড়ছে; থাক ফিরে আসি জেট ইয়ারের কাউন্টারে। তাকিয়ে দেখি, দাদাবাবু গভীর মনোযোগের সঙ্গে পাসপোর্টের প্রতিটি পাতা এবং প্রতিটি কাগজ নেড়েচেড়ে দেখছেন। দৃশ্যটা দেখে আমার বুকটা দুরু দুরু করে উঠলো। কারণ এ দৃশ্যটার সঙ্গে আমি পরিচিত। সে ঘটনা সবিস্তারে লিখতে গেলে হয়ত পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। তাই সংক্ষেপে বলছি। আজ থেকে পঁচিশ বছরেরও আগে গুলশানের দুই নম্বর গোলচত্বর থেকে একটু আগে বেড়ে ছিলো আরব আমিরাতের দূতাবাস। মরহুম মাওলানা হারুন ছাহেব আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার বড় ছেলে রাশেদ-এর ভিসাসংক্রান্তবিষয়ে দূতাবাসে যোগাযোগ করার। রাশেদ তখন চাঁদপুরের শাহতলী মাদরাসায় পড়তো। ফোনে যোগাযোগ করলাম চার্জ দ্য এফেয়ার্স-এর সঙ্গে। সময় নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম এবং বিষয়টা বললাম। তিনি বললেন, ‘মু মুশকিলা’, কিন্তু এমন ‘মুশকিলা’ হলো যে, সেটা সারতে এক ঘণ্টার পরিবর্তে দীর্ঘ একমাস লেগে গেলো।

ঘটনা হলো, চার্জ দ্য এফেয়ার্স ইন্টারকমে ভিসা সেকশনের বাঙ্গালী অফিসার ফারুক সাহেবকে ডেকে পাঠালেন এবং পাসপোর্ট ও কাগজপত্র তার হাতে দিয়ে বললেন, এখনই ভিসা লাগিয়ে দাও।

বাইরে এসে তিনি বললেন, এর জন্য এত উপরে যাওয়ার কী দরকার ছিলো? আমার কাছে এলেই তো পারতেন! বললাম, ভুল হয়ে গেছে।

আসলে আমি মাওলানা হারুন ছাহেব যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই করেছিলাম। বিষয়টি ভদ্রলোকের আত্মসম্মানে বেশ ঘা দিয়েছে। দেয়ারই কথা! একজন মৌলভীর জন্য তাকে এভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে আসতে হলো! তার থমথমে চেহারা দেখে ভিতরে ভিতরে ঘাবড়ে গেলাম। যদ্দুর পারি, দুঃখ প্রকাশ করলাম, কাজ হলো না। তিনি বললেন, ‘বসুন, কাগজপত্রগুলো দেখি’। চার্জ দ্য এফেয়ার্স-এর পক্ষ হতে আদেশ পাওয়ার পর কোন প্রয়োজন ছিলো না, তবু তিনি কাগজপত্র ‘দেখা’ শুরু করলেন এমন মনোযোগ দিয়ে যেন থিসিস জমা দেয়ার আগে চূড়ান্তভাবে দেখে নিচ্ছেন। পরের কাহিনী অনেক লম্বা।

তো দাদাবাবুর অভিনিবেশ-সহকারে অধ্যয়নের দৃশ্য দেখে পঁচিশ বছর আগের সেই দৃশ্যটি  মনে পড়ে গেলো এবং বুকটা দুরু দুরু করতে লাগলো। আমি দু‘আ ইউনুস পড়া শুরু করলাম। জেদ্দায় আমার আরব মুসলিম ভাইদের صلوا على النبي -এর দোহাই দিয়েছিলাম; দাদাবাবুকে কিসের দোহাই দেবো?! এভাবে দেখলে আর না হোক, একটা দু’টো দাড়ি-কমার ভুল তো বের হতেই পারে। তখন!

যাক, আল্লাহর শোকর; দাড়ি-কমার ভুলও বের হলো না। যেন কিছুটা নিরাশ হয়ে বললেন, কন্ফারেন্সের আমন্ত্রণপত্র আছে আপনাদের সঙ্গে?

বোঝা গেলো, এটা তার শেষ চেষ্টা। আমীর ছাহেব ব্যাগ থেকে আমন্ত্রণপত্র বের করে দিলেন। দাদাবাবু বারকয়েক উল্টেপাল্টে দেখলেন, তারপর টোকা মেরে আমাদের দিকে ফিরিয়ে দিলেন। ভাবটা যেন, বড় বাঁচা বেঁচে গেলি! একটা কোন ছুতো যদি পেতাম, গঙ্গার ঘোলাজল খাইয়ে ছেড়ে দিতাম!

ভুল হলো, পানির অভাবে পদ্মার পানি এখন ঘোলা, কিন্তু সীমান্তের ওপারে পদ্মার নাম হলো গঙ্গা, আর গঙ্গায় তো জলের অভাব নেই। তাই গঙ্গার জল ঘোলা হতে যাবে কেন!

ভদ্রমহিলা ভদ্রভাবেই বোর্ডিংকার্ড এগিয়ে দিলেন। আমরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখেছি, মধ্যএশিয়ার তিনজন পুরুষ ও মহিলাযাত্রী শুধু দাড়ি ও বোরকার অপরাধে কী হেনেস্থাটাই না হয়েছিলেন নয়া দিল্লী বিমানবন্দরে! মনে হলে এখনো চোখে পানি এসে যায়। তারা বাংলাদেশে আসছিলেন ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কাগজপত্র তাদের ঠিক ছিলো। কিন্তু নিরাপত্তাকর্মীদের নাকি ‘সন্দেহ’ হয়েছিলো। শুধু সন্দেহ হওয়াই যথেষ্ট। আমাদের পুলিশ তো মৃদু আঘাত করে উল্টো মামলা ঠুকে দেয়। দিল্লীর কর্মকর্তরা অবশ্য ‘মৃদু’ বিরক্ত করার জন্য মৃদু দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তবে ‘মৃদু’ জিনিসটাও বড় সাঙ্ঘাতিক!

***

মাওলানা আব্দুল মালিক, মাওলানা সালমান ও অন্যান্যের  কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ভেতরের দিকে রওয়ানা হলাম, যেখানে পাসপোর্টে সিলছাপ্পড় লাগানোর কথা। শেষবারের মত পিছনে ফিরে তাকালাম। মাওলানা আব্দুল মালিক তাকিয়ে আছেন, মাওলানা সালমান হাত নাড়ছে। চারপাঁচদিনের ছোট্ট একটি বিদায়, তাতেও মনে কত কষ্ট! ‘বড়’ বিদায়ের সময় যখন আসবে!

আমীর ছাহেবের নেতৃত্বে অগ্রসর হয়ে আমরা একটি কাউন্টারের লম্বা কাতারের পিছনে দাঁড়ালাম। একবারও মনে হলো না, ভুল কাতারে দাঁড়িয়েছি। কারণ আসলে আমরা ঠিক কাতারেই দাঁড়িয়েছি, কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের দাঁড়ানোটা ভুল সাব্যস্ত করেছে।

প্রিয় পাঠক, ধাঁধায় পড়ে গিয়েছো?! একটু সবুর করো।

একজন একজন করে পাসপোর্ট দেখা হচ্ছে, সিল লাগানো হচ্ছে। আর তিনি হাসিমুখে ভিতরে যাচ্ছেন। কাতারটা একটু একটু করে ছোট হচ্ছে, আমরা একটু একটু করে সামনে এগুচ্ছি।

ঢাকা বিমানবন্দরে এবার নতুন ব্যবস্থা। কিছুদিন আগেও ছিলো না। ক্যামেরায় ছবি তোলা হচ্ছে; ছবি এবং পাসপোর্টের যাবতীয় তথ্য কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। জেদ্দা বিমানবন্দরে তিনচার বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে কম্পিউটার ও ক্যামেরাপ্রযুক্তির ব্যবস্থা। আমাদের এখানে সবে শুরু। তবে কর্মদক্ষতা এখানে অনেক ভালো।

একজন ভদ্রমহিলা বোরকায় মুখ ঢাকা। তিনি কিছুতেই মুখ খোলবেন না; দায়িত্বরত ভদ্রলোকও পীড়াপীড়ি করলেন না। বললেন, থাক, লাগবে না। ওভাবেই ছবি নিলেন। জেদ্দায় কিন্তু এটা চলে না, মুখ খুলতেই হবে। বিশেষ করে গ্রামের সহজ-সরল কত পর্দানশীন নারী যে এভাবে চরম বিড়ম্বনার শিকার হন! যাক, যার যার নিজস্ব যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি। মনে মনে ভদ্রলোককে ‘জাযাকাল্লাহ’ বললাম।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যখন আমাদের পালা এলো এবং পাসপোর্ট এগিয়ে দেয়া হলো তখন জানা গেলো, এটা জেট এয়ারের যাত্রীদের বুথ নয়, এটা শুধু হাজী ছাহেবানের জন্য। আমীর ছাহেবকে মনে মনে আন্তরিক ‘ধন্যবাদ’ জানালাম। ভুল করে হলেও, কিছুক্ষণের জন্য হলেও হজ্বের কাফেলায় বাইতুল্লাহর মুসাফিরদের কাতারে দাঁড়াবার তাওফীক হলো। অসম্ভব কী, আল্লাহ মেহেরবান যদি শুধু এইটুকুর ওছিলায় এবারের হজ্বের মজমায় আমাদেরও শামিল করে নেন! তাঁর দয়া ও করুণার তো শেষ নেই!

জেট এয়ারের যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত বুথ কোথায়? দক্ষিণ দিকে বেশ দূরে। সেদিকে ধাবিত হলাম। সময় তখন একেবারে কম।

আমীর ছাহেবের কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা। একটা হাত নাড়তে কষ্ট হয়, আরেকটা হাত কিছুতেই উপরে ওঠাতে পারেন না। আমি ও মাওলানা আব্দুল মতীন বারবার বলছি তাঁর সামানটা আমাদের দেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি দেবেন না; বলেন, ‘চাকা আছে, চলছে। বহন তো করতে হচ্ছে না; সমস্যা নেই।’ চাকা থাকলেই বুঝি চলে! আমাদের দেশটা তাহলে চলছে না কেন? চাকা নেই, নাকি জ্বালানী নেই, কিংবা নেই চালক?

কী আশ্চর্য! মুদীর ছাহেবের কথাটা অসত্য প্রমাণিত করার জন্যই যেন চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটলো।

একভদ্রলোকের বিরাট লাগেজ এবং বিরাট ভুঁড়ি। জেট এয়ারেরই যাত্রী। পরে জানা গেলো বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য পোশাকশিল্পের শীর্ষ ব্যবস্থাপক। বোঝা যায়, প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা হজম করে দেশে চলেছেন। তার লাগেজে চাকা আছে। কাঁধে বুকে ফিতা লাগিয়ে বেশ হেলে দুলে চলছেন, লাগেজও চলছে। হঠাৎ কীভাবে যেন ফিতাটা ছিঁড়ে গেলো। ভদ্রলোক বেশ বেকায়দায় পড়ে গেলেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলাম, খুশী হলেন। ইচ্ছে হলো, মুদীর ছাহেবকে বলি, দেখুন চাকা আছে, অথচ ঠিকমত চলছে না। যাকগে, কোত্থেকে কোথায় চলে যাই!

নির্ধারিত বুথে এসে দেখি, প্রায় ফাঁকা। অর্থাৎ আমরা বেশ বিলম্বে পৌঁছেছি। পাসপোর্ট যিনি দেখলেন, সিলছাপ্পড় দিলেন, তিনি হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, ইস্তাম্বুলে কী উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন? একই প্রশ্ন, কিন্তু কত পার্থক্য! আমীর ছাহেব বললেন, একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি।

ইসলামী কন্ফারেন্স নিশ্চয়?

- জ্বি।

শেষে ভদ্রলোক দিল ঠাণ্ডা করে দিয়ে বললেন, আল্লাহ আপনাদের কামিয়াব করুন। মেহনত করে যান, আপনাদের দ্বারাই তো ইসলাম টিকে আছে।

যেখানে দেহতল্লাশি এবং হাতের সামান স্ক্যানিং করা হয় সেখানে বিশেষ কোন সমস্যা হলো না। ভদ্রলোক বয়স্ক এবং ‘মুছল্লী’। বললেন, খাবার ও পানীয় আছে? বললাম, জ্বি, দিল্লী বিমানবন্দরে দশঘণ্টার মত থাকতে হবে তো!

তিনি সহানুভূতিপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, ঠিক আছে। ওখানে দেখেন, ওরা কী করে!

ওখানে মানে একটু সামনে অবস্থানকারী জেট এয়ারের নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থার লোকজন। দূর থেকে দেখা গেলো, বেশ ‘কড়া’। সব ঘেঁটে তছনছ করে ফেলছে এবং ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য, আমাদের ছেড়ে দিলো! বোঝা গেলো না, দয়া না অবহেলা!

ব্রিজ দিয়ে বিমানের দোরগোড়ায় পৌঁছলাম এবং একটা পুরুষ মুখের হাসি উপহার পেলাম। হাসিটা বাসি ফুলের মত মনে হলো, তবু গ্রহণ করলাম এবং অনুরোধ করলাম আমাদের আসনটা দেখিয়ে দিতে। ভদ্রলোক ‘কিউঁ নেহি, কিউঁ নেহি’ বলে টিকেট তিনটি দেখে আমাদের আসন কোথায় হবে দেখিয়ে দিলেন। যখন পানি চাই তখন বলে, কিউঁ, কিউঁ? তখন যদি বলতো, কিউঁ নেহি, কিউঁ নেহি, বাংলাদেশ চিরকৃতজ্ঞ হতো।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)



[1] এটা আমার নিজের নয়, সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছ থেকে পাওয়া। মানুষটি লিখতেন ভালো। রসের মিশ্রণের ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ ছিলো যথেষ্ট। দুর্বলতা ছিলো শুধু একটা, এই নির্দিষ্ট ধারা থেকে বের হতে পারতেন না, বিষয়বস্তু যাই হোক। তবু কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করি, তাঁর কাছ থেকে শিখেছি যথেষ্ট।

[2]  মাযী মানে অতীত; পাসদার মানে পাহারাদার, রক্ষক

[3]  মাওলানা যাহিদকে এবং আমার ছেলেকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, তাহকীক করার জন্য, তারা জানালো, হাদীছটি এরকম- لك لك الأولى وليست لك الثانية
কিন্তু
আমার যদ্দুর মনে পড়ে, ঐরকম দেখেছি। الله أعلم (মিসবাহ)

সুনানে দারেমী তহাবীর বর্ণনায় আছে :

فإن الأولى لك والآخرة عليك

আর প্রথম দৃষ্টি দ্বারা কী উদ্দেশ্য তা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ  نظر الفجاءة বা অনিচ্ছাকৃত  হঠাৎ  যেই দৃষ্টি পড়ে যায়।  এক্ষেত্রে  হুকুম হল, দৃষ্টি অবনত করে ফেলা। হাদীসের ভাষায় اصرف نظرك (আবদুল মালেক)

[4] উটের পিছনের সহযাত্রীকে বলে রাদীফ।

 

 

advertisement