শাওয়াল ১৪৪৫ || এপ্রিল ২০২৪

তাহসিন - কুষ্টিয়া

৬৪২৯. প্রশ্ন

আমার পিতার প্রায় ৩০ বছর যাবৎ ইউনিলিভার’-এর ডিলারশিপ রয়েছে। তাদের কোম্পানির নিয়মানুযায়ী তাদের প্রদানকৃত বিভিন্ন ব্যানার, পোস্টার, ডেকোরেশন ইত্যাদি বিভিন্ন দোকানে প্রদান করতে হয়। আর এসকল ব্যানার-পোস্টারে মহিলাদের ছবি থাকে। এছাড়াও  তাদের বিভিন্ন অবৈধ ক্যাম্পেইন (ক্লোজ-আপ : কাছে আসার গল্প ইত্যাদি)-এর প্রচার-প্রচারণার কাজেও আমাদের অংশগ্রহণ  করতে হয়। আবার বর্তমানে ইসরাইলের সাথে তাদের সম্পর্ক থাকার কারণে তাদের পণ্য বয়কট করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এমতাবস্থায় তাদের পণ্য বিক্রি করা এবং তাদের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখার হুকুম কী?

যদি তা হারাম হয়, তাহলে বর্তমানে মজুদকৃত পণ্য, এখান থেকে পূর্বে অর্জিত লভ্যাংশ এবং এখানে বিনিয়োগকৃত অর্থ এবং এই লভ্যাংশ দ্বারা ক্রয়কৃত বস্তুসমূহের হুকুম কী হবে?

উত্তর

ইসলামের দৃষ্টিতে মৌলিকভাবে অমুসলিম-কাফেরদের সাথে সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও তাদের বৈধ পণ্য কেনা-বেচা জায়েয আছে। তবে কোনো অমুসলিম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী/কোম্পানির ব্যাপারে যদি জানা যায় যে, তারা ইসলাম, মুসলমান ও ইসলামী শিক্ষা-আদর্শের বিরোধী এজেন্ডা নিয়ে কাজ করে, মুসলমানদের জুলুম-নিপীড়নকারী ব্যক্তি/দেশকে আর্থিক সমর্থন ও সহায়তা করে, তাহলে একজন আত্মমর্যাদাশীল মুসলমানের জন্য এমন গোষ্ঠীর সাথে ব্যবসা করা, তাদের পণ্য কেনা-বেচা করা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকা উচিত। এটা মুমিনের শান ও ঈমানী গায়রতের দাবি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

لَا تَجِدُ قَوْمًا یُّؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ یُوَآدُّوْنَ مَنْ حَآدَّ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ لَوْ كَانُوْۤا اٰبَآءَهُمْ اَوْ اَبْنَآءَهُمْ اَوْ اِخْوَانَهُمْ اَوْ عَشِیْرَتَهُمْ اُولٰٓىِٕكَ كَتَبَ فِیْ قُلُوْبِهِمُ الْاِیْمَانَ وَ اَیَّدَهُمْ بِرُوْحٍ مِّنْهُ  وَ یُدْخِلُهُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَا رَضِیَ اللهُ عَنْهُمْ وَ رَضُوْا عَنْهُ ؕ اُولٰٓىِٕكَ حِزْبُ اللهِ  اَلَاۤ اِنَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ.

আপনি আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী মুমিনদেরকে এমন পাবেন না যে, তারা ওইসব লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত। যদিও ওরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই বা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়। এমন লোকদের অন্তরেই আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন। এবং তাদের সাহায্য করেছেন তার পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা। তিনি তাদের দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত, তারা তাতে অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। শুনে রাখ! আল্লাহর দলই সফলকাম। [সূরা মুজাদালাহ (৫৮) : ২২]

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّمَا یَنْهٰىكُمُ اللهُ عَنِ الَّذِیْنَ قٰتَلُوْكُمْ فِی الدِّیْنِ وَ اَخْرَجُوْكُمْ مِّنْ دِیَارِكُمْ وَ ظٰهَرُوْا عَلٰۤی اِخْرَاجِكُمْ اَنْ تَوَلَّوْهُمْ وَ مَنْ یَّتَوَلَّهُمْ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الظّٰلِمُوْنَ.

আল্লাহ তোমাদেরকে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এবং বের করতে সহযোগিতা করেছে। যারা ওদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তারা যালেম। [সূরা মুমতাহিনা (৬০) : ৯]

দ্বিতীয়ত, কোনো প্রতিষ্ঠানের ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড বা নিজের ব্যবসার অর্জিত মুনাফা দ্বারা ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী কাজে সহায়তা করার বিষয়টি জানার পরও এমন প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসা করা বা তাদের পণ্যের কেনা-বেচা করা- তাদের এসব কাজকে একপ্রকার সহায়তারও শামিল। আর আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ لَا تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَانِ ۪ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ شَدِیْدُ الْعِقَابِ.

আর তোমরা গোনাহের কাজ ও যুলুমে একে অপরকে সাহায্য করো না। আল্লাহকে ভয় করতে থাক, নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। [সূরা মায়িদাহ (৫) : ২]

ফকীহগণ বলেন-

ولا يحل للمسلمين اكتساب سبب تقويتهم على قتال المسلمين.

অর্থাৎ যুদ্ধরত কাফেরদের শক্তিশালী করে- এমন কোনো ক্রিয়ার সাথে যুক্ত হওয়া মুসলমানদের জন্য বৈধ নয়। (শরহুস সিয়ারিল কাবীর, সারাখসী ৪/৮০)

আর যদি ব্যবসা করতে গিয়ে তাদের কোনো ইসলাম-বিরোধী ক্যাম্পেইনের প্রচার-প্রচারণায় নিজেদেরও অংশগ্রহণ করতে হয়, তাহলে এমন কোম্পানির ব্যবসা পরিহারের বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ছেড়ে দেওয়া ঈমানী গায়রতের দাবির পাশাপাশি তা এ গোষ্ঠীগুলোর ইসলাম বিদ্বেষী এসব কর্মকাণ্ডের একপ্রকার প্রতিবাদও বটে। এবং সামর্থ্য অনুযায়ী নিজের জায়গা থেকে নির্যাতিত ও মযলুম মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টারও অংশ এটি। এমন নিয়তে কেউ তা করলে আল্লাহ তাআলার দরবারে সে এসবের প্রতিদান পাবে ইনশাআল্লাহ। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

ذٰلِكَ بِاَنَّهُمْ لَا یُصِیْبُهُمْ ظَمَاٌ وَّ لَا نَصَبٌ وَّ لَا مَخْمَصَةٌ فِیْ سَبِیْلِ اللهِ وَ لَا یَطَـُٔوْنَ مَوْطِئًا یَّغِیْظُ الْكُفَّارَ وَ لَا یَنَالُوْنَ مِنْ عَدُوٍّ نَّیْلًا اِلَّا كُتِبَ لَهُمْ بِهٖ عَمَلٌ صَالِحٌ اِنَّ اللهَ لَا یُضِیْعُ اَجْرَ الْمُحْسِنِیْنَ.

কারণ, (জিহাদকারীদের) আল্লাহর পথে যে পিপাসা, ক্লান্তি, ও ক্ষুধা স্পর্শ করে এবং তারা কাফেরদের ক্রোধ উদ্রেককারী যত পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং তারা শত্রুদের থেকে যা কিছু কেড়ে নেয়- এসবের প্রত্যেকটির বদলে তাদের জন্য নেক আমল লেখা হয়। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করবেন না। [সূরা তাওবাহ (৯) : ১২০]

আয়াতটির ব্যাখ্যায় ইমাম তীবী রাহ. বলেন-

وهو عام في كل ما يسوؤهم، وينكبهم، ويلحق بهم ضرراً.

অর্থাৎ কাফেরদের কষ্ট দেয়, ক্ষতির মুখে ফেলে, দুর্দশা বয়ে আনে- এমন সব কাজ ও পদক্ষেপ এর শামিল। (ফুতুহুল গাইব ৭/৩৯৭)

যুগে যুগে ঈমানদারগণ এ ধরনের ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে এসেছেন এবং এর জন্য সাময়িক ও পার্থিব কোনো কষ্ট হলেও তারা তা হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন। এ সম্পর্কে ইমাম নববী রাহ. বলেন-

جرى للصحابة المهاجرين وغيرهم ومن أشبههم من المؤمنين في جميع الأزمان، فإنهم يقاطعون من حاد الله ورسوله مع حاجتهم في معايشهم إلى الارتفاق بهم، والاعتضاد بمخالطتهم، فآثروا رضى الله تعالى على ذلك.

অর্থাৎ, মুহাজির ও অন্যান্য সাহাবী এবং তাদের অনুরূপ (মজবুত ঈমানের অধিকারী) অন্য মুমিন থেকে প্রতি যুগেই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও বয়কটের ধারা চলে আসছে। অথচ জীবন-জীবিকা নির্বাহে এদের সাথে সহাবস্থান ও নরম আচরণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তাঁরা এর উপর আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সন্তুষ্টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। (শরহে মুসলিম, নববী ৩/২৭)

সুতরাং প্রকাশ্যে ইসলাম বিরোধী তৎপরতায় জড়িত, মুসলিমদের নিপীড়নকারীদের সহায়তাকারী কোম্পানির পণ্য কেনা-বেচা, তাদের সাথে যুক্ত হয়ে ব্যবসা থেকে বিরত থাকা ঈমানী গায়রতের (মূল্যবোধ ও চেতনার) দাবি।

ইতিমধ্যে কেউ এ ধরনের কোনো কোম্পানির ব্যবসার সাথে জড়িত হয়ে থাকলে সেক্ষেত্রেও আল্লাহর উপর ভরসা করতঃ সাহস করে এ ধরনের কোম্পানির ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা চাই। এবং এর পরিবর্তে কোনো ভল ব্যবসা বা ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপে জড়িত নয়- এমন কোনো জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে ব্যবসা করা যেতে পারে। সুবিধাজনক বিকল্প বৈধ ব্যবসা দাঁড় করাতে না পারা বা অন্য কোনো কারণে তাৎক্ষণিকভাবে এ ধরনের ব্যবসা ছেড়ে দেওয়া সম্ভব না হলে যত দ্রুত সময়ে সম্ভব বিকল্প ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করবে। এবং বিকল্প ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে এ ধরনের ব্যবসা থেকে বেরিয়ে আসবে। আল্লাহ তাআলাই একমাত্র তাওফীকদাতা।

অবশ্য এতদিন পর্যন্ত এসব কোম্পানির বৈধ পণ্যের ব্যবসা করে যে মুনাফা গ্রহণ করা হয়েছে তা ভোগ করা জায়েয হবে। সে টাকা বা তা দ্বারা অর্জিত অন্য সম্পদ ভোগ করতে অসুবিধা নেই। অনুরূপ বর্তমানে এসব মজুতকৃত মাল বিক্রি করে এর মূল্য, এমনিভাবে এ ধরনের ব্যবসায় বিনিয়োগকৃত অর্থও ভোগ করা যাবে। তবে ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার সংকল্প করা হলে সামনে থেকে নতুন করে এমন কোনো পণ্য মজুদ বা তাতে অর্থ বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকা উচিত হবে।

-আহকামুল কুরআন, জাস্সাস ২/৫৫৫; তাফসীরুল কাশশাফ ৪/৪৯৭; শরহু মুসলিম, নববী ৩/২৭; শরহুস সিয়ারুল কাবীর ৪/১৮২ ও ১৮৩; বাদায়েউস সানায়ে ৬/৬৫; নিসাবুল ইহতেসাব, পৃ. ২৮৫

এই সংখ্যার অন্যান্য প্রশ্ন-উত্তর পড়ুন