যিলহজ্ব ১৪৩৫   ||   অক্টোবর ২০১৪

ইতিহাসের সত্যবরণ এবং ধর্মের সম্পূর্ণ চেতনা

মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ

কুরআন মজীদের অনেক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে পূর্ববর্তী বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর উত্থান-পতনের বিবরণ। এসব বিবরণের মধ্য দিয়ে ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাস স্মরণ করানোর লক্ষ্যে وَاذْكُرُوْاَ  বা ‘স্মরণ কর’ শব্দটি এসেছে বহুবার। এমনকি একটি ঘটনাকে অনেকবার স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দৃষ্টান্তও বহু। কুরআন মজীদের এসব ইতিহাস সংশ্লিষ্ট বিবরণ ও বিবরণধারা প্রমাণ করে যে, কোনো জাতির উন্নতির জন্য, পতন ও ধ্বংস থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজন পূর্ববর্তীদের ইতিহাস জানা এবং তা থেকে শিক্ষা নেয়া। সঠিকভাবে কোনো জাতির বেড়ে উঠার জন্য ইতিহাসের সঠিক চর্চার প্রয়োজন অনেক বেশি। ইতিহাসের ভুল বা মিথ্যা চর্চা যেকোনো জাতির অগ্রগতির পথে বড় রকম বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

কুরআন মজীদে বিভিন্ন নবী-রাসূল ও জাতি-গোষ্ঠীর ইতিহাস রয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, যে বা যারা সত্যের পথে অবিচল ছিল বিজয় শেষ পর্যন্ত তাদেরই হয়েছে। সাময়িক শক্তি বা প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও মিথ্যার পতন ছিল অবধারিত। হযরত নূহ আ.-এর দাওয়াত এবং তাঁর জাতির ইতিহাস দেখুন। তিনি সাড়ে নয়শ বছর তাঁর জাতিকে দাওয়াত দিয়েছেন। বেশির ভাগ লোক দাওয়াত গ্রহণ করেনি। তারা তো বেশ প্রভাবশালী ছিল। কিন্তু যখন প্লাবন এল তখন সত্যপন্থী অল্প কিছু মানুষ ও বাছাইকৃত প্রাণীকূল ছাড়া সেসব মিথ্যাপন্থী শক্তিমানেরা ডুবে মরলো। এমনকি এ ঘটনায় মিথ্যার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় হযরত নূহ আ.-এর ছেলেকেও প্লাবনে ডুবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। হযরত মূসা আ.-এর অনুসারীরা ছিল দুর্বল এবং স্বল্পসংখ্যক। কিন্তু সত্যকে অনুসরণ করার কারণে তারা বিজয়ী হয়েছে। অপরদিকে মিথ্যার পক্ষ গ্রহণকারী ফেরাউন বাহিনী যারা তাকে কষ্ট দিয়েছিল তারা লোহিত সাগরে ডুবে মরেছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আনুকূল্য ও কর্তৃত্বও তাদের বাঁচাতে পারেনি। একইভাবে ঈসা আ.-কে কষ্ট দিয়েছিল যে ইয়াহুদীরা তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা শত্রুদের সব ষড়যন্ত্র নস্যাত করে হযরত ঈসা আ.-কে ঊর্ধ্বে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। তবে একথাও সত্য যে, যুগে যুগে যারাই সত্যকে মানতে চায়নি তারাই নিজেদের মিথ্যাকে বড় করে দেখিয়েছে। তারা কথা বলেছে বড় বড়। দাবি করেছে বড় বড়। সত্যের বিপক্ষে থাকলেও নিজেদের সঠিক বলে দাবি করেছে।

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যবাণী কুরআন মজীদে এরকম সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব ও পরিণতির অসংখ্য ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। মিথ্যাচারীর পরিণতি তখনো ভালো হয়নি। এটি আসলে মানবজাতির ইতিহাসের স্বাভাবিক ধারা ও পরিণতি। মানবকুলের স্রষ্টা আল্লাহ তাআলাই এই নিয়ম চালু রেখেছেন। মানুষ শত চেষ্টা করলেও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটাতে পারেনি।

এমনিভাবে প্রকৃতির একটি অমোঘ বিধান হল, কোনো ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী ঐতিহাসিক কোনো বাস্তবতাকে অস্বীকার করে সফল হতে পারে না। কিছুদিন ধামাচাপা পড়ে থাকলেও একদিন না একদিন তা প্রকাশিত হয়ে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে এর নযীর কম নয়।

এ প্রসঙ্গে আমাদের স্বাধীনতার দীর্ঘ ইতিহাসের অধ্যায়টি সামনে আসতে পারে। আমাদের নিকটবর্তী স্বাধীনতার ইতিহাস হচ্ছে ৪২ বছরের। এর আগেও ২০০ বছরের রক্তঝরা গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। ওই সময়ে আমাদের অনেক পূর্বপুরম্নষের অমূল্য অবদান রয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর অনেকগুলো সরকারের যুগ পার হলো। কিন্তু জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর কোনো একটিরও নির্ভেজাল ও সর্বজনগ্রাহ্য বর্ণনা আমরা তুলে ধরতে পারিনি। ১৯৭১-এর মার্চের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা, প্রধান নেতৃত্বের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রস্তুতি গ্রহণ করা না-করা, যুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকার, মূল মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী বিভিন্ন বাহিনী, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা, স্বাধীনতার অঙ্গীকার, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, জাতীয় নেতৃত্বের স্বীকৃত কাঠামো, জাতীয় শত্রু-মিত্র নির্ধারণের মাপকাঠি- এগুলো কোনো কিছুই স্থির বা মীমাংসা করা হয়নি। বরং হয়েছে উল্টোটা। দিন দিন অনিশ্চয়তা ও বিতর্ক বেড়েছে। সঠিক ইতিহাসের চর্চা না করে টেবিলে বসে ইতিহাস তৈরি করা হচ্ছে। একপক্ষীয় চরদখলের মতো ইতিহাসের নানা অঙ্গন দখল করা হচ্ছে।

সেসব বিতর্কিত সিদ্ধান্তই আবার রাষ্ট্রের অন্য কিছু কিছু স্তম্ভের মাধ্যমে মীমাংসিত বলে চালিয়ে দেওয়ার দৃষ্টিকটু উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এতে মানুষের বিভ্রান্তি আরো বাড়ছে। ফলে কিছু লোক কোনো পক্ষকেই বিশ্বাস করছে না। আবার কিছুলোক নিজের অনুসরণীয় নেতৃত্বের প্রতি অন্ধবিশ্বাসী হয়ে ইতিহাসের দিকচিহ্ন ঠিক করছে। এভাবে বিভ্রামত্ম হচ্ছে পুরো জাতি। ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি অত্যন্ত খারাপ নযীর সৃষ্টি করছে। বর্তমান ও নতুন প্রজন্ম উভয় শ্রেণীই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে ৭১-এর মৃক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক এ কে খন্দকার লিখিত ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন। দেখা যাচ্ছে, সে বইটি দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বইটিতে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে অপ্রচলিত ও শক্তিমান মহল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তথ্য ও ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এতে একপক্ষীয় ইতিহাস রচয়িতাদের অনেকটাই ক্ষুব্ধ হতে দেখা গেছে। ইতিহাসের সত্য কিংবা যুক্তিসঙ্গত ভিন্নমতকে চাপ দিয়ে থামিয়ে দেওয়ার আওয়াজ পর্যন্ত উঠেছে সংসদভবনের ভেতরে। অপরদিকে ইতিহাসের এই সত্য সত্যভাষণ কিংবা একপক্ষীয় অর্গল থেকে মুক্তি উপলক্ষে অনেককেই উল্লসিত ও তৃপ্ত হতেও দেখা গেছে। এর সবই অবশ্য আমরা জেনেছি গণমাধ্যমের বরাতে।

এ কে খন্দকার মূলত ক্ষমতাসীন দলটির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অত্যন্ত প্রভাবশালী পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। শাসকদলের সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ কর্মসূচীর সংগঠন ‘সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম’-এর তিনি ছিলেন আহবায়ক। এ বইটি প্রকাশের আগ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন মহলের সঙ্গে তার আদর্শিক দূরত্ব ও শত্রুতার কোনো তথ্য কেউ জানাতে পারেনি। অথচ দেখা যাচ্ছে তার এ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরই তার বিরুদ্ধে নানা রকম বিষোদ্গার শুরু হয়েছে। তার বইটি পড়ে দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছে। বইটিতে অন্য অনেক বর্ণনার পাশাপাশি ৭ মার্চের ভাষণের শেষে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ‘জয় বাংলা’র পর ‘জয় পাকিস্তান’ বলা, মুজিব বাহিনীর বে-আইনী ও মুক্তিবাহিনী বিরোধী ভূমিকা এবং ২৬ মার্চে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে উদ্দীপনামূলক বলে বর্ণনা করেছেন। এতেই স্বপক্ষীয় মহলের মাঝে তীব্র ক্ষুব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ইতিহাসের সত্য প্রকাশ হলে কেন এমন হয়? এতদিন নিকট অতীতের স্বাধীনতার ইতিহাস যে যার মতো লিখেছেন। একই ঘটনাকে নানাভাবে লিখেছেন নানানজন। নিরপেক্ষতা কম ছিল। একজন এই দাবি করছেন, অপরজন সেই দাবি উল্টে দিচ্ছেন। ইতিহাস-উপস্থাপনের এই প্রবণতা শুধু চরম স্বার্থ-সিদ্ধির পরিচায়কই নয়, এটা পরিণতিতে মারাত্মক ধ্বংসাত্মক। নিজেদের জন্যেও, বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। কারণ, ইতিহাস আসলে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা, লেখা ও উপাস্থাপনের বিষয় নয়। ইতিহাস হচ্ছে ঘটে যাওয়া বিষয়কে সঠিক, নিরপেক্ষ ও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলা। এ ব্যাপারে পুরোপুরি ইনসাফ বজায় রাখা ইতিহাসবিদ ও চর্চাকারীর দায়িত্ব। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) তোমরা যারা ঈমান এনেছ, শোনো তোমরা ন্যায়বিচারে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকার ব্যাপারে আল্লাহর স্বাক্ষী হিসেবে মজবুত হয়ে দাঁড়াবে, যদিও সে স্বাক্ষ্যে তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে অথবা তোমাদের পিতা-মাতার বিরুদ্ধে অথবা আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে যায় তবুও। (সূরা নিসা ৪ : ১৩৫)

অথচ আমাদের অবস্থা এর কত বিপরীত! ইতিহাসের যে কোনো সত্য আমাদের নিজেদের স্বার্থে, মতাদর্শ কিংবা নিজেদের বানানো ইতিহাসের ছকের বাইরে গেলে আমরা ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করি। তার বিরুদ্ধে লেগে যাই। অপরদিকে নিজেদেরকে মুক্তচিন্তার আধুনিক মানুষ বলে দাবি করি। পবিত্র কুরআনে যেখানে নিজে এবং নিজ পিতা-মাতার বিরুদ্ধে গেলেও স্বাক্ষ্যদানের ক্ষেত্রে সত্যকে শক্তভাবে কড়ে ধরে রাখার কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেখানে নিজেদের দল, মত, নেতা ও স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে অন্ধের মতো বিরুদ্ধতার জন্য নেমে উঠে পড়ে লেগে যাই। অথচ সত্য মেনে নিয়ে মরহুম শেখ মুজিবর রহমান ৭ মার্চের ভাষণের শেষে ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন এটা মেনে নিলে কী ক্ষতি আছে? এতে কি তার ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ তৈরি হয়? বরং সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী দলের নেতা হিসাবে গোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবির প্রেক্ষাপটে সেরকম বলাই তো বেশি প্রাসঙ্গিক।

আসলে শুধু এ কে খন্দকারের বই নয়, এর আগেও জাতীয় বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে লেখা, সংবিধানে সংযুক্তিকরণ ও স্বাধীনতার ইতিহাস সংশ্লিষ্ট উঁচু মহলের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত ব্যাপক বিতর্ক ও কৌতুকের সৃষ্টি করেছে। এসবের কারণ হতে পারে সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা অথবা সঠিক ইতিহাস মেনে নেয়ার ন্যূনতম মানসিকতা না থাকা। অর্থ ও পদের লোভসহ নানা পার্থিব মতলব। পেশিশক্তি দিয়ে বাস্তব ইতিহাসকে দাবিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টাও বলা যায়। মনে রাখা দরকার, এভাবে একতরফাভাবে মনগড়া ইতিহাস দীর্ঘদিন পর্যন্ত চাপিয়ে রাখা যায় না। মিথ্যা ইতিহাস দিয়ে একটি দুটি গোষ্ঠী বা প্রজন্মকে হয়তো বিভ্রান্ত করা যেতে পারে। কিন্তু অনন্তকালের জন্য সেটা প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। কোনো না কোনো সময় নিজেদের লোকেরাই বিবেকের তাড়নায় আসল সত্যটা তুলে ধরে। সুতরাং আমাদের সবার দায়িত্ব আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ মেনে সত্য বলা, সত্য শোনা, সত্য মানা এবং সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং সত্যকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকা। সত্য নিজের বা আপনজনের বিরুদ্ধে গেলেও সত্য থেকে বিচ্যুত না হওয়া। আমরা যদি সত্যগ্রহণ থেকে বিরত না হই, সত্যকে দমানোর চেষ্টা না করি তবেই যুগে যুগে মিথ্যাচর্চার আযাব থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি।

দুই.

এ পর্যায়ে পূর্বযুগের উম্মতদের ইতিহাস থেকে আমরা হযরত নূহ আ.-এর সন্তানের করুণ পরিণতির বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারি। নবীর ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সর্বগ্রাসী প্লাবনের জোয়ার থেকে সে রেহাই পায়নি। এ থেকে বোঝা যায় মানুষের উত্তম-অনুত্তম নির্ণয়ে কে কার ছেলে এবং কে কার বাবা এটা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। বরং মুখ্য হচ্ছে সৎ আদর্শ ও সৎ আমলের উপর প্রত্যেকের অবিচল থাকা। তা না হলে পিতার সততা ও ধর্মপ্রাণতার কারণে চূড়ান্ত বিচারে পুত্রের কোনো কৃতিত্ব সাব্যস্ত হতে পারে না। প্রসঙ্গটিই এসেছে এজন্য যে, সম্প্রতি প্রবাসে অবস্থানকারী একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির সন্তান ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে অপ্রত্যাশিত মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ধর্মের উপর ভিত্তি করে কোনো রাজনৈতিক দল গঠিত হতে পারে না।’ সবসময় ইসলামী মূল্যবোধের শ্লোগান উচ্চারণকারী দলের অন্যতম কাণ্ডারি হয়েও এ ধরনের বক্তব্য কেন তিনি দিলেন এটা অনুধাবন করা মুশকিল। তবে, এ বিষয়ে বলতে গেলে যে কথাটি শুরুতেই বলতে হয় তা হচ্ছে, ইসলামে ধর্মীয় রাজনীতি বলতে কিছু নেই। ইসলাম সম্পর্কে খণ্ডিত ধারণা পোষণকারীরাই ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে রাজনৈতিক ‘ধর্মীয় রাজনীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। মূলত ইসলাম এমন একটি ধর্মের নাম, যাতে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ সবকিছুর মূলনীতি ও দিকনির্দেশনা রয়েছে। ইসলামের রাষ্ট্রনীতি সর্বদা আধুনিক ও কল্যাণমূলক। ইতিহাস সাক্ষী, যুগে যুগে ইসলামের বিচারকরা যেসব ইনসাফপূর্ণ দৃষ্টান্তমূলক সাহসী বিচার-উপমা প্রতিষ্ঠা করেছেন পরবর্তী কোনো যুগে তার নযীর পাওয়া যায়নি।

মূলত ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কথাটা এসেছে পরবর্তীতে অমুসলমানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। বিজাতিদের অনুকরণে সেক্যুলারিজমকে আদর্শ বানানোর পর ইসলামকে খণ্ডিতরূপে দেখার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে একশ্রেণীর মুসলমানের মাঝে। তারা নিজেদের শাসনব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক নাম দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিকে জোর করে নিজস্ব নীতি থেকে সরিয়ে নিয়ে বস্তাপচা মানবরচিত মতবাদ অনুসরণে বাধ্য করছে। এরা ধর্মকে শুধু কিছু আচার-অনুষ্ঠানে সীমিত রাখার প্রয়াস শুরু করে।

এমন প্রেক্ষাপটেই অনেক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বাধ্য হয়ে ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যুগে যুগে এসব ধর্মভিত্তিক দল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে বহু কুরবানীর অধ্যায় রচনা করেছে। সেক্যুলার দলগুলোর বিপরীতে তারা আদর্শ দেশপ্রেমের নযীরও উপস্থাপন করেছে। যারা মুসলিম প্রধান দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন তারা মূলত ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চর্চার ত্যাগী ও বর্ণাঢ্য ইতিহাস সম্পর্কে জানেন না। এ ধরনের মন্তব্য ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতারই পরিচায়ক। তাদের জানা উচিত যে ইউরোপে ও বহু দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সক্রিয় রয়েছে।

তাছাড়া এটা তো এজাতীয় রাজনীতিকের জন্য আত্মঘাতীও। কারণ, ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা বলে রাজনীতির ভিত দৃঢ় করেছে যে দল তাদের অন্তত ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে বিরূপ কিছু বলা সমীচীন নয়। বলা হয়ে থাকে, এ দলটি বার বার ক্ষমতায় আসে ধর্মপ্রাণ মানুষ ও দলের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থনে। সুতরাং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে বলা মানে নিজেদের রাজনৈতিক ভিত্তিকেই নড়বড়ে করে দেওয়া। এটা নিশ্চয়ই বিভিন্নভাবে পোড় খাওয়া ওই তরুণ নেতার জানার কথা। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, ধর্মীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ বাদ গেলে প্রধান দুটি দলের মাঝে আর কোনো পার্থক্য থাকে না। জাতীয়তাবাদের পক্ষের শক্তির স্বতন্ত্র কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকে না। সুতরাং ধর্মপ্রাণ শক্তির কাছে অবস্থান করতে চায়- অন্তত এমন দলের লোকদের ধর্মীয় রাজনীতি নিয়ে মন্তব্যের আগে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পড়াশোনা, চিন্তাভাবনা ও পরামর্শ করা অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি।

দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও রাজনীতি সম্পর্কিত এজাতীয় আলোচনায় যাওয়ার কারণ হচ্ছে, নাস্তিক-সেক্যুলারদের পক্ষ থেকে আরোপিত অভিযোগ যদি কোনো ধর্মীয় রাজনীতির পক্ষের দাবিদারের মুখে উঠে আসে তখন এ বিষয়ে স্পষ্টতা আনার জন্য কিছু কথা পেশ করা আমাদের দায়িত্ব হয়ে যায়।

পরিশেষে আমরা সাধারণ জনগণকেও সতর্ক থাকার এবং নিজেদের দ্বীন-ঈমান রক্ষায় সজাগ থাকার আহবান জানাবো। কারো দাবি করা মিথ্যা ইতিহাসে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। কারো গলদ কথা সমর্থন করা যাবে না কোনোভাবেই। কারণ, মুমিন কাউকে প্রতারিত করে না এবং নিজেও প্রতারিত হয় না।

 

 

 

 

advertisement