জুমাদাল উলা ১৪৩০ || মে ২০০৯

মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান - বাগেরহাট, খুলনা

প্রশ্ন

 আলকাউসারের বিগত কয়েক সংখ্যায় মাওলানা আতাউর রহমান খান রাহ.-এর প্রবন্ধ বা বয়ান ছাপা হয়েছে। আমি নিয়মিত তা পড়েছি এবং আল্লাহর শোকর অনেক উপকৃত হয়েছি। তবে এ ব্যাপারে আমার কয়েকটি প্রশ্ন রয়েছে।

১. এ আলোচনা কি হযরতের কোনো বয়ান না প্রবন্ধ? বয়ান হলে তা কোথায় হয়েছিল?

২. আলোচনার শেষ অংশে তিনি তাবলীগ জামাতে চিল্লা লাগানোর জন্য তাগিদ করেছেন। এজন্য ভালো লেগেছে। কিন্তু তাঁর এ কথাটা ভালো লাগেনি যে, এখন তো শায়েখও নেই, মুরীদও নেই। ইসলাহও নেই। কাজেই এখন পথ হল তাবলীগে কিছুটা সময় দিয়ে নিজের ইসলাহ করা। এতে কি এ যুগে সুলূক ও তাযকিয়াকে একেবারে নফী করা হচ্ছে না? আর বাস্তবেই তাবলীগ জামাতের দ্বারা কি সুলূক ও তাযকিয়ার প্রয়োজন পূর্ণ হয়ে যায়? আশা করি বিস্তারিত উত্তর দিয়ে বাধিত করবেন।


উত্তর

(ক) এটি তাঁর একটি দীর্ঘ বয়ান, যা রেকর্ড করা হয়েছিল। সামান্য সংক্ষেপ করে-বলতে গেলে হুবহু-ই ছাপা হয়েছে। গত অক্টোবর ২০০৮ ঈ. সংখ্যায় তাঁর ওফাতের উপর তাঁর ছাহেবযাদার নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। তার ভূমিকাতে আমি লিখেছিলাম তাঁর এই বয়ান মারকাযুদ দাওয়াহ্য় হয়েছিল। আমার অনুরোধে তিনি পুরো বয়ান একই বিষয়ের উপর করেছিলেন। নিজের কথা না বলে তিনি তাঁর আকাবিনেরর কথা বলেছিলেন। বর্তমানে যা খুবই কম।

(খ) এই বক্তব্যটি আপনার কাছে এজন্য ভালো লাগেনি যে, আপনি একে সম্পূর্ণ শাব্দিক অর্থে গ্রহণ করেছিলেন। অথচ এ যুগে তাযকিয়ার প্রয়োজন অস্বীকার করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না কিংবা শুধু চিল্লা লাগানোর দ্বারা তাযকিয়া ও ইসলাহে নফসের কাজ হয়ে যায়, আলাদা মেহনতের প্রয়োজন নেই একথা বলাও উদ্দেশ্য ছিল না। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যদি তাবলীগের চিল্লা উসূল মোতাবেক লাগানো হয় এবং চিল্লার মধ্যে স্বীয় নফসের ফিকির বেশি করা হয় তাহলে ঈমান ও আমলের উন্নতি হয় এবং নফসেরও ইসলাহ হয় কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাযকিয়া ও সুলূকের জন্য ভিন্নভাবে মেহনত করার এবং বুযুর্গদের সোহবত গ্রহণ করার কোনো দরকার নেই।

মনে রাখা দরকার, এ রকম ধারণা ঠিক নয়। তাবলীগ জামাতের মুরুববীদের কর্মপদ্ধতি ও তাঁদের দিকনির্দেশনা দ্বারাও এরকম ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।

হযরত মাওলানা ইলিয়াস দেহলভী রাহ. (১৩০৩-১৩৬৩ হি.) প্রথমে হযরত গাঙ্গুহী রাহ.-এর হাতে বাইয়াত হয়েছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. (১৩৩৯ হি.)-এর পরামর্শে হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রাহ. (১২৬২-১৩৪৫ হি.)-এর হাতে বাইয়াত হয়ে তাঁর তারবিয়াত ও নেগরানিতে থেকে সুলূকের স্তরগুলো অতিক্রম করেন এবং খেলাফত লাভ করেন। (হযরত মাওলানা ইলিয়াস আওর উনকী দ্বীনী দাওয়াত পৃ. ৫৪,৫৭)

দ্বিতীয় হযরতজী মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ কান্ধলভী রাহ. (১৩৩৫-১৩৮৪ হি.) হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর হাতে বাইয়াত হয়েছিলেন এবং তাঁর খলীফা ও ইজাযতপ্রাপ্ত ছিলেন। (সাওয়ানেহে হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ কান্ধলভী রাহ. পৃ. ১৯০-২০৭)

তৃতীয় হযরতজী মাওলানা এনামুল হাসান রাহ. (১৩৩৬-১৪১৫ হি.) ও হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস দেহলভীর হাতে বাইয়াত ছিলেন এবং তিনিও তাঁর ইজাযতপ্রাপ্ত খলীফা ছিলেন। (সাওয়ানেহে হযরতজী ছালিছ খ. ১, পৃ. ২২২-২২৯)

ইতিহাস সাক্ষী যে, তাঁরা দাওয়াতী কাজের শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও তাযকিয়া ও সুলূকের কাজকে গুরুত্ব দিতেন এবং নিজেদের লোকদেরকে এর গুরুত্ব বোঝাতেন।

হযরত দেহলভী রাহ.-এর যুগে তাবলীগী মেহনতের সঙ্গে জড়িত অনেক বুযুর্গই হযরত মাওলানা আবদুল কাদের রায়পুরী রাহ.-এর হাতে বাইয়াত ছিলেন। হযরত দেহলভী রাহ. চিঠির মাধ্যমে তাদেরকে স্ব স্ব ওযীফা ও যিকর আদায় করার তাগিদ দিতেন। স্বয়ং তিনি নিজেও ফুরসত না পাওয়া সত্ত্বেও রায়পুর খানকায় এবং সাহারানপুরের দরসগাহে সময় দিতেন। এর ধারাবাহিকতা পরবর্তী দুই হযরতজীর সময়ও বজায় ছিল।

বাকি রইল একটি প্রশ্ন, অর্থাৎ পূর্বে যেমন আকাবির মুসলিহ ছিলেন এখন তো তেমন নেই, তার উত্তর হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. এভাবে দিয়েছেন যে, হাদীসের উস্তাদদের মধ্যে যেমন এখন বুখারী ও মুসলিম নেই (ফিকহের ক্ষেত্রে আবু হানীফা ও মালিক নেই) তেমনি তাসাওউফের শায়েখদের মধ্যে জুনাইদ ও শিবলীও নেই।

কিন্তু এখনও যে সমস্ত উস্তাদ ও মাশায়েখ আছেন তাদের দ্বারাই প্রয়োজন পূরণ হচ্ছে। যদি তাসাওউফের  ক্ষেত্রে জুনাইদ  ও শিবলী থাকা জরুরি মনে করা হয় তাহলে হাদীসেও তো বুখারী ও মুসলিম থাকা জরুরি মনে করতে হবে। এ রকম হলে তার অর্থ দাঁড়াবে বর্তমানে কোনো ইলমই হাসিল করা যাবে না ...!! (আপবীতী খ. ৬, পৃ. ৪৩৫-৪৩৭; ইফাযাতে ইয়াউমিয়াহ খ. ২, পৃ. ২৩২)

হযরত শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ. আপবীতী-তে আরো লিখেছেন যে, একটি জরুরি বিষয়ে খুবই গুরুত্বের সাথে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আকাবিরের চলে যাওয়ার পর কিংবা কোনো শায়খের ইন্তেকালের পর অনেক লোক পরবর্তী ওয়ালাদের মধ্যে ঐ গুণগুলো দেখতে চায় যেগুলো শায়খের মধ্যে ছিল। অথচ এটা তো স্পষ্ট যে, প্রত্যেক উত্তরসূরীর যোগ্যতা তার পূর্বসূরী থেকে কম হয় (ব্যতিক্রমও হয় যদি আল্লাহ চান) এজন্য যারা আগের বুযুর্গদের সিফাত পরবর্তী বুযুর্গদের মধ্যে দেখতে না পেয়ে তাদের সাহচর্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে, তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদেরকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। 

চাচাজান (হযরতজী দেহলভী) রাহ.-এর পরে অনেক লোক আমার কাছে মৌলবী ইউসুফের ব্যাপারে অভিযোগ করতে লাগল যে, তাঁর মধ্যে তো ঐ গুণগুলো নেই যা হযরত দেহলভী রাহ.-এর মধ্যে ছিল।

আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা ঠিকই বলেছ, কিন্তু হযরত দেহলভীর মধ্যেও হযরত সাহারানপুরী রাহ.-এর গুণাবলি ছিল না। তোমাদের একথা সত্য যে, চাচাজানের মধ্যে যে গুণাবলি ছিল তা মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফের  মধ্যে নেই, কিন্তু তোমরা তার সমসাময়িকদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখবে তার পরবর্তী ওয়ালাদের মধ্যেও ঐ গুণাবলি নেই যেগুলো মৌলবী ইউসুফের মধ্যে আছে।

এখন মাওলানা এনামুল হাসান রা.-এর যুগে বেশি পরিমাণে একথা শুনছি যে, তার মধ্যে মাওলানা ইউসুফ রাহ.-এর গুণাবলি নেই।

তো আমি বলি, আরে দোস্ত! এর পরে যে আসবে তার মধ্যে ঐ গুণাবলিও থাকবে না যা মাওলানা এনামুল হাসানের মধ্যে আছে। যে যায় সে তো ফিরে আসে না। কিন্তু পূর্ববর্তীদের মধ্যে যা ছিল তা বর্তমান ব্যক্তিদের মধ্যে নেই এই ধারণার কারণে বর্তমানদের নিকট থেকে ফায়দা হাসিল করা থেকে বিরত থাকা নিজের ক্ষতি করা ছাড়া আর কিছুই নয়। (আপবীতী খ. ৪, পৃ. ৫-৬) 

এই সংখ্যার অন্যান্য শিক্ষা পরামর্শসমূহ পড়ুন