মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন একই দিনে ঈদের বিষয় দায়িত্বশীলদের উপর ছাড়ুন-৫
শাফেয়ী মাযহাব
আলোচিত মাসআলায় হানাফী মাযহাবের ফকীহগণের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু আলোচনা হয়েছে। আরো কিছু কথা সামনের শিরোনামগুলোর অধীনেও হবে ইনশাআল্লাহ। এখন অন্য তিন মাযহাবের (শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী) ফকীহগণের সিদ্ধান্ত উল্লেখ করা মুনাসিব মনে হচ্ছে।
প্রথমে শাফেয়ী মাযহাব। তবে তা বর্ণনার আগে ভূমিকা হিসেবে এটুকু বলে নিচ্ছি যে, শাফেয়ী মাযহাবের ফিকহের কিতাবগুলোর পরিভাষায় ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর সিদ্ধান্তগুলোকে ‘ক্বওল’ (قول ) ব.ব আকওয়াল (أقوال) বলে। আর মাযহাবের অনুসারী ও ভাষ্যকার ইমামদের ইস্তিমবাতকৃত মতামতকে ‘ওয়াজহ’ (وجه) ব.ব ‘উজূহ’ (وجوه) বলে। ‘আকওয়াল’ বা ‘উজূহ’ বর্ণনার ক্ষেত্রে মাযহাবের ফকীহগণের মাঝে পার্থক্য বা বিভিন্নতা দেখা দিলে একে ‘তরীক’ (طريق) বলে।
শাফেয়ী মাযহাবের বর্ণনা ও উপস্থাপনা এবং ব্যাখ্যা ও দলিল-নির্দেশের ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে দুটি বড় ‘তরীকা’ আছে : ‘তরীকাতুল ইরাকিয়ীন’ (ইরাকীগণের তরীকা) ও ‘তরীকাতুল খুরাসানিয়ীন’ (খুরাসানীগণের তরীকা)। প্রথম তরীকার শায়খ (প্রধান) হলেন আবু হামিদ আসফারাইনী (৩৪৪-৪০৬ হি.)। আর দ্বিতীয় তরীকার শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ কাফফাল মারওয়াযী (৪১৭ হি.)। (আলমাজমূ শরহুল মুহাযযাব, ইমাম নববী, ভূমিকা; তবাকাতুশ শাফিয়িয়্যাতিল কুবরা, তাজুদ্দীন সুবকী ৫/৫৪)
ভূমিকার পর এবার মূল প্রসঙ্গ
শাফেয়ী ফকীহগণ আলোচিত মাসআলায় (এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য অবশ্যঅনুসরণীয় কি না) শুধু ‘উজূহ’ বর্ণনা করেছেন, ‘আকওয়াল’ বর্ণনা করেননি। এর অর্থ, তাঁরা এ মাসআলা ইমাম শাফেয়ীর কিতাবসমূহে পাননি এবং ইমাম শাফেয়ী রাহ. থেকে তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত পৌঁছেনি। তাঁদের কাছে শুধু আছে ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর অনুসারী ফকীহ ইমামগণের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত।
ইমাম শাফেয়ী রাহ. থেকে এ মাসআলা স্পষ্টভাবে বর্ণিত না হওয়ার এক বড় আলামত এ-ও যে, শাফেয়ী মাযহাবের সবচেয়ে বড় সহায়তাকারী ইমাম বায়হাকী রাহ.-এর কিতাব ‘‘মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার’’-এ (যার বিষয়বস্ত্তই হচ্ছে ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর সিদ্ধান্তসমূহের দলিল উল্লেখ করা) আমাদের জানা মতে, এ মাসআলার উল্লেখ নেই। এখন দেখার বিষয় এই যে, শাফেয়ী মাযহাবের অধিকাংশ ফকীহ কোন দিকে। সাইমারী ও আবুত তাইয়েব তবারীসহ কতিপয় মনীষী যদিও বলেন, এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্যও অবশ্যঅনুসরণীয়, কিন্তু অধিকাংশ শাফেয়ী ফকীহর সিদ্ধান্ত এই যে, দূর-দূরান্তের শহর-নগরে এক জায়গার চাঁদ দেখা অন্য জায়গার জন্য অবশ্যঅনুসরণীয় না হওয়াই সঠিক। তবে নিকট ও দূরের মাপকাঠি সম্পর্কে শাফেয়ী ফকীহ ও অন্যান্য ফকীহগণের বিভিন্ন মত আছে। ইনশাআল্লাহ এ বিষয়ে পরে আলাদাভাবে আলোচনা হবে। শাফেয়ী মাযহাবের সর্বসম্মত মুখপাত্র ইমাম আবু যাকারিয়া নববী রাহ. (৬৭৬ হি.) ‘‘শরহুল মুহাযযাবে’’ লেখেন-
إذا رأوا الهلال في رمضان في بلد ولم يروه في غيره، فإن تقارب البلدان فحكمهما حكم بلد واحد ويلزم أهل البلد الآخر الصوم بلا خلاف، وإن تباعدا فوجهان مشهوران في الطريقتين :
أصحهما : لا يجب الصوم على أهل البلد الآخر، وبهذا قطع المصنف والشيخ أبو حامد والبَنْدَنِيْجِي وآخرون، وصححه العَبْدَرِي والرافعي والأكثرون.
والثاني : يجب، وبه قال الصيمري، وصححه القاضي أبو الطيب، والدارمي، وأبو علي السِّنْجِي وغيرهم.
অর্থ, এক শহরের লোকেরা রমযানের চাঁদ দেখেছে, অন্য শহরের লোকেরা দেখেনি এক্ষেত্রে শহর দুটি কাছাকাছি হলে তা এক শহরের মতো গণ্য হবে। সুতরাং দ্বিতীয় শহরের অধিবাসীদেরও রোযা রাখা জরুরি হবে। এতে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু যদি দুই শহর পরস্পর দূরবর্তী হয় তাহলে এক্ষেত্রে দুই ‘তরীকায়’ দুটি প্রসিদ্ধ ‘ওয়াজহ’ রয়েছে : অধিকতর শুদ্ধ ‘ওয়াজহ’ এই যে, (এক শহরে চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার কারণে) অন্য শহরের অধিবাসীদের উপর রোযা রাখা জরুরি হবে না। গ্রন্থকার (আবু ইসহাক শীরাজী), শায়খ আবু হামিদ, বান্দানীজী ও অন্যরা নিশ্চিতভাবে এ কথাই বলেছেন। (অর্থাৎ অন্য মতের উল্লেখও করেননি) আবদারি ও রাফেয়ীসহ অধিকাংশ মনীষী একেই সহীহ বলেছেন।
‘দ্বিতীয় ‘ওয়াজহ’ এই যে, রোযা রাখা জরুরি হবে। সাইমারী তা বলেছেন এবং কাযী আবুত তাইয়্যেব, দারিমী ও আবু আলী ছিনজী প্রমুখ একে সহীহ বলেছেন। (আলমাজমূ শরহুল মুহাযযাব ৭/৪২৭, দারুল হাদীস, কাহেরা)
ইমাম নববী রাহ. এখানে শুধু الأكثر নয়; বরং বহুবচন الأكثرون ব্যবহার করেছেন। এ থেকে অনুমান করা যায়, কী বিপুলসংখ্যক শাফেয়ী ফকীহ ঐ সিদ্ধান্তকে সঠিক বলেছেন। ‘আলমাজমূ’-এর পূর্ণ আলোচনা, যা এখানে নকল করা হয়নি এবং ফিকহে শাফেয়ীর অন্যান্য কিতাব থেকে এ আলোচনা আদ্যোপান্ত পড়া হলে দেখা যাবে, শাফেয়ী মাযহাবের উভয় ঘরানা ‘ইরাকী তরীকা’ ও ‘খুরাসানী তরীকা’র অধিকাংশ ফকীহ এ মতই গ্রহণ করেছেন। আর উভয় ঘরানার শায়খ (প্রধান) আবু হামিদ আসফারাইনী রাহ ও কাফফাল মারওয়াযী রাহ.-এর অবস্থানও তাই।
‘আলমাজমূ’ তো ইমাম আবু ইসহাক শীরাজী (৩৯৩ হি.-৪৭৬ হি.) কৃত ‘আলমুহাযযাব’-এর ভাষ্যগ্রন্থ, ‘আলমুহাযযাব’-এর মতো ফিকহে শাফেয়ীর দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কিতাব ইমাম গাযালী রাহ.-এর ‘আলওজীয’। এর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ভাষ্যগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয় ইমাম আবদুল কারীম রাফেয়ী (৬২৩ হি.)-এর ‘ফাতহুল আযীয’, যা ‘আশশরহুল কাবীর’ নামে প্রসিদ্ধ।
শাফেয়ী মাযহাবে রাফেয়ী ও নববীকে ‘শায়খাইন’ উপাধিতে স্মরণ করা হয় এবং এঁদের সম্মিলিত মতামত (متفقه تصحيح وترجيح) কে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে পাঠক নববী রাহ.-এর আলোচনা পাঠ করেছেন। এবার রাফেয়ীর বক্তব্য দেখুন-
إذا رئي الهلال في بلدة ولم ير في أخرى نظر، إن تقاربت البلدتان فحمهما حكم البلدة الواحدة، وإن تباعدتا فوجهان : أظهرهما، وبه قال أبو حنيفة رحمه الله، وهو اختيار الشيخ أبي حامد أنه لا يجب الصوم على أهل البلدة الأخرى ...
والثاني : يجب، وهو اختيار القاضي أبي الطيب، ويروى عن أحمد ...
এক শহরে চাঁদ দেখা গেল, অন্য শহরে দেখা গেল না এ অবস্থায় দেখতে হবে : যদি শহর দুটি কাছাকাছি হয়, তাহলে দুটোকে এক শহরের মতো গণ্য করা হবে। (অর্থাৎ এক জায়গার চাঁদ দেখা অন্য জায়গার জন্যও অবশ্যঅনুসরণীয় হবে) আর যদি শহর দুটি পরস্পর দূরবর্তী হয় তাহলে এ ক্ষেত্রে দুটি ‘ওয়াজহ’ রয়েছে : অধিক জাহির (অর্থাৎ দলিলের বিচারে অধিক স্পষ্ট এবং গ্রহণকারীর সংখ্যার বিচারে অধিক প্রসিদ্ধ) ‘ওয়াজহ’ এই যে, দ্বিতীয় শহরের অধিবাসীদের রোযা রাখা জরুরি হবে না। আবু হানীফা রাহ. এ-ই বলেছেন এবং শায়খ আবু হামিদও তা গ্রহণ করেছেন।
‘দ্বিতীয় ওয়াজহ’ এই যে, রোযা রাখা জরুরি হবে। কাযী আবুত তাইয়েব তা গ্রহণ করেছেন আর আহমদ রাহ. থেকেও তা বর্ণিত।’’
(ফাতহুল আযীয শরহুল ওয়াজীয, আবদুল করীম রাফেয়ী, কিতাবুস সওম ৩/১৭৯-১৮০)
রাফেয়ী রাহ.-এর বৃত্তান্ত থেকে এ-ও বোঝা গেল, কাছাকাছি শহর-নগরের ক্ষেত্রে সব ইমাম একমত যে, এক জায়গার চাঁদ দেখা অন্য জায়গার জন্য অবশ্যঅনুসরণীয়। মতভেদ দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে।
তেমনি এ-ও জানা গেল যে, মতভেদের ক্ষেত্রে শাফেয়ী মাযহাবের ‘আযহার’ তথা বেশি যাহির ও অগ্রগণ্য মত, যা তা ইমাম রাফেয়ীর দৃষ্টিতে ইমাম আবু হানীফারও মত। তবে আমার জানা নেই, আবু হানীফার এ মত তিনি কোথায় পেয়েছেন। না কি তার উদ্দেশ্য এ কথা বলা যে, হানাফী মাযহাবেরও অগ্রগণ্য মত এটি। অর্থাৎ ‘আবু হানীফা’ বলে তিনি ‘হানাফী মাযহাব’ নির্দেশ করেছেন।
ফিকহে শাফেয়ীর বহু গ্রন্থ মাশাআল্লাহ মুদ্রিত। সেসব থেকে নকল করতে থাকলে লেখা অনেক দীর্ঘ হয়ে পড়বে। তাই এখানে ফিকহে শাফেয়ীর কিছু কিতাবের শুধু বরাত উল্লেখ করছি। আগ্রহী পাঠক সেগুলো খুলে দেখতে পারেন।
1. ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, ইমাম গাযালী শাফেয়ী (৪৫০-৫০৫ হি.)
ইমাম গাযালী রাহ.-এর এই কিতাব তো মাশাআল্লাহ আম-খাস, আলিম-বুদ্ধিজীবী সব মহলে সমান সমাদৃত। এতে (১/৩৩৮) সিয়ামের আলোচনায় প্রথম পরিচ্ছেদেই এ মাসআলা আছে। তিনি পরিষ্কার লিখেছেন-
إذا رؤي ببلدة ولم ير بأخرى وكان بينهما أقل من مرحلتين وجب الصوم على الكل، وإن كان أكثر كان لكل بلدة حكمها ولا يتعدى الوجوب.
2. আততাহযীব ফী ফিকহিল ইমামিশ শাফেয়ী, আবু মুহাম্মাদ হুসাইন ইবনে মাসউদ আলবাগাভী (৫১৬ হি.) (৩/১৪৭, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া বৈরুত, প্রথম প্রকাশ : ১৪১৮ হি., ১৯৯৭ ঈ.)
3. আলবায়ান ফী মাযহাবিল ইমামিশ শাফেয়ী (৩/৪৭৮, দারুল মিনহাজ, জিদ্দা), আবুল হুসাইন ইয়াহইয়া ইবনে আবিল খায়ের আলইমরানী আশশাফেয়ী (৪৮৯-৫৫৮)
4. রওযাতুত তালেবীন ওয়া উমদাতুল মুফতীন (২/৩৪৮), ইমাম নববী শাফেয়ী (৬৩১-৬৭৬ হি.)
5. তুহফাতুল মুহতাজ শরহুল মিনহাজ (৪/৫০৫, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত), ইবনে হাজার মক্কী হাইতামী শাফেয়ী (৯৭৪ হি.)
6. মুগনিল মুহতাজ শরহুল মিনহাজ (১/৫৬৯, দারুল ফিকর, বৈরুত), আলখতীবুশ শিরবীনী শাফেয়ী (৯৭৭ হি.)
7. নিহায়াতুল মুহতাজ ইলা শারহিল মিনহাজ (৩/২৩৫-২৩৬, আলমাকতাবাতুত তাওফীকিয়্যা, কায়রো), শামসুদ্দিন মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আররামলী শাফেয়ী (১০০৪ হি.)
মিনহাজ ফিকহে শাফেয়ীর নির্ভরযোগ্যতম ‘মতন’। এর অনেক ভাষ্যগ্রন্থ আছে, তন্মধ্যে ‘তুহফাতুল মুহতাজ’ ও ‘নিহায়াতুল মুহতাজ’ শাফেয়ী ফকীহগণের কাছে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত। মিনহাজের অন্য অনেক শরহের মতো এ দুটোতেও আলোচিত মাসআলায় শায়খাইন (রাফেয়ী ও নববী)-এরই সহমত পোষণ করা হয়েছে।
8. আলফাতাওয়াল ফিকহিয়্যাহ, ইবনে হাজার মক্কী হাইতামী ২/৬০
9. আহকামুল কুরআন (১/৭০) ইলকিয়া আততবারী (৪৫০-৫০৪ হি.)
10. বাহরুল মাযহাব, আবুল মাহাসিন আররুয়ানী (৪১৫-৫০২ হি.)
শেষোক্ত দুই কিতাবের আলোচনা এখানে তুলে দেওয়া মুনাসিব মনে হচ্ছে। ইমাম ইলকিয়া তবারী (শামসুল ইসলাম আবুল হাসান আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইলকিয়া আলহাররাছী) ‘‘আহকামুল কুরআনে’’ লেখেন-
وأجمع أصحاب أبي حنيفة على أنه إذا صام أهل بلد ثلاثين يوما للرؤية، وأهل بلد تسعة وعشرين يوما، أن على الذين صاموا تسعة وعشرين قضاء يوم.
وأصحاب الشافعي لا يرون ذلك، إذ كانت المطالع في البلدان يجوز أن تختلف.
অর্থ, আসহাবে আবু হানীফার (অর্থাৎ হানাফী মাযহাবের ধারক-বাহক ফকীহবৃন্দের) ইজমা আছে যে, যদি কোনো শহরের অধিবাসীরা চাঁদ দেখে ত্রিশ রোযা রাখে তাহলে যে শহরের অধিবাসীরা উনত্রিশ রোযা রেখেছে তাদেরকে একদিনের রোযা কাযা করতে হবে।
আর আসহাবে শাফেয়ী (অর্থাৎ শাফেয়ী মাযহাবের ধারক-বাহক ফকীহবৃন্দ) একে জরুরি মনে করেন না। কারণ দুই শহরের উদয়স্থলে পার্থক্য হতে পারে। (আহকামুল কুরআন, ইলকিয়া তবারী ১/৭০; আলজামি লিআহকামিল কুরআন, কুরতুবী ৩/১৫৭, আলবাকারা ২ : ১৮৫)
ইলকিয়া রাহ. আপন মাযহাব সম্পর্কে যা বলেছেন সে সম্পর্কে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তিনিই তাঁর মাযহাব সম্পর্কে ভালো জানেন। কিন্তু আসহাবে আবু হানীফার বিষয়ে তিনি যা লিখেছেন সে সম্পর্কে মনে রাখতে হবে, এ মাসআলা শুধু আবু ইউসুফ রাহ. ও মুহাম্মাদ রাহ. থেকে বর্ণিত এবং অধিকাংশ বড় বড় হানাফী ফকীহ এ বিধানকে শুধু কাছাকাছি শহর-নগরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মনে করেন, যা ইতিপূর্বে নির্ভরযোগ্য বরাত সহকারে লেখা হয়েছে। আমার ধারণা, এখানে ইলকিয়া রাহ.-এর বিভ্রান্তি হয়েছে আবু বকর রাযী রাহ.-এর বক্তব্য থেকে। এ কারণে তিনি ব্যতিক্রমহীনভাবে ‘আসহাবে আবু হানীফা’র সাথে একটি কথা সম্বন্ধ করে বলে দিয়েছেন যে, ঐ বিষয়ে সকলের ইজমা আছে।
মূল ঘটনা এই যে, জাসসাস রাহ. ‘‘আহকামুল কুরআনে’’ আল্লাহ তাআলার বাণী- فعدة من ايام اخر এর অধীনে দুটি মাসআলা উল্লেখ করেছেন : এক. যে ব্যক্তি অসুস্থতার কারণে রমযানে কোনো রোযা রাখতে পারেনি সে কয়দিনের রোযা কাযা করবে-উনত্রিশ না ত্রিশ।
দুই. কোনো শহরে ত্রিশ দিন রোযা রাখা হয়েছে তাহলে যারা উনত্রিশ রোযা রেখেছে তাদেরকে একদিনের রোযা কাযা করতে হবে কি না।
এই দুই মাসআলার বর্ণনা জাসসাস রাহ. এভাবে শুরু করেছেন-
ذكر بشر بن الوليد عن أبي يوسف، وهشام عن محمد، من غير خلاف من أحد من أصحابنا، قالوا ... .
অর্থাৎ, বিশর ইবনুল ওয়ালীদ আবু ইউসুফ রাহ. থেকে, এবং হিশাম মুহাম্মাদ রাহ. থেকে বর্ণনা করেন-আর এ বিষয়ে আমাদের ইমামদের থেকে বিপরীত কোনো সিদ্ধান্ত বর্ণিত হয়নি-তাঁরা বলেন, ...।
এভাবে কথা শুরু করে জাসসাস মাসআলা দুটি বলেছেন যে, অসুস্থ ব্যক্তি যে শহরের অধিবাসী ঐ শহরের অধিবাসীরা যদি ২৯ রোযা রেখে থাকে তাহলে তাকেও উনত্রিশ রোযা কাযা করতে হবে। আর কোনো শহরে যদি চাঁদ দেখার ভিত্তিতে ত্রিশ রোযা রাখা হয় এবং উনত্রিশওয়ালারা তা জানতে পারেন তাহলে তাদের একদিনের রোযা কাযা করা জরুরি। (আহকামুল কুরআন, জাসসাস ১/২২০)
জাসসাসের বক্তব্যের অর্থ, এ মাসআলা আবু ইউসুফ রাহ. ও মুহাম্মাদ রাহ. থেকে (নাদির রেওয়ায়েতে বিশর ও হিশামের সূত্রে) বর্ণিত হয়েছে। আর আমাদের অন্য কোনো ইমাম থেকে এ মাসআলা বর্ণিত না হলেও বিপরীত সিদ্ধান্ত তাদের থেকে বর্ণিত হয়নি। এ হচ্ছে তাঁর বক্তব্য। কিন্তু চিন্তা না করলে এ বক্তব্য পড়ামাত্র কারো মনে হতে পারে এর অর্থ, ‘‘আমাদের সকল ফকীহ এমনটা বলেছেন, কেউ এ বিষয়ে দ্বিমত করেননি।’’ সম্ভবত ইলকিয়া রাহ.-এর এ বিভ্রান্তিই হয়েছে এবং এরই ভিত্তিতে তিনি এ কথাটিকে সকল হানাফী ফকীহর ইজমাকৃত মাসআলা বানিয়ে দিয়েছেন!!
অথচ জাসসাস রাহ.-এর উদ্দেশ্য কখনো এই নয় যে, এটি ফিকহে হানাফীর ইজমায়ী মাসআলা। এখানে ইলকিয়া রাহ.-এর এক ‘তাসামুহ’ তো এই যে, ইজমায়ী নয় এমন মাসআলাকে ইজমায়ী বানিয়ে দিয়েছেন। আর দ্বিতীয় তাসামুহ এই যে, এ মাসআলা কি সকলস্থানের জন্য প্রযোজ্য, না শুধু কাছাকাছি শহর-নগরের ক্ষেত্রে-এ দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেননি। অথচ বড় বড় অনেক হানাফী ফকীহ একে শুধু কাছাকাছি শহর-নগরের বিধান মনে করেন।
যাহোক, বিষয়টি প্রসঙ্গক্রমে এসেছিল। আলোচনা হচ্ছিল শাফেয়ী মাযহাব সম্পর্কে, তো এ বিষয়ে ফিকহে শাফেয়ীর অন্যান্য উদ্ধৃতির মতো ইলকিয়া রাহ.-এর উপরোক্ত উদ্ধৃতিরও মূলকথা হচ্ছে, শাফেয়ী মাযহাবে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য।
এবার শুনুন আবুল মাহাসিন রুয়ানী রাহ.-এর ‘বাহরুল মাযহাব’-এর বরাত। ফিকহে শাফেয়ীতে আবুল মাহাসিন রুয়ানীর মাকাম ও অবস্থান কী তা এ ঘটনা থেকেও অনুমান করা যায় যে, একবার তিনি আল্লাহর নেয়ামতের বর্ণনা হিসেবে বলেছেন-
لو احترقت كتب الشافعي لأ مليتها من حفظي
অর্থাৎ আল্লাহ না করুন, যদি শাফেয়ীর গ্রন্থাবলী পুড়ে ছাই হয়ে যায় তাহলে আমি তা নিজ স্মৃতি থেকে লিখিয়ে দিতে পারব। (তবাকাতুশ শাফিয়িয়্যাহ, তাজুদ্দীন সুবকী ৭/১৯৪)
তাঁর জন্ম ৪১৫ হিজরীতে। আর মৃত্যু ৫০২ হিজরীতে। আশুরার দিন জুমার আগে যখন তিনি ইমলার মজলিস থেকে ফারিগ হন ঐ সময় বাতেনী মালাউনেরা তাকে শহীদ করে দেয়। (রাহিমাহুল্লাহ ওয়া রাযিয়া আনহু)
তিনি ফিকহে শাফেয়ীর উপর অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। জীবনের শেষের দিকে লিখেছেন ‘বাহরুল মাযহাব গ্রন্থটি। এর ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘মাযহাব’ ও ‘খিলাফিয়্যাত’ বিষয়ে ছোট-বড় অনেক গ্রন্থ রচনা করেছি। পরে ইমামগণের আরো অনেক ফাওয়াইদ (মাসাইল ও দালাইল) সংগৃহীত হয়েছে। তো ইচ্ছে হল, জীবনের শেষদিকে এক কিতাবে আমার কথাগুলো একত্র করে দেই -
(أحببت أن أجمع كلامي في آخر عمري في كتاب واحد)
যাতে আমার জন্য জানা সহজ হয় যে, ঐ কিতাবগুলোতে কী আছে। আর এ গ্রন্থে আমি ‘আসাহ’ (أصح)-এর উপর নির্ভর করব। (অর্থাৎ অধিকতর বিশুদ্ধ ‘কওল’ ও ‘ওয়াজহে’র উপর এ কিতাবের বুনিয়াদ হবে) আর এর নাম রাখছি ‘বাহরুল মাযহাব।’ (বাহরুল মাযহাব, রুয়ানী, ভূমিকা)
তাঁর এ প্রিয়তম গ্রন্থে তিনি লেখেন, (অর্থ) এক শহরের অধিবাসীগণ চাঁদ দেখল অন্য শহরের অধিবাসীরা দেখল না-যদি দুই শহরের মাঝে দূরত্ব এত কম হয় যে, উদয়স্থল আলাদা হয় না, যেমন বাগদাদ ও বসরা, তাহলে অন্য শহরের অধিবাসীদের উপরও ঐ শহরের চাঁদ দেখার কারণে রোযা ফরয হবে।
আর যদি দুই শহর দূর-দূরান্তের হয় যেমন ইরাক ও হিজায বা শাম ও খোরাসান, তাহলে আবু হামেদ (আসফারাইনী, ইরাকী তরীকার শায়খ) বলেন, এক্ষেত্রে এক শহরের অধিবাসীদের অন্য শহরের অধিবাসীদের চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করা জরুরি নয়। কাযী আবু হামেদ (আলমারওয়াররূযী, মৃত্যু : ৩৬২ হি.)ও এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন ...।
এরপর রুয়ানী এর দলীল উল্লেখ করেছেন। অতপর কাযী আবুত তাইয়েব তবারীর সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেছেন যে, এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য সর্বাবস্থায় অবশ্যঅনুসরণীয়। এরপর রুয়ানী লেখেন- والأول أظهر عندي অর্থাৎ প্রথম সিদ্ধান্তই আমার কাছে অধিক ‘জাহির’ (স্পষ্ট ও প্রসিদ্ধ)। (বাহরুল মাযহাব, আবুল মাহাসিন রুয়ানী ৪/২৭১, দারু ইহইয়াইত তুরাছিল আরাবী, বৈরুত)
আবুল মাহাসিন রুয়ানীর শেষজীবনের এ কিতাবের বর্ণনার আলোকে ‘তরহুত তাছরীব’ অলিউদ্দীন ইরাকীর* মুদ্রিত নুসখায় (৪/১১২) রুয়ানীর বরাতে যে বিবরণ আছে তা সংশোধন করে নেওয়া উচিত।
[টীকা : * আহকামের হাদীসের উপর যায়নুদ্দীন ইরাকীর অতি উত্তম কিতাব ‘তাকরীবুল আসানীদ ওয়া তারতীবুল মাসানীদ’। এরই শরহ-ভাষ্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘তরহুত তাছরীব’। এর রচনা তিনি নিজেই শুরু করেছিলেন কিন্তু সমাপ্ত করেছেন তাঁর পুত্র অলিউদ্দীন ইরাকী। কিতাবুস সিয়ামের এ পরিচ্ছেদগুলো অলিউদ্দীন ইরাকীকৃত তাকমিলারই অংশ।]
তাতে এ স্পষ্ট বৃত্তান্তের পর যে, শাফেয়ী মাযহাবের কতিপয় মনীষী উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য মনে করেন না এবং এ বৃত্তান্তেরও পর যে, শায়খ আবু হামেদ (আসফারাইনী), আবু ইসহাক শীরাজী, গাযালী, শাশী (আবু বকর ফখরুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ ৪২৯ হি-৫০৭ হি., হিলয়াতুল উলামার লেখক) ও অধিকাংশের নিকট ‘আসাহ’ অধিকতর সহীহ এই যে, দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক জায়গার চাঁদ দেখার কারণে অন্য জায়গায় রোযা জরুরি হবে না-এই দুই স্পষ্ট বিবরণের পর তরহুত তাছরীবের মুদ্রিত নুসখায় লেখা আছে-
والثاني : الوجوب، وإليه ذهب القاضي أبو الطيب، والروياني، وقال : إنه ظاهر المذهب، واختاره جميع أصحابنا.
অর্থাৎ দ্বিতীয় ‘ওয়াজহ’ এই যে, (দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক জায়গার চাঁদ দেখার কারণে অন্য জায়গায়) রোযা ওয়াজিব হবে। কাযী আবুত তাইয়েব এদিকেই গিয়েছেন, রুয়ানীও। তিনি বলেছেন, এটি ‘জাহিরুল মাযহাব।’ এবং একে আমাদের সকল আসহাব (সকল শাফেয়ী ফকীহ) গ্রহণ করেছেন।-তরহুত তাছরীব ৪/১১২, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত ১৪২১ হিজরী)
আহমদ গুমারী এ বরাতের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে চিন্তা না করে এবং আগে-পরের স্পষ্ট কথাগুলোর দিকে লক্ষ্য না করে তার কিতাব ‘‘তাওজীহুল আনযার’’-এ তা নকল করে দিয়েছেন!!
চিন্তা করার বিষয় এই যে, যখন অধিকাংশ শাফেয়ী ফকীহ প্রথম
সিদ্ধান্তকে ‘আসাহ’ (অধিক বিশুদ্ধ/অগ্রগণ্য) বলছেন তখন দ্বিতীয় ওয়াজহের বিষয়ে واختاره جميع أصحابنا (আমাদের সকল ফকীহ তা গ্রহণ করেছেন) বলার কী অর্থ? এবং যখন ফিকহে শাফেয়ীর কিতাবসমূহে এ মাসআলায় শুধু শাফেয়ী ফকীহগণের মাসলাকই উল্লেখ করা হচ্ছে, সরাসরি ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর কোনো উক্তি/বক্তব্য কেউ উল্লেখই করছেন না, স্বয়ং রুয়ানীও উল্লেখ করেননি তাহলে একে ‘জাহিরুল মাযহাব’ বলা যায় কীভাবে?
পাঠক ইতিমধ্যে তার শেষ জীবনের কিতাব ‘বাহরুল মাযহাবের’ আলোচনা পাঠ করেছেন। ওখানে তিনি পরিষ্কার বলছেন-
والأول أظهر عندي
অর্থাৎ দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য অবশ্যঅনুসরণীয় না হওয়ার সিদ্ধান্তই আমার কাছে অধিক ‘জাহির’ (স্পষ্ট ও প্রসিদ্ধ)।
রুয়ানীর রচনাবলির মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত কিতাব ‘হিলয়াতুল মুমিন’। জামেয়া উম্মুল কুরার একজন তালিবে ইলম এর এক অংশের তাহকীক (পান্ডুলিপি-সম্পাদনা) করেছেন। তাঁর সামনে এ কিতাবের দুটো হস্তলিখিত পান্ডুলিপি ছিল। দুটোতেই অনেক জায়াগায় কিছু কিছু বাক্য অস্পষ্ট।
‘হিলয়াতুল মুমিন’ সম্পর্কে ইবনুস সালাহ রাহ. (৬৪৩ হি.) বলেছেন, এ কিতাবে তিনি শাফেয়ী মাযহাবের বাইরের অনেক সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছেন (তাহযীবুল আসমা, নববী ১/৭৮৩)। এবং কাযী আবু শুহবা (৭৭৯-৮৫১ হি.) ‘তবাকাতুশ শাফেয়িয়্যাহ’য় বলেছেন, এতে মাযহাবের বাইরে তাঁর নিজের অনেক ‘‘ইখতিয়ারাত’’ বা ব্যক্তিগত মত আছে, যার অনেক কিছুই মালেক রাহ.-এর মাযহাবের মুয়াফিক। (শাযারাতুয যাহাব, ইবনুল ইমাদ ৪/৪, ৫০২ হি.)
হিলয়াতুল মুমিনের যে অংশ ঐ তালিবে ইলম তাহকীক করেছেন তাতে লেখা আছে-
ولو أن أهل بلد رأوا الهلال يلزم على جميع أهل البلاد الصوم في ذلك اليوم في ظاهر المذهب وهو اختيار جماعة من أصحابنا، وبه قال أحمد، ... وهو اختيار القاضي الطبري.
অর্থ, যদি কোনো শহরবাসী চাঁদ দেখে তাহলে অন্য সকল শহরের অধিবাসীদের উপর ঐ দিন রোযা রাখা জরুরি হবে, জাহের মাযহাব অনুযায়ী।
এটিই আমাদের আসহাবের (ফকীহদের) এক জামাতের গৃহীত সিদ্ধান্ত। আর আহমদ রাহ. এমনটি বলেছেন ... এবং কাযী তবারীর গৃহীত মাসলাকও তা। (হিলয়াতুল মুমিন, আবুল মাহাসিন রুয়ানী, তাহকীক, তালিবে ইলম মুহাম্মাদ ইবনে মাতার ইবনে আলী আলমালেকী, জামেয়া উম্মুল কুরা ১৪২৮ হি.)
‘‘হিলয়াতুল মুমিনে’র এ উদ্ধৃতি ‘তরহুত তাছরীবে’র সূত্র হতে পারে। তবে اختيار جماعة من أصحابنا (আমাদের ফকীহগণের মধ্যে এক জামাতের গৃহীত মাসলাক) বিকৃত হয়ে اختاره جميع أصحابنا (আমাদের সকল আসহাব তথা ফকীহগণের গৃহীত মাসলাক)-এ পরিণত হয়েছে।
এখন থাকল একে ‘জাহিরুল মাযহাব’ বলা, যদি ‘জাহিরুল মাযহাব’ শব্দবন্ধের বিষয়ে রুয়ানীর বা শাফেয়ী লেখকগণের নিজস্ব কোনো পরিভাষা* না থাকে তাহলে প্রবল সম্ভাবনা এই যে, ওখানে বাক্যের কিছু অংশ বাদ পড়ে গেছে। প্রাচীন ও স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লিখিত পান্ডুলিপি খুঁজলে প্রকৃত বিষয়টি বোঝা যাবে। আমার ধারণা, এখানে বাক্যটি এরকম হয়ে থাকবে-
في ظاهر مذهب مالك، وهو اختيار جماعة من أصحابنا
অর্থাৎ (উপরোক্ত সিদ্ধান্ত) মালেক রাহ.-এর মাযহাবের জাহির অনুযায়ী। আর তা আমাদের এক জামাত আসহাবের (ফকীহের) গৃহীত মাসলাক।
ফিকহের কিতাবের সাথে অন্তরঙ্গতা রাখা তালিবে ইলমগণ চিন্তা করলে দেখবেন في ظاهر المذهب (ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর মাযহাবের জাহের রেওয়ায়েত) বলার পর (وهو اختيار جماعة من أصحابنا) বাক্যটি অসংলগ্ন মনে হয়। এ বাক্য তখনই সংলগ্ন হতে পারে যখন ইতিপূর্বে অন্য কোনো ইমাম বা ফকীহের মাযহাব বর্ণনা করা হবে। অন্যথায় যে মাসলাক ইমাম শাফেয়ীর জাহির রেওয়ায়েত তা তো ঐ মাযহাবের একদল ফকীহর নয়, অধিকাংশ ফকীহর মাসলাক হবে। আর তা হবে ‘ইত্তিবা’র (অনুসরণের) ভিত্তিতে, ‘ইখতিয়ারে’র (পছন্দ ও গ্রহণের) ভিত্তিতে নয়। এটাই সাধারণ নিয়মের কথা।
যাহোক, এ বিষয়ে চূড়ান্ত ও নিশ্চিত কথা তো ‘হিলয়াতুল মুমিনে’র প্রাচীন পান্ডুলিপিসমূহ এবং এর লেখকের পরিভাষাসমূহের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের পর এবং এ যুগের গবেষক শাফেয়ী আলিমগণের শরণাপন্ন হওয়ার পরই বলা যেতে পারে। আফসোস, এ মুহূর্তে আমার পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে আল্লাহ তাআলা হয়তো এর সুযোগ করে দিবেন। আমীন।
কিন্তু যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, ‘হিলয়াতুল মুমিনে’ রুয়ানীর এ বাক্য এভাবেই আছে এবং এর সাধারণ অর্থই উদ্দেশ্য তাহলে বলাই বাহুল্য যে, এটি একটি অবাস্তব কথা, যা তাঁর শেষ জীবনে লেখা ‘‘বাহরুল মাযহাবে’’র বিবরণেরও পরিপন্থী। এতে তিনি দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অবশ্যঅনুসরণীয় না হওয়াকেই ‘আযহার’ বলেছেন। আর তাঁর আগের-পরের অধিকাংশ শাফেয়ী ফকীহর বক্তব্যও তা-ই। وبالله التوفيق
* টীকা :
যেমন এ পরিভাষা হতে পারে যে, মাযহাবের কোনো ফকীহর (আসহাবুত তারজীহ স্তরের) দৃষ্টিতে যে সিদ্ধান্ত বিশুদ্ধ বা অগ্রগণ্য মনে হবে তিনি তাকে المذهب বা ظاهر المذهب শব্দে ব্যক্ত করেন। যদিও তা ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর কোনো ‘মানসূস আলাইহি’ স্পষ্ট বক্তব্য না হয়; বরং তাঁর মাযহাবের কোনো ফকীহর ইস্তিমবাত হয়।
কিংবা এ পরিভাষাও হতে পারে যে, মাযহাবের কোনো ফকীহ (মুজতাহিদ ফিল মাসাইল স্তরের, বা শাফেয়ীগণের পরিভাষা অনুযায়ী ‘আসহাবুল উজূহ’ স্তরের) যে সিদ্ধান্ত ইমাম শাফেয়ী রাহ. থেকে বর্ণিত কোনো মাসআলার ভিত্তিতে ইসতিখরাজ করেছেন এবং তা তাঁর দৃষ্টিতে শাফেয়ী মাযহাবের সিদ্ধান্ত হওয়ার দাবি রাখে, একে তিনি ‘জাহিরুল মাযহাব’ বলবেন।
কোনো লেখকের গ্রন্থে এ ধরনের কোনো পরিভাষার অনুসরণ বিচিত্র নয়। তবে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া নিশ্চিতভাবে কিছু বলা গবেষণার নীতির পরিপন্থী এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে না-জায়েয।
মালেকী মাযহাব
ইবনুল কাসিম রাহ. ও ইবনে ওয়াহব রাহ. ইমাম মালেক রাহ. থেকে বর্ণনা করেন-
إن أهل البصرة إذا رأوا هلال رمضان، ثم بلغ ذلك إلى أهل الكوفة والمدينة واليمن أنه يلزمهم الصيام أو القضاء إن فات الأداء.
অর্থ, বসরার লোকেরা রমযানের চাঁদ দেখল, এরপর এর সংবাদ কুফা, মদীনা ও ইয়ামানবাসীদের নিকট পৌঁছল