তকী উদ্দীন - ফরিদাবাদ মাদরাসা

প্রশ্ন

 

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু। এক কিতাবে পড়লাম, সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. আরবী সাহিত্যের পাঠ গ্রহণের যামানায় তিনটি কিতাব খুব বেশি পড়েছেন এবং বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যথা : নাহজুল বালাগাহ, হামাসা এবং দালাইলুল ইজায। আমার আবেদন হলো, হযরত যদি এই কিতাব তিনটির পরিচয় কী এবং কিতাবত্রয় ক্রয় করলে কোন নোসখা ভালো হবে। এবং এর থেকে কোন্ পদ্ধতিতে পূর্ণাঙ্গ ফয়েদা অর্জন করতে পারবো- জানা বড়ই উপকৃত হবো এবং হযরতের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।

 

 

উত্তর

 

 

নাহযুল বালাগাহ’ কিতাবের পরিচয় : এটি হযরত আলী রা.-এর বিভিন্ন বাণীবক্তৃতাকবিতা এবং চিঠি-পত্রের সংকলন। এ কিতাবের সংকলক কে সে বিষয়ে কিছুটা মতবিরোধ রয়েছে। অনেকে বলেছেনএর সংকলক হলেনশরীফ রাযী মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন (মৃত্যু ৪০৬ হি.)। আবার কেউ কেউ বলেছেনএর সংকলক হলেন শরীফ রাযীর ভাই শরীফ মুরতাযা আলী ইবনুল হুসাইন (মৃত্যু ৪৩৬ হি.)। এঁরা উভয়ই শীয়া ইমামিয়্যাহ ফেরকার আলেম। 

উল্লেখ্যএ কিতাবটিতে যেসব বিষয় আলী রা.-এর প্রতি সম্বন্ধ করা হয়েছে তার কোনো সনদ সাধারণত উল্লেখ করা হয়নি। মূলত এর অনেক কথাই আলী রা. থেকে প্রমাণিত নয়। এতে সংকলিত কিছু কিছু কথা তো বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হওয়া স্পষ্টযা আলী রা.-এর নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে এতে এমন অনেক বাণী ও বিষয়ও সংকলিত হয়েছে যেগুলো নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত এবং নির্ভরযোগ্য কিতাবে রয়েছে। 

যাহোক এ কিতাবটি আরবী আদবের একটি নমুনা। তাই এ কিতাব থেকে আদবী ইস্তেফাদা করা যেতে পারে। কিন্তু এর কোনো কথাকে আলী রা.-এর কথা হিসেবে বর্ণনা করতে হলে তা প্রমাণিত কি না সে তাহকীক করা জরুরি। এটি মুতালাআর সময় সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এর সংকলক হলেন শীয়া মতাবলম্বী। এতে অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আলী রা.-এর প্রতি সম্বন্ধকৃত বিভিন্ন বানোয়াট ও মিথ্যা মন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। 

এ কিতাবটির ব্যাপারে আহলে ইলমের মন্তব্য ও পর্যালোচনা জানার জন্য নিম্নোক্ত কিতাবগুলো দেখা যেতে পারে।

১. মিনহাজুস সুন্নাহহাফেজ ইবনু তাইমিয়া৭/৮৬৮/৫৩-৫৬

২. সিয়ারু আলামিন নুবালাহাফেয যাহাবী ১৩/৩৮৩ (শরীফ মুরতাযা আলী ইবনুল হুসাইন-এর জীবনী)

৩. মীযানুল ইতিদালহাফেয যাহাবী ৩/১২৪ (শরীফ মুরতাযার জীবনী)।

৪. তারীখুল আদাবিল আরাবীড. আহমদ হাসান যায়্যাতপৃ. ১৩৬

৫. আল মুরতাযা’, মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভীপৃ. ২৮৫-২৮৭

হামাসা’ কিতাবের পরিচয়

আরবী কাব্য সাহিত্যে হামাসা’ নামে একাধিক কিতাব রয়েছে। যেগুলো বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন আরব কবিগণ সংকলন করেছেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ হলআবু তাম্মাম (২৩১ হি.) সংকলিত দিওয়ানুল হামাসা। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর বাল্যকালের আরবী সাহিত্য বিষয়ক পাঠ্যপুস্তকের তালিকায় আমরা যে হামাসা’-এর উল্লেখ পাইসেটিও আবু তাম্মাম রচিত এইদিওয়ানুল হামাসা

আবু তাম্মাম হলহাবীব ইবনে আওস ইবনে হারেছ আত্বায়ী (জন্ম : ১৮৮ হি. মৃ. ২৩১ হি)। তৃতীয় শতাব্দীর সুপ্রসিদ্ধ একজন আরব শায়ের। আরবের প্রাচীন কাব্যভা-ার থেকে তাঁর পছন্দেরকাব্যমালা’-কে এ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। এটি দশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। প্রথম অধ্যায়টির শিরোনামআল-হামাসা’ যার অর্থ বীরত্ব।  পরবর্তীতে এই প্রথম অধ্যায়ের নামেই কিতাবটি প্রসিদ্ধি লাভ করে। আবু তাম্মাম রচিত আরেকটি কিতাব হল : আলওয়াহশিয়্যাত। এটি ديوان الحماسة الصغرى  নামে পরিচিত। তবে শুধু আলহামাসা’ বলে প্রথমটিকেই বোঝানো হয়।

দ্রষ্টব্য : কাশফুয যুনুন ১/ ৬৯১-৬৯২আলআলামযিরিকলী ২/১৬৪মুজামুল মুআল্লিফীনউমর রেযা কাহহালাহ ৩/১৮৩

দালায়েলুল ইজায’ কিতাবের পরিচয়

দালায়েলুল ইজায বালাগাত শাস্ত্রের অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ’ কিতাব। বিশেষ করে ইজাযুল কুরআন বিষয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। পঞ্চম শতাব্দীর বালাগাত শাস্ত্রের ইমাম আবদুল কাহের ইবনে আবদুর রহমান আলজুরজানী রাহ. (মৃ. ৪৭১ হি.)-এর একটি শ্রেষ্ঠ রচনা। এ কিতাবে তিনি ভাষা ও সাহিত্যের বিচারে কুরআনে কারীমের মুজিযা ও অলৌকিকত্বের দিকগুলোর বিশ্লেষণ পেশ করার চেষ্টা করেছেন।

 

শেয়ার লিংক

মুহাম্মাদ যুবাইর হুসাইন - ঢাকা

প্রশ্ন

 

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।

() ছোটদের হাদীস শিক্ষায় আপনার লিখিত উৎসাহমূলক ভূমিকা পড়ে আহকাম সম্পর্কিত নুসূসগুলো হিফজ করতে উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। তাই উক্ত বিষয়ের কোনো খাছ কিতাবের নাম বলে দিলে বহুত বড় এহসান হত। 

() প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা ইয়াসিনের ফযীলত বর্ণণা করতে গিয়ে বলেছেন, একবার সূরা ইয়াসীন পাঠ করা ১০ বার কুরআন খতমের সমান সাওয়াব রাখে। এমনিভাবে বার সূরা ইখলাস পড়া বার কুরআন খতমের সাওয়াব রাখে। জানার বিষয় হল, তাহলে কি সূরা ফাতেহা থেকে নাস পর্যন্ত  পড়া আর বার সূরা ইখলাস পড়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই? বিস্তারিত উত্তর দিলে কৃতজ্ঞ থাকব। 

() মুহতারাম গোস্তাখী মাফ করবেন, আমরা গ্রামের ছাত্র, আলকাউসার আমাদের কাছে মাস পরেও পৌঁছে। অধিকন্তু ইলমী ইস্তেফাদামূলক আমাদের লিখিত প্রেরিত অনেক চিঠি হয়ত মধ্যস্থ গোলযোগের কারণে আপনার হাতে পৌঁছেনি। ফলে আমরা বারংবার মাহরুম নিরাশ হয়েছি তাই আপনার নিকট আকুল আবেদন, যদি কোনো খাস মোবাইল নম্বর দিতেন তাহলে আমরা খুশি হতাম। আল্লাহ আপনাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। 


 

উত্তর

 

() আহকাম বিষয়ক হাদীসের হিফ্জ আপনি নীমাবী রাহ.-এর আছারুস সুনান কিতাবটি থেকে করতে পারেন।

() দেখুন সওয়াব লাভ করা তিলাওয়াতের একটি ফায়েদা, একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। কুরআনে কারীম তিলাওয়াতের ঈমানী, ইলমী, আমলী এবং হেদায়েতী বহুবিধ উদ্দেশ্য উপকারিতা রয়েছে। এরপর যে কোনো নেক আমল ইবাদতের সওয়াব দুধরনের হয়ে থাকে। এক. আমলের মূল সওয়াব। দুই. আমলের তাযয়ীফ বা বর্ধিত সওয়াব, যা আল্লাহ তাআলা অতিরিক্ত পুরস্কার হিসেবে মূল সওয়াব থেকে বাড়িয়ে দেন। তো আপনি প্রশ্নে সূরা ইয়াসীন এবং সূরা ইখলাসের ফযীলত সংক্রান্ত যে হাদীস দুটির প্রতি ইশারা করেছেন তার মধ্যে সূরা ইখলাসের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসটির সনদ সহীহ, যা সহীহ বুখারী সহীহ মুসলিমসহ অন্য অনেক কিতাবে রয়েছে। আর সূরা ইয়াসীনের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসটির সনদ জয়ীফ, সুনানে তিরমিযীতে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।

তবে সূরা ইখলাস সংক্রান্ত হাদীসটি আপনি যেভাবে উল্লেখ করেছেন সেভাবে মূলত বর্ণিত হয়নি। قل هو الله أحد تعدل ثلث القرآن   অর্থ কুলহু ওয়াল্লাহু আহাদ এই সূরাটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের বরাবরএই শব্দে বা এর সমার্থক শব্দে বর্ণিত হয়েছে। তিনবার সূরা ইখলাস পড়ার সওয়াব একবার পূর্ণ কুরআন খতমের সওয়াবের বরারবসরাসরি এভাবে নয়।

যা হোক সূরা ইখলাসের তিলাওয়াতকে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলওয়াতের বরাবর এবং সূরা ইয়াসীনের  তিলাওয়াতকে দশবার পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াতের বরাবর বলার উদ্দেশ্য সর্বদিক থেকে সম্পূর্ণ বরাবর হওয়া নয়। কোন্ দিক থেকে বরাবর সে বিষয়ে একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা অনুসারে সওয়াবের দিকটি ধরা হলে তার উদ্দেশ্য হবে- সূরা ইখলাস তিলাওয়াতের মূল সওয়াব বর্ধিত সওয়াব মিলে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াতের মূল সওয়াবের বরাবর। সুতরাং এখন যদি কুরআনে কারীমের এক তৃতীয়াংশ তিলওয়াতের সাথে তার বর্ধিত সওয়াবকে যোগ করা হয় তবে তো তা সূরা ইখলাস তিলাওয়াতের মূল সওয়াব থেকে অনেক বেশি হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, কুরআনে কারীমের প্রতিটি সূরা, প্রতিটি আয়াতের রয়েছে নিজস্ব হেদায়েত, শিক্ষা, বিধান এবং ঈমানী আমলী বহু ফায়দা। তাই এসব ফায়েদা অর্জনের জন্য কুরআনের সব সূরা আয়াত তিলাওয়াত করা অত্যাবশ্যক।

() প্রেরিত চিঠিপত্র সাধারণত ঠিকভাবেই পৌঁছে থাকে। কিন্তু চিঠির জবাব লিখতে আমার দেরি হয়ে যায়। আপনি চিঠিপত্র পাঠাতে থাকুন। ইনশা আল্লাহ সামনে থেকে চিঠিপত্রের জবাব আরো দ্রুত দিতে চেষ্টা করব। আপনি খাস মোবইল নম্বরের কথা বলেছেন। তো আমার কোনো খাস মোবাইল নম্বর নেই। একটি সাধারণ মোবাইল নম্বর রয়েছে; যা ইতিপূর্বে আল কাউসারে ছাপা হয়েছে।

 

শেয়ার লিংক

মুহাম্মাদ ইসমাঈল বিন আবদুল হালীম - ওয়েব থেকে প্রাপ্ত

প্রশ্ন

 

রদ্দুল মুহতারের ইবারতের শেষাংশে বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে আল্লামা শামী রাহ. রুমুয হিসেবে (ط) (ح  ) ব্যবহার করেছেন, এর দ্বারা তিনি কোনদিকে ইশারা করে থাকেন- জানালে উপকৃত হবো।


 

উত্তর

 

কিতাবের শুরুতে আল্লামা ইবনু আবিদীন রাহ.-এর ভূমিকা খেয়াল করে পড়লে আপনি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। তিনি সেখানে লিখেছেন-

ضاما إلى ذلك ما حرره العلامة الحلبي والعلامة الطحطاوي  .

যে বক্তব্যের শেষে তিনি (ط) বা (ح) ব্যবহার করেছেন তা তিনি দুই হাশিয়া থেকে নিয়েছেন এবং রুমুয ব্যবহার করে এর হাওয়ালা দিয়েছেন।

(ط) দ্বারা তিনি বুঝিয়েছেন আল্লামা তাহতাবী রাহ.-কে, যার حاشية الطحطاوي على الدر খুবই প্রসিদ্ধ। আর (ح) দ্বারা বুঝিয়েছেন আল্লামা হালাবী রাহ.-কে, যার পূর্ন নাম ইবরাহীম ইবনে মুস্তফা হালাবী, ওফাত ১১৯০ হিজরীতে। আদ্দুররুল মুখতারেরউপর তার হাশিয়া রয়েছে تحفة الأخيار على الدر المحتار

দেখুন : ইযাহুল মাকনূন ফিয যাইলি আলা কাশফিয যুনূন /২৪০

আর হালাবী রাহ.-এর জীবনীর জন্য দেখুন সিলকুদ দুরার ফী ইয়ানিল করনিছ ছানীয়া আশার মুহাম্মাদ খলীল মুরাদী /৩৭-৩৯

উল্লেখ্য, হালাবী গুনইয়াতুল মুতামাল্লী-এর লেখক হালাবী নন। তার নাম হলো ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মাদ হালাবী, যার ওফাত ৯৫৬ হিজরীতে। আদ্দুররুল মুখতারের উপর তার হাশিয়া হবে কীভাবে? মুসান্নিফ হাসকাফী রাহ.-এর ওফাত হলো ১০৮৮ হিজরীতে।

 

শেয়ার লিংক

জনৈক তালিবে ইলম - ঢাকা

প্রশ্ন

 

প্রশ্ন : আমাদের উপমহাদেশে বুযুর্গদের নামে যে শাজারা প্রচলিত আছে তাতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি যে, কোনো বুযুর্গ ব্যক্তি তার মুরশিদের সান্নিধ্যে থেকে ফয়েয-বরকতে ধন্য হয়েছেন এবং তার থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাই সেসব বুযুর্গদের খেলাফতের ধারাবাহিকতা জানার জন্য এই শাজারা তৈরি করা হয়েছে। কিন্ত এই শাজারার ব্যাপারে কিছু জায়গায় কোনো কোনো উলামায়ে কেরাম আপত্তি করে বলে থাকেন- যেমন, হাসান বসরী রাহ. হযরত আলী রা. থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত এবং আলী রা. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত হয়েছেন। কথাটি ভিত্তিহীন। বিশেষ করে হাসান বসরী রাহ. সম্পর্কে বলে থাকেন যে, তিনি ২২ হিজরীতে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বয়স যখন ১৩ বছর তখন ৩৫ হিজরীতে আলী রা. খলীফা নিযুক্ত হন এবং খিলাফতের কেন্দ্র মদীনা থেকে কুফায় স্থানান্তরিত করেন। এরপর আলী রা.-এর সাথে তার আর সাক্ষাৎ হয়নি। তাহলে হাসান বসরী রাহ. আলী রা. থেকে কীভাবে খেলাফত পেলেন? এখন জানার বিষয় হলো, উল্লেখিত আলোচনায় কোন্টি সঠিক- জানালে কৃতজ্ঞ হবো। 


 

উত্তর

 

দেখুন হাসান বসরী রাহ. প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ইমাম। তিনি অনেক সাহাবীর সোহবত তরবিয়াত লাভে ধন্য হয়েছেন। তিনি যে হযরত আলী ইবনু আবী তালিব রা.-এরও দর্শন সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং তাঁর সোহবত সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন - বিষয়টি অবশ্যই প্রমাণিত। এটাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কারণ তিনি জন্মগ্রহণ করেন মদীনায় ২১ হিজরী সনে, যখন হযরত উমর রা.-এর খেলাফত কালের দু বছর বাকি ছিল। হাসান বসরী রাহ.-এর মাতা ছিলেন উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা.-এর বাদী। তাই হাসান বসরী রাহ. শৈশবে উম্মে সালামাহ রা.-এর কোলে লালিত পালিত হয়েছেন। বর্ণিত হয়েছে, মায়ের অনুপস্থিতিতে তিনি কাঁদলে উম্মুল মুমিনীন তাকে দুধ পান করিয়েছিলেন এবং তিনি তালীম তারবিয়াতের জন্য তাকে সাহাবায়ে কেরামের মজলিসে পাঠাতেন। তিনি তো উসমান রা.-কেও দেখেছেন। ৩৫ হিজরী সনের যুলহজ্জ মাসে যখন উসমান রা.-কে শহীদ করা হয় তখন তিনি মদীনায় ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল চোদ্দ-পনের বছর।  সময় পর্যন্ত হযরত আলী রা.- মাদীনায় অবস্থান করছিলেন। উসমান রা.-এর শাহাদাতের পর আলী রা. খলীফা মনোনীত হন এবং মদীনায় খেলাফতের বায়আত গ্রহণ করেন। সময় হাসান বসরী রাহ. তো মদীনার অধিবাসী ছিলেন। ৩৬ হিজরী সনের জুমাদাল আখিরাহ মাসে জামাল যুদ্ধের পর আলী রা. কুফায় স্থানান্তরিত হন। সুতরাং আমরা সহজেই বুঝতে পারছি যে, হাসান বসরী রাহ. মদীনায় থাকাকালীন তার চৌদ্দ পনের বছর বয়স পর্যন্ত আলী রা. মদীনায় অবস্থান করেছেন। এই সময়ের মধ্যে এটাই স্বাভাবিক যে, হাসান বসরী রাহ. আলী রা.-কে দেখেছেন, তাঁর মজলিসে বসেছেন এবং তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেছেন। শুধু সম্ভাবনার কথা নয়, বরং একাধিক রেওয়ায়েত থেকে কথা সুস্পষ্টভাবে বুঝে আসে। হযরত আলী রা.-কে হাসান বসরী রাহ. দেখেছেন- কথা অনেক মুহাদ্দিসই বলেছেন। তবে তিনি হযরত আলী রা থেকে সরাসরি শুনে কোনো হাদীস বয়ান করেছেন কি না- সে বিষয়ে অনেক মুহাদ্দিসের দ্বিমত রয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েকজন মুহাদ্দিস কথাকেই সহীহ অগ্রগণ্য বলেছেন যে, হাসান বসরী রাহ. আলী রা. থেকে সরাসরি হাদীস শুনেছেন। দ্রষ্টব্য : তাহযীবুল কামাল, মিয্যি /২৯৭; তাহযীবুত তাহযিব /২৬৩; ইকমালু তাহযিবিল কামাল, মুগলাতাঈ /৭৮; ইতহাফুল ফিরকাহ বিরাফওইল খিরক্বাহ, সুয়ূতী (আলহাবী লিল ফাতাওয়া-এর অন্তর্ভুক্ত) /২৬৮-২৭১; আলী ইবনু আবী তালিব ইমামুল আরিফীন, আহমদ আলগুমারী ২০০-২২৫; আত তাবিউনাস সিকাত আলমুতাকাল্লাম ফী সামাইহিম মিনাস্ সাহাবাহ, মুবারাক বিন সাইফ পৃ. ৩০০; তারিখুল ইসলাম, হাফেয যাহাবী /২৫

কিন্তু এর পাশাপাশি এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তাসাওউফের শাজারা থেকে কথা বুঝাও সম্পূর্ণ ভুল ধারণা যে, হযরত আলী রা. হাসান বসরী রাহ.-কে এবং শাজারায় উল্লিখিত প্রত্যেক ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি পরবর্তী ব্যক্তিকে পারিভাষিক অর্থে ইজাযত খেলাফত প্রদান করেছেন। কেননা সালাফের যামানায় তাসাওউফের ক্ষেত্রে বর্তমানের পারিভাষিক ইজাযত খেলাফত প্রদানের রীতি ছিল না। সালাফের যুগে তো ইসলাহ তাযকিয়ার জন্যে আল্লাহওয়ালাদের সংশ্রব সাহচর্য, তাঁদের মুহাব্বত এবং অনুসরণ-অনুকরণের পদ্ধতিই প্রচলিত ছিল। এটাই হল তাসাওউফের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এর জন্য প্রচলিত বাইআত এবং ইজাযত খেলাফত প্রদান শর্ত নয়।

সুফিয়ায়ে কেরামের মাঝে পরবর্তী যুগে যখন নির্দিষ্ট কোনো শায়েখের হাতে বাইআত হওয়া এবং তাসাওউফের আনুষ্ঠানিক ইজাযত খেলাফত প্রদানের ব্যাপক প্রচলন ঘটে তখনো সুন্নাতের অনুসারী হক্কানী সুফিয়ায়ে কেরামের কাছে এগুলো তাসাওউফ তথা ইসলাহ তাযকিয়ার অপরিহার্য শর্ত প্রতিপাদ্যরূপে পরিগণিত হয়নি।

দেখুন, আওয়ারিফুল মাআরিফ, উমর ইবনু মুহাম্মদ সুহরাওয়ার্দী (মৃত্যু : ৬৩২) /১৫৯; আলী ইবনু আবী তালিব ইমামুল আরেফীন পৃ. ১১১-১১৯; ইলাউস সুনান ১৮/৪৪৯-৪৫০; ইমদাদুল আহকাম /৩০৮; রিসালাতুল মুসতারশিদীন ৭২-৭৩ এবং ১০২-১০৮; তাসাওউফ : তত্ত্ব বিশ্লেষণ,পৃ. ৭৫-৭৮

যাহোক সালাফে সালিহীনের যুগে তাযকিয়া ইসলাহের জন্য আল্লাহওয়ালাদের সোহবত গ্রহণের পদ্ধতিই প্রচলিত ছিল এবং সে যুগে সোহবতের তাছীর প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর শক্তিশালী। এর সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন সাহাবায়ে কেরাম রাযিআল্লাহু আনহুম। কেননা তাঁরা ঈমান মুহাব্বতের সাথে রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সোহবত লাভে ধন্য হয়েছিলেন। ঈমানের সাথে অল্প সময়ের সোহবত এমনকি একবারের দর্শনের দ্বারাও তাঁরা সাহাবী হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম সুবকী রাহ. লিখেছেন-

و ذلك لشرف الصحبة و عظم رؤية النبي صلى الله عليه وسلم، وذلك أن رؤية الصالحين لها أثر عظيم، فكيف رؤية سيد الصالحين؟! فإذا رآه مسلم و لو لحظة، انطبع قلبه على الاستقامة، لأنه بإسلامه متهيء للقبول، فإذا قابل ذلك النور العظيم أشرق عليه وظهر أثره في قلبه وعلى جوارحه  .

দ্রষ্টব্য : আল ইবহাজ ফী শরহিল মিনহাজ /, আরো দ্রষ্টব্য : লামাহাত মিন তারিখিস সুন্নাহ ওয়া উলূমিল হাদীস, শায়েখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ পৃ. ৪৯-৫১

এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

طوبى لمن رآني وآمن بي، وطوبى لمن رأى من رآني، ولمن رأى من رآني وآمن بي (رواه الحاكم في المستدرك ৪/৯৬ و الضياء المقدسي في الأحاديث المختارة ৯/৯৯ وهو حديث ثابت وله طرق كثيرة)

সালীহীন নেককারদের সোহবতের তাছীর ফযীলত সম্পর্কে হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

خير جلساءكم من يذكركم الله رؤيته، وزاد في علمكم منطقه، وذكركم الآخرة عمله.

অর্থাৎ তোমাদের সর্বোৎকৃষ্ট সঙ্গী সে, যাকে দেখলে আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ হয়, যার কথায় ইলম বৃদ্ধি পায়, যার কাজ তোমাদেরকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। -মুসনাদে আব্দ ইবনে হুমাইদ, হাদীস নং ৬৩১; মুসনাদে আবী ইয়ালা, ২১৯৯

তো বহু সাহাবীর সোহবত তারবিয়াত লাভে ধন্য হাসান বসরী রাহ.-এর মত ব্যক্তিত্ব  শৈশবে কৈশরে আলী রা.-এর মত ইমামুল আরেফীনের অল্প সময়ের সোহবত দর্শন লাভের বরকতে তাযকিয়া ইসলাহের উচ্চ মার্গে উন্নীত হন- তবে তো তা খুব স্বাভাবিক বিষয়। খোদ হাসান বসরী রাহ. সম্পর্কে তাঁর জীবনীতে হাফেজ ইবনে কাছীর রাহ. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া কিতাবে ইউনুস ইবনে উবাইদের উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেছেন-

كان الرجل إذا نظر إلى الحسن انتفع به، وإن لم يسمع من كلامه ولم ير عمله.

সার কথা তাসাওউফের শাজারাটি মূলত সোহবত এবং তালীম-তারবিয়তের সিলসিলাহ। তবে পরবর্তী যে যুগে পারিভাষিক ইজাযত খেলাফত প্রদানের রীতি প্রচলিত হয়েছে, সে যুগের মাশায়েখদের মাঝে সোহবত তারবিয়তের পাশাপাশি পারিভাষিক ইজাযত খেলাফতও ছিল। অন্যথায় শাজারাটি মূলত কেবল সোহবত লাভের বিবরণী। কারণে শাজারার সিলসিলায় যদি হাসান বসরী রাহ.-এর উপরে অন্য কোনো সাহাবীর নাম উল্লেখ করা হত যার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ সোহবত প্রমাণিত, তবে তাতেও কোনো সমস্যা ছিল না।

 

শেয়ার লিংক