Jumadal Akhirah 1447   ||   December 2025

ড. মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ রাহ.

প্রফেসর খুরশিদ আহমাদ

পাক-ভারত উপমহাদেশের আকাশকে যারা জ্ঞান ও দ্বীনের আলোয় উদ্ভাসিত করেছিলেন, সেই উজ্জ্বল নক্ষত্রসম ব্যক্তিত্বরা একে একে অস্তমিত হয়েছেন!

আল্লামা ইকবাল বিদায় নিয়েছেন, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী চলে গেছেন, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ চলে গেছেন, মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানী চলে গেছেন, সায়্যেদ সুলায়মান নদভী বিদায় নিয়েছেন, মুফতী মুহাম্মাদ শফী চলে গেছেন, মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী ইন্তেকাল করেছেন আর এখন, পূর্ব দিগন্তে উদিত সেই সোনালি ধারার শেষ নক্ষত্র ড. মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ পশ্চিমের বুকে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন

إنا لله وإنا إليه راجعون.

ড. মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ রাহ. ১৩৩৬ হিজরীর ১৬ই মুহাররম, ১৯০৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি হায়দারাবাদ দাক্ষিণাত্য বা হায়দারাবাদ রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন হায়দারাবাদেই (যাকে আসফ রাজ্যও বলা হয়) প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার সব ধাপ অতিক্রম করেন পরবর্তীতে তিনি উসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যা উপমহাদেশের ইতিহাসে উর্দূ ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং উন্নত শিক্ষাগত ঐতিহ্যের কারণে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ এবং এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং সেখানেই অধ্যাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন

দেশ ভাগের কিছু আগে তিনি উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে জার্মানিতে যান এবং বন বিশ্ববিদ্যালয় ((University of Bonn)) থেকে আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে গবেষণাপত্র রচনা করে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন ড. হামীদুল্লাহ রাহ.-এর এই গবেষণাকর্মই পরবর্তীকালে প্রয়োজনীয় সংযোজনসহ তার খ্যাতনামা গ্রন্থ Muslim Conduct of State-এ রূপান্তরিত হয় পরে জার্মানি থেকে তিনি ফ্রান্সে পাড়ি জমান এবং সোর্বন বিশ্ববিদ্যালয় (Sorbonne University) থেকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগে ইসলামী কূটনীতি নিয়ে প্রণীত গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে ‘ডক্টর অব লেটার্স’ ডিগ্রি লাভ করেন

সে সময় হায়দারাবাদ পতনের (১৯৪৮ সালে) বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে এরপর ড. হামীদুল্লাহ প্যারিসেই থেকে যান একবার আমার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আসেফিয়া সরকারের (হায়দরাবাদ দাক্ষিণাত্য ইসলামী সরকারের) পাসপোর্টে ইউরোপ এসেছিলাম এরপর আমার আত্মমর্যাদা সইতে পারেনি যে, আমি ভারতের পাসপোর্ট গ্রহণ করি আমৃত্যু আমি ফরাসি নাগরিকত্বও গ্রহণ করিনি আশ্রয়প্রার্থী হিসেবেই সারা জীবন কাটিয়েছি এবং কেবল সাময়িক ভ্রমণপত্র বা ট্রাভেল ডকুমেন্ট ব্যবহার করে বিশ্বভ্রমণ করেছি, যার শর্ত ছিল ছয় মাসের মধ্যে আমাকে ফ্রান্সে ফিরে আসতে হবে

সত্য কথা হল, তিনি কেবল কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন না, এমন নয়; বরং মানসিক ও বস্তুগত দিক থেকে তিনি এই পৃথিবীর নাগরিকও ছিলেন না তিনি ৭০ বছর কাটিয়েছেন পাসপোর্ট ছাড়াই এবং অবশেষে চলে গেছেন এমন এক জগতে, যেখানে কোনো পার্থিব পাসপোর্টের প্রয়োজন হয় না তবে তার সাথে ছিল ঈমান, সৎকর্ম, জ্ঞান ও গবেষণার ভান্ডার এবং দাওয়াত ও তাবলীগে উৎসর্গকৃত একটি জীবন, যা প্রকৃত মূলধন এবং এটি সব সময় কাজে আসবে

ড. হামীদুল্লাহ পূর্ব ও পশ্চিমের নয়টি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এবং তার মধ্যে চারটি ভাষায় (উর্দূ, ইংরেজি, ফরাসি ও আরবী) সরাসরি লিখতে ও বলতে পারতেন পাঠ ও আলোচনার উচ্চ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন জার্মান, ইতালীয়, ফারসি, তুর্কি ও রুশ ভাষাতেও তিনি প্যারিসের প্রসিদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র Centre National de la Recherche Scientifique -এর সাথে অবসর গ্রহণ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন

জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা, দাওয়াত ও তাবলীগের সাথে এমন এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন যে, দাম্পত্য জীবনের চিন্তারও অবকাশ পাননি ইমাম ইবনে তাইমিয়ার অনুকরণে সংসার জীবন থেকে মুক্ত থেকেছেন এবং রেখে গেছেন শুধু জ্ঞানের উত্তরাধিকার

ইসলামী বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তিনি অধ্যাপনা করেছেন, বিশেষভাবে দীর্ঘ সময় ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন প্রতি বছর তিনি কয়েক মাস সেখানে অতিবাহিত করতেন এছাড়াও তিনি ভাওয়ালপুর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বারোটি বক্তৃতা প্রদান করেন, যা ‘খুতুবাত-এ-ভাওয়ালপুর’ নামে প্রকাশিত হয় এ বক্তৃতাগুলোর সুন্দর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ড. আফজাল ইকবাল, যা The Emergence of Islam শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে

আমার দৃষ্টিতে ড. মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ ছিলেন মুসলমানদের মধ্যে প্রথম এবং শেষ প্রাচ্যবিদ (Orientalist) তাঁকে আমি প্রাচ্যবিদ বলছি এজন্য যে, তিনি গবেষণার পদ্ধতিতে (methodology) এমনই দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, যেমন গ্রিক দর্শনে করেছিলেন ইমাম গাযালী গবেষণা ও রচনার দিক থেকে তিনি প্রাচ্যবিদ ছিলেন, তবে এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি অন্যান্য প্রাচ্যবিদ থেকে আলাদা ছিলেন যে, তাঁর কিবলা সঠিক ছিল তার আসল উৎস ছিল কুরআন ও সুন্নাহ এবং মুসলমানদের নির্ভরযোগ্য আলেমদের রচনাসমূহ প্রকৃত অর্থে ইসলাম যেমন তিনি বিশ্বের সামনে তাকে তেমনই উপস্থাপন করেছেন তবে গবেষণা ও রচনা, অনুসন্ধান ও অনুসন্ধিৎসা, সমালোচনা ও পর্যালোচনার সেইসব পদ্ধতি সফলভাবে ব্যবহার করেছেন, যা প্রাচ্যবিদদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা হয় এভাবেই জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে মুসলমানদের ওপর পাশ্চাত্যের যে ঋণ ছিল, ড. হামীদুল্লাহ তা সকলের পক্ষ থেকে পরিশোধ করে দিয়েছেন এবং পাশাপাশি তিনি সেই কাজও করেছেন, যাকে ইংরেজি প্রবাদে বলা হয় Paying in the same coin (একই মুদ্রায় পরিশোধ করা) আলহামদু লিল্লাহ!

ড. মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ছিলেন খাঁটি মুসলমান তিনি সালাফের দৃষ্টিভঙ্গিকে সততার সাথে আধুনিক ভাষা ও প্রাচ্যবিদ ধাঁচের গবেষণা পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে পুরোপুরি উপস্থাপন করেছেন এক অর্থে বলা যায়, তিনি ইসলামী জ্ঞানচর্চা ও আধুনিক যুগের ছাত্র ও গবেষকদের মাঝে এক সেতুবন্ধন রচনা করেছিলেন

জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে ড. মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহর আগ্রহের পরিধি ছিল অতি বিস্তৃত এবং এই দিক থেকে তাঁর কাজ ছিল Multidimensional বা বহুমাত্রিক তিনি গবেষণার নানান ক্ষেত্রে অসাধারণ কাজ উপস্থাপন করেছেন সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান (Contribution) হল ইসলামী আন্তর্জাতিক আইন (International Law) নিয়ে এই ক্ষেত্রে তিনি শিক্ষিত বোদ্ধা মহলকে স্বীকার করাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা সপ্তদশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য চিন্তাবিদরা নন, বরং মুসলিম ফকীহ ও আলেমগণ

হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রেও তাঁর কাজ ছিল অত্যন্ত মূল্যবান ‘সহীফায়ে হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ’-এর সংকলন ও প্রকাশ তাঁর এক বিশাল কৃতিত্ব, যা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, হাদীসের লিখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগেই এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলেই শুরু হয়ে গিয়েছিল তিনি এর পাণ্ডুলিপি জার্মানির একটি লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করেন এবং যথাযথভাবে সম্পাদনা করে দেখিয়ে দেন যে, প্রথম দিকের সংকলনে লিখিত হাদীস ও পরবর্তী সময়ের সংকলনগুলোতে প্রাপ্ত হাদীসের মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য নেই তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হাদীসের বিশুদ্ধতা প্রমাণে অসামান্য অবদান রেখেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাজনৈতিক জীবন, তাঁর যুদ্ধসমূহ, হিজরতের সফর, চিঠিপত্র এবং দলীল-দস্তাবেজের অনুসন্ধান ও বিন্যাসের ক্ষেত্রেও ড. হামীদুল্লাহ গবেষণা ও রচনার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে

ইসলামী ফিকহের সংকলন এবং বিশেষত ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর কর্মপদ্ধতি নিয়ে তাঁর গবেষণা পথপ্রদর্শকের মর্যাদা রাখে ইসলামী আইন ও রোমান আইনের মধ্যে পার্থক্যও তিনি শক্তিশালী যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন এবং প্রাচ্যবিদদের সেই ধারণার মূলোৎপাটন করেছেন যে, ইসলামী আইন মূলত রোমান আইন থেকে নেওয়া

পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় কুরআন শরীফের অনুবাদ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করাও তাঁর একটি প্রিয় বিষয় ছিল এবং এ বিষয়ে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল মৌলিক ও ভিত্তিপ্রস্তরমূলক তাঁর গবেষণার ধরণ কেবল পাঠ-ভিত্তিক প্রচেষ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের সফর সম্পর্কিত অনুসন্ধানে তিনি স্বয়ং পদব্রজে এবং ঘোড়া ও উটের পিঠে চড়ে সেই পথ অতিক্রম করেছিলেন, যে পথে নবীজী হিজরত করেছেন এভাবে তিনি সেই পথটিকে নির্দিষ্ট করেছিলেন, যা নানা বর্ণনায় অস্পষ্ট ছিল পবিত্র কুরআন ও মুবারক সীরাত শুধু তাঁর জীবনের রূপকারই ছিল না, বরং তাঁর জ্ঞানচর্চার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল

ফরাসি ভাষায় কুরআনে কারীমের অনুবাদ এবং দুই খণ্ডে সীরাত গ্রন্থ প্রণয়ন তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের অন্তর্ভুক্ত সীরাতের বইটির ইংরেজি অনুবাদ ড. সাহেব নিজেই করেছিলেন, যা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কলম শতাধিক প্রবন্ধ ও নিবন্ধ উপহার দিয়েছে, যা জ্ঞানপিপাসুদের তৃষ্ণা নিবারণে সহায়ক হয়েছে নিশ্চিতভাবেই তাঁর ছোট-বড় সব মিলিয়ে গ্রন্থের সংখ্যা ১৫০-এর অধিক

ড. মুহাম্মদ হামীদুল্লাহ্র সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ছাত্র অবস্থায় যখন তিনি পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদকে ইসলামী সংবিধান রচনায় সহায়তা করার জন্য পাকিস্তানে এসেছিলেন মাওলানা সুলায়মান নদভী, মুফতী মুহাম্মাদ শফী এবং মাওলানা জাফর আহমাদ আনসারীর সঙ্গে ‘ইসলামী শিক্ষা পরিষদ’-এর সদস্য ছিলেন এবং পরিষদ ভবনের এক অংশেই তাঁর অফিস ছিল

তাঁর জ্ঞানের ব্যাপকতা ও গাম্ভীর্যের প্রভাবে আমার মনে তাঁর একটি প্রতিচ্ছবি গড়ে উঠেছিল কিন্তু তাঁকে সামনে দেখে যেন হঠাৎ এক ধাক্কা খেলাম আমি তাঁকে পেলাম এক হ্যাংলাপাতলা, সরল স্বভাবের সাদাসিধে মানুষ হিসেবে লম্বা গড়ন, উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ, ছবির মতো মুখ, মাঝারি দৈর্ঘ্যের, কিন্তু এলোমেলো দাড়ি, উজ্জ্বল চোখ এবং এর চেয়েও বড় বিষয় ছিল তাঁর বিনয়, ভদ্রতা ও সরলতা কিন্তু যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করেছিল তা হল, পরিষদ ভবনের অফিসে তিনি পরেছিলেন কুর্তা-পায়জামা আর পায়ে ছিল খড়ম! জানি না আজকের প্রজন্ম এই জিনিসের সঙ্গে পরিচিত কি না আমাদের শৈশবে ওযু করার জন্য কাঠের তৈরি এক ধরনের সরল চটি ব্যবহার করা হত, যাকে খড়ম বলা হত এবং যা সাধারণত গোসলখানায় রাখা হত আমার মনের কোনো কোণে এ কল্পনাও আসেনি যে, কেউ পরিষদ ভবনে খড়ম পায়ে বসে থাকতে পারে

বিস্ময়ের সেই আবেশ কয়েক মুহূর্তেই তাঁর স্নেহ ও মমতাভরা কথার স্রোতে দূর হয়ে গেল; তাঁর গভীর পাণ্ডিত্যের সঙ্গে মিশ্রিত বিনয় হৃদয়ে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেল তিনি ধীরে ধীরে, নরম স্বরে, কিছুটা থেমে থেমে এবং মাথা দোলাতে দোলাতে কথা বলতেন কিন্তু এমনভাবে বলতেন যে তা হৃদয়ের গভীরে গিয়ে গেঁথে যেত

এরপর ডক্টর সাহেব আমাকে হঠাৎ চমকে দিলেন, যখন মাসিক ‘চেরাগে রাহ’-এর ইসলামী আইন সংখ্যা প্রকাশ উপলক্ষ্যে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর তিন পৃষ্ঠার একটি চিঠি এসে পৌঁছল  সেই তিন পৃষ্ঠা ছিল এমন, তার মধ্যে দশ পৃষ্ঠার উপকরণ ঠাঁই পেয়েছিল কারণ, ডক্টর সাহেব হালকা কাগজে ক্ষুদ্র অক্ষরে এমনভাবে লিখতেন যে, সংক্ষিপ্ত পাদটীকা ছাড়া পুরো কাগজ লেখায় ভরপুর থাকত কিন্তু এর চেয়েও বেশি বিস্ময়কর ছিল তাঁর প্রচেষ্টা ও শ্রম ইসলামী আইন সংখ্যাটি দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, উদারভাবে এর প্রশংসাও করেছিলেন, তবে বিনয়ের সঙ্গে লিখেছিলেন যে, আপনাকে কষ্ট থেকে বাঁচাতে দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য মুদ্রণভুলগুলো চিহ্নিত করে দিচ্ছি পাতা ও লাইন নম্বর উল্লেখসহ তিন পৃষ্ঠায় তিনি আমার ও আমার সহকর্মীদের অসতর্কতার ক্ষতিপূরণ করে দিয়েছিলেন ডক্টর সাহেবের সঙ্গে আমার চিঠিপত্রের আদান-প্রদান ছিল চল্লিশ বছর জুড়ে তবে কীভাবে যে এ কথা লিখব, এর অধিকাংশই সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি! শেষ চিঠিটি ছিল আমার সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ Family Life of Islam -এর ফরাসি অনুবাদ নিয়ে তাঁর সংশোধনী ও সমালোচনা সম্বলিত

ডক্টর সাহেব ১৯৪৮ সালে প্যারিসে যে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন, সেটি ছিল এমন একটি ভবনের চতুর্থ তলায়, যেখানে লিফট ছিল না জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্যারিসে অবস্থানকালে তিনি সেখানেই থাকতেন পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে, এমনকি রান্নাঘর পর্যন্ত বইয়ে ভর্তি ছিল, আর এটিই ছিল তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ জীবনযাপন ছিল এতটাই সাধারণ যে, অল্প কয়েক জোড়া কাপড় আর অল্প কিছু বাসনপত্র ছাড়া তাঁর ঘরে আর কিছুই ছিল না খাদ্যের ব্যাপারেও ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক হালাল গোশত না পাওয়ায় ছাত্রজীবনেই গোশত ত্যাগ করেছিলেন সবজি ও পনির খেয়েই দিন কাটাতেন কিন্তু যখন সন্দেহ হল যে, পনিরেও পশুর অন্ত্রের চর্বি ব্যবহৃত হয়, তখন সেটিও বর্জন করলেন জ্ঞান ও ধার্মিকতায়, সংযম ও সরলতায় তিনি ছিলেন পূর্বসূরিদের দৃষ্টান্ত

আমি ডক্টর সাহেবের সঙ্গে বহু ইলমী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি তবে সবচেয়ে স্মরণীয় ছিল সেই তরবিয়তী ক্যাম্প, যা ফ্রান্সের এক গ্রামীণ অঞ্চলে ফ্রান্সের মুসলিম ছাত্রসংগঠন (UMSO) -এর উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল, যেখানে আমরা পাঁচ দিন-রাত একসঙ্গে কাটিয়েছিলাম ডক্টর সাহেবও সাধারণ ছাত্রদের মতো মাটিতে শুতেন এবং নিজের বাসন নিজ হাতে ধুতেন আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয় ছিল, তিনি আন্তরিকতার সাথে আমার বক্তৃতাগুলো ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন আল্লাহ তাঁকে উত্তম প্রতিদান দিন

সময়ানুবর্তিতার দিক থেকেও ডক্টর সাহেব ছিলেন এক অনন্য উদাহরণ এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ বেমানান হবে না এ ঘটনার বর্ণনাকারী ছিলেন ডক্টর সাহেবের দীর্ঘদিনের সঙ্গী এবং আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু আহমাদ আব্দুল্লাহ মাসদুসী (রহিমাহুল্লাহ) তিনি বলেন, হায়দারাবাদের যুবক হামীদুল্লাহ তার পুরো ছাত্রজীবনে মাত্র একবার ক্লাসে দেরি করে পৌঁছেছিলেন (অনুপস্থিত থাকার প্রশ্নই ওঠে না) সেটি ছিল সেই দিন, যেদিন তার মায়ের ইন্তেকাল হয় দাফন সম্পন্ন করার পর এই যুবক সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাসে অংশ নেন

پیدا کہاں ہیں ایسے پراگندا طبع لوگ

افسوس تم کو میر سے صحبت نہیں رہی

কোথায় আর মিলবে এমন বিরল প্রতিভাধর মানুষ/

আহা, আফসোস! মীরের সোহাগময় সঙ্গ হারালে তুমি

ডক্টর হামীদুল্লাহ শুধু জ্ঞান ও গবেষণার ক্ষেত্রেই নয়, বরং দাওয়াত ও তাবলীগের ময়দানেও নিমগ্ন ছিলেন দীর্ঘ সময় ধরে তিনি প্যারিসের জামে মসজিদে শিক্ষা ও অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ থেকে শুরু করে তাবলীগী সফর, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন সব ক্ষেত্রেই তিনি দাওয়াতের কাজ করে গেছেন ফ্রান্সে তিনি শুধু উত্তর আফ্রিকার মুসলমানদের কেন্দ্রবিন্দুই ছিলেন না, বরং ফরাসি মুসলমানদেরও একটি উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠীও তার চারপাশে গড়ে উঠেছিল ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় তাদেরকে সময় দিতে তিনি অপরিসীম উদার ছিলেন

ডক্টর হামীদুল্লাহ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না শাসকশ্রেণি তাকে নিজেদের নিকটে আনার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তিনি সর্বদা তাদের থেকে দূরেই থেকেছেন বিভিন্ন শিক্ষা ও সাহিত্য সম্মাননার মাধ্যমে তাঁর পিছু নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি সব সময় তা থেকে দূরে ছিলেন আমি জানি, ফয়সাল অ্যাওয়ার্ডে তার নাম উঠেছিল, কিন্তু তিনি অপারগতা প্রকাশ করেছেন পাকিস্তান সরকার তাকে হিজরী অ্যাওয়ার্ড প্রদান করলে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তা গ্রহণ করা পছন্দ করেননি এবং অ্যাওয়ার্ডের অর্থ ইসলামিক ইউনিভার্সিটির জন্য ওয়াক্ফ করে দেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না হয়েও তার ধর্মীয় অনুভূতি ছিল এতটাই জাগ্রত যে, স্বাধীন হায়দারাবাদ দাক্ষিণাত্য থেকে ইউরোপে গমনের পর তিনি আর কখনো দখলকৃত হায়দারাবাদে ফিরে যাননি এমনকি আমি যখন তাকে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন লেস্টার’-এর এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানাই, তখন তিনি দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেনআমি সেই ইংল্যান্ডের মাটিতে পদার্পণ করতে চাই না, যে আমার স্বাধীন দেশকে ভারতের দাসত্বে সঁপে দিয়েছে

তিনি কখনো ব্রিটেনে যাননি

ড. মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ যতদিন শরীর সঙ্গ দিয়েছে ততদিন তিনি লেখালেখি, গবেষণা ও বক্তৃতায় ব্যস্ত ছিলেন কিন্তু যখন অসুস্থতা এমনভাবে ঘিরে ধরল যে, এই কাজ আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তখন তিনি তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয় গ্রন্থাগারকে শিক্ষা ও গবেষণামূলক কাজে দান করে দেন এবং আমেরিকায় আত্মীয়দের কাছে চলে যান

আমার কাছে যখন একজন পাকিস্তানী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং সায়্যেদ হোসাইন নাসরের মাধ্যমে তাঁর এ অবস্থার খবর এল, তখন আমি চেষ্টা করলাম, যেন তিনি পাকিস্তানে চলে আসেন এ ব্যাপারে আমি রাষ্ট্রপতিকে একটি চিঠিও লিখেছিলাম, যার ইতিবাচক উত্তরও পাই কিন্তু ড. হামীদুল্লাহ তাঁর আত্মীয়দের প্রস্তাবকে অগ্রাধিকার দিলেন এবং আমেরিকার ফ্লোরিডায় চলে গেলেন দুঃখের বিষয়, তাঁর জীবনের শেষ সময়ে পাকিস্তান তাঁর খেদমত করার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে

অবশেষে ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে, প্রায় এক শতাব্দী (৯৫ বছর) এই নশ্বর জগতে কাটিয়ে, জ্ঞান ও দাওয়াতের শত শত প্রদীপ জ্বালিয়ে, আল্লাহর এই বান্দা তাঁর রবের কাছে ফিরে গেলেন যাতে তিনি ‘ইবাদুর রহমান’-এর শাশ্বত আবাস লাভ করতে পারেন আল্লাহ তাআলা তাঁর অবদানগুলো কবুল করুন, মানবীয় সীমাবদ্ধতা ও ভুলত্রুটি উপেক্ষা করে তাঁকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ বাগিচায় স্থান দান করুন

آسماں تیری لحد پر شبنم افشانی کرے

আসমান যেন তোমার কবরে শিশির বর্ষণ করে

 

[ফিকর ও নযর, ইসলামাবাদ, ডক্টর মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ সংখ্যা (২০০৩), খণ্ড : ৪০-৪১, পৃ. ২৯-৩৫

ভাষান্তর : মুনশি মুহাম্মাদ মহিউদ্দিন

ঈষৎ সংক্ষেপিত]

 

advertisement