জুমাদাল উলা ১৪৩৯ || ফেব্রুয়ারি ২০১৮

গোলাম রাব্বানী - মতিহার, রাজশাহী

প্রশ্ন

মুহতারাম, আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। আশা করি ভাল আছেন। আমার জানার বিষয় হল, মাযী মুতলাকের সীগা এবং মাযী কারীবের সীগা-এর তরজমা বিভিন্ন আলেম বিভিন্নভাবে করে থাকেন। তো সঠিক তরজমা কী হবে- দলীল-প্রমাণসহ বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর

আপনার এ প্রশ্নটি সম্ভবত দুই-তিন বছর আগে এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু এর জবাব লিখতে বিলম্ব করা হয়েছে। কারণ প্রশ্নটির সার্বিক দিক নিয়ে চিন্তাভাবনা ও পর্যালোচনার প্রয়োজন ছিল। এমনিভাবে বাংলাভাষা ও অনুবাদ সম্পর্কে ভালো জানাশোনা রয়েছে এমন আহলে ইলমের সঙ্গে এ বিষয়ে মশওয়ারা করারও প্রয়োজন ছিল।

মাযী মুতলাক ও মাযী করীবের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু মৌলিক বিষয় আলকাউসারের গত রবিউল আউয়াল ১৪৩৯ হি./ডিসেম্বর ২০১৭ সংখ্যায় শিক্ষার্থীদের পাতার শিক্ষাপরামর্শে আলোচনা করা হয়েছে। এখন কেবল অনুবাদ সংক্রান্ত কিছু কথা আরয করছি।

আমার জানামতে সাধারণভাবে এ কথাই প্রচলিত যে, فعل ‘ফেয়েলে মাযী মুতলাকের’ সীগার বাংলা অনুবাদ হল,  ‘সে করল’ বা ‘তিনি করলেন’। আর قد فعل ‘মাযী কারীবের’ সীগার অনুবাদ হল, ‘সে করেছে’ বা ‘তিনি করেছেন’। কিন্তু বাংলা ব্যাকরণ এবং ভাষার বাস্তব প্রয়োগ থেকে বোঝা যায় যে, ‘করল, করেছে এবং হল, হয়েছে’-উভয় ক্রিয়ারূপ দ্বারাই মাযী মুতলাক এবং মাযী করীব উভয়ের অনুবাদ করা যেতে পারে। তবে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সবটা সব জায়গায় খাটে না। উভয়ের মধ্যে কাঠামোগত ও ব্যবহারগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। কারণ, যেকোনো সীগা ও ক্রিয়ারূপের দু’ধরনের অর্থ হয়। এক. শব্দের সরফী বা কাঠামোগত অর্থ। দুই. শব্দটি বাক্যে প্রযুক্ত হওয়ার পর তার নাহবী এবং বালাগাতী অর্থ ও মর্ম, যা বাক্যের পূর্বাপর এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে বোঝা যায়। তো মাযী মুতলাকের সীগা মূলগতভাবে ক্রিয়ার কাজটি শুধু সম্পন্ন হয়েছে বোঝায়, তার বেশি কিছু নয়। কাজ কতটা আগে শেষ হয়েছে? এক্ষুণি। নিকট অতীতে নাকি দূর অতীতে তা মূল অর্থের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে কখনো কখনো বাক্যের পূর্বাপর অবস্থা থেকে এমন কিছু আলামত ও অনুষঙ্গ পাওয়া যায়, যা বাক্যস্থ ক্রিয়াটি নির্দিষ্টভাবে নিকট অতীতে বা দূর অতীতে সম্পন্ন হওয়া প্রমাণ বহন করে। এমনকি বালাগাতী মাকসাদে মাযীর সীগা বর্তমান বা ভবিষ্যত ক্রিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়।

এমনিভাবে বাংলাভাষার ক্রিয়াপদ সম্পর্কে একটি মৌলিক কথা মনে রাখতে হবে- বাংলায় ক্রিয়াপদের কাল রূপ-নির্ভর, অর্থ-নির্ভর নয়। “কারণ ক্রিয়ার কাল একটা ব্যাকরণিক ধারণা। তা সাধারণ সময়ের ধারণার সাথে সংগতিপূর্ণ হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। ব্যাকরণে কালের চিহ্ন আর অর্থ প্রায়ই পৃথক হয়। যেমন আমরা যখন বলি, ‘সে আগামীকাল কানাডা যাচ্ছে, আর ফিরছে না।’ তখন আমরা ভবিষ্যত কালের কথা বলি। কিন্তু ‘যাচ্ছে’ ক্রিয়াপদ থেকে বোঝা যায় যে, আমরা ক্রিয়ার বর্তমান কালের রূপ ব্যবহার করেছি। এমনিভাবে ‘তিনি গতকাল হাটে যাননি’। এখানে বাক্যটি গতকাল সম্পাদিত ক্রিয়ার কথা বলছে। সুতরাং এটি অতীত কালের উদাহরণ হওয়া উচিত। কিন্তু বাক্যের ক্রিয়াপদ ‘যাননি’ বর্তমান কালের রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। (যেমন, ‘আপনি আজ হাটে যাননি’)। তাই, এখানে ক্রিয়াপদের কাল বর্তমান হিসেবে ধরা হয়। এধরনের আরো বহু উদাহরণ রয়েছে। এ ধরনের উদাহরণকে ব্যাকরণে কালের বিশিষ্ট প্রয়োগ হিসেবে গণ্য করা হয়”। -‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ’ অবলম্বনে, দ্রষ্টব্য : পৃ. ২৩৩-২৩৫

ঘটে যাওয়া ঘটনা বা অতীত ঘটনা বোঝাতে বাংলা ভাষায় সাধারণত যেসব ক্রিয়ারূপ ব্যবহৃত হয় সেগুলোর মূল কাঠামোগত অর্থ এবং বাক্যে সেগুলোর বিশিষ্ট প্রয়োগ ও আলংকারিক ব্যবহার সম্পর্কে কিছু উদ্ধৃতি ব্যাকরণের নির্ভরযোগ্য বইপত্র থেকে এখানে পেশ করছি।

 

সাধারণ অতীত কাল

ভাষাবিদ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাধারণ অতীত কালের ক্রিয়াপদের পরিচয় এভাবে দিয়েছেন- ‘আমি ফল খাইলাম’। এখানে খাওয়া কাজটি  সাধারণভাবে অতীত বা শেষ হইয়াছে। এইজন্য খাইলাম ক্রিয়ার কাল সাধারণ অতীত।

যে ক্রিয়া সাধারণভাবে অতীত সময়ে হইয়াছে, তাহার কালকে সাধারণ অতীত কাল বলে। -বাঙ্গালা ব্যাকরণ, পৃ. ৮৪

একসময়ের বাংলা একাডেমীর পরিচালক ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক সাহেব লিখেছেন- “বর্তমান কালের পূর্বে যে ক্রিয়া সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে, তাহার সময়ই সাধারণ অতীতকাল বুঝায়; যথা-‘আমি নিদ্রিত হইলাম’। ‘সে সেদিন একাকীই কাঁদিল’।” -মুহাম্মদ এনামুল হক রচনাবলী (ব্যাকরণ মঞ্জরী) ২/৪৩০

প্রখ্যাত বাংলা ভাষাবিদ ও ব্যাকরণবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আরো বিশদভাবে সাধারণ অতীতের পরিচয় তুলে ধরেছেন- “সাধারণ বা নিত্য অতীত-যে

ঘটনা কোনো অনির্দিষ্ট অতীত কালে হইয়াছে তাহার জন্য এই ‘ইল’ প্রত্যয়-যুক্ত সাধারণ অতীত প্রযুক্ত হয়। এই অতীতের একটা পুরাতন নাম ‘অদ্যতনী’। উদাহরণ, যথা-...‘আলেক্সান্দর পারস্য-সম্রাট দারয়হুঘ্কে যুদ্ধে পরাজিত করিলেন।’ কোনও ঘটনার সাঙ্গ বা সম্পূর্ণ হইয়া যাওয়ার কথা এই অতীত প্রকাশ করে বলিয়া ইংরেজীর Historical past -এর অনুকরণে, বাঙ্গালাতে ইহাকে ‘ঐতিহাসিক অতীত’-ও বলা হয়। কখনও-কখনও নিত্য-অতীত ক্রিয়া ‘এইমাত্র ঘটিল’ এই ভাব প্রকাশ করে। -ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ, পৃ. ৩২১

সাধারণ অতীতের বিশিষ্ট প্রয়োগ

(ক) একটু আগেই কাজ শেষ হয়েছে এমন ভাব প্রকাশের জন্য। যেমন সে এইমাত্র চলে গেল। শুনলাম, পরীক্ষা পিছিয়ে যাবে। -মুহাম্মাদ এনামুল হক রচনাবলী (ব্যাকরণ মঞ্জরী) ২/৪৩০

(খ) বর্তমান নির্দেশ : ওকে তোমার কাছে রেখে গেলাম (যাচ্ছি)।

(গ) আসন্ন ভবিষ্যত সময় বোঝাতে : কাপড়গুলো ঘরে তোল, বৃষ্টি এল বলে। -বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ, পৃ. ২৩৭

বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ গ্রন্থে ক্রিয়ার সাধারণ অতীত রূপের মূল কাঠামোগত অর্থ এবং বাক্যে প্রযুক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিবেশ অনুযায়ী অর্থের যেসব সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে বলা হয়েছে- “সাধারণ অতীত- ঘটে যাওয়া ঘটনা বা অতীত ঘটনা যেমন বোঝায়, তেমনই আবার কোনো কোনো ক্রিয়ার ক্ষেত্রে সদ্য অতীত বোঝায়-‘এই এলাম’। অনুমতির ক্ষেত্রে কখনও কখনও আশু ভবিষ্যৎও বোঝায়-‘এলাম তাহলে!’, ‘চলি তাহলে!’, ‘চললাম তাহলে’ প্রায় সমার্থক। কোনো কোনো প্রতিবেশে অব্যবহিত ভবিষ্যতও বোঝায়-ধর ধর! গেল গেল!’

সাধারণ অতীত আখ্যান বর্ণনায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত কালরূপ।” - প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (১/২৬৬)

 

পুরাঘটিত অতীত

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লেখেন- “ইহার প্রচলিত নাম ‘পরোক্ষ’ অর্থাৎ যে কার্য্য বক্তার চোখের বাহিরে ঘটিয়াছে। এই অতীত কাল দ্বারা ইহা সূচিত হয় যে, ক্রিয়ার ব্যাপার বহু পূর্বে অথবা বর্ণিত অন্য (অতীত) ঘটনার পূর্বে হইয়া গিয়াছে এবং তাহার ফল বিদ্যমান থাকিতেও পারে, না-ও থাকিতে পারে; যথা- ‘অতি শিশুকালে আমি একবার খাট হইতে পড়িয়া গিয়াছিলাম;...।” -ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ, পৃ. ৩২২

 

পুরাঘটিত অতীতের বিশিষ্ট ব্যবহার

অতীতকালের কোনো ক্রিয়ার আগে আরও একটি ক্রিয়া ঘটিয়া গিয়াছিল এমন ভাব বুঝাইতেও পূর্ববর্তী ক্রিয়ায় পুরাঘটিত অতীত কাল ব্যবহৃত হয়; যথা- ‘সভায় আমি পৌঁছিবার আগেই তিনি আসিয়াছিলেন’। ‘এখানে আসিবার আগেই সে পত্র দিয়াছিল’। -মুহাম্মদ এনামুল হক রচনাবলী (ব্যাকরণ মঞ্জরী) ২/৪৩০-৪৩১

‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ গ্রন্থে পুরাঘটিত অতীত ক্রিয়াপদের  প্রয়োগ সম্পর্কে আরেকটু বিশদভাবে বলা হয়েছে- “অতীতে এই প্রকার- চলে গিয়েছিল, ভেঙ্গে পড়েছিল, আমাকে দেখে হেসেছিল- এই পুরাঘটিত অতীত সাধারণভাবে আর-একটি অতীত ক্রিয়াপদের সঙ্গে প্রকাশ্য বা অনুমিত তুলনায় প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন এই প্রয়োগগুলিতে : আমি যখন ওখানে যাই তখন অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছিল। তুমি ভেবেছিলে কী?- না পড়েই পাশ করে যাবে?

প্রথম বাক্যের ‘যাই’ এবং দ্বিতীয় বাক্যের ‘পাশ করে যাওয়া’ দুটিই অতীত কালে  ঘটেছে, তার আগে ঘটে যাওয়া ক্রিয়াদুটিতে সম্পন্ন অতীত কালের প্রয়োগ ঘটেছে। কোনো ঘটনা কেউ ভুলে গেছে, (‘তুমি কি আমাকে বাজার থেকে গন্ধলেবু আনতে বলেছিলে?’), কিংবা অন্য একটি অতীত ক্রিয়া এসে তাকে আরও অতীত করে দিয়েছে, (আমি তো ঠিকই করেছিলাম বলব, তার আগেই তুমি কথাটা বলে ফেললে?)- এই রকম নানা প্রতিবেশে পুরাঘটিত অতীতের ব্যবহার হয়। বলার সময় থেকে  এই অতীতের দূরত্ব কতটা, তার হিসাব সরল নয় : ‘ও তো একটু অগেই এসেছিল, কোথায় গেল সে ছেলেটা?’ -প্রাগুক্ত ১/২৬৭-২৬৮

 

সাধারণ বর্তমান বা নিত্য বর্তমান

ক্রিয়ার যে কালরূপ নিয়মিত বা সাধারণত ঘটে- সাধারণ বর্তমান কাল এমন অবস্থা বোঝায়। যেমন : করে, বলে, হাসে, যায়, ওঠে ইত্যাদি। এ হল মূল কাঠামোগত অর্থ। কিন্তু বাংলা ভাষায় প্রায়ই এই ক্রিয়ারূপটি অতীত ঘটনার জন্য ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লেখেন- “বাঙ্গালায় বহুশঃ কোন অতীত ঘটনা অথবা ঐতিহাসিক ঘটনা জানাইবার জন্য অতীত কালের ক্রিয়ার পরিবর্তে নিত্য বর্তমান ব্যবহৃত হয়। যেমন- আকবর বাদশাহ ১৫৫৪ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট হয়েন; ...”। তিনি পুরাঘটিত অতীতের আলোচনায় আরো বলেন- “ঐতিহাসিক ঘটনা-বর্ণনায় এই পুরাঘটিত অতীতের স্থানে, অতীতার্থে বর্তমানের প্রয়োগ বাঙ্গালায় খুবই হইয়া থাকে।” -ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ, পৃ. ৩২০, ৩২২

সাধারণ বর্তমানের আরো কিছু বিশেষ প্রয়োগ রয়েছে। যদি, যখন, যতক্ষণ, যেবার, পাছে ইত্যাদি শব্দ থাকলে কিংবা অতীত কালের উল্লেখ থাকলে সাধারণ বর্তমানের ক্রিয়া অতীত কালের দ্যোতক হয়। যেমন : যখন জলোচ্ছ্বাস হয় আমি তখন স্কুল ছেড়েছি,...। প্রাচীন লেখকের উদ্ধৃতি দিতেও বর্তমানের কালরূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন- তিনি বলেন,...। এমনিভাবে  সাধারণ বর্তমান ক্রিয়ারূপের শেষে নাই, ‘নি’ ইত্যাদি নিষেধার্থক অব্যয় যোগ করে অতীত কাল নির্দেশ করা হয়। যেমন- ‘তিনি গতকাল হাটে যাননি’। -বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ অবলম্বনে পৃ. ২৩৪-২৩৫

 

পুরাঘটিত বর্তমান কাল

সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় লেখেন- “যে কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে কিন্তু যাহার ফল এখনও বিদ্যমান, অথবা যাহার জের বা প্রভাব এখনও চলিতেছে, তাহা পুরাঘটিত বর্তমান। যথা- আমি কালই তাহাকে দেখিয়াছি; কলিকাতায় আসিয়াছি চারি বৎসর হইল; বৃষ্টির দরুন রাস্তায় কাদা হইয়াছে।’ এই কালের চলিত নাম ‘হ্যস্তনী’-‘হ্যঃ’ অর্থাৎ গতকল্য যাহা ঘটিয়াছে; কিন্তু এই কাল দ্বারা এইভাবে গত-কল্যের সময়-নির্দেশ ঠিক নয়। -ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ, পৃ. ৩২২

ড. এনামুল হক সাহেব আরো স্পষ্ট ভাষায় লেখেন- কিঞ্চিৎপূর্বে অথবা বহুপূর্বে ক্রিয়া শেষ হইয়া গিয়াছে। অথচ সেই ক্রিয়ার ফল এখনও বর্তমান, এমন ক্ষেত্রে পুরাঘটিত বর্তমান কাল ব্যবহৃত হয়। যথা- গেল বারে আমি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছি। আজই তাহাকে পত্র দিয়াছি। ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ-রাজত্ব এদেশ হইতে বিদায় নিয়াছে। -মুহাম্মদ এনামুল হক রচনাবলী (ব্যাকরণ মঞ্জরী) ২/৪২৯, আরো দেখুন : বাঙ্গালা ব্যাকরণ; ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ পৃ. ৮৫

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্রিয়াপদের ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলেন- “বাংলায় থাকার কথাটা যখন জানাই তখন বলি- আছি বা আছে, ছিলে, ছিল বা ছিলুম। আছিল শব্দেরই সংক্ষেপ ‘ছিল’। কিন্তু ভবিষ্যতের বেলায় হয় ‘থাকব’। বাংলায় ক্রিয়াপদের রূপ প্রধানত এই থাকার ভাবকে আশ্রয় করে। করেছে, করছে, করেছিল, করছিল- এই শব্দগুলো আছি ক্রিয়াপদকে ভিত্তি করে স্থিতির অর্থকেই মুখ্য করেছে। সংস্কৃত ভাষায় এটা নেই, গৌড়ীয় ভাষায় আছে। হিন্দিতে বলে ‘চলা থা’, চলেছিল। কাজটা যদিও ‘চলা’ তবু ‘থা’ শব্দে বলা হচ্ছে, চলার অবস্থাতে স্থিতি করেছিল। গতিটা যেন স্থিতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত।” (দ্রষ্টব্য : বাংলা ভাষার পরিচয় পৃ. ৫৫; রবীন্দ্র-রচনাবলী, খ- ২৬, পৃ. ৪৪২)

‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ (১/২৬৭) গ্রন্থে পুরাঘটিত বর্তমান ক্রিয়াপদের প্রয়োগ সম্পর্কে একটু ভিন্ন আন্দাযে বলা হয়েছে- “বর্তমান কালের এই প্রকারে ক্রিয়ার কাজ শুধু  সম্পন্ন হয়েছে বোঝায়, তার বেশি কিছু নয়- ‘আমি বলেছি, তিনি খেয়েছেন, লোকটা চলে গেছে।’ কতটা আগে শেষ হয়েছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়।”

যাহোক বোঝা গেল, বাংলা ভাষায়  পুরাঘটিত বর্তমানের ক্রিয়ারূপ কাঠামোগতভাবে পূর্বেই শেষ হয়ে যাওয়া কোনো ক্রিয়ার ফল বা প্রভাব বর্তমানে বিদ্যমান থাকা বোঝায় কিংবা ক্রিয়ার কাজ শুধু  সম্পন্ন হয়েছে বোঝায়, তার বেশি কিছু নয়। ক্রিয়া কতটা আগে শেষ হয়েছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ক্রিয়ার ফল বলতে এখানে ক্রিয়ার কার্যকারিতা উপস্থিত থাকা বোঝনো হয়েছে। যেমন ধরুন- কেউ বলল, ‘আমি খেয়েছি’। তার মানে আমার এখন খাওয়ার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমার খাওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ‘তিনি বসেছেন’ অর্থাৎ তার বসার কাজটি সম্পন্ন হয়েছে এবং তার বসার অবস্থা ও কার্যকারিতা এখনো বিদ্যমান।

আমরা যেসব ভাষার সাথে পরিচিত তার মধ্যে উর্দূ ভাষার ব্যাকরণে যাকে মাযী করীবের সীগা বলা হয় তার অর্থও খুবসম্ভব বাংলা ভাষার পুরাঘটিত বর্তমানের ক্রিয়াপদের অনুরূপ। এজন্য উর্দূ ব্যাকরণের আধুনিক অনেক লেখক মাযী করীবের পরিবর্তে ‘হালে তামাম’ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। উর্দূ ভাষার এক আধুনিক গবেষক উর্দূ ক্রিয়াপদ সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র কিতাব লিখেছেন। সেই কিতাব থেকে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করছি-

حال تمام كا صيغہ  اصل فعل كى حاليہ تمام اور فعل "ہونا" كے  حال كے مفرد صيغوں سے بنايا جاتا ہے، جيسے" لڑكا آيا  ہے"-

حال تمام كا استعمال يہ ديكھ كر بتايا جاسكتا ہے كہ گزرے ہوۓ كام كا بولنے كے وقت سے كيا تعلق ہے- اس لحاظ سے حال تمام كى استعمال كے حسب ذيل تين اوقات ہیں  :

- كام بولنے كے وقت سے ذرا پہلے  يا بہت پہلے ہوا ہےليكن اسكا نتيجہ بولنے کے وقت ظاہر ہونا  ضرورى ہے-

حال تمام كا صيغہ  يہ نہيں ظاہر كرتاہے كہ كام كو ہوۓ كم وقت گزراہے، وقت كی قلت كا اظہار جملے ميں مناسب الفاظ كے  ذريعہ ہو جاتا ہے-

قواعد كى كتابوں ميں حال تمام كو ماضی قريب كے نام سے ياد كيا جاتا ہے، يہ ٹھيک نہيں معلوم ہوتاہے  كيونكہ جملوں كا جائزه ليتے ہوۓ يہ بات چهپی نہيں ره سكتی كہ  ان صورتوں ميں ماضی قريب كے معنى خود صيغے سے نہيں بلكہ جملے کے اورالفاظ سے نكلتے ہيں، جيسے " ابهی" " تهوڑی دير ہوئی "وغيره- ۓ

- حال تمام سے يہ بهى ظاہر ہوتا ہے كہ كام بولنے كے وقت سے پہلے وكسى وقت ہوچکاہے  اور کہنے والا  اسے حال سے ملا كر جملے ميں" اب تك" يا  "آج تك"  كا مفہوم پوشيده كرديتا ہے-

- حال تمام ماضی كو حال بنا كر پيش كرتا ہے (يعنی حال حکائی)-(اردو افعال : ترقی اردو بيورد نئى دہلى ص ১৭৭-১৯১، اور ديكھئے : قواعد اردو مولفہ پروفيسر فدا على خان، خدا بخش اورينٹل پبلك لائبريری، پٹنہ ص ২২৯)

 

পুরাঘটিত বর্তমানের বিশেষ প্রয়োগ

(ক) অতীত সময় বোঝাতে : দশ বছর হল তার বাবা মারা গেছেন। গত মাসে তাকে ঢাকায় দেখেছি

(খ) ভবিষ্যত সময় বোঝাতে : সেও এসেছে আর তোমারও যাওয়া হয়েছে। সে আগামীকাল কানাডা যাচ্ছে, আর ফিরছে না। -বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ পৃ. ২৩৬

উপরের উদ্ধৃতিগুলোতে আমরা লক্ষ করেছি, দেখিয়াছি, আসিয়াছি, হইয়াছে, দিয়াছি, খাইয়াছি’- এ ধরনের ক্রিয়াপদকে বাংলা ব্যাকরণে ‘পুরাঘটিত বর্তমান’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। পুরাঘটিত শব্দের অর্থ হল : ‘আগে ঘটেছে এমন’। এ ধরনের বাংলা ক্রিয়ারূপকেই অনেকে আরবীর قد فعل এই ওজনের ‘মাযী কারীবের’ সীগার সমার্থক মনে করে থাকেন। কিন্তু তা পুরোপুরি ঠিক মনে হয় না। কারণ বাংলার ‘পুরাঘটিত বর্তমান’ মূলগতভাবে সরাসরি নিকট অতীত বোঝায় না, যা আমরা একটু আগে ব্যাকরণের উদ্ধৃতিতে বিশদভাবে আলোচনা করেছি। বরং বাংলা ভাষার ব্যাকরণে যাকে সাধারণ অতীতকালের ক্রিয়াপদ বলা হয়, অর্থাৎ করল-করলেন-গেলেন-বললেন- এধরনের ক্রিয়ারূপ নিকটতম অতীতের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত। এ ধরনের ব্যবহারকে যদিও বাংলা ব্যাকরণের বইয়ে সাধারণত বিশিষ্ট প্রয়োগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এধরনের ক্রিয়াপদকে সরাসরি ‘সদ্য-অতীত কালের ক্রিয়াপদ’ নামেই অভিহিত করেছেন। দ্রষ্টব্য : বাংলা ভাষার পরিচয় পৃ. ৩৩, ৪৬; রবীন্দ্র-রচনাবলী, খ- ২৬, পৃ. ৪১২, ৪৩০

এমনিভাবে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন- “আমি এইমাত্র পড়িলাম। ‘পড়িলাম’ ক্রিয়াপদ দ্বারা বুঝাইতেছে যে, কার্যটি এইমাত্র শেষ হইল। ইহাকে সাধারণ (বা অদ্যতন) অতীত বলে”। -বাঙ্গালা ব্যাকরণ পৃ. ৮৫

লক্ষ করব ক্রিয়াপদের এই বিশেষ রূপটি আমরা প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকি। একটু আগে আমরা উল্লেখ করেছি- ‘সাধারণ অতীত আখ্যান বর্ণনায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত কালরূপ।’ কারণ ক্রিয়াপদের সাধারণ অতীত কাল রূপটাই বাংলা কথাসাহিত্যে লেখকদের হাতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ তারা এই কালরূপটিকেই গল্প ও কাহিনী বর্ণনায় মূল কাঠামো হিসেবে নির্বাচন করেছেন এবং এর সঙ্গে মিলিয়েই প্রয়োজনের মুহূর্তে অন্যতর কালরূপ ব্যবহার করেছেন।

বাংলা কথাসাহিত্যে এই সাধারণ অতীত কালরূপটি ব্যবহারের একটা আলাদা আবেদন ও তাৎপর্য রয়েছে। ক্রিয়াপদের এই রূপটির কাজই হচ্ছে, কাজের কথাটি সরাসরি হাজির করা; এবং এই রূপটির রেখে যাওয়া ঢেও হচ্ছে, ঐ যা ঘটে গেল তার রেশ এখনো রয়েছে, এখনো সেটা ফুরিয়ে যায়নি। যেমন, একটি লেখার অংশ- “সে ঘরের ভেতর এলো। দেখলো ঘরে কেউ নেই। বারান্দায় গেলো, সেখানেও কেউ নেই। তার মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেলো। সে চুপ করে বিছানার ওপর বসে রইলো, যেন কারো জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো”।

সাধারণ অতীত কালরূপ ব্যবহার করে লেখা এই অংশটি পড়ে আমরা বুঝতে পারি, লেখক চান ‘সে’ চরিত্রের সঙ্গে  সঙ্গে আমরা ঘরে ঢুকি, ঢুকে চরিত্রটির  সঙ্গেই আবিষ্কার করি যে, ঘর শূন্য। তারই পাশাপাশি হেঁটে আমরা বারান্দায় যাই এবং ফিরে এসে তারই মতো কারো জন্য অপেক্ষা করি। অর্থাৎ ঘটনাটি আমাদের খুব কাছে এবং চোখের ওপরই ঘটছে এবং এক্ষুণি, এইমাত্র তা ঘটে গেল।

বাকি থাকল অনুবাদ প্রসঙ্গ। তো এতক্ষণ ব্যাকরণের উদ্ধৃতিতে যে আলোচনা পেশ করা হল তার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি- মাযী মুতলাক এবং মাযী করীবের সরফী বা কাঠামোগত তরজমা ‘করল বা করেছে’ উভয় রকম হতে পারে। তবে কোনো আরবী নস ও ইবারতের অনুবাদের ক্ষেত্রে ‘মাযী মুতলাকের’ সীগার বাংলা অনুবাদ বাক্যের পূর্বাপর আলামত ও অবস্থা অনুসারে ‘করল-করেছে-করে-করেছিল’- এই ক্রিয়ারূপগুলোর যে-কোনোটি ব্যবহার করা যায়। আর মাযী করীবের বাংলা অনুবাদে ‘করল-বলল-দেখল-শুনল-এল-গেল’-এর মতো  সাধারণ অতীত কালরূপ ব্যবহার করাই অধিক মানানসই। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ‘করেছে-বলেছে-দেখেছে- শুনেছে-এসেছে- গিয়েছে’-এর মতো পুরাঘটিত বর্তমানের কালরূপ ব্যবহার করাও ঠিক আছে। এছাড়া মূল ক্রিয়ার সাথে ‘এখন, এইমাত্র, এক্ষুণি, এতক্ষণ’ এজাতীয় সহায়ক শব্দ ব্যবহার করে মাযী করীব আরো স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা যায়। এমনিভাবে সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার সমন্বয়ে গঠিত যৌগিক ক্রিয়ার মাধ্যমেও উপরোক্ত ভাব প্রকাশ করা যায়। যেমন, করে ফেলল, বলে ফেলল, উঠে পড়ল ইত্যাদি। মোটকথা বক্তব্যের ভাব, ভঙ্গি, সুর ও ছন্দ এবং দর্শনের সঙ্গে সঙ্গতি  রেখে কোনো একটি কালরূপ নির্বাচন করতে হবে। আর তা সম্ভব হবে ব্যাকরণ-সচেতনতা এবং সাহিত্যরুচির মাধ্যমে।

(উত্তর প্রদানে : মাওলানা আবদুল মাজীদ)

এই সংখ্যার অন্যান্য শিক্ষা পরামর্শসমূহ পড়ুন