আব্দুল্লাহ আল মামুন বিন আব্দুল বারী - আশরাফুল উলূম, সুতারপুর, নেত্রকোণা

প্রশ্ন

হুযুর! আল্লাহ তাআলা আপনাকে সিহহাত-আফিয়াতের সাথে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন। আমীন। হুযুরের কাছে কয়েকটি বিষয় জানতে চাই।

(ক) মাকতাবাতুল আযহার কর্তৃক প্রকাশিত মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রাযযাক কাসেমী দা.বা. (উসতায, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া কাসিমুল উলূম জামে মসজিদ, আমরুহা, ইউপি, ভারত) কর্তৃক তালীককৃত তালীমুল মুতাআল্লিমকিতাবের ৪৩ নাম্বার পৃষ্ঠায় ইমাম বুরহানুদ্দীন যারনুজী রাহ. বলেন-

وكان يحكى أن محمد بن إسماعيل البخاري رحمه الله تعالى كان بدأ بكتاب الصلاة على محمد بن الحسن رحمه الله تعالى  إلخ

এখানে আমার জানার বিষয় হলো, এই মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান কে? তার জীবনী কোথায় পাব? তিনি ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান শাইবানী নাকি অন্য কেউ? তালীমুল মুতাআল্লিম কিতাবের সবচেয়ে উত্তম নুসখা কোনটি?

(খ) এই কিতাবের ১৯ নাম্বার পৃষ্ঠায় আছে-

وقد صنف الشيخ الإمام الأجل الشهيد ناصر الدين أبو القاسم رحمه الله تعالى كتابا في الأخلاق  إلخ

এই الأخلاق  কিতাবটি কোথায় পাওয়া যাবে? এটি প্রকাশিত কি না।

২৮ নাম্বার পৃষ্ঠায় আছে-

وينبغي لطالب العلم أن يحصل كتاب "الوصية" إلخ

কিতাবুল ওসিয়্যাটি মূল মতনসহ (হিন্দুস্থানের) কোন্ মাকতাবা থেকে প্রকাশিত জানতে চাই। আমার ইলমী-আমলী তারাক্কীর জন্য হুযুরের কাছে দুআর দরখাস্ত। জাযাকাল্লাহু খাইরান।

উত্তর

(ক) মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান নামে ইমাম বুখারী রাহ.-এর প্রসিদ্ধ কোনো উস্তাযের কথা আমার জানা নেই। খুব সম্ভবতালীমুল মুতাআল্লিম’ কিতাবের উপরোক্ত ইবারতে মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান’ নামটি নুসখার ভুলআসলে হবে আহমদ ইবনু হাফ্স। অথবা মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান’ নামের আগে আহমদ ইবনু হাফস’ এই নামটি ছিল। কেননা ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুুল হাসান রাহ.-এর প্রসিদ্ধ শাগরিদ হলেন আবূ হাফ্স কাবীর আহমদ ইবনু হাফ্স আল বুখারী রাহ. (মৃত্যু : ২১৭ হি.),যিনি ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আলবুখারী রাহ.-এর খাস উস্তায এবং তাঁর বাবা ইসমাঈল ইবনু ইবরাহীমের বন্ধু। ইমাম বুখারী রাহ. কিশোর বয়সে তাঁর কাছে জামে সুফিয়ান ছাওরী’-এর পাঠ গ্রহণ করেছেন। আর আবূ হাফ্স কাবীরের পুত্র মুহাম্মাদ ইবনু আহমদ ইবনু হাফ্স (মৃত্যু: ২৬৪হি.) ছিলেন ইমাম বুখারী রাহ.-এর সহপাঠী। দ্রষ্টব্য : তারীখে বাগদাদ ২/১১সিয়ারু আলামিন নুবালা ১০/১৫৭ (আহমদ ইবনু হাফসের জীবনী)১২/৪২৫৪৪৭ (ইমাম বুখারীর জীবনী);আল-ফাওয়ায়েদুল বাহিয়্যহইবনু মাজাহ আওর ইলমে হাদীসমাওলান মুহাম্মাদ আব্দুর রশীদ নুমানী রাহ.পৃ. ১০৮-১০৯১৮৫-১৮৬

(খ) আবূল কাসিম নাসিরুদ্দীন রাহ.-এর পূর্ণ নাম মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ। তিনি সমরকন্দের অধিবাসীহানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস। ৫৫৬ হিজরী সনে তিনি ইন্তেকাল করেন। রিয়াযুল আখলাক’ বা রিযাযাতুল আখলাক’ নামে তাঁর  একটি কিতাবের কথা তাঁর জীবনীতে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কিতাবটি মুদ্রিত বা পাণ্ডুলিপি আকারে কোথাও আছে কি না তা আমার জানা নেই। মুসান্নিফের জীবনী সম্পর্কে দ্রষ্টব্য : হাদিয়্যাতুল আরিফীন ১/৪৯৩আল-আলামযিরিকলী ৭/১৪৯ 

(গ) ইমাম আবূ হানীফা রাহ.-এর ওসীয়ত’ নামে একাধিক রিসালা তাঁর প্রতি সম্বন্ধ করা হয়ে থাকে। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা রাহ. পর্যন্ত সেসব ওসিয়্যাতের সবগুলোর সহীহ সনদ জানা যায় না। সেসব ওসিয়্যাতনামার মধ্যে একটি হল ইউসুফ ইবনু খালিদ আস- সামতির উদ্দেশ্যে ইমাম আবূ হানীফা রাহ.-এর ওসিয়্যাত ও উপদেশ।

এই ওসিয়্যাতটির পাঠ সনদসহ মুয়াফফাক ইবনু আহমদ আলমাক্কী (মৃত্যু ৫৬৮ হি.) তাঁর কিতাব মানাকিবুল ইমাম আজম’-এ (২/১০৭২৫ তম অধ্যায়ে) উল্লেখ করেছেন। এটি ইবনুল বাযযাযী আল-কারদারী (মৃত্যু ৮২৭ হি.) তাঁর কিতাব মানকিবুল ইমাম আজম’-এও উল্লেখ করেছেন। বাযযাযীর এই কিতাবটি মূলত মুয়াফফাক আলমাক্কীর কিতাবের তালখীস ও সারসংক্ষেপ।

ওসিয়্যাতটির শুরুতে একটি দীর্ঘ ঘটনা ও কাহীনিরও উল্লেখ রয়েছেযাতে বেশ কিছু মুনকার ও অপত্তিকর কথাবার্তাও রয়েছে। আর এর সনদটিতে রয়েছে একজন মাজহুল’ রাবী। সুতরাং এই ওসিয়্যাতটি ইমাম আবূ হানীফা রাহ. থেকে প্রমাণিত- এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

 

যাহোকএ ওসিয়্যাতটি এবং ইমাম আবূ হানীফা রাহ.-এর প্রতি সম্বন্ধকৃত ভিন্ন আরো চারটি ওসিয়্যাত একত্রে মাওলানা মুহাম্মাদ আশেক ইলাহী বুলন্দশহরী রাহ.-এর তারতীব ও তরজমাসহ হিন্দুস্তানের মাকতাবাতুন নূর থেকে ওয়াসায়া ইমাম আজম’ নামে ছেপেছে।

শেয়ার লিংক

মুহাম্মাদ আবদুল আযীয নাঈম - হাটহাজারী মাদরাসা, চট্টগ্রাম

প্রশ্ন

মুহতারাম, আশা করি আল্লাহ আপনাকে সুস্থ রেখেছেন, আমি ইতিহাস সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।

(ক) একজন আলিমের জন্য ইতিহাস জানা কতটুকু প্রয়োজন, জানতে হলে তা কোন্ ধরনের ইতিহাস হতে হবে।

(খ) ইতিহাসের কিতাবাদীতে অনেক এমন ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় যা অসম্ভব কিংবা অবাস্তব মনে হয়। তাই এমন কিছু ইতিহাসের কিতাবের নাম জানতে চাই যেগুলোতে নির্ভরযোগ্য ইতিহাস পাওয়া যাবে এবং সেসব কিতাবের হাওয়ালা দিয়ে ঘটনা বলা বা লেখা যাবে।

(গ) ইতিহাসের কিতাবাদীতে যখন কোনো ঘটনা বর্ণনা করা হয়, দেখা যায়, অনেক ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয়- অমুকে এ কাজ করেছেন, অমুকে প্রধান ছিলেন, তাদের সংখ্যা এত ছিল ইত্যাদি। এবং সন, তারিখ ও বারের নামও উল্লেখ করা হয়। এখন জানার বিষয় হলো, ইতিহাস কখন থেকে লেখা শুরু হয়?

(ঘ) আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের পর যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর সনদ তো সাহাবা-তাবেয়ীন পর্যন্ত পৌঁছে। আবার দেখা যায় পৃথিবীর শুরু থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানার মধ্যবর্তী সময়ের যেসব ইতিহাস লেখা হয় সেগুলোর সদনও সাহাবা-তাবেয়ীন পর্যন্ত পৌঁছে। প্রশ্ন হলো, তাঁরা যাদের থেকে বর্ণনা করেছেন সেই সনদ কোথায়, সেই সনদ তো কোনো কিতাবেই পাওয়া যায় না, তাহলে ঐ সব ঘটনা বা ইতিহাস তাঁদের কাছে কীভাবে পৌঁছলো- আমরা এ সনদহীন বিষয় কীভাবে বর্ণনা করবো বা সঠিক মনে করবো?

 

উত্তর

(ক) তারীখ ও ইতিহাসশাস্ত্রের বিভাগ ও উপবিভাগ অনেক। ইসলামী ইতিহাসবিশ্ব-ইতিহাসদেশীয় ও আঞ্চলিক ইতিহাস,সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসজ্ঞান ও শাস্ত্রের ইতিহাসজীবন-চরিত ইত্যাদি। প্রয়োজন ও গুরুত্বের বিচারে এসবের মাঝে তারতম্য রয়েছে।

শুধু ইসলামী ইতিহাসেরও রয়েছে অনেক শাখা-প্রশাখা। যেমনসীরাতমাগাযীসালাফ তথা সাহাবাতাবেয়ীনআইম্মায়ে দ্বীন প্রমুখের জীবনীদ্বীনের দায়ী ও মুজাহিদদের জীবনীখেলাফাত ও সালতানাতের ইতিহাসআসমাউর রিজাল বা রিজালশাস্ত্রীয় ইতিহাসকাসাসুল কুরআনকাসাসুল আম্বিয়াতারীখু আরাদিল কুরআনতারীখু আরাদিল হাদীসতারীখু আরাদিত তারীখিল ইসলামী। ইসলামী ইতিহাসশাস্ত্রের এসব শাখা-প্রশাখার প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। এগুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে।

দ্বীনীঈমানীফিকরীআখলাকী এবং ইলমী বহুবিধ ফায়েদা ও প্রয়োজনীয়তা এগুলোর সাথে জড়িত। আর  এ ছাড়া মানব জাতির দ্বীন ও দুনিয়ার বহুমুখী কল্যাণের উৎস হিসেবে পৃথিবীর সাধারণ ইতিহাস ও ভূগোলশাস্ত্রেরও স্বতন্ত্র স্থান ও মর্যাদা রয়েছে। উম্মতের স্মরণীয় বরণীয় আলিমগণ মানব জাতির উত্থান-পতনসভ্যতার ক্রমবিকাশদেশ-শাসক ও জ্ঞান সেবক স্মরণীয় ব্যক্তিদের বিচিত্র জীবনকাহিনী এবং বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশ-মহাদেশের বিবরণ সম্বলিত সাধারণ ইতিহাস ও ভূগোল চর্চায় মনোনিবেশ করে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছিলেন। হাফেয আব্দুর রহমান সাখাবী রাহ. (মৃত্যু: ৯০২হি.) الإعلان بالتوبيخ لمن ذم التاريخ গ্রন্থে ইতিহাসের বিভিন্ন কল্যাণ ও উপকারিতা এবং এ সম্পর্কে উলামায়ে উম্মতের বিভিন্ন মন্তব্য ও বক্তব্য এবং অবদান ও কীর্তি অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। ইসলামে ইতিহাসের স্থান ও গুরুত্ব সম্পর্কে মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.-এর সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ আলোচনাযা তিনি মাকামে সাহাবা’ পুস্তিকার শুরুতে উল্লেখ করেছেন তাও পড়ে দেখার মত।

(খ) আপনি নির্ভরযোগ্য এমন কিছু ইতিহাসগ্রন্থের নাম জানতে চেয়েছেনযাতে কোনো অবাস্তব কিছু থাকবে না। তো এখানে প্রথমে মনে রাখতে হবেসাধরণভাবে ইতিহাসের উৎস গ্রন্থগুলোতে নির্বিচারে সহীহ-গায়রে সহীহ ও সবল-দুর্বল বর্ণনা সংকলিত হয়েছে। কারণ সাধারণভাবে ইতিহাস সংকলকদের উদ্দেশ্য থাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সব ধরনের বর্ণনারাজি একত্র করা। রেওয়ায়েত ও বর্ণনার যাচাই-বাছাই এবং সহীহ-যয়ীফের পার্থক্য নিরূপণের প্রতি তারা লক্ষ রাখেন না। অনেক ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতাগণ স্পষ্ট বলেছেন যে, “বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কযুক্ত যত বর্ণনা ও তথ্য তাঁরা পেয়েছেন সবই সন্নিবেশিত করেছেন। বর্ণনার শুদ্ধাশুদ্ধি বিচারের কাজ তারা করেননি। এসব বর্ণনা দ্বারা যারা কোনো বিষয় প্রমাণ করতে চায় বর্ণনার শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই করে নেওয়া তাদের দায়িত্ব।

তবে তারীখ ও রিজালশাস্ত্রের কোনো কোনো বরেণ্য ইমাম ইতিহাস সংকলণের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করে নির্বাচিত তথ্য-উপাত্ত সংকলন করেছেন। ফলে তাদের সংকলিত ইতিহাসগ্রন্থ অন্যান্য ইতিহাসগ্রন্থের তুলনায় অধিক নির্ভরযোগ্য। কিন্তু এটাও বাস্তব সত্য যেইতিহাসের সনদের ক্ষেত্রে তারা হাদীসশাস্ত্রের ন্যায় কঠিন বিচার বিশ্লেষণ প্রয়োগ করেননি। অধিকন্তু কোনো কিতাব নির্ভরযোগ্য হওয়ার অনিবার্য অর্থ এই নয় যেএ কিতাবে উল্লেখিত প্রত্যেক কথাই সঠিক ও নির্ভরযোগ্য;বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর অর্থ এই যেসার্বিক বিচারে কিতাবটি নিভর্রযোগ্য। এজন্য আকাঈদ ও আহকামের সঙ্গে নিকটবর্তী বা দূরবর্তী সম্পর্ক রয়েছে এমন কোনো বিষয় সেখানে আসলে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাহকীক করা জরুরি। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য মাকামে সাহাবামুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.হযরত মুয়াবিয়া আওর তারীখী হাকাইক,মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী এবং শহীদে কারবালা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.-এর ভূমিকা ও পরিশিষ্ট অংশ অধ্যয়ন উপকারী হবে।

সমষ্টিগত বিবেচনায় নির্ভরযোগ্য প্রসিদ্ধ কয়েকটি ইতিহাসগ্রন্থের নাম নিম্নে উল্লেখ করা হল।

১. আল-কামিল ফীত তারীখইযযুদ্দীন ইবনুল আছীর (মৃত্যু : ৬৩০ হি.)

২. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াইবনু কাসীর ( মৃত্যু : ৭৪৪ হি.)

৩. তারীখুল ইসলামহাফেজ যাহাবী (মৃত্যু : ৭৪৮ হি.)

৪. দুয়ালুল ইসলামহাফেজ যাহাবী (মৃত্যু : ৭৪৮ হি.)

৫. ইমবায়ুল গুমর ফী আমবায়িল উমরইবনু হাজার আসকালানী (মৃত্যু : ৮৫২ হি.)

৬. শাযারাতুয যাহাবাইবনুল ইমাদআলহাম্বলী (মৃত্যু : ১০৮৯ হি.)

৭. আখতাউন ইয়াজিবু আন তুসাহহাহা ফিত তারীখ’-এর সিরিজসমূহযা জামাল আব্দুল হাদী ও ওয়াফা মুহাম্মাদ রিফাআত জুমুআহ কর্তৃক রচিত।

৮. আলী মুহাম্মাদ সাল্লাবী রচিত ইতিহাসের কিতাবসমূহ

৯. তারীখে দাওয়াত ওয়া আযীমাতমাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী

(গ) ইতিহাস কখন থেকে লেখা শুরু হয়আপনার এ প্রশ্নটি যদি ব্যাপক এবং সারা পৃথিবী সম্পর্কে হয় তবে তার সুনির্দিষ্ট ও সুনিশ্চিত জবাব দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ইতিহাসের ঘটনাবলী সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ধারা অতি প্রাচীন। দেশ-জাতি-অঞ্চল নির্বিশেষে পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের অতীত ঘটনা ও কাহিনী তাদের মুখে মুখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে এসেছে। ক্ষেত্রবিশেষ লিপিবদ্ধ আকারেও সংরক্ষিত হয়েছে।

যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা নবীদের উপর যেসব কিতাব নাযিল করেছেন তাতে উপদেশ ও শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্যে অতীতের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ আসমানী কিতাব আল-কুরআনুল কারীমের অন্যতম আলোচ্য বিষয় কাসাসুল আম্বিয়া এবং অতীতের বিভিন্ন জাতির ঘটনাবলি। এছাড়া ইসলামী ইতিহাসের প্রধান ও মৌলিক অংশ সীরাতে নববী। সীরাতের সবচেয়ে বড় ও সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য উৎস হাদীস শরীফ। আর হাদীস শরীফ গ্রন্থাকারে সংকলন শুরু হয়েছে অনেক আগে। সাহাবা-তাবিয়ীনের যুগে সতন্ত্রভাবে সীরাত সংকলকদের মধ্যে বিশিষ্ট তাবিয়ী উরওয়া ইবনুয যুবাইর রা. (জন্ম : ২২ হি.-মৃত্যু : ৯৪ হি.) অন্যতম।

ইসলামপূর্ব যুগেও ইতিহাসের চর্চা ছিল। আরব ভূখণ্ডে আরবদের মাঝে আইয়ামুল আরব এবং ইলমুল আনসাবের চর্চা হত। প্রধানত আরবী পদ্য আকারে আবার কখনো গদ্য আকারে। এগুলোকে তারা প্রধানত সংরক্ষণ করত স্মৃতিতে এবং কখনো লিপিতে। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তাদের মাঝে এসবের চর্চা ছিল। সে সময় আরবে আহলে কিতাব- ইয়াহুদী খ্রীস্টানদেরও বসবাস ছিল। তাদের কাছেও ছিল ইতিহাসের লিখিত ও মৌখিক বিভিন্ন উপাদান। এ ছাড়া সে সময়ের রাজা-বাদশাহদের রাজনামারাজ ফরমানরাজকীয় দলীল-দস্তাবেজ ছাড়াও তাদের রাজপ্রাসাদে এবং রাজগ্রন্থাগারে ইতিহাসের নানা উপাদান ছিল। এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানাবার জন্য আলমুফাসসাল ফী তারীখিল আরব কবলাল ইসলামড. জাওয়াদ আলী; ‘নাশআতু ইলমিত্ তারীখ ইনদাল আরব’,  ড. আব্দুল আযীয আদদুরী; ‘আলমাদখাল ইলাত তারীখিল ইসলামী’, ড. মুহাম্মাদ ফাতহী উছমান দেখা যেতে পারে।

(ঘ) সাহাবা-তাবিয়ীগণ থেকে ইসলামপূর্ব যুগের যেসব ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে সেগুলো কয়েক ভাগে বিভক্ত।

১. যেসব রেওয়ায়েতের সনদ সাহাবী-তাবিয়ী পর্যন্ত সহীহ নয়,  এ ধরনের রেওয়ায়েতগুলো যদি ভিন্ন সূত্রেও প্রমাণিত না হয়বরং অসত্যতা প্রমাণিত হয় তবে তো তা পরিত্যাজ্য এবং বর্ণনাযোগ্য না হওয়া স্পষ্ট।

২. এ ধরনের অনেক রেওয়ায়েতের উৎস হলইসরাঈলী রেওয়ায়েত। ইসরাঈলী রেওয়ায়েত বলা হয় সেসব রেওয়ায়েতকেযেগুলো ইহুদী বা নাসারা থেকে এসেছে। সেগুলো কিছু সরাসরি বাইবেল বা তালমুদ থেকে গৃহীতকিছু এসবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ থেকেআর কিছু আছে মৌখিক রেওয়ায়েত যা আহলে কিতাবের মাঝে আগে থেকেই বর্ণিত হয়ে আসছিল এবং আরবের ইহুদী-নাসারাদের মাঝে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ ছিল।

আর ইসরাঈলী রেওয়ায়েতের হুকুম হলযেসব রেওয়ায়েতের অসারতা কুরআন-হাদীস বা অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য দলীলের মাধ্যমে প্রমাণিত সেগুলো বিশ্বাস করা জায়েয নেই। আর যেসব ইসরাঈলী রেওয়ায়েত এমনকুরআন হাদীসে সেসবের স্বপক্ষেও কোনো কিছু নেই আবার বিপক্ষেও কোনো কিছু নেইএসব রেওয়ায়েতের ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করা জরুরি। এ ধরনের রেওয়ায়েত সম্পর্কে এই ঈমান রাখা জরুরি যেএর প্রকৃত ইলম আল্লাহ তাআলাই জানেন। দৃঢ়তার সঙ্গে আমরা একে না সত্য বলব না মিথ্যা।

ঈসরাঈলী রেওয়ায়েত সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য ড. মুহাম্মদ আবু শাহবাহকৃত আলইরাঈলিয়্যাত ওয়াল মাউযূআত ফী কুতুবিত তাফাসীর এবং মারকাযুদ দাওয়াহ থেকে প্রকাশিত এসব হাদীস নয়’ প্রথম খ-/ প্রথম খণ্ডের ভূমিকা মুতালাআ করতে পারেন। সাহাবা-তাবিয়ীন থেকে বর্ণিত বিভিন্ন ঈসরাঈলী রেওয়ায়েত সম্পর্কে হাফেয ইবনু কাসীর রাহ. তাঁর তাফসীরগ্রন্থে এবং আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে আলোচনা করেছেন।

৩. আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং পূর্ববর্তী কোনো কওম সম্পর্কে তাদের যেসব রেওয়ায়েতের উৎস হল মারফূ হাদীস। অর্থাৎ তারা তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছেন। তবে কোন রেওয়ায়েতটির ভিত্তি মারফূ হাদীস তার স্বপক্ষে ভিন্ন কোনো সহীহ মারফূ রেওয়ায়েত বা অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য দলীল থাকা আবশ্যক। আর এ বিষয়ে একমাত্র নাকিদ মুহাদ্দিসগণের সিদ্ধান্তই গ্রহণযোগ্য।

৪. যেসব রেওয়ায়েতের সম্পর্ক আরব জাহিলিয়্যাতের যামানা- আইয়ামূল আরব ও আনসাবুল আরবের সাথেকিংবা ভিন্ন কোনো জাতি ও অঞ্চলের ঘটনা ও ইতিহাসের সাথেএসব রেওয়ায়েতে বর্ণিত বিষয়াবলীর কোনো কোনোটা তারা নিজেরা প্রত্যক্ষ করেছেন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে শুনেছেন। অনেক দূরবর্তী যামানার বিষয় হলে সেগুলোকে তারা তাদের মধ্যে প্রচলিত মৌখিক বর্ণনা পরম্পরা থেকে জেনেছেন বা ভিন্ন কোনো উৎস থেকে জেনেছেন। যা হোক এ সবই হল সাধারণ ইতিহাসের উপাদান। ইতিহাস বিচারের যে নীতিমালা সে আলোকে এসবের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।

ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছায়ের উসূল ও নীতিমালাঐতিহাসিকের মধ্যে কী কী গুণ ও বৈশিষ্ট্য থাকা জরুরি এবং ইতিহাস লেখার আদব ও নিয়ম-কানুন- এগুলো স্বতন্ত্র ও দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। এসব বিষয়ে অনেক কিতাব ও বই-পুস্তক রয়েছে।

কয়েকটির নাম এখানে উল্লেখ করা হল-

مقدمة ابن خلدون

الإعلان بالتوبيخ لمن ذم التاريخ

مقدمة السيرة النبوية الصحيحة، للدكتور أكرم ضياء العمري

مقدمة سيرة النبي، للعلامة شبلي النعماني والسيد سليمان الندوي

المدخل إلى التاريخ الإسلامي، للدكتور محمد فتحي عثمان

المسلمون وكتابة التاريخ، للدكتور عبد العليم عبد الرحمن خضر، المنشور من المعهد العالمي للفكر الإسلامي

المفصل في تاريخ العرب قبل الإسلام، للدكتور جواد علي ১৩৭-১৪০

مقام صحابہ، مفتي محمد شفيع  رحمه الله

حضرت معاويہ اور تاريخى حقائق، مفتي محمد تقي عثماني

১০شهيد كربلاء، مفتى محمد شفيع (مقدمه اور خاتمه)

১১. مقدمات رسائل مولانا محمد عبد الرشيد النعمانى : يزيد كى شخصيت اهل سنت كے نظر مين، ناصبيت تحقيق كے بهيس مين، حضرت على اور قصاص عثمان، شهداء كربلاء پر افتراء

শেয়ার লিংক