সফর ১৪৩১   ||   ফেব্রুয়ারী ২০১০

ইসলাহী মাজালিসঃ একটি অনন্য উপহার

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

আমানত আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত, কিন্তু এখন তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। আর এ কারণে দ্বীন ও দুনিয়ার প্রতিটি বিভাগ জুলুম ও অবহেলার শিকার হয়ে চলেছে। অবস্থা এতই করুণ যে, দ্বীনের কোন অংশ সর্বাধিক অবহেলিত ও মাযলূম তা নির্ণয় করাও কঠিন। এক হিসাবে বলা যায়, দ্বীনের যে বিভাগ তাসাওউফ নামে পরিচিত অংশটিই সবচেয়ে বেশি জুলুমের শিকার। তাসাওউফ বা সুফীবাদের নামে বিদআতী ও মুলহিদ গোষ্ঠীর অনাচার ও স্বার্থ-হাসিলের কথা তো বলাই বাহুল্য, যারা এসব অনাচারকে প্রত্যাখানের পাশাপাশি সহীহ তাসাওউফের প্রয়োজন স্বীকার করেন তাদেরও অধিকাংশের অবস্থা এই যে, এ ময়দানের আমলী মেহনত ছেড়ে শুধু তাত্ত্বিক অংশের উপরই তারা সন্তুষ্ট। কিংবা খুব বেশি হলে সামান্য কিছু রীতিনীতি পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ তাসাওউফের মূল অংশই হচ্ছে আমলী তাসাওউফ, অর্থাৎ তাযকিয়ায়ে নফস, ইসলাহে কলব, ইহসান ও ইহতিসাব, তাকওয়া-তহারাত এবং যিকর ও দুআ। তাযকিয়ায়ে নফস ও ইসলাহে কলবের উপায় হল, নিজেকে সর্বদা মুহাসাবার মধ্যে রাখা। কোন আচরণ কোন আত্মিক ব্যাধির প্রভাবে প্রকাশিত হল কিংবা কলবে ছালেহ-এর কোন বৈশিষ্ট্য আমার মাঝে অনুপস্থিত তা সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা। এরপর কিতাব ও সুন্নাহ এবং সীরাতে নবী ও সীরাতে সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে চিকিৎসার উপায় অন্বেষণ করা। এক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সীরাতের পাশাপাশি সাহাবা ও তাবেয়ীনের জীবনাদর্শের কথা এজন্য বলা হল যে, সেটিও প্রকৃতপক্ষে নবী জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। এখান থেকে খুঁজে নিতে হবে যে, কীভাবে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বা কীভাবে ওই উত্তম বৈশিষ্ট্য অর্জন করা যায়।

যেহেতু সবার পক্ষে আত্মিক ব্যাধি নির্ণয় করা এবং সরাসরি কিতাব ও সুন্নাহ থেকে চিকিৎসার উপায় খুঁজে বের করা সম্ভব নয় তাই এমন একজন আল্লাহওয়ালার রাহনুমায়ী প্রয়োজন, যাঁকে আল্লাহ তাআলা ‘ছালাহ’ বা আদর্শ জীবন ও চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়বান মুসলিহের গুণাবলীও দান করেছেন। অতঃপর রোগ-নির্ণয় এবং কিতাব ও সুন্নাহ থেকে নিরাময়ের উপায় খুঁজে বের করা বা বের করতে সক্ষম হওয়া যথেষ্ট নয়। সুস্থতার জন্য তো ঔষধ সেবন অপরিহার্য। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, বাতেনী রোগ-ব্যাধি দ্বারা যেহেতু প্রত্যক্ষ কোনো দৈহিক সমস্যা অনুভূত হয় না তাই এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসার নিয়ম কানূন পালনের ঝামেলায় পড়বে কেন? এজন্য যুক্তি ও অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত যে, একজন ছালিহ ও মুছলিহ মুরব্বীর সোহবতই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক। বুযুর্গানে দ্বীনের সোহবত থেকে ফায়েদা হাসিলের অনেক বিষয় রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মুহাসাবায়ে নফসের অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নিজের হালত পেশ করে শায়খের নিকট থেকে একটি একটি করে বাতেনী রোগসমূহের চিকিৎসা করা।

এই শেষ যামানায় তাসাওউফের সংস্কার ও নব নির্মাণের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা যে কাজ আকাবিরে দেওবন্দের মাধ্যমে করিয়েছেন তার নযীর খুঁজে পাওয়া কঠিন। তারা এ বিষয়েও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর সার্থক উত্তরসূরী। আর তাঁদের মধ্যেও কর্ম ও অবদানের বিচারে আকাবিরে দেওবন্দের তৃতীয় সারির বুযুর্গ হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. অনেক বেশি অগ্রগামী। তাঁর নিকটে তাসাওউফের কঠিনতম দু’টি বিষয়ের সর্বাধিক গুরুত্ব ছিল। তা হচ্ছে আচার-আচরণে ‘আদাবুল মুআশারা’ ও ‘আদাবে ইনাসানিয়াতে’র অনুশীলন আর হৃদয় ও অন্তরের পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রে নফসের রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা ও পরিশুদ্ধ অন্তরের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যসমূহ অর্জন। এ বিষয়ে তাঁর রেখে যাওয়া বিপুল ভাণ্ডারে কুরআন-সুন্নাহর মৌলিক নির্দেশনা এবং শত শত বছরের প্রয়োগ-অভিজ্ঞতার সারনির্যাস বিদ্যমান রয়েছে। হযরত মাওলানা ঈসা ছাহেব হাকীমুল উম্মতের খুতবাত ও মাওয়ায়িজ, মাকতূবাত ও মালফূযাত, রাসাইল ও মুআললাফাত থেকে কিছু নির্বাচিত ব্যবস্থা ‘আনফাসে ঈসা’ নামে সংকলন করেছেন। কিতাবটি একাধিকবার মুদ্রিত হয়েছে। তবে তা ছিল বিশেষ বিশেষ আহলে ইলমের পাঠ-সামগ্রী। কেননা, এর উপস্থাপনা কিছুটা ইলমী এবং আলোচনা অত্যন্ত সারগর্ভ হলেও অতি সংক্ষিপ্ত । এজন্য সাধারণ পাঠক তো বটেই, তালিবে ইলম ও ইলমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাধারণ লোকদের পক্ষেও তা থেকে ফায়েদা হাসিল করা সহজ ছিল না।

আল্লাহ তাআলা লাখো শোকর, তাঁর ফযল ও করমে কিতাবের এমন একটি ভাষ্যগ্রন্থ তৈরি হয়েছে, যা বিস্তারিত প্রামাণ্য আলোচনায় সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত সহজ ও সর্বজনবোধ্য। আর তা উৎসারিত হয়েছে কলম থেকে নয়, যবান ও কলব থেকে। আমাদের উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুমকে আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিয়েছেন, বহু দিন পর্যন্ত রমযানুল মোবারকের শেষ দশকে বাদ যোহর তাঁর ইসলাহী মজলিসে এই কিতাব সামনে থাকত। যার দ্বারা এই আযীমুশশান শরহ প্রস্তুত হয়েছে।

গ্রন্থটি তাসাওউফের ওই গুরুত্বপূর্ণ অংশকেও পুনরায় জীবিত করেছে, যা আহলে হক তাসাওউফপন্থীদের নিকট থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে। তদ্রূপ যারা সকল বিষয় দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে জানতে ইচ্ছুক তাদের জন্যও এতে পর্যাপ্ত খোরাক রয়েছে। পাশাপাশি উপস্থাপনা এতই আকর্ষণীয় যে, যারা নফসের সংশোধন-সাধনাকে তিক্ত ও বিরক্তিকর মনে করে এ ময়দানে প্রবেশে অনাগ্রহী তাদের আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টিতেও ইনশাআল্লাহ সফল। নফসের বহুবিধ চক্রান্ত এবং ইসলাহে নফসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা, যা কোনো বুযুর্গের সোহবতে থেকে মুহাসাবায়ে নফসের সামান্য চিন্তা-ভাবনাকারীকেও সম্মুখীন হতে হয়, তা সমাধানে আলহামদুলিল্লাহ এই কিতাব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এবং ইনশাআল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত রাখবে। করাচির মায়মান ইসলামিক পাবলিশার্সকে অভিনন্দন যে, তারা এই ভাষ্যগ্রন্থটি ‘ইসলাহী মাজালিস’ নামে ছয় খণ্ডে প্রকাশ করেছে। অতঃপর বাংলা-ভাষার পাঠকদের প্রতি অনুগ্রহ করে ‘মাকতাবাতুল আশরাফ’ খুব দ্রুত এর বাংলা তরজমা প্রকাশ করেছে। প্রায় এক বছর হল ‘ইসলাহী মাজালিস’ নামেই এই অনুবাদ পাঠকবৃন্দের হাতে পৌঁছে গেছে। ইতিপূর্বে এর ইংরেজি তরজমাও প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের দেশে প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান অনেক, কিন্তু এখনো এমন প্রকাশকের বড় অভাব, যাদের প্রকাশনার উপর নজর বুলালে ধারণা হয় যে, তাদের সামনে কিছু দ্বীনী লক্ষ্য আছে, যা বাস্তবায়নে তারা সচেষ্ট। মাকতাবাতুল আশরাফের কিছু কিছু প্রকাশনা থেকে মনে হয়, সম্ভবত এই প্রতিষ্ঠান কিছুটা এই ধারার। আল্লাহ তাআলা কবুল করুন এবং মনযিলে মাকসূদ পর্যন্ত পৌঁছে দিন। অন্যান্য প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠানের জন্য আদর্শ হওয়ার তাওফীক দান করুন আমীন।

প্রকাশনার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু নির্বাচন অতঃপর সে বিষয়ের উপযোগী গ্রন্থ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে পাঠকের চাহিদার চেয়ে তার দ্বীনী প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া কর্তব্য। কেননা, অনেক সময় পাঠকের চাহিদা বিভিন্ন আবেগ-অনুভূতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। আমার আনন্দ হয় যে, মাকতাবাতুল আশরাফের প্রকাশনায় একটা পর্যায় পর্যন্ত সুনির্বাচনের ছাপ লক্ষ করা যায়। আশরাফুস সাওয়ানেহ, ইসলাহী নেসাব, ইসলাহী মাজালিস, দিল কী দুনিয়া, তাসাওউফ ক্যায়া আওর কেঁউ, তাযকিরাতুল আখিরাহ ... ইত্যাদি গ্রন্থের পর তাদের নতুন প্রকাশনা-‘নবীজীর নামায’ ইনশাআল্লাহ পাঠকবৃন্দের জন্য উত্তম উপহার বলে গণ্য হবে। আমি আরো আনন্দিত হয়েছি এজন্য যে, তারা অতি শীঘ্রই উস্তাদে মুহতারাম (হযরত মাওলানা তাকী উছমানী)-এর সর্বজনবোধ্য তাফসীর-গ্রন্থ ‘আছান তরজমায়ে কুরআন’-(জনাব মাওলানা আবুল বাশার-আ.ব.ম. সাইফুল ইসলাম-এর মতো যোগ্য আলিম ও লেখকের হাতে অনুদিত) প্রকাশ করছেন। নিঃসন্দেহে তা বাংলা ভাষার পাঠকদের উপর অনেক বড় অনুগ্রহ।

আল্লাহ তাআলা সংশ্লিষ্ট সকলকে কবুল করুন এবং জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমাদেরকে এই সকল মূল্যবান কিতাব থেকে ফায়দা হাসিলের তাওফীক দান করুন। আমীন। ইসলাহী মাজালিস তো কয়েক ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এখন দেখার বিষয় এই যে, আমরা ক’জন তা থেকে নিছক চিন্তার নয়, হৃদয় ও অন্তরের খোরাক গ্রহণ করি। আল্লাহ তাআলাই তাওফীক দানকারী।

 

advertisement