(মুফতী) মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান - লক্ষ্মীপুর ভরেরচর, মুন্সিগঞ্জ
৬৭৯২. প্রশ্ন
মুহতারাম, লক্ষ্মীপুর ভরেরচর, গজারিয়া, মুন্সিগঞ্জ-এ ওয়াকফকৃত আমাদের একটি পুরাতন মসজিদ রয়েছে। যা এলাকার মুসল্লীবৃন্দের পাঁচ ওয়াক্ত নামায, জুমা, জানাযা, তারাবীসহ অন্যান্য ইবাদত বন্দেগীর একমাত্র কেন্দ্রস্থল। বর্তমানে এদিক দিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক প্ল্যানকৃত একটি রাস্তা হতে যাচ্ছে, যা মতলব এলাকায় গিয়ে পৌঁছবে। সরকারি কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে, মসজিদটি ভেঙে সেখান দিয়ে রাস্তা নিয়ে মসজিদটি অন্য স্থানে স্থানান্তর করে দেবে। আমরা এলাকাবাসী ও মুসল্লীবৃন্দ জানতে চাই, একটি প্রাচীন মসজিদ এভাবে ভেঙে রাস্তা নির্মাণ করা শরীয়তে কতটুকু বৈধ?
উল্লেখ্য, মসজিদের জমিদাতা মোতাওয়াল্লি এমনটি করতে আদৌ রাজি নন; বরং তিনি এবং এলাকাবাসী মসজিদকে যথাস্থানে রেখে রাস্তা করার জন্য সরকারকে অন্য দিক দিয়ে জায়গা দিতে প্রস্তুত। এমতাবস্থায় সরকার-কর্তৃপক্ষের জন্য করণীয় কী? শরীয়তের আলোকে জানিয়ে আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলতে সহায়তা করুন।
উত্তর
প্রশ্নের বিবরণ অনুযায়ী সরকারি কর্তৃপক্ষের জন্য উক্ত মসজিদটিকে ভেঙে দিয়ে তাতে সড়ক নির্মাণ করা বৈধ হবে না। এক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে সরকার অন্যত্র মসজিদের জায়গা দিয়ে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করে দিলেও এ কাজ কখনো বৈধ হবে না। আগের মসজিদকে বিরান করা কবীরা গুনাহ ও স্পষ্ট হারাম হবে এবং চরম জুলুম ও অন্যায় হবে। মসজিদ আল্লাহ তাআলার ঘর, ইসলামের শিআর। মসজিদের জন্য ওয়াকফকৃত জায়গায় যখন মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়, তা চিরস্থায়ীভাবে মসজিদের জন্য নির্ধারিত হয়ে যায়। উক্ত মসজিদকে স্বস্থানে আবাদ রাখা এলাকাবাসী সকলের ওপর আবশ্যক। তা ভেঙে ফেলা, বিরান করা সম্পূর্ণ হারাম ও কবীরা গুনাহ।
কুরআন মাজীদে মসজিদ আবাদ করাকে আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হিসাবে ব্যক্ত করা হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে–
اِنَّمَا یَعْمُرُ مَسٰجِدَ اللهِ مَنْ اٰمَنَ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ وَ اَقَامَ الصَّلٰوةَ وَ اٰتَی الزَّكٰوةَ وَ لَمْ یَخْشَ اِلَّا اللهَ فَعَسٰۤی اُولٰٓىِٕكَ اَنْ یَّكُوْنُوْا مِنَ الْمُهْتَدِیْنَ.
আল্লাহর মসজিদসমূহ তো আবাদ করে তারাই, যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছে এবং নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। এরূপ লোকদের সম্পর্কেই আশা আছে যে, তারা সঠিক পথ অবলম্বনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। –সূরা তাওবা (০৯) : ১৮
অপরদিকে মসজিদ বিরানে অপচেষ্টাকারীকে সর্বাধিক জালেম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
وَمَنْ اَظْلَمُ مِمَّنْ مَّنَعَ مَسٰجِدَ اللّٰهِ اَنْ یُّذْكَرَ فِیْهَا اسْمُهٗ وَسَعٰی فِیْ خَرَابِهَا اُولٰٓىِٕكَ مَا كَانَ لَهُمْ اَنْ یَّدْخُلُوْهَاۤ اِلَّا خَآىِٕفِیْنَ لَهُمْ فِی الدُّنْیَا خِزْیٌ وَّ لَهُمْ فِی الْاٰخِرَةِ عَذَابٌ عَظِیْمٌ.
সেই ব্যক্তির চেয়ে বড় জালেম আর কে আছে, যে আল্লাহর মসজিদসমূহে আল্লাহর নাম নিতে বাধা প্রদান করে এবং তাকে বিরান করার চেষ্টা করে? এরূপ লোকের তো ভীত-বিহ্বল না হয়ে তাতে প্রবেশ করাই সংগত নয়। তাদের জন্য দুনিয়ায় রয়েছে লাঞ্ছনা এবং আখেরাতে রয়েছে মহা শাস্তি। –সূরা বাকারা (০২) : ১১৪
হিজরী সপ্তম শতাব্দীর প্রখ্যাত তাফসীরবিদ ইমাম কুরতুবী রাহ. উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন–
وعلى الجملة فتعطيل المساجد عن الصلاة وإظهار شعائر الإسلام فيها خراب لها. ... ولذلك قلنا: لا يجوز نقض المسجد ولا بيعه ولا تعطيله وإن خربت المحلة.
সারকথা হল, মসজিদসমূহে নামায আদায় ও ইসলামের নিদর্শনাবলি প্রকাশে বিঘ্ন সৃষ্টি করা মসজিদ বিরান করার নামান্তর। এ কারণেই আমরা বলি, মহল্লা বিরান হয়ে গেলেও মসজিদ ভেঙে ফেলা, বিক্রি করা বা তা বন্ধ করে দেওয়া– কোনোটিই জায়েয নয়। (তাফসীরে কুরতুবী ২/৭৭)
আরো দ্রষ্টব্য : আলহিদায়া ইলা বুলূগিননিহায়া, মাক্কী ইবনে আবী তালিব ১/২৭৫
ইমাম আবু ইউসুফ রাহ. (১৮২হি.) বলেন–
مسجد باد أهله، وعطلت الصلوات فيه، لم يجز لأحد أن يهدمه، ولا يتخذه منزلا، ولا يسعه ذلك.
কোনো মসজিদ যদি আবাদিশূন্য হয়ে পড়ে, ফলে উক্ত মসজিদে নামায আদায় না হয়, তথাপি কারো জন্যই উক্ত মসজিদ ভেঙে ফেলা, তাকে ঘর বানিয়ে নেওয়া– কোনো কিছুই জায়েয নয়। (আলআজনাস, নাতিফী ১/৫৪৭)
সুতরাং সরকারি কর্তৃপক্ষের উক্ত সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা কর্তব্য। এক্ষেত্রে তাদের কর্তব্য হল, সুবিধাজনক অন্য দিক দিয়ে রাস্তা বের করা। আর প্রশ্নের বক্তব্য অনুযায়ী প্রস্তাবিত রাস্তাটি নির্মাণের জন্য অন্য দিক দিয়ে যেহেতু জায়গা প্রস্তুত রয়েছে, তাই তা কঠিন কিছু বিষয়ও নয়। কিন্তু তা না করে স ও জ কর্তৃপক্ষ যদি মসজিদ ভেঙে দিয়ে সেখানে রাস্তা নির্মাণে উদ্যোগী হয়, তবে একে তো তা হবে আল্লাহর ঘরের সাথে চরম জুলুম ও অন্যায় আচরণ, অপরদিকে এ নিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সাথে বিবাদে জড়াবার এবং খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সমূহ আশঙ্কা প্রবল। তাই ধর্মীয় ও সামাজিক সকল বিবেচনায়ই স ও জ কর্তৃপক্ষের উক্ত পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকা কর্তব্য।
উল্লেখ্য, এমন হারাম কাজের বৈধতার জন্য জনৈক ব্যক্তি উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর দিকে সম্বন্ধকৃত একটি ঘটনা উল্লেখ করেছে। তা হল, তিনি নাকি কূফার একটি মসজিদকে বিশেষ এক কারণে স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এ বর্ণনাটি সূত্র বিচ্ছিন্ন। যা হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি অনুসারে প্রমাণযোগ্য নয়।
ইমাম ইবনে কাছীর রাহ. ‘আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে উক্ত ঘটনা উল্লেখপূর্বক বর্ণনাটিকে সূত্র বিচ্ছিন্ন বলেছেন। প্রখ্যাত হাদীসবিদ ইমাম নুরুদ্দীন হাইসামী রাহ.-ও এমনটিই বলেছেন।
দেখুন : আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ৯/৫১১; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৬/৪২৪
আরো উল্লেখ্য, জনগণের সুবিধার্থে রাস্তাঘাট নির্মাণ, গণমুখী বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সরকারের দায়িত্ব। এসবের জন্য প্ল্যান-পরিকল্পনা অত্যন্ত সুচিন্তিত হওয়া দরকার। এসব ক্ষেত্রে মসজিদ-মাদরাসা, ওয়াকফিয়া কবরস্তান যেন সুরক্ষিত থাকে, তা প্রকল্পের নকশা তৈরির সময়ই মাথায় রাখা কর্তব্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এদেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে উক্ত বিষয়গুলোকে অবহেলা করা হয়ে থাকে। যার দরুন মাঝে মাঝেই বিভিন্ন অঞ্চলে সরকার ও সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে বিবাদ ও পরস্পর বিরোধী অবস্থান তৈরি হয়। যা কারো জন্যই কাম্য নয়।
* >الأجناس< للناطفي ১/৫৪৯: وفي >نوادر هشام< : سألت محمدا عن ...، ولو كان مسجدا في محلة ضاق بأهله، لا يقدرون أن يزيدوا فيه، فسـألهم بعض الجيران أن يجعلوا ذلك المسجد له يدخله داره، ويعطيهم مكانه عوضا من داره ما هو خير منه، ويسع فيه أهل المحلة، قال: لا يسعهم ذلك.
* >خزانة الأكمل< ৩/৭৯০: أرض متصلة بالمسجد وبالطريق، شهدا أنها من المسجد، وشهد آخران أنها من الطريق، فالمسجد أولى؛ فإنه أخص، فإنه يتخذ الطريق مسجدا، وبالعكس لم يجز.
* رد المحتار ৪/৩৭৮-৩৭৯ : لكن كلام المتون في جعل شيء منه طريقا، وأما جعل كل المسجد طريقا، فالظاهر أنه لا يجوز قولا واحدا. ... بخلاف جعل المسجد طريقا؛ لأن المسجد لا يخرج عن المسجدية أبدا.
–আলমু‘জামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১৩২১৯; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ২/৪২; আলমুহীতুল বুরহানী ৯/১২৫; আলহাবিল কুদসী ১/৪৫৮; হাশিয়াতুত তাহতাবী আলাদ্দুর ২/৫৪৩; মাজমূউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া ২২/১৯৩