রবিউল আখির ১৪৪২ || ডিসেম্বর ২০২০

মুহাম্মাদ নুমান খান - ঢাকা

৫২৬৬. প্রশ্ন

আমি মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করি। আমাদের কলেজের অনেক স্টুডেন্ট মাঝেমধ্যে পরীক্ষার সময় এভাবে মান্নত করে যে, আমি যদি এ পরীক্ষায় পাস করি বা ফার্স্ট ক্লাসে উত্তীর্ণ হই তাহলে এত টাকা আল্লাহ্র রাস্তায় দান করব, কিংবা এতদিন রোযা রাখব। কেউ কেউ আবার কাক্সিক্ষত ফলাফলে উত্তীর্ণ হওয়ার পর মান্নত করে যে, আমি শুকরিয়া আদায়ের জন্য দুই রাকাত নামায বা একদিনের রোযা রাখব। ইদানীং কিছু ছাত্র বলাবলি শুরু করেছে যে, মান্নত করা ঠিক নয়। হাদীসে মান্নত করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। মান্নতের দ্বারা বাস্তবে কোনো উপকার হয় না; বরং এটা গুনাহের কাজ। প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবে এ ধরনের কোনো হাদীস আছে কি না? থাকলে সেটা কোন্ কিতাবের হাদীস এবং হাদীসটি সহীহ কি না? হাদীসের অর্থ কি সেটাই, যেটা তারা বলছে যে, মান্নত করা গোনাহ? বিষয়গুলোর উত্তর জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর

মান্নত করার অর্থ হচ্ছে- ওয়াজিব নয় এমন কোনো নেক কাজকে নিজের উপর ওয়াজিব করে নেওয়া। এটা দুভাবে হতে পারে।

১. কোনো ধরনের শর্ত ছাড়া এভাবে মান্নত করা যে, আমি দুই রাকাত নামায পড়ার মান্নত করছি বা কিছু টাকা সদকা করার মান্নত করছি। এ ধরনের মান্নত করা জায়েয। এতে অসুবিধা নেই।

২. শর্তযুক্ত মান্নত করা। এভাবে যে, আমি যদি পরীক্ষায় পাশ করি তাহলে এত টাকা সদকা করব। অথবা আমার ছেলে যদি সুস্থ হয়ে যায় তাহলে দুই দিন রোযা রাখব।

মান্নতের এই দ্বিতীয় প্রকারের প্রতি হাদীসে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত হাদীস সহীহ বুখারী-মুসলিমসহ হাদীসের অনেক কিতাবাদীতে বিশুদ্ধ সনদে একাধিক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-

نَهَى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ النَّذْرِ، وَقَالَ: إِنَّهُ لاَ يَرُدُّ شَيْئًا، وَإِنَّمَا يُسْتَخْرَجُ بِهِ مِنَ البَخِيلِ.

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মান্নত করা থেকে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন যে, মান্নত কোনো কিছু ফিরিয়ে দিতে পারে না। মান্নত দ্বারা কেবল কৃপণদের থেকে কিছু সম্পদ বের করে নিয়ে আসা হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬০৮)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِنَّ النَّذْرَ لَا يُقَرِّبُ مِنِ ابْنِ آدَمَ شَيْئًا لَمْ يَكُنِ اللهُ قَدَّرَهُ لَهُ، وَلَكِنِ النَّذْرُ يُوَافِقُ الْقَدَرَ، فَيُخْرَجُ بِذَلِكَ مِنَ الْبَخِيلِ مَا لَمْ يَكُنِ الْبَخِيلُ يُرِيدُ أَنْ يُخْرِجَ.

আল্লাহ তাআলা বনী আদমের জন্য যা নির্ধারণ করে রাখেননি তারা তা মান্নত করার মাধ্যমে নিয়ে আসতে পারবে না। তবে  কখনো কখনো মান্নত তাকদীরের মোতাবেক হয় এবং এর দ্বারা কৃপণ লোকদের থেকে এমন সম্পদ বের করে নিয়ে আসা হয়, যা সে বের করতে চায়নি। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৪০)

উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসীনে কেরাম দুটি কথা বলেছেন-

এক. এ বিশ্বাসের সাথে মান্নত করা নিষেধ যে, মান্নত তাকদীর পরিবর্তন করে দেয়।

দুই. ইবাদতের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অন্য কাজের সাথে শর্তযুক্ত করা যে, যদি আমার এ কাজ পূর্ণ হয়ে যায় তাহলে আমি এত টাকা সদকা করব- কোনো ইবাদতকে এভাবে শর্তযুক্ত করা প্রশংসনীয় কাজ নয়; বরং তা অপছন্দনীয় ও অসুন্দর পদ্ধতি।

বিপদ-মসিবত থেকে মুক্তি বা কোনো প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে মাসনূন পদ্ধতি হচ্ছে, বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকা। শর্তহীন নফল নামায ও দান সদকা করে আল্লাহ তাআলার নিকট কাকুতি-মিনতি সহকারে দুআ করা। নফল নামায ও দান-সদকা করার বিষয়টিকে অন্য কোনো কাজের সাথে শর্তযুক্ত করবে না; বরং বিপদের সময় তাৎক্ষণিক সামর্থ্যানুযায়ী এসব কাজ করবে। বিপদ-মসিবত থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে অধিক উপকারী।

অবশ্য মান্নত করার এ দ্বিতীয় পদ্ধতিটি অপছন্দনীয় হলেও তা গোনাহ নয়। কেউ এমনটি করলে সে গোনাহগার হবে না। ইমাম তহাবী রাহ. বলেন-

ولم يكن نهيه عنه لأنه معصية.

অর্থাৎ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মান্নত করতে যে নিষধ করেছেন এটা এ কারণে নয় যে, মান্নত করা গুনাহের কাজ। (শরহু মাআনিল আছার ২/৩০৭)

প্রকাশ থাকে, হাদীসের উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞাটি হচ্ছে, মান্নত করা প্রসঙ্গে তথা মান্নত করা উচিত কি না- এ বিষয়ে। কিন্তু কেউ মান্নত করে ফেললে তার জন্য সেটা পূর্ণ করা ওয়াজিব হয়ে যায়। কুরআন-হাদীসে মান্নত পূর্ণ করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদের الْأَبْرَار (নেককারদের) সিফাতের বর্ণনায় ইরশাদ হয়েছে-

یُوْفُوْنَ بِالنَّذْرِ.

অর্থাৎ তারা মান্নত করার পর তা পূর্ণ করে। [সূরা দাহ্র (৭৬) :৭]

সহীহ বুখারীর এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ نَذَرَ أَنْ يُطِيعَ اللهَ فَلْيُطِعْهُ.

অর্থাৎ কেউ যদি আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের মান্নত করে তাহলে সে যেন তা করে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬৯৬)

লক্ষণীয় যে, হাদীসে যে মান্নত পূর্ণ করার কথা এসেছে তা হচ্ছে ভালো কাজের মান্নত; কোনো গুনাহের কাজের মান্নত নয়। গুনাহের কাজের মান্নত করা হারাম। এবং তা পূর্ণ করাও জায়েয নয়। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

وَمَنْ نَذَرَ أَنْ يَعْصِيَهُ فَلاَ يَعْصِهِ.

আর যে কোনো গুনাহের মান্নত করল সে যেন গুনাহের কাজটি না করে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬৯৬)

-শরহু মাআনিল আছার তহাবী ২/৩০৭; ফাতহুল বারী ১১/৫৮৭; মিরকাতুল মাফাতীহ ৬/৫৪৩; বযলুল মাজহুদ ১৪/২৪৬

এই সংখ্যার অন্যান্য প্রশ্ন-উত্তর পড়ুন