সফর ১৪৩৫   ||   ডিসেম্বর ২০১৩

মালালা! তুমি কি এসব কথাও বলতে পারবে?

ড. আমের লিয়াকত হুসাইন

মালালা ইউসুফ জাই। পাকিস্তানের আলেচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত এক তরুণী। তার তৎপরতা, যোগাযোগ, সম্পর্ক, আক্রান্ত হওয়ার সব ঘটনাই পশ্চিমা শাসক-কূটনীতিক, গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও মিডিয়ার কল্যাণে পৃথিবীজুড়ে প্রচারিত। গত অক্টোবরে সেই মালালার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনার খবর ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিমা মিডিয়া তাকে নিয়ে নানা রকম প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। সেই সময়েই পাকিস্তানের একজন কথিত প্রগতিশীল কলামিস্ট মালালাকে নিয়ে একটি লেখা উর্দূ দৈনিক জংয়ে প্রকাশ করেন। বিভিন্ন বিষয়ে মালালার প্রতি স্নেহশীল ওই কলামিস্ট তার লেখায় অতি দরকারি কিছু প্রশ্ন ও প্রসঙ্গও উত্থাপন করেন। প্রাসঙ্গিক কারণে এখানে সে লেখাটির অনুবাদ প্রকাশ করা হল।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সোয়াতের সেই সাহসী মেয়েটির সাথে কৃত চরম গর্হিত আচরণের মর্মান্তিক অধ্যায় ইতিহাসের পাতা থেকে কখনো মুছে ফেলা যাবে না। আবার এ কথাও ঠিক যে, সে তার সাহসিকতা, দৃঢ়তা ও অবিচলতার দ্বারা অন্যায়ের গালে এক তীব্র চপেটাঘাত করেছে। লেখাপড়া-জানা এক নিরস্ত্র মেয়ের উপর এ হিংস্র মানবরূপী পশুদের সশস্ত্র হামলা পৌরুষের দাবিদারদের লজ্জিত করার জন্য যথেষ্ট। আর অসংখ্য মানুষের দুআর বরকতে সে মেয়ের প্রাণে বেঁচে যাওয়াও মানবতার শত্রুদের প্রতি এক আসমানী পয়গাম যে, যার সাথে তার রব থাকেন দুর্বৃত্তদের জুলুম-নির্যাতন তাকে ধ্বংস করতে পারে না। এমনকি ভ্যানে ঢুকে মাথায় গুলি করলেও এবং রক্তের নেশায় মত্ত হয়ে বারবার আক্রমণ করলেও। আর ওরা কাউকে হত্যা করে ফেললেও আল্লাহ তাআলা তাকে শহীদের মর্যাদা দান করেন। আর এ তো এমন মৃত্যু, যা সকল জীবিতরই বাসনা।

হত্যাকারী হয়তো মনে করে যে, সে সফল হয়েছে। অথচ ফেরেশতাগণ তার ব্যর্থতার জন্য আফসোস করেন। কেননা ঐ একটি মুহূর্ত হত্যাকারীকে জাহান্নামের গহবরে নিক্ষেপ করে আর নিহতকে পৌঁছে দেয় মাগফিরাতের শীতল ছায়ায়।    

এমনও হতে পারত যে, মালালা আর পৃথিবীতে শ্বাস গ্রহণের সুযোগ পেল না। আবার দুর্বৃত্তদের এ আক্রমণের শিকার হয়ে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বও বরণ করতে পারত। কিন্তু তা তো আমাদের মতো সংকীর্ণ দৃষ্টির মানুষই ভাবতে পারে। গোটা বিশ্বজুড়েই যার দৃষ্টি, যিনি সকল ক্ষমতার উৎস, সেই একক অধিপতি ও স্রষ্টার নির্দেশে তাকদীরের কলম কী লিখে রেখেছে ও কেন লিখেছে তা তো মহাজ্ঞানী আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।

সুতরাং মালালা বেঁচে গিয়েছে। হাসপাতালের বিছানায় সে নবজীবন লাভ করেছে এবং লা-শরিক আল্লাহ তাআলার নির্দেশে। সে সুস্থ হয়ে উঠেছে। চলাফেরা করতে শুরু করেছে। সবাইকে চিনতেও পেরেছে এবং কিছুদিন পর আগের মতোই হয়ে গিয়েছে।

যে মালালা সোয়াতের স্কুলগুলোতে জ্ঞানের আলো বিতরণ করে বেড়াত আল্লাহ তাআলা তাকে শুধু এক নতুন জীবনই দান করেননি; তার বাবা-মা ও ভাইকেও নিরাপত্তার চাদরে আবৃত রেখেছেন। মালালার মাথায় লাগা একটি গুলি অনেকের জীবনকেই নতুন মাত্রা দান করেছে। তার বাবা-মা হাই কমিশনে চাকরি পেয়েছেন। ভাইও উচ্চশিক্ষার জন্য চেষ্টা করছে। ভ্যানে তার সাথে থাকা দুই সহপাঠীও ইতিমধ্যে বৃটেন চলে গিয়েছে। সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়, বই-পুস্তক, এওয়ার্ড, সনদ, পুরস্কার, সম্মান, অভ্যর্থনা, অর্থ ও খ্যাতি সবই তার পদচুম্বন করছে। মজার কথা এই যে, সে এসব থেকে পলায়ন করছে না; বরং এসবের মিষ্টি সুরে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে।

এ মুহূর্তে আমি মক্কা মুকাররমার যাত্রী। এক সাচ্চা গোলামের মতো আমিও যেন নিজ প্রভুকে এই বলে সম্বোধন করতে পারি-লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক ...। (আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির ...)। তাই আমি জানি না, দুনিয়ার বুকে অশান্তি বিস্তারকারীদের পক্ষ থেকে শান্তির নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা হয়েছে কি না। তবে সম্ভাবনা, এই লেখা প্রকাশের আগেই তাকে নোবেল বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। ... ভালো। ... নিশ্চয়ই ভালো। ... খুব ভালো। আমার তো এ কারণেও আনন্দিত হওয়া উচিত যে, পাকিস্তানী মিডিয়ায় একমাত্র আমিই সে হামলার পর মিলিটারি হাসপাতালের বাইরে থেকে মালালার জন্য প্রথম দুআর অনুষ্ঠান করেছিলাম। আর গোটা জাতি একযোগে তার সুস্থতার জন্য কেঁদে কেঁদে দুআ করেছিল।

আমি আজ মালালাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, ভিন্নজাতির লোকদের এই প্রকাশ্য অভ্যর্থনা-সম্বর্ধনা কি তোমাকে একটি বারের জন্যও বিচলিত করেনি? তুমি কে মালালা? একটি ‘‘মুসলিম মেয়ে’’। ... দুনিয়ায় কেউ তোমাকে মেয়ে মুসলিম বলবে না। সবাই মুসলিম মেয়েই বলবে। তাহলে তোমার কি অবাক লাগছে না যে, একজন মুসলিমের প্রতি কেন এত অনুগ্রহ?

কুরআন তো বলে, (তরজমা) ইহুদী-খৃস্টানরা তোমার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের অংশ হয়ে যাও। (সূরা : বাকারা (২) : ১২০)

নিঃসন্দেহে তুমি তাদের অংশ হওনি। কিন্তু তারা তোমাকে তাদের অংশ বানিয়ে নিয়েছে। একটি মুসলিম মেয়েকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য ওরা প্রস্ত্তত। অথচ এই মুসলিম মেয়ের নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবমাননা (নাউযুবিল্লাহ) থেকে এসব স্বঘোষিত শান্তির ঠিকাদাররা নিবৃত্ত হয় না। এদের হাতে গড়া শাদ্দাদী  দুনিয়ায়  শ্রেষ্ঠ নবী, তাঁর সাহাবী ও পুতঃপবিত্র পরিবারবর্গের কোনোই স্থান নেই। তারা শান্তি ও নিরাপত্তার নবী, সর্বস্ব রহমত ও সকল রাসূলের শ্রেষ্ঠ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবমাননার জন্য (নাউযুবিল্লাহ) হাজার হাজার ওয়েবসাইট ও পেজ তৈরি করে রেখেছে। অথচ তোমার সমর্থনে ব্লগ লেখানো হচ্ছে, সংবাদপত্র প্রকাশ করা হচ্ছে। তোমাকে জ্ঞান ও শান্তির প্রতীক আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এ সব কি তোমার ভালো লাগছে?

মা মালালা! বল তো, যখন জ্ঞানের শহরকে ভস্মিভূত করা হয়, শান্তির অদ্বিতীয় নিদর্শনের পবিত্র সীনায় নাযিল হওয়া কুরআন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আর সূরায়ে কলমের অধিকারী, কলমের প্রকৃত আমানতদারের সম্মান ও মর্যাদায় জাহেলের বিষাক্ত কলম বিষ উদগীরণ করে তখন তোমার করণীয় কী হবে?

আমি এবং আমার মতো লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানী তোমার উপর কৃত জুলুমের এ জন্য প্রতিবাদ করিনি যে, আমরা বৃটেনে বসে মিডিয়ার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে বিজাতির ভাষায় তোমার এই অভিব্যক্তি আমরা পছন্দ করব যে, আমি রাজনীতিতে আসতে চাই। তুমি কি ভুলে গেছ, তোমাকে রাজনীতি থেকে বাঁচানোর জন্যই তো সবাই এগিয়ে এসেছিলেন। কোন রাজনীতি? কার রাজনীতি? শিক্ষা বিষয়ক তোমার সব দায়িত্ব পূরণ হয়ে গেছে? এত সব পরিশ্রম কি তুমি এ দিনটির জন্যই করছিলে?    

মা! এসব তুমি নিজে বলছ না। তোমাকে দিয়ে বলানো হচ্ছে। সহমর্মিতা, সহায়-আশ্রয় ও অভ্যর্থনা দিয়ে তোমাকে বিপথগামী করা হচ্ছে। তুমি নিজের পথ ছেড়ো না। তুমি তো এত বড় কষ্ট শুধু শিক্ষার জন্য সহ্য করেছ। এখন একে নতুন কোনো যুদ্ধের কারণ হতে দিও না। নোবেল পুরস্কার প্রদানকারীদের একবার জিজ্ঞাসা করে দেখ, আমার নবী সম্পর্কে তোমাদের মনে কী আছে?

যদি তোমরা তাঁকে সম্মান কর এবং বিশৃঙ্খলা বন্ধের জন্য এই ঘোষণা দাও যে, আল্লাহর যমীনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী যেমন আমাদের চোখে অপরাধী তেমনি নবীগণের অবমাননাকারীও সমান অপরাধী। তাহলে আমি তোমাদের এ পুরস্কার সাদরে গ্রহণ করব। কিন্তু যদি আমার ক্ষেত্রে মাপকাঠি হয় একরকম আর আমার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে মাপকাঠি হয় আরেক রকম তাহলে আমাকেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হোক এবং এ কথা বলতে দেওয়া হোক যে, কোনো খাঁটি মুসলমানের জন্য দুনিয়ার সকল সম্মানও তার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মান ও মর্যাদার চেয়ে বেশি হতে পারে না। তাঁর বদৌলতেই তো আমাদের সম্মান। সম্মানের কথা না হয় বাদই দিলাম। আল্লাহর কসম! আমাদের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত এই রক্তকণিকাও তাঁরই বদৌলতে।

সকল সনদ-সম্মান এখানেই পড়ে থাকবে। সব এওয়ার্ড শোকেসেই সাজানো থেকে যাবে। কবরে তো শুধু তাঁর গোলামির মর্যাদাই সাথে যাবে। নিঃসন্দেহে আমি দুঃসাহসী, কিন্তু এতটা বে-আদব নই যে, এই চিরস্থায়ী সম্মান থেকে মুখ ফেরানোর দুঃসাহস দেখাব।

তোমাদের নোবেল পুরস্কার আমার নিকট সাদরে গৃহীত। তোমার সব কথাই ভালো। আর নিয়ত সম্পর্কেও আমার কোনো প্রশ্ন নেই। তবে তোমরা শুধু এটুকু বল যে, আমার নবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি তোমাদের মহববত আছে। আমরা তো অন্ধকার দূর করারই শপথ করেছি। তাহলে চল, সবাই মিলে সেই প্রদীপই ধারণ করি, যার দ্বারা অন্ধকার দূর হয় এবং যার আলোয় সবকিছু আলোকিত হয়ে উঠে। তোমরা আমার নবীর সম্মানের কথা স্বীকার কর। আমি তোমাদের এওয়ার্ডের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

... মালালা! তুমি কি এসব কথাও বলতে পারবে?

অনুবাদ : আবদুল্লাহ ফাহাদ

**  [মালালার বিতর্কিত বই আই অ্যাম মালালা। বইটিতে নারী স্বাধীনতা ও নারী শিক্ষার প্রেক্ষাপটে মুসলিমসমাজ ও ইসলামী শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমে বইটির প্রতি অতিরিক্ত বাহবা দেওয়া হচ্ছে। এ বইটি নিয়ে পাকিস্তানজুড়ে মালালার দরদীরাও তাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। নভেম্বরের শুরুতে এ বইটি পাকিস্তানের দেড় লক্ষাধিক বেসরকারি স্কুলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অল পাকিস্তান প্রাইভেট স্কুলস ফেডারেশন নিজ উদ্যোগে এ সিদ্ধান্তের কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। শেষ পর্যন্ত মালালাকে অন্য কিছু পুরস্কারে ভূীষত করা হলেও নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি।-অ.]

 

 

advertisement