জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৬ || এপ্রিল ২০১৫

নূরুল হক বিন নূরুল ইসলাম - ওলামা বাজার,সোনাগাজী,ফেনী

প্রশ্ন

আশা করি ভাল আছেন। আর ভাল থাকাটাই কামনা করি এবং দুআ করি আল্লাহ যেন হযরতকে ভাল রাখেন,আমীন।

নিম্নের সমস্যাগুলোর সমাধান চাই। আশা করি দলিলসহ সমাধান পাবো।

(ক) ছাত্র জীবনে ছাত্রদের জন্য পত্রিকা পড়া কেমনযদি ভাল না হয় তাহলে কেন?

(খ) মাসিক আলকাউসারকে অন্যান্য পত্রিকার মত ধরা হবে কি না?

(গ) শেখ সাদী রাহ.-এর লিখিত কিতাবগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকুযদি বলেন নাইতবে তাঁর লিখিত কিতাবগুলোর মধ্য থেকে গুলিস্তাঁ ও বোস্তাঁ কওমী পাঠ্য সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত কেনআর যদি বলেন আছে তাহলে তাঁর লিখিত বোস্তাঁ নামক কিতাবের দিবাচার ১৮ নং শেরটি সম্পর্কে আপনার মতামত কীকেননা আলকাউসার ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসের সংখ্যার প্রচলিত ভুল পাতায় বলা হয়েছে যে কোহে কাফ-এর মোরগ তো দূরের কথা কোহে কাফের কোনো অস্তিত্ব নাই।

উল্লেখ্যবোস্তাঁ নামক কিতাবের দিবাচার ১৮ নং শেরটি হল,

چناں پہن خواںکرم گسترد

کہ سیمرغ درقاف قسمت خورد

উত্তর

উত্তর : (ক) একজন তালিবে ইলমকে সবধরনের ব্যস্ততা ও প্রতিবন্ধকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে একাগ্রতার সাথে ইলম চর্চায় নিজেকে ওয়াকফ করে দিতে হয়। এছাড়া দ্বীনের সঠিক বুঝ ও ইলমের দৃঢ়তা অর্জনের আশা করা যায় না। ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, তেলাওয়াত এবং কিছু নাওয়াফেল ও আওরাদ আদায়ের পর দরস, মুতালাআ ও তামরীন এসব ইলমী কাজে সবসময় মশগুল থাকতে হয়। এছাড়া প্রয়োজনীয় ইযাফী মুতালাআও জারি রাখতে হয়।

এসব ইলমী কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন। মনোযোগ ও আত্মনিবেদনের প্রয়োজন। এরপর আবার পত্র-পত্রিকা দেখার সুযোগ হবে কীভাবে? সংবাদপত্র দেখার অভ্যাস তো তার ইলমী নিমগ্নতা ও অভিনিবেশকে বিঘ্নিত করবে। অধিকন্তু সংবাদপত্র পাঠ তালিবে ইলমের প্রয়োজনের আওতায় আসে না। এসব কারণে ছাত্রজীবনে তালিবে ইলমকে প্রচলিত সংবাদপত্র দেখতে আকাবির সবসময় নিষেধ করেছেন।

এরপর কর্মজীবনে যখন কারও পত্র-পত্রিকা দেখার প্রয়োজন হবে তখন যথাযথ উসূল ও আদব রক্ষা করেই পত্রিকা দেখা উচিত। কারণ প্রচলিত সংবাদপত্র তো শরয়ী উসূল অনুসরণ করে ছাপা হয় না এবং এতে পরিবেশিত সবকিছু প্রয়োজনের আওতায় পড়ে না।

(খ) মাসিক আলকাউসার একটি দ্বীনী এবং ইলমী পত্রিকা। এতে তালিবে ইলমদের খোরাক রয়েছে। এটা তালিবে ইলমদের জন্য ইযাফী মুতালাআর আওতায় আসতে পারে। তবে ইযাফী মুতালাআর বিষয় তালিমী মুরুব্বীর ইজাযত ও মশওয়ারার মধ্যে থাকা উচিত। আমাদের কাছে বিভিন্ন মাদরাসা থেকে এ ধরনের খবর এসেছে যে, আমরা তালিবে ইলমদেরকে সাধারণ পত্র-পত্রিকা থেকে বারণ করে থাকি। কিন্তু মাসিক আলকাউসারে তালিবে ইলমদের খোরাক রয়েছে। এটি তাদের ইলমী উন্নতির প্রতিবন্ধক নয়; সহায়তাদানকারী। আল্লাহ তাআলা তাঁদের বদ্ধমূল সুধারণা কবুল করুন এবং আমাদের তাওফীক দান করুন।

(গ) শায়খ মুসলিহুদ্দীন সাদী রাহ. (মৃত্যু ৬৯১ হি.)-এর গুলিস্তাঁ-বোস্তাঁ ফার্সি ভাষায় রচিত

 (فن الأخلاق والتصوف وأدب الدنيا و الدين ) বিষয়ের মকবূল ও নির্ভরযোগ্য কিতাব। কোনো কিতাবকে নির্ভরযোগ্য বলার অর্থ হয় কিতাবটি মৌলিকভাবে এবং সমষ্টিগত বিচারে নির্ভরযোগ্য। কোনো একটি গ্রন্থ নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হওয়ার অর্থ কখনই এই হয় না যে, ঐ গ্রন্থে কোনো ইলমী ত্রুটি নেই। "أبى الله العصمة لكتاب غير كتابه" -নীতিটি সর্বজন স্বীকৃত ও সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং কোনো কিতাবের নির্দিষ্ট কোনো বিষয় দলিলসম্মত না হওয়া স্বত্তে¡ও শুধু একারণে গ্রহণ করা যায় না যে, তা কোনো একটি নির্ভরযোগ্য কিতাবে উল্লেখ আছে।

বাকি থাকল বোস্তাঁ-কিতাবে উল্লেখিত পঙ্ক্তিতে বর্ণিত কোহেকাফ ও তার সেমোরগ-এর কথাতো এ বিষয় দুটি যে এখানে হাকীকী ও আক্ষরিক অর্থেই বলা হয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কারণ,  কোহেকাফ সেমোরগ এ দুটি বস্তু ফার্সি-উর্দু ভাষায় রচিত সাহিত্যের কিতাবাদিতে প্রকৃত অর্থে নয় বরং প্রতীকী ও রূপক অর্থে ব্যবহার হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। ফার্সি-উর্দু সাহিত্যে এ দুটি কাল্পনিক বস্তু হিসেবে এবং মুবালাগা ও অতিশয়োক্তি হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। ফার্সির সেমোরগ  তো অনেকের মতেই আরবী সাহিত্যে ব্যবহৃত আনকা পাখিরই সমার্থক। পারসিক কবি আবুল কাসেম ফেরদাউসী (৪১১ হি.) রচিত ইরানী ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাহিত্যের কাব্যগ্রন্থ শাহনামা-এ ইরানে প্রচলিত যেসব রূপকথা ও গল্প-কাহিনী সন্নিবেশিত সেমোরগের গল্প সেসবের অন্যতম। ফার্সী সাহিত্যে এই কাল্পনিক কিংবদন্তীকে রূপক উপমা হিসেবে অনেকেই ব্যবহার করেছেন। যেমন আল্লামা জালালুদ্দীন রূমী রহ. (৬৭২ হি.) মছনবী গ্রন্থে এবং শায়েখ ফরীদুদ্দীন আত্তার রহ. মানতেকুত তইর গ্রন্থে। দ্রষ্টব্য : ফীরুযুল লুগাত (পৃ. ৮২৯)    গীয়াছুল লুগাত: (পৃ. ২৮২) ক্লাসিকী আদব কী ফরহাঙ্গ, রশীদ হাসান খান, পৃ. ৫২০ আঞ্জুমানে তারাক্কী উর্দু (হিন্দ), উর্দু দায়েরায়ে মাআরিফে ইসলামিয়া ১১/৫৩২, ১৬/১/৪৮-৫২, ১৫/২৩৫-২৪১; বোস্তাঁ- উর্দু হাশিয়াসহ কাযী সাজ্জাদ হুসাইন, পৃ. ২; মছনবী- উর্দু তরজমা ও টীকা, কাযী সাজ্জাদ হুসাইন, ১/৩১৫

যাহোক বাস্তবিক অর্থে পৃথিবী পরিবেষ্টনকারী কোহেকাফ এবং তাতে অবস্থিত সেমোরগের কোনো অস্তিত্ব প্রমাণিত নয়। দলিলে নকলী দ্বারাও নয় দলিলে আকলী দ্বারাও নয়। প্রাচীন ইরানে এধরনের অমূলক কিংবদন্তী, প্রচলিত ছিল, কিন্তু তার বাস্তব অস্তিত্ব কখনই প্রমাণিত ছিল না। বরং তা  কেবল কল্পনা-প্রসূত এবং অতিকথন জাতীয়।

কোনো কোনো কিতাবে সূরা কাফ প্রসঙ্গে জাবালে কাফ সংক্রান্ত যেসব রেওয়ায়েত উল্লেখ আছে সেগুলো ভিত্তিহীন ও অবাস্তব, তা অনেক আগেই মুহাদ্দিসীনে কেরাম ও মুহাক্কিক আহলে ইলমগণ বলেছেন। দ্রষ্টব্য : তাফসীরে ইবনে কাছীর, তাফসীরে রুহুল মাআনী- আল ইসরাইলিয়্যাত ওয়াল মাওযূআত ফী কুতুবিত তাফাসীর, ড. মুহাম্মাদ আবু শাহবাহ পৃ. ২৯২-২৯৫

প্রাচীন ভুগোল ও বিশ্ব সৃষ্টিতত্তে¡র আলোচনায় কোনো কোনো কিতাবে জাবালে-কাফ-এর কথা উল্লেখ রযেছে। কিন্তু তার পক্ষে কোনো চাক্ষুস প্রমাণ বা গ্রহণযোগ্য কোনো দলিল পেশ করা হয়নি। সম্ভবত প্রচলিত কিংবদন্তীই তার উৎস। আধুনিক বিজ্ঞান ও ভুগোলতত্তে¡ পৃথিবী পরিবেষ্টনকারী কোহেকাফের কোনো অস্তিত্বই যে প্রমাণিত নয়, তা আর বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। দ্রষ্টব্য : উর্দু দায়েরায়ে মাআরেফে ইসলামিয়া, পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ১৬/১/৪৮-৫২; ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭/৫৭-৬০

উল্লেখ্য, কোনো কোনো কিতাবে জাবালে কাফ নামে উত্তর এশীয় পর্বতমালাকে বুঝানো হয়েছে। বিশেষত ককেশাস পর্বতমালা যা ইরান ও তুরস্ক থেকে উত্তরে কাস্পিয়ান ও কৃষ্ণসাগরের মাঝে আর্মেনিয়ার অঞ্চলে অবস্থিত। এই পর্বতের মাধ্যমে রাশিয়ার এশীয় ও ইউরোপীয় অংশ আলাদা হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার। দেখুন, জামে উর্দু ইনসাইক্লোপিডিয়া (ইন্ডিয়া) ৪/৩৭৯; উর্দু দায়েরায়ে মাআরেফে ইসলামিয়া,পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি, ১৬/১/৪৮-৫২; আলমুনজিদ (কিসমুল আলাম), আল মওসূআতুল আরাবিয়্যাহ আল আলামিয়্যাহ, ১৮/৪২৪

এই ককেশাস পর্বতমালার সাথেও জড়িয়ে আছে নানা ঘটনা,জনশ্রুতি ও রূপকথা।

এই পর্বতমালাই নাকি অলীক ও কাল্পনিক সেমোরগের আবাস- একথা কেউ কেউ বলেছেন। ফার্সি-উর্দু সাহিত্যের গল্প-কাহিনীর বইপত্রে এই ককেশাস পর্বতমালা ও সেখানে অবস্থিত কাল্পনিক সেমোরগের কথা উল্লেখ রয়েছে। এই ককেশাস অঞ্চলই নাকি গল্পের কিংবদন্তী শিরিন-ফরহাদের আবাসভূমি। দ্রষ্টব্য: প্রাগুক্ত কিতাবসমূহ এবং ক্লাসিকী আদব কী ফরহাঙ্গ, পৃ.৫৪০,৫৪১; ফাসানায়ে আজায়েব, রজব আলী বেগ সরওয়ার পৃ. ২৮০

 


এই সংখ্যার অন্যান্য শিক্ষা পরামর্শসমূহ পড়ুন