সফর ১৪৩৫   ||   ডিসেম্বর ২০১৩

আমাদের রাজ্যশাসন-১৩

মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মিসর

মিসর ছিল তৎকালীন রোমসাম্রাজ্যের অধীন। ফলে শাম রক্ষার স্বার্থে মিসরেও নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা জরুরি ছিল। তাই হযরত আমর ইবনুল আস রা.-এর অভিমত ছিল, যদি মিসর জয় করা যায় তবে রোমকদের পক্ষ থেকে আক্রমণের কোনো আশঙ্কা থাকবে না। তাই তিনি উমর রা.-এর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন। প্রথমদিকে উমর রা. এতে অমত করলেও আমর ইবনুল আস রা.-এর জোর তাকিদে তিনি সম্মত হন এবং চার হাজার সৈন্য দিয়ে তাঁকে মিসর অভিমুখে প্রেরণ করেন।

মিসরীয়দের সঙ্গে প্রথম সংঘর্ষ ফারমা নামক স্থানে সংগঠিত হল। দীর্ঘ প্রায় এক মাস পর্যন্ত এ সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। অবশেষে রোমকরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। আর মুসলমানগণ সামনে অগ্রসর হয়ে খাছ মিসর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। রোম সম্রাটের পক্ষ থেকে নিযুক্ত এখানকার শাসক ছিল মুকাওকিস। সে প্রথমে আক্রমণের প্রস্ত্ততি নিলেও মুসলমানগণ অতি নিকটে এলে সে কেল্লার ভেতর অবস্থান নিল। আমর ইবনুল আস রা. অনেক চেষ্টা করেও সফল হলেন না। এভাবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে হযরত উমর রা. হযরত যুবাইর রা. ও হযরত মিকদাদ রা.-এর সাথে দশ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ করলেন। এরপর দীর্ঘ সাত মাস পর্যন্ত মুসলিম বাহিনী সে দূর্গ অবরুদ্ধ করে রাখে। কিন্তু এতেও কোনো কাজ হল না। অবশেষে একদিন হযরত যুবাইর রা. সাহস করলেন। তিনি একটি সিঁড়ি স্থাপন করে দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং প্রধান ফটক খুলে দিলেন। এভাবে মুসলমানগণ শহরে প্রবেশ করেন। মুকাওকিস নিরাপত্তা প্রার্থনা করলে তা গ্রহণ করা হয়।

মুকাওকিস গোটা মিসরবাসীর জন্যই এই সন্ধি করেছিল। কিন্তু হিরাকল (রোমসম্রাট) তা মঞ্জুর করল না। সে সমুদ্রপথে এক বিশাল বাহিনী ইস্কান্দারিয়ায় (মিসরের একটি বড় শহর) প্রেরণ করল। এদিকে মুকাওকিস সন্ধিবদ্ধ হওয়ায় লড়াইয়ে সম্মত ছিল না। কিন্তু রোম সম্রাটের ভয়ে বাহ্যিকভাবে যুদ্ধের প্রতি উৎসাহ প্রকাশ করে। আর গোপনে হযরত আমর ইবনুল আস রা.কে জানিয়ে দেয় যে, আমি ও আমার কওম এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব না। তাই আমাদের যেন কোনো ক্ষতি না করা হয়। মুসলমানগণ তাদেরকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং পুরা যুদ্ধে কোনো কিবতীর (মুকাওকিসের স্বজাতি লোক) কোনো প্রকার ক্ষতি করেননি।

 পথিমধ্যে রোমকরা কয়েকবার আক্রমণ করলেও প্রতিবারই তারা পরাজিত হয়। মুসলিম বাহিনী সামনে অগ্রসর হয়ে ইস্কান্দারিয়া ঘিরে ফেলে। কিন্তু সাগরের দিকের পথটি মুক্ত থাকায় রোমকদের সবধরনের প্রয়োজনই মিটে যেত। অন্যদিকে মুসলমানগণ দীর্ঘদিন পর্যন্ত শহরের সামনে অবস্থান করতে থাকল। অবশেষে তাদের সাথেও সন্ধি হয়ে যায় এবং মুসলমানগণ মিসরে ফিরে আসেন।

এখন গোটা সাম্রাজ্য মুসলমানদের দখলে। হযরত আমর ইবনুল আস রা. মুসলিম বাহিনীর জন্য একটি শহর আবাদ করেন। যা আজও ফুসতাত নামে পরিচিত। আর সেখানে তিনি একটি মসজিদও নির্মাণ করেছিলেন। যা আজ জামে আমর ইবনুল আস নামে পরিচিত।

 

হযরত উমর রা.-এর ওফাত

মদীনায় ফিরোজ নামে এক পারস্য গোলাম ছিল। সে একবার অভিযোগ করল যে, আমার মনিব মুগীরা আমার কাছ থেকে দৈনিক ২ দিরাম (১ রতি পরিমাণ রৌপ্যমুদ্রা) গ্রহণ করে। অথচ এটা আমার পক্ষে অনেক বেশি। হযরত উমর রা. জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী কর? সে উত্তরে বলল, আমি কাঠমিস্ত্রি, কর্মকার ও চিত্রাঙ্কনের কাজ করি। তখন উমর রা. বললেন, তোমার কাজের তুলনায় তো দুই দিরাম খুব বেশি নয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত সে কিছুতেই মেনে নিতে পারল না।

পরদিন হযরত উমর রা. ফজরের নামায পড়ানোর জন্য দাঁড়ালে সে অগ্রসর হয়ে তাকে খঞ্জর দিয়ে উপুর্যপরি আঘাত করতে থাকে। লোকেরা তাকে পাকড়াও করার আগেই সে কয়েকজনকে খঞ্জর দ্বারা আহত করে। অবশেষে অনেক কষ্টে সে ধরা পড়ে। কিন্তু তার সাথে কিছু ঘটার আগেই সে নিজে খঞ্জর দিয়ে আঘাত করে আত্মহত্যা করে।

আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার তৃতীয়দিন

বুধবার ২৭ যিলহজ্ব ২৩ হিজরীতে হযরত উমর রা. ইন্তিকাল করেন।

তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাশে সমাহিত করা হয়।

তিনি মোট সাড়ে দশ বছর রাজ্য পরিচালনা করেন। ওফাত পর্যন্ত তিনি ২২ লক্ষ ৫১ হাজার ত্রিশ (২২৫১০৩০) বর্গমাইল ভূমি ইসলামী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করেন।

 

হযরত উমর রা.-এর কীর্তি

হযরত উমর রা. মোট সাড়ে দশ বছর রাজ্য পরিচালনা করেছেন। কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই রোম ও ইরানের নাভিশ্বাস ছুটে গেছে। উড়ে যায়। কায়সার ও কিসরা (রোম ও ইরানের সম্রাট)-যাদের নাম শুনলেই একসময় আরববাসীদের গায়ে কম্পন সৃষ্টি হত, আজ তাদের শাহী তখত সেসব আরব বেদুঈনের দখলে। যে আরবরা বৃক্ষ ও পাথরের সামনে মস্তক অবনত করত, দেব-দেবীর সামনে নাকে খত দিত, রাজা-বাদশাহদের সামনে সিজদা করত আজ তারা বাইরে বের হলে এই ভাব নিয়ে বের হয় যেন তারা বাদশাহদের কোনো তোয়াজ করে না, রাজত্বের কোনো পরোয়া নেই। আর কোনো বাহিনীকেও তারা ভয় পায় না। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের পথ রোধ করতে অগ্রসর হলেও তারা খরকুটার মতো ভেসে যায়। তাদের সম্পর্কে সবাই অবাক! এক পলকে এমন কী ঘটে গেল?

কিন্তু এতে আশ্চর্যের কী আছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তালীমই ছিল এত দৃঢ় ও মজবুত যে, যেখানে একবার ইসলামের আছর হয়েছে এবং আল্লাহর খেয়াল মনে বদ্ধমূল হয়েছে এরপর আর কী দরকার! গোটা দুনিয়া এখন তাদের পদতলে চলে এল। তাঁরা আল্লাহর জন্য হয়ে গেছেন আর আল্লাহর তাদের জন্য হয়ে গেছেন। ষ 

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement