শাবান-রমযান ১৪৩৪ || জুন-জুলাই ২০১৩

মুহাম্মাদ সিরাজুস সালেকীন - মাদানীনগর, ঢাকা

প্রশ্ন

ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর ইবাদত যুহদের আলোচনা করতে গিয়ে যে কথাটি বেশি বলা হয় তা হল, তিনি ৪০ বছর এশার অযু দিয়ে ফজরের নামায পড়েছেন। আরবী বাংলা অনেক কিতাবে এর বর্ণনা পাওয়া যায়। এর সনদগত শুদ্ধতা বা অশুদ্ধতা সম্পর্কে আমার জানা নেই। আমার কাছে এটা ভুল মনে হয়। কারণ আলখায়রাতুল হিসান-এর ৭৪ পৃষ্ঠায় তাঁর রাত্রি জাগরণের কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে-

سبب إحيائه أنه سمع رجلا يقول لآخر : هذا أبو حنيفة الذي لا ينام، فقال لأبي يوسف : سبحان الله ألا ترى الله تعالى نشر لنا هذا الذكر، أو ليس بقبيح أن يعلم الله منا ضد ذلك، والله لا يتحدث الناس عني بما لم أفعل، فكان يحيي الليل صلاة وتضرعا ودعاء.

  দ্বারা বুঝা গেল, তাঁর রাত্রি জাগরণ শুরু হয়েছে আবু ইউসুফ রাহ. তার শিষ্যত্ব গ্রহণের পর। আর তিনি দরসদানের কাজ শুরু করেছেন তাঁর উস্তায হাম্মাদের মৃত্যুর পর। আর শাযারাতুয যাহাবে হাম্মাদ রাহ.-এর মৃত্যুর সন বলা হয়েছে ১২০ হি. দ্বারা বুঝা যায় তাঁর রাত্রি জাগরণ শুরু হয় ১২০ হিজরীর পর। তিনি ইন্তেকাল  করেছেন ১৫০ হিজরীতে। সুতরাং তিনি রাত্রি জাগরণ করেছেন বেশি হলে ৩০ বছর। এর বেশি নয়। এতে তাঁর প্রশংসা বুঝা গেলেও আরেক দিকে অপবাদের মত মনে হয়। তিনি কি তার স্ত্রীর হক আদায় করেননি? উপরের কথাগুলো কতটুকু সঠিক হয়েছে আমার জানা নেই, তবে আশা করি, আপনি ব্যাপারে সঠিক কথাটি জানাবেন। উল্লেখ্য, সীরাতে নুমানে কথাকে ভুল বলা হয়েছে।

 

উত্তর

 কথা তো অসংখ্য সূত্রে প্রায় তাওয়াতুরের পর্যায়ে প্রমাণিত যেইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলইবাদতগুযারী এবং রাতে নফল নামাযতিলাওয়াত  দুআয়মশগুল থাকা। এটি ছিল তাঁর জীবনের প্রায় শুরুর দিক থেকে সারা জীবনের সাধারণ চিত্র। এজন্য হাফেয যাহাবী রাহঅত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় বলেছেন-

قد تواتر قيامه الليل وتهجده وتعبده رحمه الله.

 (মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা ২০এবং হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান রাহ. (মৃত্যু ১২০ হি.) যাঁর সোহবতে দীর্ঘ দিন ইমাম আবু হানীফা রাহকাটিয়েছেন তিনি একদিন কোনো প্রসঙ্গেফিকহের ব্যাপারে তাঁর বিচক্ষণতা  পারদর্শীতার প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন,

هذا مع فقهه يحيي الليل ويقومه

 (আলইনতিকা ফী ফাযায়িলিল আইম্মাতিল ফুকাহাইবনু আবদিল বার ১৯৪মুয়াফফাক আলমক্কীমানাকিবু আবী হানীফা পৃ২১৬)

এশার পর থেকে ফজর পর্যন্ত না ঘুমিয়ে পুরো সময় ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। ফলে ফজরের নামাযের জন্য নতুন অযুর প্রয়োজন হত না-একথাও অনেক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আমলটিও তাঁর যিন্দেগীর এক দীর্ঘ সময়ে পরিব্যাপ্ত। এমনকি যখন তিনি তাঁর উস্তায আমর ইবনে মুররা আলকুফী রাহ. (ওফাত : ১১৬ হি.)-এর দরসে শরিক হতেন তখনও তিনি এর ওপরআমল করতেন।  প্রসঙ্গে তাঁর সমসাময়িক মুহাদ্দিস আবূ সিনান ইবনে সিনান আলকূফী বলেন-

كنا نختلف إلى عمرو بن مرة، فكان أبو حنيفة يصلي العشاء والفجر بطهور واحد

অর্থাৎ আমরা আমর ইবনে মুররার মজলিসে যাতায়াত করতামতখন আবূ হানীফা এশা  ফজর একই ওযুতে আদায় করতেন।

(ফাযায়িলু আবী হানীফাআবূল কাসিম ইবনু আবিল আওয়াম পৃ৫৭)

তবে এভাবে মোট কতদিন এশার ওযুতে ফজর পড়েছেন সে সম্পর্কে তারীখ  মানাকেবের কিতাবে তাঁর শাগরিদ বা সমসাময়িক ব্যক্তিদের উদ্ধৃতিতে একাধিক সূত্রে বিভিন্ন হিসাব বর্ণিত হয়েছে।সেসব হিসাবের একটি হলোযা আপনি প্রশ্নে উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ চল্লিশ বছর। এই চল্লিশ বছরের কথাটিও একাধিক রেওয়ায়েতে রয়েছে। এর মধ্যে আসাদ ইবনে আমর রাহ.-এর উদ্ধৃতিতেবর্ণিত রেওয়ায়াতটি তো দলিলযোগ্য নয়- কথা শায়খ যাহেদ আলকাওছারী রাহউল্লেখ করেছেন। কারণ এর সনদে দুজন মাজহুল রাবী এবং এর মতনে নাকারাত রয়েছে। দেখুন : যাহাবী,মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা পৃষ্ঠা ২৩-২৪ (টীকা)

আর ইমাম আবূ ইউসুফ রাহ.-এর সূত্রে ইমাম আবূ হানীফা রাহ.-এর কোনো প্রবীণ শাগরিদ বা সমসাময়িক ব্যক্তি থেকেও চল্লিশ বছরের একটি রেওয়ায়াত রয়েছে। কিন্তু এর সনদে ইবনেআতিয়্যাহ নামে একজন রাবী আছেনযিনি জারহ-তাদীলের ইমামদের মতে নির্ভরযোগ্য নন।

(আখবারু আবী হানীফাহুসাইন আসসয়মারী ৪৪-৪৫)

 দুটি রেওয়ায়াত ছাড়াও চল্লিশত্রিশপঁয়তাল্লিশ এবং অনির্দিষ্টভাবে অনেক বছর একই ওযুতে এশা  ফজরের নামাজ আদায় করার ব্যাপারে আরো কয়েকটি রেওয়ায়াত এখন আমার সামনেরয়েছে। কিন্তু সেসব রেওয়ায়াতের তাহকীক করার  সুযোগ আমার  মুহূর্তে হয়নি। কারণ এর কোনো কোনোটির পূর্ণ সনদ সম্পর্কে এখনো আমি জানতে পারিনি বা কোনো কোনো সনদেরতাহকীকের জন্য তারীখ  তারাজীমের যেসব কিতাব প্রয়োজন তা এখন আমাদের সংগ্রহে নেই।

তবে তারীখে বাগদাদে (১৩/৩৫৪ইমাম আবূ হানীফা রাহ.-এর জীবনীতে তাঁর সমসাময়িক  ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হাসান ইবনে উমারা রহ.-এর উদ্ধৃতিতে একটি রেওয়ায়াত রয়েছে যা সনদ মতনসহ নিম্নরূপ-

أخبرني الحسين بن محمد أخو الخلال، حدثنا إسحاق بن محمد بن حمدان المهلبي ببخارى، حدثنا عبد الله بن محمد بن يعقوب، حدثنا قيس بن أبي قيس، حدثنا محمد بن حرب المروزي، حدثنا إسماعيل بن حماد بن أبي حنيفة عن أبيه قال : لما مات أبي سألنا الحسن بن عمارة أن يتولى غسله فغسل، فلما غسله قال : رحمك الله وغفر لك لم تفطر منذ ثلاثين سنة ولم تتوسد يمينك بالليل منذ أربعين سنة وقد أتعبت من بعدك وفضحت القراء.

হাম্মাদ ইবনে আবী হানীফা বলেনআমার পিতা যখন মারা গেলেন তখন আমরা হাসান ইবনে উমারাহকে দরখাস্ত করলাম যেতিনি যেন আমার পিতাকে গোসল করানোর দায়িত্ব নেন। তিনি তাইকরলেন এবং গোসল করানোর সময় বললেনআল্লাহ আপনার উপর রহম করুন এবং মাগফেরাত নসীব করুন। আপনি তো ত্রিশ বছর পর্যন্ত রোযা বর্জন করেননি এবং চল্লিশ বছর পর্যন্ত রাতেবিছানায় শোননি।

উল্লেখ্যএই রেওয়ায়াতটির সনদে কোনো মাতরুক  জয়ীফ (পরিত্যাজ্য  অনির্ভরযোগ্যরাবী নেই।

সনদটি কমপক্ষে হাসান পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে হয়। তবে এই রেওয়ায়াতটিতে অবশ্য একই ওযুতে এশা  ফজর পড়ার কথা স্পষ্টভাবে নেই। যাহোকএখানে আমাদেরকে বিশেষভাবেকয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে-

এক. আপনি অবশ্যই লক্ষ্য করেছেন যেউপরোক্ত রেওয়ায়াতগুলি মূলত ত্রিশ-চল্লিশ বা সুনির্দিষ্টভাবে কত বছর একই ওযুতে এশা  ফজর পড়েছেন- বিষয়ে। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা রাহ.তাঁর জিন্দেগীতে দীর্ঘকাল রাতে না ঘুমিয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থেকেছেনফলে অনেক সময়ই এশার ওজুতেই ফজর পড়েছেন একথা একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত।

 বিষয়ের রেওয়ায়াত নিম্নোক্ত কিতাবগুলোতে পাওয়া যাবে-

ফাযায়িলু আবী হানীফা

আবুল কাসিম ইবনু আবীল আওয়ামপৃ৫৭-৬১

আখবারু আবী হানীফা ওয়া আসহাবিহী

কাযী আবু আব্দিল্লাহ আসসয়মারীপৃ৪১-৪৬

তারীখু বাগদাদ ১৩/৩৫২-৩৫৭

মানাকিবু আবী হানীফা

মুয়াফফাক আলমাক্কীপৃ২০৭-২৩৩

মানাকিবু আবী হানীফা

হাফেয যাহাবীপৃ২১-২৪

উকুদুল জুমান

মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ আসসালেহীপৃ২১১-২২৩

দুই. উপরোক্ত বর্ণনাগুলির কোনোটিই ইমাম আবূ হানীফা রাহএর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়নিবরং এগুলো তাঁর বিভিন্ন শাগরিদ  সমসাময়িক ব্যক্তিদের উক্তিযা তাদের নিজ নিজজানাশোনা  ধারণার উপর নির্ভরশীল। সুতরাং তাদের পরস্পরের বিবরণে পার্থক্য থাকা খুবই স্বাভাবিক।

তিন. বিশেষভাবে লক্ষণীয় যেরেওয়ায়াতসমূহে মাগরিবের ওযুতে ফজরের নামায আদায়ের কথা বলা হয়নিএশার ওযুতে ফজর পড়ার কথা বলা হয়েছে। মনে রাখতে হবে সলফ এশার নামাযআমাদের মতো মাগরিবের কিছু সময় পরেই আদায় করতেন না বরং সাধারণত আরো বিলম্ব করে পড়তেন।

চার. মূল সুন্নত তো সেটাই যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত বাণীতে বলেছেন-

صم وأفطر وقم ونم، فإن لجسدك عليك حقا وإن لعينك عليك حقا وإن لزوجك عليك حقا.

অর্থাৎ কখনো রোযা রাখবেআবার কখনো রোযা ছাড়া থাকবে। রাতে কিছু সময় ইবাদতে মশগুল থাকবে আর কিছু সময় ঘুমাবে। কারণ তোমার উপর রয়েছে তোমার নিজ দেহের হকচোখের হকএবং তোমার স্ত্রীর হক।সহীহ বুখারীহাদীস : ১৯৭৫

কিন্তু কারো যিম্মায় অন্যের হক না থাকার কারণে অথবা খুব কম থাকার কারণে যদি সারা রাত ইবাদতে মশগুল থাকে তবে তা নিষিদ্ধও নয়যদি এতে তার কোনো ফরয বা ওয়াজিব আমল ছুটেনা যায় এবং কারো কোনো হক নষ্ট না হয়। সলফ তথা সাহাবীতাবিয়ীন  তাবে তাবিয়ীনদের মধ্যে  ধরনের অনেক নজির রয়েছে।

সাহাবা-তাবিয়ীন থেকে শুরু করে পরবর্তী যামানায় আল্লাহর নেক বান্দাদের বিস্ময়কর  কষ্টসাধ্য আমল  ইবাদত-বন্দেগীর ঘটনাবলি এবং  সবের শরয়ী হুকুম জানার জন্যে নিম্নোক্তকিতাবগুলো দেখা যেতে পারে-

হিলয়াতুল আওলিয়াহাফেজ আবু নুয়াঈম আসফাহানী

ইকামাতুল হুজ্জাহ আলা আন্নাল ইকছারা ফীত তাআববুদি লাইছা বিল বিদআহমাওলানা আবদুল হাই লখনবী (১৩০৪ হি.)

আলকালামুল মুফীদ ফী ইছবাতিত তাকলীদমাওলানা সরফরায খান সফদার রাহ.

আলউলামাউল উযযাবশায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ রাহ.

বাকি থাকল আপনি ইমাম আবূ ইউসুফ রাহ.-এর উদ্ধৃতিতে যে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। মূলত  ঘটনাটি চল্লিশ বছরের রেওয়ায়াতের পরিপন্থী নয়। কারণ  ঘটনার আগেও যে তিনি সারারাতজেগে ইবাদতে মগ্ন থাকতেনতা এতে নাকচ করা হয়নি। বরং ঘটনার বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে ঘটনার আগেই অনেক মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধ ছিল যেআবূ হানীফা রাহরাতে না ঘুমিয়েইবাদতে মশগুল থাকতেন। আর ১২০ হিজরীর আগেও যে তার  আমল ছিল তা তো আবূ সিনান সাঈদ ইবনে সিনান-এর উপরোল্লিখিত বক্তব্য থেকেও প্রমাণিত হয়।

এই সংখ্যার অন্যান্য শিক্ষা পরামর্শসমূহ পড়ুন