Jumadal Akhirah 1447   ||   December 2025

ফেমিনিজম
‖ নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন : মুসলিম সমাজকে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় পশ্চিমাকরণের স্থায়ী বন্দোবস্ত

মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান

(পূর্ব প্রকাশের পর)

 

দণ্ডবিধি ৩৭৭ : সমকামিতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ

ব্রিটিশ আইনে ১৮৬০ সন থেকেই গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে সমকামিতা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হত এরপর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান তৈরি হলে সেখানের আইনে এবং ১৯৭২ সালে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশে এই আইন বহাল রাখা হয়  বাংলাদেশ পেনাল কোড বা দণ্ডবিধির ৩৭৭ নং ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে

‘‘Unnatural Offences

377.Whoever voluntarily has carnal intercourse against the order of nature with any man, woman or animal, shall be punished with [imprisonment] for life, or with imprisonment of either description for a term which may extend to ten years, and shall also be liable to fine.’’(1)

অস্বাভাবিক (প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ) অপরাধসমূহ

৩৭৭ : যদি কোনো ব্যক্তি প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে কোনো পুরুষ, স্ত্রীলোক বা পশুর সহিত যৌন সংগম করে, তাহা হইলে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে, কিংবা দশ বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে এবং তাহাকে অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা যাইবে” (দণ্ডবিধি, এডভোকেট আশরাফুল আলম, কামরুল বুক হাউস, দ্বাদশ মুদ্রণ ২০২২)

দণ্ডবিধি ৩৭৭ কি মানবাধিকার লঙ্ঘন?!

কিন্তু ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকারের আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত Mapping Exercise on HIV/AIDS- Law, Ethics and Human Rights (এইচআইভি/এইডস সংক্রান্ত সমীক্ষা : আইন, নৈতিকতা ও মানবাধিকার) শীর্ষক প্রতিবেদনটি উপসংহারে বলে

Section 377 of the Penal Code violates [the] constitutionally protected right to privacy under the expanded definition of right to life and personal liberty (article 32).

 ‘‘দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ অনুযায়ী জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার বিস্তৃত সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত ‘গোপনীয়তার অধিকারের’ পরিপন্থী’’2  এরপর ২০০৩ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ Ravaging the Vulnerable: Abuses Against Persons at High Risk of HIV Infection in Bangladesh (সুরক্ষাহীনদের ওপর নির্যাতন : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের উচ্চঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের প্রতি সহিংসতা) শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে আইন মন্ত্রণালয়ের উক্ত উপসংহারের উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করে

To the extent that section 377 discriminates on the basis of sexual orientation, it is in violation of international human rights law.

৩৭৭ ধারা যৌন অভিমুখিতার ভিত্তিতে মানুষকে যতটা বৈষম্যের শিকার করে, ঠিক ততটাই তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের নীতিমালার সরাসরি লঙ্ঘন’ 

সমকামিতার বৈধতাদানে জাতিসংঘের সুপারিশ

২০০৯ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ United Nations Human Rights Council (UNHRC) চিলি ও চেক প্রজাতন্ত্রের স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এর ভিত্তিতে তারা সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী ও তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত (LGBT) ব্যক্তিদের আইনগত অবস্থা উন্নয়নে(!) বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তিনটি সুপারিশ প্রদান করে প্রথম সুপারিশ ছিল

To de-criminalize consensual same sex sexuality between adults by abolishing penal code 377, in accordance with international human rights obligations to which Bangladesh is a signatary.

‘‘বাংলাদেশের স্বাক্ষরকৃত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি অনুযায়ী, দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিলের মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সম্মতিসূচক সমলৈঙ্গিক যৌনাচারকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা’’ 

নারীপক্ষ’ : পশ্চিমাদের নির্লজ্জ অনুকরণের নমুনা

নারীপক্ষ এখানেও বাছবিচার ছাড়াই পশ্চিমাদের নির্লজ্জ অনুকরণ করেছে ২০২২-এর নভেম্বরে ‘নারীপক্ষ’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত Call for Action: Sexual and Reproductive Health Rights for Women and Girls in the Post-2015 Development Agenda শীর্ষক প্রতিবেদন বিদ্যমান বাংলাদেশী আইনে সমকামিতা অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও এর বৈধতার জোরালো দাবি জানিয়েছে এভাবে

Recognition of LGBTQI through amends of existing laws and enacts new law and policy for this group and initiates adequate appropriate services for them.

এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বিদ্যমান আইন সংশোধন করা, এই সম্প্রদায়ের জন্য নতুন আইন ও নীতি প্রণয়ন করা, এবং তাদের জন্য যথাযথ ও প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা’ 

 পাঠক চিন্তা করে দেখুন, কত আগ থেকে এদেশে নানা বাহানায় ধাপে ধাপে সমকামীদের জন্য মাঠ তৈরি করা হচ্ছে!

বাংলাদেশ সরকারের জবাব

সরকার এই ভাষায় উক্ত সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছে

Bangladesh is a society with strong traditional and cultural values. Same-sex activity is not an acceptable norm to any community in the country.

বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী ঐতিহ্যগত ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ সমকামী আচরণ দেশের কোনো সম্প্রদায়েই স্বীকৃত বা গ্রহণযোগ্য সামাজিক আচরণ হিসেবে বিবেচিত নয়

এলজিবিটিকিউ-এর স্বাভাবিকীকরণ ও আইনি বৈধতা আদায়ে নারী কমিশনের ধূর্ত কৌশল

বাংলাদেশ সরকার বরাবরই এ ঘৃণ্য বিষয়ের আইনি বৈধতাদানে বিরোধিতা করে আসছে, কিন্তু নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং কমিশনের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কমিশন গঠনের বহু আগে থেকেই বাংলাদেশে সমকামিতার মতো ঘৃণ্য কাজের প্রসার ও আইনি বৈধতাদানের চক্রান্তে লিপ্ত!

তাদের অধীনে কমিশনটি পুরো প্রতিবেদনে বারবার বাংলাদেশের আইন ও সংবিধানে শব্দগত পরিবর্তনের দুরভিসন্ধিমূলক সুপারিশ করেছে যাতে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই সকল আইনি ধারার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়

কয়েকটি উদাহরণ দেখুন

ক. প্রতিবেদনের চতুর্থ অধ্যায়ের একটি সুপারিশ হল, ‘মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় করা’ (অনুচ্ছেদ ৪.৩.১.৩)

খ. পঞ্চম অধ্যায়ের সুপারিশে আছে, “সকল আইনে ‘মহিলা’ শব্দকে ‘নারী’ দ্বারা প্রতিস্থাপন করা” (অনুচ্ছেদ ৫.৩.১.১)

মহিলা’ ও ‘নারী’ উভয় শব্দই বায়োলজিক্যাল বা জন্মগত নারীকে বোঝায় কিন্তু কমিশনের সদস্যরা ট্রান্স নারীকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ‘নারী’ শব্দটি বেছে নিয়েছেন

গ. বাংলাদেশের সংবিধানে আছে

২৮ (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না

(২) রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন

(৩) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না

২৯ (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না

কিন্তু কমিশনটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে চতুরতার সাথে সংবিধানের এই চারটি ধারায় নতুন একটি শব্দ যোগ করার সুপারিশ করেছে

(আন্ডারলাইন করা অংশ লক্ষ করুন) প্রতিবেদনের ৩৩ নং পৃষ্ঠায় সুপারিশ করা হয়েছে

ক) অনুচ্ছেদ ২৮ (১) : এ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ পরিচয়, বয়স বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’ লেখা

খ) অনুচ্ছেদ ২৮ (২): এ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ‘সর্বক্ষেত্রে ও সর্বস্তরে লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সকল নাগরিক সমান অধিকার লাভ করিবেন’ লেখা

গ) অনুচ্ছেদ ২৮ (৩): এ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, লিঙ্গ পরিচয়, বৈবাহিক অবস্থা বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না’ লেখা

ঙ) অনুচ্ছেদ ২৯ (২): এ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, লিঙ্গ পরিচয় বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না’ লেখা

এই গুরুত্বপূর্ণ আইনি ধারাগুলোতে ‘লিঙ্গ পরিচয়’ শব্দ যোগ করে কৌশলে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রের সকল স্তরে অনুপ্রবেশের বৈধতা আদায়ের অপচেষ্টা করেছে

এ দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম সবকিছুকে বিসর্জন দিয়ে বস্তাপচা ঘৃণ্য সমাজবিধ্বংসী পশ্চিমা কালচার এদেশে আমদানি ও প্রসার ঘটানোর পেছনে ফান্ডকেন্দ্রিক এনজিও এজেন্ডা বাস্তবায়ন ছাড়া আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে!

পতিতাবৃত্তিকে সম্মানজনক(!) পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ!

নারীপক্ষ ২০০২ সালে যৌনকর্মীদের নিয়ে ‘ফিরে দেখা’ শিরোনামে একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করেছে এতে দেখা যায়, টানবাজার ও তাঁতীবাজার পতিতালয় উচ্ছেদের সরকারি অভিযানের বিরোধিতা করেছে ‘নারীপক্ষ’ তারা একে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে ব্যক্ত করেছে! সেইসাথে পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পেছনে নানা কুযুক্তি দিয়েছে

১৯৯০ সালে কান্দুপট্টি যৌনপল্লীতে একটি গবেষণার সূত্রে যৌনকর্মীদের সাথে নারীপক্ষ’র সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৯১ সালে যৌনপল্লী উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করে এবং প্রথমবারের মতো যৌনকর্মীরা নারী-আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয় আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তাদের পরিচয় ‘পতিতা’-এর পরিবর্তে ‘যৌনকর্মী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলে পতিতাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য নারীপক্ষ তাদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেয় এবং ‘সংহতি’ নামক জোট তৈরি করে

সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান রিপোর্টেও পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে

অনুচ্ছেদ ৩.২.১.৪-এ বলা হয়েছে

যৌনকর্মীদের অধিকার: যৌনপেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা এবং শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা

আরও বলা হয়েছে, “শ্রম আইনে যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া” (অনুচ্ছেদ ১২.৩.১.১)

পতিতাদের পুনর্বাসনের পেছনে পূর্ণ শক্তি ব্যয় না করে একে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ হল, মন্দ কাজের স্বাভাবিকীকরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি বৈধতা ও সুরক্ষা প্রদান

 রাষ্ট্র হবে ইহজাগতিক’!

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্যরা তাদের আওতার বাইরের অনেক বিষয়েও কথা বলেছেন নারী বিষয়ক সুপারিশ পেশ করার কথা তাদের, কিন্তু এদেশের আপামর জনসাধারণের আচরিত ধর্মের প্রতি তাদের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব খোলামেলাভাবে ফুটে উঠেছে এই বিষয়ে

নারীপক্ষ’র মতে রাষ্ট্র হবে ইহজাগতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ১৯৮৮ সালে সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তারা রিট মামলা দায়ের করেছে সেই সময় থেকেই সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজনের প্রস্তাবের প্রতিবাদে আন্দোলন করে এসেছে

নিজেদের পরিচয় দিয়েছে এভাবে, ‘নারীপক্ষ একটি ইহজাগতিক সংগঠন নারীপক্ষ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে, যা ধর্মীয় বা পরজাগতিক চিন্তা-চেতনা নির্ভর নয়; বরং গণতান্ত্রিক ও সমতাভিত্তিক

এবং সেই অনুসারে, প্রতিবেদনের ৩৫নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘যেহেতু রাষ্ট্র একটি ইহজাগতিক সত্তা, সেহেতু কোনো ধর্মীয় বিধান অনুসরণ করে  (‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ লিখে) সংবিধান শুরু হওয়া উচিত নয়

২৪০নং পৃষ্ঠায় আছে, ‘রাষ্ট্র হবে ইহজাগতিক এবং মানবিক!’

ধর্ম নাকি বৈষম্যের মূল কারণ!

প্রতিবেদনজুড়ে বহুবার ধর্মকে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতা এবং বৈষম্যের কারণ বলে উল্লেখ করেছে তাদের বক্তব্যেপরিবার এবং সমাজ প্রথা ও ধর্মীয় অজুহাতে নারীর ওপর অন্যায় ও অবিচার করে নারীর দৈনন্দিন জীবনে সবক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করা হয় নারীকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে নারীকে অবরুদ্ধ রাখা এবং অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড থেকে বাদ দেওয়া হয় ধর্মের অজুহাত দেখিয়েই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মীয় আইনকে বলবৎ রেখে নারীর প্রতি বৈষম্যকে সুদৃঢ় করা হয়েছে উল্লেখ্য, ধর্মভিত্তিক আইনগুলো শুধু যে নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্যের প্রসার করছে তা নয়, বরং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার দ্বন্দ্ব বাড়াচ্ছে

পৃষ্ঠা ৯-এ আছে, ‘সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের অধীনে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্যমূলক বিধান বিদ্যমান, বিশেষ করে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ ও ভরণপোষণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইন অনুসরণ বাধ্যতামূলক হওয়ায় নারীরা বৈষম্যের শিকার হন যার ফলে পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিদ্যমান অসমতা তাদের সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ করে রাখছে... নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্রধান প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি, প্রথা ও ধর্মব্যবস্থা

পৃষ্ঠা ১১-এ আছে, ‘নারীর প্রতি সহিংসতার সূত্রপাত হয় নারীর প্রতি বৈষম্যের গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে  ধর্ম, প্রথা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নারীর প্রতি বৈষম্যের মূল কারণ

এভাবে কমিশনের সদস্যরা তাদের দীর্ঘদিনের লালিত ধর্মবিদ্বেষ পরিষ্কার ভাষায় জনগণের সামনে প্রকাশ করেছে

পাঠ্যপুস্তকে  উল্লেখিত ইসলামী বিধানকে আপত্তির দৃষ্টিতে দেখা

যেমন, বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ না করার নির্দেশনা, পর্ন দেখা ও বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হওয়া ইত্যাদি ধর্মীয় বিধান সম্পর্কে তারা আপত্তির সুরে আলোচনা করেছে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে, এমনকি বিগত সরকারের হঠকারিতায় দুষ্ট লোকদের হাত হয়ে পাঠ্যপুস্তকে পচা দুর্গন্ধময় বিষয়াদি যুক্ত হওয়ার পর অভিভাবকদের ব্যাপক সমালোচনা ও দাবির মুখে যখন কোনো কোনো বোর্ড তাদের বই সংশোধন করে প্রকাশ করে, তাতেও নারাজ হয়ে যায় চিহ্নিত গোষ্ঠীটি

সে সময় বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পাঠ্যপুস্তক থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপযুক্ত বিষয়গুলো সংশোধন করে পাঠ্যবই পুনঃপ্রকাশ করে কিন্তু নারীপক্ষ এই সংশোধনে জোর আপত্তি জানায়

নারীপক্ষ’র, এই ধ্যান-ধারণা সামনে রেখেই নারী বিষয়ক সংস্কার প্রতিবেদনের পৃষ্ঠা ৭৪-এ বলেছেশিক্ষা-পাঠ্যক্রম সংস্কারের মাধ্যমে সম্মতি বিষয়ে ধারণা, যৌন নির্যাতন ও হয়রানি কী... সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়া” হুবহু একই কথা পৃষ্ঠা ২০৬-এও বলা হয়েছে

ট্রান্সজেন্ডার এবং নারীর বহুগামিতার আইনি বৈধতা হাসিলের অপচেষ্টা!

প্রতিবেদনের পৃষ্ঠা ৪০-এ বলেছে

সন্তানের অভিভাবকত্বের আবেদন করার সময় পিতার নাম প্রদান করতে অনিচ্ছুক বা অসমর্থ এমন একক মা অথবা অজৈবিক মা ও নারী আইনি অভিভাবকরা যেন বৈষম্যের শিকার না হন, সেজন্য জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টে পিতা বা মাতার নামের পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আইনগত অভিভাবকের নাম অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে উচ্চ আদালতে অপেক্ষমান জনস্বার্থ বিষয়ক মামলায় জারিকৃত নির্দেশনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা

সাধারণত বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে পিতার নাম প্রদান করতে অনিচ্ছুক হতে দেখা যায় আর অজৈবিক বলতে ট্রান্স নারীকে বোঝানো হয়েছে

বাল্যবিবাহের বৈধতার বিশেষ আইনও বাতিলের দাবি!

১৫ থেকে ১৮ বছরে পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কে সায় থাকলেও, বাল্যবিবাহের দেশীয় আইনে বৈধতার যে বিশেষ সুযোগ রাখা হয়েছে, সেটিও নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে কমিশন

প্রতিবেদনের ৪১ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছেবাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ ও বাল্যবিবাহ নিরোধ নীতিমালা, ২০১৮ সংস্কার করা তারা স্পষ্ট বলেছে, বৈধতার বিশেষ আইনটি বাতিল করতে হবে... এছাড়া আইনে উল্লেখিত “বিশেষ প্রেক্ষাপট” কোন বয়সের শিশুদের জন্য প্রযোজ্য হবে তা উল্লেখ না থাকায় আইনের অপব্যবহার ঝুঁকি রয়ে যায় সেক্ষেত্রে উক্ত “বিশেষ প্রেক্ষাপট”-কে পুনরায় বিবেচনা করে অপব্যবহার রোধে যৌক্তিক শর্ত আরোপ করা উচিত” (অনুচ্ছেদ ৩.২.২.১.৫)

দেশের সব সেক্টরে নারী-পুরুষের সমতা বাস্তবায়নের আইনি তোড়জোড়

কমিশনের ভাষায় তাদের উদ্দেশ্যই হল ‘‘প্রশাসন ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের বিষয়গুলো প্রতিবেদনে তুলে আনা” (পৃ. ৫)

এই লক্ষ্যে তারা অনেকগুলো প্রস্তাব দিয়েছে যেমন, “নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্বদান, সমন্বয় ও পরিবীক্ষণে শক্তিশালী করা আবশ্যক... নারী-পুরুষ সমতা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে সকল মন্ত্রণালয়ে নারী-পুরুষ সমতা ইউনিট প্রতিষ্ঠা, প্রকল্প সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রকল্প প্রস্তাবনায় নারী পুরুষ সমতা বিষয় অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা দরকার” (পৃ. ১০)

পৃ. ২৬-এ আরও বলা হয়েছে

নারী উন্নয়নের পথে চ্যালেঞ্জ: নারী উন্নয়নের পথে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া বড় চ্যালেঞ্জ বিশেষ করে পারিবারিক আইন ও উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা প্রায়শই রক্ষণশীল ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে এ পরিস্থিতিতে নারী-আন্দোলন ও নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলো আইনগত সংস্কারের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা রেখে চলেছে

আগামীতে নির্বাচিত সরকারের আমলে নারী বিষয়ক স্বাধীন সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন তারা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে

কমিশনের অন্যতম প্রধান একটি কাজ হবে নারী ও নারী-পুরুষের সমতা-বিষয়ক গবেষণাকে উৎসাহিত করা এবং সহায়তা করা, যাতে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক নীতিনির্ধারণ সম্ভব হয় কমিশন জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে সংযোগ ও সংলাপ গড়ে তুলবে, যাতে নারী-পুরুষের সমতার জন্য কার্যকর কৌশল ও নীতিমালা বাস্তবায়ন করা যায়” (পৃ. ২৪৩)

স্বেচ্ছাচারের চরম লজ্জাজনক প্রকাশ!

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন পুরো প্রতিবেদনে ধর্ম ও সমাজবিরোধী এমন সব সুপারিশ দিয়েছে, যাতে নীতি-নৈতিকতা, হায়া ও লজ্জা-শরমের কোনো বালাই থাকে না এমনকি পাঠক জেনে আশ্চর্য হবেন, তারা ‘নীতি-নৈতিকতা’ শব্দও সংবিধান থেকে তুলে দিতে চেয়েছে যাতে মানবাধিকার ও নারী অধিকারের নামে পশ্চিমের আবর্জনা সহজেই আমাদের দেশে আইনিভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় এবং সেটা সংবিধানের কোনো ধারার সাথে সাংঘর্ষিক না হয় এটা মূলত বাংলাদেশের মুসলিম সমাজকে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় পশ্চিমাকরণের স্থায়ী বন্দোবস্তের প্রাথমিক ধাপ

কয়েকটি উদাহরণ দেখুন,

এক. প্রতিবেদনের ৩৫নং পৃষ্ঠায় প্রস্তাব করেছে

“(সংবিধানে) শব্দ প্রয়োগে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা ...‘গণিকাবৃত্তি’, ...শালীনতা, নৈতিকতা’ শব্দসমূহের ব্যবহার পরিহার করা

তারা আরও বলেছে, অস্পষ্ট কোনো শব্দ ব্যবহার করা যাবে না ১৬২নং পৃষ্ঠায় তারা অস্পষ্ট পরিভাষা পরিহার করতে বলেছে এবং টীকায় অস্পষ্ট পরিভাষার উদাহরণ দিয়ে বলেছে

অস্পষ্ট পরিভাষা যেমন, ‘নৈতিক অবক্ষয়’, ‘সুস্থ বিনোদন’, ‘জনস্বার্থ বিরোধী’, ‘অশ্লীল’, ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ ‘রাজনৈতিক অনুভূতি’ ‘শালীনতাপূর্ণ পোশাক’

দুই. আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অধ্যায়ে অনুচ্ছেদ ১৮ (২)-এ বলা আছে

গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন

কিন্তু নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রতিবেদনের ৩৪ নং পৃষ্ঠায় সুপারিশ করেছে

গ) অনুচ্ছেদ ১৮ (২) : গণিকাবৃত্তির বিষয়টি বাদ দিতে হবে কারণ জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার নামে যৌনকর্মীদের পেশাকে নিরোধ করা মানবাধিকার লঙ্ঘন

তিন. বাংলাদেশের সংবিধানের  ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদের ২ নং ধারায় আছেরাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে

(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং

(খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল

কিন্তু নারী সংস্কার কমিশন প্রতিবেদনের ৩৪ নাম্বার পৃষ্ঠায় বলেছেঅনুচ্ছেদ ৩৯ (২) : এ অনুচ্ছেদ থেকে শালীনতা ও নৈতিকতার বিষয়টি বাদ দিয়ে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা নিষেধ-সাপেক্ষে’ লেখা

ধর্ম অবমাননা, রাসূল অবমাননা, ধর্মীয় আইন অবমাননা, ধর্মীয় গ্রন্থ অবমাননা অথবা ধর্মীয় পোশাক-আশাকের প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য প্রকাশ করা যাতে বাংলাদেশের আইন মোতাবেক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত না হয়, সেজন্য কমিশনটি এই সুপারিশ করেছে

গত মাসে প্রথম কিস্তিতে আমরা দেখেছি, নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের অধীনে তারা ‘থাবাবাবা’ নামে কুখ্যাত রাজিব হায়দারের পক্ষেও কথা বলেছে এই শব্দগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশের পেছনে মৌলিক কারণও এটি এবং ধর্মীয় অনুভূতি, শালীনতা, নৈতিকতা এ শব্দগুলো সংবিধান থেকে বাদ দেওয়ার পেছনেও মৌলিক কারণ এটিই

অবাস্তব সব দাবি কমিশন প্রধানের!

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান একটি টকশোতে অংশ নিয়েছিলেন   সেখানে তিনি নিজ দাবি প্রমাণ করতে গিয়ে বেশ কিছু অবাস্তব কথা বলেছেন

একটি বক্তব্য ছিলধর্ম নিয়ে আলোচনাটাই অবান্তর কারণ আমরা একেবারে পরিষ্কারভাবে বলেছি যে, এটা অপশনাল, ঐচ্ছিক একটা সিভিল অপশন তৈরি করা মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধন হয়েছিল ১৯৬১ সনে সেই সংস্কারের কেউ বিরোধিতা করেনি

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের কেউ বিরোধিতা করেনি কথাটা নিরেট অসত্য দাবি আসল সত্য কথা হল, স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের ওই কুখ্যাত আইনটি যে কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে হয়েছিল, সে ইসলামী নযরিয়াতি কাউন্সিলের একমাত্র আলেম সদস্য মাওলানা এহতেশামুল  হক থানভী সুপারিশমালায় কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী অংশগুলোর দলীলভিত্তিক বিরোধিতা করে সুস্পষ্টভাবে  নোট অব ডিসেন্টও দিয়েছিলেন এছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য সব আলেম ও দ্বীনদার শ্রেণি সেই সংস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন সেই সময়কার ইতিহাস সামান্য ঘাঁটলেই তারা পেয়ে যেতেন

তিনি আরও বলেছেন, “যারা ধর্মভিত্তিক আইনে নিজেদেরকে পরিচালিত করতে চায় না, তাদের জন্য একটি সিভিল আইন তৈরি করা ঐচ্ছিক

জাতীয় পর্যায়ের গঠিত একটি কমিশন কীভাবে চিহ্নিত একটি গোষ্ঠীর স্বার্থে কথা বলছে এবং সেটাকে খোলামেলাভাবে প্রকাশ করার দুঃসাহসও দেখাচ্ছে

পাঠক চিন্তা করে দেখুন, ৯০ ভাগ মুসলিমসহ প্রায় ১০০ ভাগ ধার্মিক নাগরিকদের জন্য তারা আইন প্রণয়ন করছে, আথচ বলছেধর্ম নিয়ে আলোচনাটাই অবান্তর” এবং ধার্মিকদের জন্য তারা আইন প্রণয়ন করছেন না, বরং রাষ্ট্রের ধার্মিকদের অর্থ খরচ করে মুষ্টিমেয় ধর্মহীন মানুষের জন্য আইন প্রণয়ন করছেন! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন

সংস্কারের নামে জাতির সাথে এ তামাশাও কি সম্ভব!

চিহ্নিত একটি গোষ্ঠীর জন্য সিভিল আইন তৈরি করতে চাওয়ার যে আপাতদৃষ্টির সৎ উদ্দেশ্য তারা প্রকাশ করছেন, আসলে সেটিও অবাস্তব  কারণ প্রতিবেদন জুড়ে তারা বহুবার ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন’ বলেছেন অর্থাৎ সকলের জন্য একটি পারিবারিক আইন এবং ধর্মকে ‘বৈষম্যমূলক’ আখ্যা দিয়ে সিভিল আইন তৈরির বৈধতা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন যেমন : পৃষ্ঠা ২০২-এ তারা বলেছেন

অভিন্ন পারিবারিক আইন : সকল ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে তালাক উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করা (অনুচ্ছেদ ৩.২.১.৪)”

অধ্যায় ৬-এ তারা বলেছেন

নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ও পশ্চাদপদ আইনসমূহ সংস্কার করে নারীর পারিবারিক ও জনপরিসরে সমঅধিকার নিশ্চিত করতে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে অভিন্ন পারিবারিক অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা অভিন্ন পারিবারিক আইন (টহরভড়ৎস ঋধসরষু ঈড়ফব) সব সম্প্রদায়ের জন্য ঐচ্ছিকভাবে প্রযোজ্য হবে

এ কমিশন একদিকে দাবি করছে, “কোন ধর্মের বিশ্বাসের প্রতিই আঘাত করাটা আমাদের উদ্দেশ্য না” অপরদিকে ধর্মকে বৈষম্যের অন্যতম প্রধান কারণ আখ্যা দিচ্ছে এবং ধর্মের গোড়া কেটে দিচ্ছে এদেশের মুসলিমদের ঈমান ধ্বংসের আইনি ও সাংবিধানিক সব আয়োজন পাকাপোক্ত করছে!

স্ববিরোধিতার বিরল নজির এবং দাবিত্যাগের অবাস্তব দাবি

প্রচ্ছদপাতার পরের পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘‘দাবিত্যাগ: এই প্রতিবেদনে উপস্থাপিত মতামত এবং দৃষ্টিভঙ্গি কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট লেখকদের সুতরাং এগুলো লেখকবৃন্দের সাথে সম্পর্কিত সংস্থাসমূহের মতামত, অবস্থান বা নীতির প্রতিনিধিত্ব বা প্রতিফলন করে না’’

অথচ এ নিবন্ধের এ কিস্তি এবং আগের কিস্তিতে পাঠক দেখে এসেছেন যে, কমিশন প্রধানের সাথে সম্পৃক্ত ‘নারীপক্ষ’র এজেন্ডাগুলোকেই সংস্কারের নামে বাংলাদেশের নব্বই ভাগ মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মের মানুষদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে

পাঠক আরও পড়েছেন, এই প্রতিবেদনেই তারা স্বীকার করেছে, নারীবাদী আন্দোলনের দাবিনামা তাদের মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে নারী আন্দোলনের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা তারা সগর্বে প্রচার করেছে পশ্চিমা নারী অধিকারের দাবিসমূহ স্থায়ী সাংবিধানিক আইনে রূপ দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে সুতরাং দাবিত্যাগের এই দাবি যে অবাস্তব, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না

এ কমিশন পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর

এ কমিশন নারীদের বাস্তব সমস্যা সমাধান বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাবনা তুলে ধরার তুলনায় পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নেই অধিক তৎপর এবং এ বিষয়ে তারা বদ্ধপরিকর ফলে তারা বহু ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের বাস্তব পথে না হেঁটে চোখ বুজে পশ্চিমের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়নে মরিয়া

তারা ধর্ষণ আইন সংস্কার করতে চান (অনুচ্ছেদ ৩.২.১.৪); কিন্তু ধর্ষণের মৌলিক কারণগুলো চিহ্নিত করতে চান না এবং ধর্মীয় ও সামাজিক যেসব নীতি অনুসরণ করলে এধরনের নির্যাতনের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে আসার কথা, সেগুলো অনুসরণ করাকে পশ্চাৎপদতা হিসেবে এবং নারী উন্নয়নের পথে বাধা হিসেবে দেখেন! অর্থাৎ সমস্যার গোড়ায় হাত দিতে চান না অথচ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলেও ইসলাম যেসকল বিষয়কে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছে, তা সুস্থ বিবেক ও সাধারণ আকলেরও দাবি

এজাতীয় বহু উদাহরণ রয়েছে পুরো প্রতিবেদনজুড়ে

মোটকথা, একদিকে অযৌক্তিকভাবে পশ্চিমের অনুকরণ ও তাদের বস্তাপচা কালচার ও এজেন্ডা মুসলিমপ্রধান এ দেশে বাস্তবায়নের অপচেষ্টা, অপরদিকে কেবল ধর্মীয় বিষয় হওয়ার কারণে নারীদের জন্য কল্যাণকর, যৌক্তিক ও ফলপ্রসূ বিষয় পশ্চাৎপদতা বলে উপেক্ষা করা এ-ই হল এ কমিশন ও তাদের প্রতিবেদনের মূল চরিত্র 

আল্লাহ এ জাতিকে রক্ষা করুন সব ধরনের ঈমানবিধ্বংসী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত থেকে হেফাজত করুন আমীন

 

টীকা :

(1) [Offences Affecting the Human Body, of the Penal Code, (Act XLV of 6th October, 1860); Laws Continuance Enforcement Order, 1971 (P.O. No. 48 of 1972); The Bangladesh Code, vol 1, p. 199, published in 2007]

 

advertisement