যিলহজ্ব ১৪৪১ || আগস্ট ২০২০

মুহাম্মাদ আবুল কাসেম - পাঁচকাহনীয়া, কিশোরগঞ্জ

৫১৬৩. প্রশ্ন

মুহতারাম, বিনীত নিবেদন এই যে, আমাদের এলাকায় খাস বা সরকারি অনেক নদী-নালা, খাল-বিল আছে। এর চারপাশে মালিকানাধীন ফসলী জমি। বর্ষাকালে বর্ষার পানিতে প্লাবিত হয়ে যায়। নদী-নালা, খাল-বিলগুলো দুই পদ্ধতিতে ভোগ করা হয় :

১. কিছু নদী-নালা, খাল-বিল সরকার থেকে নিয়ম মুআফেক লিজ নেওয়া হয়।

২. কিছু এলাকার গণ্যমান্য সরকারি স্থানীয় প্রতিনিধি উপজেলা চেয়াম্যান-এর সম্মতিতে মসজিদ-মাদরাসার নামে লিজ দেওয়া হয়। আমার জানামতে যা সরকারি আইন পরিপন্থী। এর থেকে যে টাকা অর্জিত হয় তা মসজিদ-মাদরাসার উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করা হয়। লিজ দেওয়া ও নেওয়ার কারণে গরীব-গোরাবা ও সাধারণ মানুষ বর্ষার পানির মুক্ত মাছ ধরা থেকে বঞ্চিত হয়।

উল্লেখ্য, নদী-নালা, খাল-বিলে মাছ আসা এবং থাকার জন্য ইজারাদারগণ বাঁশ, গাছের ডাল এবং খাবার ইত্যাদি দিয়ে থাকেন।

এখন জানার বিষয় হল :

১। লিজ দেওয়া-নেওয়া শরীয়তসম্মত কি না? থাকলে এর পদ্ধতি কী?

২। বিবরণে উল্লিখিত উভয় পদ্ধতিতে লিজ দেওয়া-নেওয়া  বৈধ হচ্ছে কি না?

৩। উক্ত লিজের টাকা দিয়ে মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, ইমাম, মুআযযিন, খাদেম, শিক্ষকগণের বেতন ও প্রতিষ্ঠানের অন্য কোনো কাজে ব্যয় করা বৈধ হবে কি না? না হলে এর বৈধতার উপায় কী?

৪। লিজের মাধ্যমে অর্জিত মসজিদের টাকা কেউ যদি মসজিদ কমিটি থেকে এই বলে নিয়ে যায় যে, মসজিদের নামে খাল-বিলের  লিজের কাগজ-পত্র সরকার থেকে ব্যবস্থা করে দেবে। অতঃপর  সে নিজেই তা আত্মসাৎ করে, তবে এর জন্য দায়ী কে- মসজিদ কমিটি, না গ্রহিতা?

৫। মুক্ত পানির মাছ ধরতে ইজারাদাগরণ সাধারণ মানুষকে বাধা দেওয়ার অধিকার রাখে কি না?

৬। মালিকানাধীন জমি ইজারাদারগণ ব্যবহারের অধিকার রাখে কি না? রাখলে এর সীমা কতটুকু?

৭। সরকার থেকে সল্পমূল্যে লিজে এনে  বেশি মূল্যে সাধারণ মানুষের নিকট লিজে দেওয়া শরীয়তসম্মত কি না? থাকলে এর শর্ত কী?

৮। এলাকার কিছু প্রভাবশালী লোক দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে হাওড়ের অপরের মালিকানাধীন কিছু জমি বর্ষাকালে মুক্ত মাছ ধরার জন্য লিজ দিয়ে ভোগ করে আসছে। শরীয়তে এর বৈধতা আছে কি না? থাকলে এর পদ্ধতি কী?

অতএব, মুফতী সাহেবের নিকট আকুল আবেদন এই যে, উল্লিখিত প্রশ্নাবলীর উত্তর প্রদান করে কৃতজ্ঞ করবেন।

উত্তর

১. লিজ বা ইজারা শরীয়ত স্বীকৃত বৈধ একটি কারবার। এর বিধি-বিধান সুবিস্তৃত। ব্যক্তি নিজ মালিকানাধীন জায়গা এবং সরকার রাষ্ট্রের মালিকানাধীন ভমি লিজ দিতে পারে। -আলমাবসূত, সারাখসী ১৫/৭৪; আলইখতিয়ার ২/১২১

২. ও ৫. নদী থেকে উপকার গ্রহণের অধিকার সকলের। তাই ইসলামে নদী লিজ দেওয়ার বিধান নেই। আর সরকারী আইনেও নদী লিজ দেওয়া নিষিদ্ধ।

আর ব্যক্তি মালিকানাহীন সরকারি বিলও জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখাই উচিত। বিশেষত যেসব খাল-বিলের সঙ্গে সাধারণ জনগণের স্বার্থ জড়িত, সেগুলো কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দিয়ে দেওয়ার অবকাশ ইসলামে নেই। অবশ্য যদি কোনো খাল-বিল ছোটখাটো হয় এবং তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লিজ দিলে বড় জনগোষ্ঠীর কষ্টে পড়ার আশংকা না থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে সরকার, দেশ ও জনগণের কল্যাণে এগুলো লিজ দেওয়ার অধিকার রাখে। এভাবে বিধি মোতাবেক লিজ নেওয়ার পর সেখানে মাছ চাষ করার জন্য ইজারাদাররা ব্যবস্থা নিলে অন্যদের জন্য ওই জায়গা থেকে মাছ ধরা বৈধ হবে না।

আর সরকার কিংবা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়া যেহেতু অন্য কেউ এসব খাস খাল-বিল লিজ দেওয়ার অধিকার রাখে না, তাই প্রশ্নের বর্ণনা মতে এলাকার সেসব লোক থেকে সেগুলো লিজ বা ভাড়া নেওয়া বৈধ হবে না। নিলে অন্যায়ভাবে সরকারি সম্পদ ভোগ করা হবে। মসজিদ-মাদরাসার লিজ নেওয়ার প্রয়োজন হলে বৈধ পন্থায় সরকার থেকে লিজ নেবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩০৮২; কিতাবুল আছল ৮/১৫২; আলমাবসূত, সারাখসী ২৩/১৬৩; আননুতাফ ফিল ফাতাওয়া পৃ. ৩৮২; আলমুহীতুল বুরহানী ৮/১২০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩৭০, ৩৯০

৩. ও ৪. প্রশ্নকারীর মৌখিক বর্ণনা অনুযায়ী মসজিদ কর্তৃপক্ষ প্রথমত এলাকার সেসব লোকের (অননুমোদিত ব্যক্তিবর্গ) অনুমতি নিয়ে এসব খাস খাল-বিলের অংশবিশেষ দখল করে। এরপর তা অন্যের কাছে ইজারা দেয়। এমনটি হয়ে থাকলে এ ভাড়ার টাকা সম্পূর্ণ হারাম। এ টাকা মসজিদ-মাদরাসায় ব্যয় করা যাবে না। এগুলো গরীবদের সদকা করে দিতে হবে। অতএব প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে মসজিদের এ টাকাগুলো যদি লিজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে কেউ আত্মসাত করে থাকে, তাহলে কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হল তা উদ্ধার করে এর দায় থেকে মুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৬. ইজারাদাররা যতটুকু জমি যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে বৈধ পন্থায় ভাড়া নিয়েছে/নেবে ততটুকু জমি ব্যবহার করতে পারবে। অন্যের মালিকানাধীন জমি ব্যবহার করার অধিকার তাদের নেই।

৭. এ ধরনের লিজ সাধারণত হস্তান্তর নিষিদ্ধ থাকে। তাই নিজে গ্রহণের পর তা অন্য কাউকে দেওয়ার অবকাশ নেই।

৮. না, শরীয়তে এই জবরদখলের বৈধতা নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ أَخَذَ شَيْئًا مِنَ الأَرْضِ بِغَيْرِ حَقِّهِ خُسِفَ بِهِ يَوْمَ القِيَامَةِ إِلَى سَبْعِ أَرَضِينَ.

যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কারো সামান্য জমিও দখল করবে, কেয়ামতের দিন তাকে (শাস্তিস্বরূপ) সাত জমিন পর্যন্ত ধ্বসিয়ে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৩১৯৬)

এই সংখ্যার অন্যান্য প্রশ্ন-উত্তর পড়ুন