মুহাররম ১৪৩৫   ||   নভেম্বর ২০১৩

প্র বা স : উল্টোকথার উল্টোফল

খসরূ খান

ঘটনা দুটির উপর প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ঘটে গেছে আপনা থেকেই। যদি কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থাকতো তাহলে ঘটনা দুটির খবর এভাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে চলে আসতো না। অন্য অনেক ঘটনার মতো এ ঘটনা দুটিকেও ছাই দিয়ে ঢেকে ফেলা হতো। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। তাই সবাই  কিছু না কিছু জানতে পেরেছে। দুটি ঘটনাই ঘটেছে গত সেপ্টেম্বরে। প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফরকালে। দুটি ঘটনাই গণমাধ্যমে এসেছে দুদিনের ব্যবধানে।

এর একটি হচ্ছে জাতিসংঘে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের মুদ্রিত কপি নিয়ে। জানা গেছে অতিথিদের হাতে বিতরণের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের আগে নিউইয়র্কের রাস্তার পাশে সে ভাষণের মুদ্রিত বান্ডিল রেখে দেওয়া হয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য সেখানে আমাদের দেশীয় কোনো কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না। ফলে বেওয়ারিশ বান্ডিল ও প্যাকেট রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে মার্কিন পুলিশ ও গোয়েন্দারা তৎপর হয়ে ওঠে। তারা প্যাকেটগুলোতে বোমা বা বিষ্ফোরক কিছু রয়েছে সন্দেহ করে রাস্তাঘাট আটকে দেয়। আশেপাশে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও তল্লাশি শুরু হয়। এ ধরণের বোমা-আতংকের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়। তখন আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু বিড়ম্বনা ও বিব্রতকর অধ্যায়ের সূচনা দিয়েই জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুরু হয়।

ঘটনাটির প্রচারে ঢাকার গণমাধ্যম কিছুটা কৃপণতা করেছে বটে। তবে এ সত্য লুকানো যায়নি যে, জাতিসংঘ ভবনের সামনে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের কপিগুলো বোমাবাহী বা বিস্ফোরকবাহী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রশাসনের লোকজনের মাঝে কোনো ষড়যন্ত্রকারী ছিল কিনা তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে নিজ দেশে রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক বিরোধীদের প্রতি সব সময় বোমা-সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের অভিযোগ উঁচু স্বরে বার বার তোলার পর প্রধানমন্ত্রীর নিজের ভাষণের প্যাকেটেই বিষ্ফোরকের সন্দেহজনক অস্তিত্ব নিয়ে বিদেশিদের দৌড়-ঝাঁপে আমরা বিব্রত না হয়ে পারিনি। যে প্রধানমন্ত্রী প্রায় সব সময় বিরোধী মহলকে বোমাবাজির সাথে জড়িত করে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন আমেরিকার মাটিতে তারই ভাষণের কপিতে বোমার অস্তিত্বের সন্দেহে আমাদের যে কী লজ্জা লেগেছে তা-ভাষায় ব্যাক্ত করাও কঠিন। তবে প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার কোনো প্রতিনিধি এ ঘটনার ব্যাপারে মুখ খুলেছেন বলে শোনা যায়নি। সম্ভবত তারাও কিছুটা লজ্জা পেয়েছেন।

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার একদিন কি দুদিন আগে। প্রধানমন্ত্রীর হোটেলকক্ষে। সেখানে বাংলাদেশের একজন আলোচিত নারী সাংবাদিককে কিছুটা নাজেহালই করা হয়েছে। সব গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশ না হলেও দু-একটি সাহসী সংবাদপত্রের সুবাদে যতটুকু জানা গেছে তাতে এটা মোটামুটি পরিষ্কার যে, সরকারী দল পন্থী সেই সংখ্যালঘু নারী সাংবাদিকের কাছ থেকে জোর করে তার রেকর্ড ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা বা সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর তাকে বিশেষ নিরাপত্তারক্ষীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর ওইসব বক্তব্যই অফ দ্য রেকর্ড (ধারণ বা প্রকাশযোগ্য নয়)। সুতরাং সেগুলো প্রকাশ করা যাবে না। ওই নারী সাংবাদিক এতে সম্মত না হলে জোর করেই তার রেকর্ডার ও ক্যামেরা জব্দ করে নেওয়া হয় এবং পরে সেসব বক্তব্য মুছে দেওয়া হয়। এ নিয়ে সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে কিছুটা বিড়ম্বনা ও উত্তেজনার পরিবেশও তৈরি হয়। কিন্তু ওই সাংবাদিক মুখ খুলতে রাজি হয়নি। অবশ্য একজন নারী সাংবাদিককে তার পেশাগত কাজে বাধা দেওয়ার চূড়ান্ত ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীর হোটেলকক্ষে ঘটানো হলেও এ দেশের প্রগতিশীল সাংবাদিক সমাজ কোথাও কোনো প্রতিবাদ জানিয়েছেন বলে শোনা যায়নি।

আলেম সমাজকে নারীবিদ্বেষী হিসেবে চিত্রিত করা এ দেশের গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক ক্রেজ। প্রধানমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রীসহ সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক সমাজ একজন শীর্ষ আলেমকে ব্যঙ্গ করে দিবানিশি অহর্নিশি তেঁতুল হুজুর আখ্যা দিয়ে হারজিতের অশোভন খেলায় লিপ্ত আছেন। কিন্তু নিজেদের হাতে নারীদের নাজেহাল করা নিয়ে তারা চুপ মেরেই থাকছেন। হেফাজতের সমাবেশে নারী সবাদকর্মীর বিব্রত হওয়ার নাটক নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করলেও এ ঘটনাটি নিয়ে সাংবাদিক নেতারা কোনো শব্দই করেন নি। বছর খানেক আগে স্কুলে ছাত্রভর্তিকে কেন্দ্র করে মিরপুরের এক সরকার দলীয় সংসদ সদস্যের চাঁদাবাজির খবর সংগ্রহ করতে গেলে আরেক নারী সাংবাদিকের হাত ভেঙ্গে দিয়েছিলেন ওই সংসদ সদস্য নিজেই। তখনও কোনো প্রতিবাদ করে নি মতলবী নারীবাদী নেত্রী ও সংবাদকর্মীরা। এবারও তাই হলো। বিদেশের মাটিতেও উল্টোকথার উল্টোফল দেখানো হলো।  কিন্তু তারা মুখে কুলুপ এঁটেই রাখলো। মূলত আলেমদের তেঁতুল হুজুর আখ্যা দিয়ে নারীবিদ্বেষী হিসেবে হাজির করতে চাইলেও বেশিরভাগ সুস্থ মানুষ জানেন, নারীর প্রকৃত শত্রু ও ঘাতক এ সমাজে কারা। তারা এসব প্রতারণাপূর্ণ প্রয়াসে কিছুতেই বিভ্রান্ত হন না কিন্তু বিভিন্ন ঘটনায় ছদ্মবেশ খুলে যাওয়ার পরও নারীর বক-দরদীদের মুখে তেঁতুলহুজুরের উন্মাদ ও নির্লজ্জ জিগির শুনতে পেয়ে তারা বড়ই লজ্জিত বোধ করেন। 

 

 

advertisement