গাজা আজ ধূসর ভূমি
ওয়াসআতুল্লাহ খান
৭ অক্টোবর ২০২৩-এর ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ইসরাইল যখন অভিযান শুরু করেছিল, তখন আমরা বুঝেছিলাম সময়টা কঠিন হবে। কিন্তু কেউ ভাবেনি, এ যুদ্ধটা দুই বছর ধরে চলবে। আর এটি থামাতে বিশ্ব কিছুই করবে না ।
২০১৪ সালে গাজায় ইসরাইলের হামলা ৫১ দিন স্থায়ী হয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল, এ ৫১ দিনই বুঝি ৫১ বছরের সমান। অথচ গত দুই বছরের তুলনায় ২০১৪-এর হামলা ছিল কেবল চোখের এক পলকের মতো।
প্রথমে মনে হয়েছিল, শাহাদা হাসপাতালে মিসাইল হামলায় শত মানুষের মৃত্যু হয়তো প্রতিশোধের আগুন নিভিয়ে দেবে; কিংবা গাজার সবচেয়ে বড় আশশিফা হাসপাতাল ধ্বংস করার পর হয়তো থামবে; অথবা পুরো রাফাহ শহর ধ্বংস হওয়া দেখে হয়তো তাদের রক্তের তৃষ্ণা মিটবে; কিংবা উত্তর গাজা মুছে দেওয়ার পর প্রতিশোধের বাসনা নিস্তেজ হবে। কিন্তু এ বছরের জানুয়ারির সাময়িক যুদ্ধবিরতিও মরীচিকা হয়ে উঠল। ইসরাইল যখন একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ভেঙে খাদ্য অবরোধ জারি করল আর ক্ষুধায় মৃত্যু ও গণহত্যার নতুন অধ্যায় শুরু হল, তখন মনে হল, এ বছরের তুলনায় গত বছরটি যেন সহনীয়ই ছিল।
গত বছর সাত অক্টোবরের প্রথম বার্ষিকীতে আমি খান ইউনুসে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তখন হঠাৎ করে আবার আলমাওয়াসির-এর ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ হিজরত করার সামরিক আদেশ এল। হাজারো মানুষ আবার সব ছেড়ে পথে নামল।
আরেকটি যুদ্ধবিরতির পর আজও আমরা মাওয়াসিরের এক তাঁবুতে অভুক্ত দিন কাটাচ্ছি। গত আট মাসে শুধু ধ্বংস আর মৃত্যুই বাড়েনি; বরং ইসরাইল আমাদের সামনে একের পর এক নতুন ফাঁদ পেতে রেখেছে, যেন আমরা কোন্ ধরনের মৃত্যু বেছে নেব– তা নিজেরাই ঠিক করতে পারি।
২ মার্চ ইসরাইল যখন আমাদের খাদ্য-পানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিল এবং ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর ওপর মুহুর্মুহু বোমা হামলা চালাতে লাগল, তখন মনে করেছিলাম, এটিই হয়তো নিষ্ঠুরতার সর্বোচ্চ সীমা। কিন্তু এবারও ভুল প্রমাণিত হলাম। মূলত খাদ্য অবরোধ ছিল নতুন এক ‘খেলা’র শুরু।
মে মাসে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের মঞ্চে এ খেলাটির মঞ্চস্থ হয়। যেখানে খাবার বিতরণের নামে প্রকৃতপক্ষে ‘হাঙ্গার গেম’ চালানো হয়। ক্ষুধার্ত মানুষের দিকে কয়েক কৌটা খাবার ছুঁড়ে দিয়ে নিজেরা নিরাপদ স্থানে অবস্থান করত। আর বিরক্ত হয়ে মানুষকে টার্গেট বানিয়ে হত্যা করত। এরপর শিকারের নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত তার ছটফট দেখে আপ্লুত হত।
ক্ষুধায় অসংখ্য শিশু মারা যাওয়ার খবর যখন ছড়িয়ে পড়ল, তখন ইসরাইল নতুন আরেকটি খেলা শুরু করল। খাদ্যসহায়তা বোঝাই বাণিজ্যিক ট্রাকগুলোকে গাজায় ঢুকতে দিল। তার ওপর ফল-সবজি সাজিয়ে রাখল। আর বিশ্বকে দেখাল যে, গাজায় কোনো দুর্ভিক্ষ নেই। এখানে ক্ষুধায় মানুষের মৃত্যু শুধু ইসরাইলবিরোধী অপপ্রচারমাত্র। কিন্তু বাস্তবে এসব খাদ্যের দাম এত বেশি ছিল যে, শিশু ও তাদের মায়েরা শুধু দূর থেকে দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিত। তা ছোঁয়ারও ক্ষমতা তাদের ছিল না।
দুই সপ্তাহ আগে গাজা শহর দখলের উদ্দেশ্যে ইসরাইল যখন বড় ধরনের গণহত্যা চালায় তখন অনেক পুরোনো সামরিক যানে বিপুল পরিমাণ বারুদ ভরে বসতবাড়ির নিচে রেখে দিত। এরপর রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে তার বিস্ফোরণ ঘটাত। ফলে এক নিমিষেই মানুষসহ গোটা এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হত।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও নিবন্ধকার টি এস এলিয়ট লেখেন, মানুষ খুব বেশি বাস্তবতা সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আমরা দুই বছর ধরে প্রতিটি মুহূর্তে নরকের অসহ্য বাস্তবতা বয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদের চোখ যতটা গণহত্যা দেখেছে, বাস্তবে তার চেয়েও বেশি ঘটেছে। আমাদের চোখ তা দেখতেও পারেনি।
আমার বন্ধু, তরুণ লেখক মুহাম্মদ হাম্মোসহ তাঁর পরিবারের ২০০ জনকে শহীদ করা হয়েছে। আরও ১১২ জন ক্ষুধার্ত মানুষ, যারা শুধু আটা নেওয়ার জন্য সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছিল, তাঁদের কেউ আর বেঁচে ফেরেনি।
১৮ মার্চের সে দিনটির কথাও হয়তো ইতিহাসে সংরক্ষিত থাকবে, যেদিন ১০০ শিশুসহ এক দিনে চার শ’রও বেশি মানুষ মরদেহে পরিণত হয়েছিল।
আর সে ১৫ জন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর কথা কীভাবে ভুলব, রাফাহর কাছে যাদের অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে এক একজনের মাথায় গুলি করে সবাইকে শহীদ করা হয়েছিল? গাজার বেসামরিক মানুষ আর তথাকথিত সন্ত্রাসীর মাঝে কোনো পার্থক্যই আর রাখা হয়নি। ‘নিরাপদ’ ও ‘অনিরাপদ’ অঞ্চলের ধারণা তো অনেক আগেই অচল হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার-রোগী, সাংবাদিক-সাক্ষী, শিক্ষক-ছাত্র, নারী ও তার গর্ভস্থ শিশু কারোরই জীবন আর রক্ষা পায় না। সবাই এখন তাদের লক্ষ্যবস্তু।
আমি আর আমার পরিবার তো মাত্র নয়বার বাস্তুহারা হয়েছি। এমন হাজারো পরিবার আছে, যাদেরকে গাজার ভেতরে বিশবারেরও বেশি জায়গা বদল করতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা যেখানেই যেতেন সেখানে সূর্যের প্রখরতা ও বাতাসের তীব্রতা থেকে বাঁচার জন্য দুটি চাদর টাঙিয়ে কল্পনার একটি ঘর বানিয়ে নিতেন। গর্ত খুঁড়ে টয়লেট বানাতেন। এরপরই আবার আদেশ আসত– ‘এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাও।’
‘অন্য কোথাও চলে যাও’ কথাটিরও আর কোনো অর্থই বাকি থাকেনি।
আপনাদের কাছে গাজা হয়তো একটি রুক্ষ বালুময় উপকূল। কারণ গাজা সম্পর্কে আপনি এমনটিই শুনেছেন। কখনো দেখেননি। অথচ গাজা শহরে উঁচু উঁচু দালানকোঠা ছিল। ছিল জনবহুল বাজার-ঘাট ও হাসিখুশিভরা বিশ্ববিদ্যালয়। আর ছিল বহু পুরোনো বাড়ি-ঘর, গির্জা, মসজিদ।
গাজার উপকণ্ঠে বায়ত হানুন, বায়ত লাহিয়ায় ছিল কৃষিভূমি ও সবুজে ভরা মাঠ। দক্ষিণের খান ইউনুস ও রাফাহ শহরের চারপাশে ছিল ফলের বাগান আর হাজার হাজার যয়তুন গাছ। জাবালিয়া, বুরেইজ ও খান ইউনুস যেন ছিল ৮০ বছরের পুরোনো ফিলিস্তিনেরই প্রতিচ্ছবি। যেখানে ১৯৪৮ সালের নাকবায় বাস্তুচ্যুত হয়ে হিজরত করে মানুষেরা প্রজন্ম পরম্পরায় অতীতের সাথে নিজেদেরকে এমনভাবে জুড়ে রেখেছিল, যেন এক আয়নার সামনে দাঁড় করানো আরেকটি আয়না।
এখানে এখন জীবনের শুধু একটাই রং আছে। তা হল মাটি মেশানো ধূসর রং। ধ্বংসস্তূপের কোনো রং হয় না। না লাল, সাদা, সবুজ কিংবা নীল। যতদূর চোখ যায় শুধুই ধূসর বিস্তীর্ণ বিরাণ ভূমি।
বিধ্বস্ত দেয়ালের কোনো ফাঁকে একটি সবুজ কুঁড়ি বের হলে আমরা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি– এ সবুজ এল কীভাবে!!
আপনাদের তো সুবিধা যে, টিভির স্ক্রিনে অথবা মোবাইলে ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে অসহ্য লাগলে চ্যানেল বদলে নেন অথবা মোবাইল স্ক্রল করে এগিয়ে যান। কিন্তু আমাদের তো এই দৃশ্যগুলো শুধু দেখতেই হয় না; বরং এর ভেতরেই বাঁচতে হয়।
এ দুই বছরে আমরা সুন্দর স্বপ্ন দেখাও ছেড়ে দিয়েছি। কারণ সেগুলোর ব্যাখ্যা খোঁজার শক্তিও আর নেই।
তবে একটি আশা, যা অদ্ভুত জেদি! ধুলো ও রক্তে রঞ্জিত হয়েও আমাদের পিছু ছাড়ে না।
[একটি বিদেশি দৈনিক থেকে
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ]