কৃপণতা ইহুদী ও মুনাফিকদের চরিত্র
আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বিভিন্ন মন্দ স্বভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছেন এবং সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। এরকমই একটি বিষয় হল কৃপণতা। আল্লাহ বলেছেন, কৃপণতা করা মন্দ কাজ। কৃপণতা করলে দুনিয়া-আখেরাতে সফলতা লাভ হয় না এবং যে তা করে, সে আল্লাহর রহমত নিআমত থেকে বঞ্চিত হয়।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে কৃপণতার নিন্দা করার পাশাপাশি এ-ও বলেছেন যে, এই মন্দ স্বভাব মুনাফিক ও ইহুদীদের মধ্যে আছে। তারা আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ দ্বীন ও কল্যাণের কাজে ব্যয় করা থেকে হাত গুটিয়ে রাখে, দান-সদকা করতে চায় না। যারা এরকম কৃপণতা করে, আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন না। কাজেই এ মন্দ স্বভাব থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুমিনের জন্য অবশ্যকর্তব্য।
কৃপণতা সম্পর্কে কুরআনের বার্তা
আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইরশাদ করেছেন–
وَلَا یَحْسَبَنَّ الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ بِمَاۤ اٰتٰىهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهٖ هُوَ خَیْرًا لَّهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَیُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهٖ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ.
আল্লাহপ্রদত্ত অনুগ্রহে যারা কৃপণতা করে, তারা যেন কিছুতেই মনে না করে, এটা তাদের জন্য ভালো কিছু; বরং এটা তাদের পক্ষে অতি মন্দ। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করে, কিয়ামতের দিন তা তাদের গলায় বেড়ি হবে। –সূরা আলে ইমরান (০৩) : ১৮০
আল্লাহ্ই সবাইকে ধনসম্পদ দান করেন। তাঁরই দেওয়া ধনসম্পদের অতি সামান্য এক অংশ তিনি আবার যাকাত হিসেবে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু কেউ কেউ এ সামান্য সম্পদও দিতে চায় না, কৃপণতা করে। অথচ যাকাতের অংশটা মূলত অন্যের হক, অন্যের প্রাপ্য।
যে ব্যক্তি সম্পদের যাকাত দেয় না, তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আখেরাতে এই সম্পদকে বিষাক্ত সাপ বানিয়ে ওই ব্যক্তির গলায় জড়িয়ে দেওয়া হবে। সে সাপ তার গলা কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ! আমি তোমার সঞ্চিত ধনভান্ডার! (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪০৩)
আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে যাকাত ছাড়াও অন্যান্য দ্বীনী কাজে ব্যয় করতে এবং সাধারণ দান-সদকা করতে উৎসাহিত করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন। যে ব্যক্তি কৃপণতা করে দ্বীনী কাজে ব্যয় করল না, দান-সদকা করল না, এটা তার জন্য ভালো কিছু নয়। আল্লাহ বলছেন, সে যেন এটাকে কিছুতেই ভালো মনে না করে।
যাকাত ও দান-সদকা না দিয়ে সঞ্চয় করার চিন্তা একটা স্থূল চিন্তা। পরিণাম বিচারে এটা নিজের জন্যই অত্যন্ত মন্দ কাজ; ইহজগতেও, আখেরাতেও। যারা কৃপণতা করে এবং অন্যকেও তা করতে বলে, তাদের জন্য আখেরাতে মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে। আর দুনিয়াতেও এটা বহু অকল্যাণ টেনে আনে।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন–
هٰۤاَنْتُمْ هٰۤؤُلَآءِ تُدْعَوْنَ لِتُنْفِقُوْا فِیْ سَبِیْلِ اللهِ فَمِنْكُمْ مَّنْ یَّبْخَلُ وَمَنْ یَّبْخَلْ فَاِنَّمَا یَبْخَلُ عَنْ نَّفْسِهٖ وَاللهُ الْغَنِیُّ وَاَنْتُمُ الْفُقَرَآءُ وَاِنْ تَتَوَلَّوْا یَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَیْرَكُمْ ثُمَّ لَایَكُوْنُوْۤا اَمْثَالَكُمْ.
দেখ, তোমরাই তো তারা, যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য ডাকা হচ্ছে, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কিছু লোকে কার্পণ্য করছে। আর যে-কেউ কার্পণ্য করে, সে তো কার্পণ্য করে নিজেরই প্রতি, আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরা অভাবগ্রস্ত। তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তোমাদের স্থানে অন্য কোনো সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করবেন, অতঃপর তারা তোমাদের মতো হবে না। –সূরা মুহাম্মাদ (৪৭) : ৩৮
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যদি আল্লাহর বান্দারা দ্বীনী কাজে আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাহলে এতে তাদেরই লাভ। আল্লাহর তো বান্দার কাছে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই; বরং তিনিই সবাইকে দেন। কেউ আল্লাহর পথে ব্যয় করলে, দান-সদকা করলে তাতে তারই লাভ। আল্লাহ তাকে আরও বহু গুণ বাড়িয়ে দেবেন। আর যে কৃপণতা করবে, সে তো আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে নিজেই নিজেকে বঞ্চিত করল। আল্লাহ দানশীল ব্যক্তি বা জাতিকেই নিআমত, সাফল্য ও উৎকর্ষ দান করেন, তাদের প্রতি নিজ রহমত ও অনুগ্রহ বর্ষণ করবেন।
আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন–
وَاللهُ لَا یُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورِ،ِالَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ وَیَاْمُرُوْنَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ وَمَنْ یَّتَوَلَّ فَاِنَّ اللهَ هُوَ الْغَنِیُّ الْحَمِیْدُ.
আল্লাহ এমন কোনো ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না, যে দর্প দেখায় ও বড়ত্ব প্রকাশ করে। তারা এমন লোক, যারা কৃপণতা করে এবং অন্যকেও কৃপণতার নির্দেশ দেয়। কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে (সে জেনে রাখুক) আল্লাহ সকলের থেকে অমুখাপেক্ষী, তিনিই প্রশংসার উপযুক্ত। –সূরা হাদীদ (৫৭) : ২৩-২৪
আরও বলেছেন–
فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوْا وَاَطِیْعُوْا وَاَنْفِقُوْا خَیْرًا لِّاَنْفُسِكُمْ وَمَنْ یُّوْقَ شُحَّ نَفْسِهٖ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ، اِنْ تُقْرِضُوا اللهَ قَرْضًا حَسَنًا یُّضٰعِفْهُ لَكُمْ وَیَغْفِرْ لَكُمْ وَاللهُ شَكُوْرٌ حَلِیْمٌ.
তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চল এবং শোন ও মান। আর (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) অর্থ ব্যয় কর, এটা তোমাদের জন্য উত্তম। যারা তাদের অন্তরের লোভ-লালসা থেকে মুক্তি লাভ করেছে, তারাই সফলকাম। তোমরা যদি আল্লাহকে উত্তমভাবে ঋণ দাও, তবে আল্লাহ তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবেন এবং তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন। আল্লাহ অতি গুণগ্রাহী, মহা সহনশীলতার অধিকারী। –সূরা তাগাবুন (৬৪) : ১৬-১৭
‘আল্লাহকে ঋণ দেওয়া’-এর অর্থ– আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে আল্লাহর পথে ও সৎকাজে সম্পদ ব্যয় করা। উত্তমভাবে ঋণ দেওয়ার অর্থ– ইখলাস ও খাঁটি নিয়তে ব্যয় করা। যাতে লোক দেখানো ও সুনাম কুড়ানো উদ্দেশ্য থাকবে না।
এমন বিশুদ্ধ নিয়তে আল্লাহর হুকুম মতো অর্থ ব্যয় করলে এবং সম্পদের প্রতি লোভ-লালসা ও কৃপণতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখলে এর বদৌলতে আল্লাহ তাআলা গুনাহ মাফ করে দেবেন, দুনিয়া-আখেরাতে উত্তম বিনিময় দান করবেন। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে এরকম শতাধিক আয়াতে আল্লাহর পথে ও কল্যাণকর কাজে অর্থ ব্যয় করতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
সুতরাং আল্লাহর প্রতি যে ঈমান রাখে, তাঁকে ভালবাসে, সে কি কৃপণ হতে পারে? আমি যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখি, তাহলে কৃপণতা করা আমার কিছুতেই সাজে না। যদি তা করি, তাহলে আল্লাহর প্রতি আমার ঈমান ও ভালবাসা পরিপূর্ণ নয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
لَا يَجْتَمِعُ الشُّحُّ وَالْإيمَانُ فِي قَلْبِ عَبْدٍ أبَدًا.
কোনো বান্দার অন্তরে ঈমান ও কৃপণতা একত্র হতে পারে না। –আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ২৮১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৪৭৯
সুতরাং সত্যিকার মুমিন বান্দা কৃপণ হতে পারে না। আমার মধ্যে কৃপণতা থাকলে আমি সত্যিকার মুমিন হতে পারিনি। আল্লাহ বলেছেন, মুনাফিক ও ইহুদীরা কৃপণতা করে। আমিও যদি তা-ই করি, তাহলে কি আমার মধ্যে তাদের স্বভাব-চরিত্র এসে যায় না?
মুনাফিকদের কৃপণতার স্বভাব
দ্বীনী কাজে অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে মুনাফিকরাই বেশি কৃপণতা করত। তারা আল্লাহর পথে ব্যয় করতে চাইত না, তালবাহানা করত। একান্ত বাধ্য না হলে দ্বীনী কাজে অর্থ ব্যয় করত না। আর যতটুকু করত, সেটাও অসন্তোষের সাথে এবং লোক দেখানো উদ্দেশ্যে করত।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে তাদের সম্পর্কে বলেছেন–
وَمِنْهُمْ مَّنْ عٰهَدَ اللهَ لَىِٕنْ اٰتٰىنَا مِنْ فَضْلِهٖ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَكُوْنَنَّ مِنَ الصّٰلِحِیْنَ، فَلَمَّاۤ اٰتٰىهُمْ مِّنْ فَضْلِهٖ بَخِلُوْا بِهٖ وَتَوَلَّوْا وَّهُمْ مُّعْرِضُوْنَ.
তাদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার করেছিল, তিনি যদি নিজ অনুগ্রহে আমাদেরকে দান করেন, তবে আমরা অবশ্যই সদকা করব এবং নিঃসন্দেহে আমরা সৎলোকদের অন্তর্ভুক্ত হব। কিন্তু আল্লাহ যখন তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে দান করলেন, তখন তারা তাতে কার্পণ্য করল এবং মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। –সূরা তাওবা (০৯) : ৭৫-৭৬
মুনাফিকদের কেউ কেউ বলেছিল, আল্লাহ যদি ধনদৌলত দান করেন, তাহলে অবশ্যই আল্লাহর পথে খরচ করব। কিন্তু আল্লাহ যখন সম্পদ দান করলেন, তখন তারা কৃপণতা শুরু করল। যাকাত দিল না, দান-সদকা করল না। তাদের এই দ্বিমুখিতা ও হীন চরিত্রের কারণে আল্লাহ তাদের মনে নেফাককেই স্থিত করে দিলেন। আসলে তাদের স্বভাবই ছিল এমন যে, কথা রক্ষা করত না।
ভেবে দেখা দরকার, আমার মধ্যেও এ চরিত্র আছে কি না। সৎকাজে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্র আসলে আমি কার্পণ্য করি, তালবাহানা করি, আর বলি– আল্লাহ যদি আমাকে ধনসম্পদ দিতেন, তাহলে আমি এত এত অর্থ দান করতাম। অথচ আমি ভালো করেই জানি, আল্লাহ আমাকে আরও সম্পদ দিলে আমি আরও বেশি কার্পণ্য করব। যদি আমার চরিত্র এমন হয়, তাহলে অচিরেই আমাকে এ চরিত্র থেকে মুক্ত হতে হবে!
আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন–
هُمُ الَّذِیْنَ یَقُوْلُوْنَ لَا تُنْفِقُوْا عَلٰی مَنْ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ حَتّٰی یَنْفَضُّوْا وَلِلهِ خَزَآىِٕنُ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ وَلٰكِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ لَا یَفْقَهُوْنَ.
তারাই বলে, যারা রাসূলুল্লাহ্র কাছে আছে, তাদের জন্য ব্যয় করো না, যতক্ষণ না তারা নিজেরাই সরে পড়ে, অথচ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর ধনভান্ডার তো আল্লাহরই। কিন্তু মুনাফিকরা বোঝে না। –সূরা মুনাফিকূন (৬৩) : ০৭
মুনাফিকরা পরস্পরে বলাবলি করত, তোমরা মুমিনদের জন্য কিছু ব্যয় করো না। এতে তারা অভাবে পড়ে নিজেরাই রাসূলের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে।
আল্লাহ বলছেন, তাদের কি এই বোধও নেই যে, আল্লাহ্ই তো সবাইকে ধনসম্পদ দেন। কাজেই মুনাফিকদের দু-চার পয়সার জন্য কি মুমিনরা অভাবে পড়বে? আর তিনি চাইলে কি মুনাফিকদেরকেই সংকটে ফেলতে পারেন না?
সূরা তাওবার ৫ নম্বর আয়াতে তাদের ব্যাপারে আরও বলা হয়েছে, তারা কোনো সৎকাজে অর্থ ব্যয় করলে তা করে অসন্তোষের সাথে। অর্থাৎ একেবারে বাধ্য না হলে তারা কাউকে কিছু দিতে চায় না।
এদিকে তারা নিজেরা তো দান-সদকা যাকাত কিছুই দিতে চাইত না। অন্যদিকে আবার নবীজীর কাছ থেকে দান-সদকা পাওয়ার জন্য লালায়িত থাকত। না দিলে বা তাদের চাহিদার চেয়ে কম দিলে ক্ষুব্ধ হত। অসন্তুষ্ট হয়ে নবীজীকে দোষারোপ করত। (দ্র. সূরা তাওবা : ৫৮)
কুরআন কারীমে বিভিন্ন জায়গায় এভাবেই তাদের এ সকল চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
ইহুদীদের কৃপণতার স্বভাব
আল্লাহ কুরআনে ইহুদীদের কৃপণতার স্বভাব সম্পর্কে বলেছেন–
اَمْ لَهُمْ نَصِیْبٌ مِّنَ الْمُلْكِ فَاِذًا لَّا یُؤْتُوْنَ النَّاسَ نَقِیْرًا، اَمْ یَحْسُدُوْنَ النَّاسَ عَلٰی مَاۤ اٰتٰىهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهٖ.
তবে কি (বিশ্বজগতের) সার্বভৌমত্বে তাদের কোনো অংশ আছে? যদি তাই হত, তবে তারা মানুষকে খেজুরবীচির আবরণ পরিমাণও কিছু দিত না। নাকি তারা এই কারণে মানুষের প্রতি ঈর্ষা করে যে, আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহ দান করেন। –সূরা নিসা (০৪) : ৫৩-৫৪
অর্থাৎ তাদের হাতে যদি সবকিছুর মালিকানা থাকত, তাহলে কাউকেই কিছু দিত না। আবার আল্লাহ যে অন্যদের প্রতি নিজ রহমত ও অনুগ্রহ বর্ষণ করেন, তাতেও তাদের ঘোর আপত্তি।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওতের প্রতি তাদের আপত্তি তো ছিলই, মুসলমানদের কোনো কল্যাণ ও সাফল্য অর্জিত হলেও তারা যারপরনাই মনক্ষুণ্ন হত।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর্যুপরি অবাধ্যতার পরিণামে তাদের কোনো সংকট বা অভাব-অনটন দেখা দিলে তারা আল্লাহকে কৃপণ বলে দোষারোপ করত।
কুরআনে বর্ণিত হয়েছে–
وَقَالَتِ الْیَهُوْدُ یَدُ اللهِ مَغْلُوْلَةٌ غُلَّتْ اَیْدِیْهِمْ وَلُعِنُوْا بِمَا قَالُوْا ۘ بَلْ یَدٰهُ مَبْسُوْطَتٰنِ یُنْفِقُ كَیْفَ یَشَآءُ.
ইহুদীরা বলে, আল্লাহর হাত বাঁধা। হাত বাঁধা তো তাদেরই। তারা যে কথা বলেছে, সে কারণে তাদের ওপর লানত বর্ষিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর উভয় হাত প্রসারিত। তিনি যেভাবে চান ব্যয় করেন। –সূরা মায়েদা (০৫) : ৬৪
আরবী ভাষায় ‘হাত বাঁধা’ দ্বারা কৃপণতা বোঝানো হয়। অর্থাৎ ইহুদীরা বলে, আল্লাহ কৃপণ। আর আল্লাহ বলছেন, আসলে কৃপণ তারাই। আল্লাহর হাত তো প্রসারিত, আল্লাহর বদান্যতা ও দানশীলতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আল্লাহ সবাইকেই দান করেন। যারা তার অবাধ্যতা করে, তাদেরকেও অপরিসীম দান করেন।
তারা আল্লাহকে কৃপণ বলে, অথচ তিনিই তাদেরকে অর্থ-সম্পদ দেন। তাঁরই শত সহস্র নিআমত ভোগ করে উল্টো তাঁকেই কৃপণ বলে। এদিকে তাদের স্বভাব-চরিত্রে কার্পণ্য এতই বেশি যে, কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী তারা কাউকে খেজুরবীচির আবরণ পরিমাণও কিছু দিতে রাজি নয়।
কুরআন বিভিন্ন প্রসঙ্গে ইহুদী-মুনাফিকদের কৃপণতার স্বভাব এভাবে চিত্রিত হয়েছে যে, যখনই তাদেরকে আল্লাহর পথে ও সৎকাজে অর্থ ব্যয় করতে বলা হয়, মানুষকে কিছু দিতে বলা হয়, তখন তারা গড়িমসি করে, টালবাহানা করে। দান-সদকা তো পরে, সাধারণ ব্যবহার্য জিনিসও তারা কাউকে দিতে চায় না। নিজেরা তো কিছু দেয়ই না, উপরন্তু যারা মানুষকে দান-সদকা হাদিয়া দেয়, আল্লাহর রাস্তায় ও দ্বীনের কাজে অর্থ ব্যয় করে, তাদেরকে নিয়ে তারা ঠাট্টা-উপহাস করে। তারা অন্যদেরকেও প্ররোচিত করতে থাকে, যেন তারা মানুষকে কিছু না দেয়, আল্লাহর পথে ব্যয় না করে। কুরআনে বহু জায়গায় তাদের এ স্বভাব-চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন–
اِنَّ اللهَ لَا یُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُوْرَا، الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ وَیَاْمُرُوْنَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ وَیَكْتُمُوْنَ مَاۤ اٰتٰىهُمُ اللٰهُ مِنْ فَضْلِهٖ وَاَعْتَدْنَا لِلْكٰفِرِیْنَ عَذَابًا مُّهِیْنًا، وَالَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ رِئَآءَ النَّاسِ وَلَا یُؤْمِنُوْنَ بِاللٰهِ وَلَا بِالْیَوْمِ الْاٰخِرِ وَمَنْ یَّكُنِ الشَّیْطٰنُ لَهٗ قَرِیْنًا فَسَآءَ قَرِیْنًا وَمَا ذَا عَلَیْهِمْ لَوْ اٰمَنُوْا بِاللهِ وَالْیَوْمِ الْاٰخِرِ وَاَنْفَقُوْا مِمَّا رَزَقَهُمُ اللهُ وَكَانَ اللهُ بِهِمْ عَلِیْمًا.
নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দর্পিত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। যারা নিজেরা কৃপণতা করে এবং মানুষকেও কৃপণতার নির্দেশ দেয়, আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহ হতে তাদের যা দান করেছেন তা গোপন করে। আমি (এরূপ) অকৃতজ্ঞদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি। এবং যারা নিজেদের অর্থ-সম্পদ খরচ করে মানুষকে দেখানোর জন্য, না আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং না আখেরাত দিবসের প্রতি। বস্তুত শয়তান কারও সঙ্গী হয়ে গেলে সঙ্গীরূপে সে বড়ই নিকৃষ্ট। তাদের কী ক্ষতি হত, যদি তারা আল্লাহ ও পরকালে ঈমান আনত এবং আল্লাহ তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছেন তা থেকে কিছু (সৎকাজে) ব্যয় করত? আল্লাহ তাদের অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবগত। –সূরা নিসা (০৪) : ৩৬-৩৯
শুধু স্বভাবেই নয়, মানসিকভাবেও তারা ছিল কৃপণ চরিত্রের। মনেও তারা অন্যের ভালো চাইত না।
কৃপণতা দুই ধরনের; এক হল স্বভাবের কৃপণতা। কাউকে কিছু দিতে বা ব্যয় করতে কার্পণ্য করা। আরেক হল আত্মিক বা মনের কৃপণতা। অর্থাৎ সংকুচিত মনের হওয়া।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে বলেছেন–
البَخِيلُ الَّذِي مَنْ ذُكِرْتُ عِنْدَه فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ.
অর্থাৎ যার সামনে আমার নাম নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সে আমার প্রতি দরূদ পড়েনি, সে হল কৃপণ। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৪৬
এটা আত্মিক বা মনের কৃপণতার সাথে সম্পর্কিত।
আমাদের করণীয়
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন–
وَلَا تَجْعَلْ یَدَكَ مَغْلُوْلَةً اِلٰی عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوْمًا مَّحْسُوْرًا.
(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং (অপব্যয়ী হয়ে) তা সম্পূর্ণরূপে খুলে রেখ না, যদ্দরুন তোমাকে নিন্দাযোগে ও নিঃস্ব হয়ে বসে পড়তে হবে। –সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ২৯
ইতিপূর্বে উল্লেখিত আয়াতগুলোর প্রতি লক্ষ করলে আমরা বুঝতে পারব, আল্লাহর নিআমত ও রহমত পেতে চাইলে এবং উভয় জাহানের সফলতা লাভ করতে চাইলে কৃপণতা পরিত্যাগ করতে হবে। নতুবা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত করব ও বঞ্চিতের সারিতে দাঁড় করাব।
মুমিনের বৈশিষ্ট্য উদারতা-দানশীলতা। কুরআন কারীমে বিভিন্ন জায়গায় মুমিনকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, তোমরা সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখবে না। আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় যাকাত আদায় করবে, ভারসাম্য রক্ষা করে আল্লাহর পথে ও দ্বীনের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত চিত্তে ব্যয় করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে সম্পদ দান করেছেন, তাতে অভাবীদের জন্য হিস্যা রাখবে। গোপনে-প্রকাশ্যে ও অভাবে-সচ্ছলতায় সর্বাবস্থায় সৎকাজে অর্থ ব্যয় করবে, দান-সদকায় একে অন্যকে উৎসাহিত করবে। আবার দান করে তা বলে বেড়াবে না। অন্যদিকে অর্থ ব্যয়েও ভারসাম্য বজায় রাখবে, অপব্যয় অপচয় করবে না। এভাবেই কুরআনে মুমিনদেরকে উদারতা ও দানশীলতার গুণ অর্জন করতে বলা হয়েছে। যদি আমরা তা মেনে চলি, তাহলে আল্লাহ তাআলা দুনিয়া-আখেরাতে আমাদের বিপুল প্রতিদান দান করবেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম এমনই ছিলেন। আল্লাহ তাআলার নির্দেশনা তারা শতভাগ পালন করেছেন। তাদের মধ্যে যারা সচ্ছল ছিলেন তারা দুহাত খুলে দান করতেন। যেন দানের প্রতিযোগিতা হত, কে কত দান করতে পারে। তাবুক যুদ্ধে আবু বকর রা. ও উমর রা.-এর দানের ঘটনা তো আমরা সকলেই জানি।
আর যারা সচ্ছল ছিলেন না, তারাও নিজেদের সাধ্যমতো দান করতেন। দ্বীনের জন্য নিজের সব বিলিয়ে দিতেন। তারা কর্মেও ছিলেন উদার, মনে ছিলেন আরও বেশি উদার। দান করার মতো কিছু না থাকলে শ্রম দিয়ে সাহায্য করতেন।
হিজরতের পর মুহাজিরদের সাথে আনসার সাহাবীগণ যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়েছেন, নিজেদের ধনসম্পদ তাদেরকে অর্পণ করেছেন, তা তাদের মনের বিশালতারই পরিচয়।
সাহাবায়ে কেরামের পরোপকারের অসংখ্য ঘটনা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তাদের পরার্থপরতার অনুপম বৈশিষ্ট্য কুরআনেও তুলে ধরা হয়েছে।
তারাই আমাদের আদর্শ ও অনুসৃত। কিন্তু আমরা তাদের পথ থেকে দূরে সরে গেছি। যাকাত দিতে অবহেলা করি, তালবাহানা করি, সাধারণ দান-সদকা দিতে কার্পণ্য করি। কার্পণ্য ছেড়ে দানশীলতার গুণ অর্জন করার যে নির্দেশনা কুরআনে দেওয়া হয়েছে, আমরা সে ব্যপারে উদাসীন। অনেক সময় অজুহাত দেই বা আফসোস করি, আল্লাহ আমাকে সম্পদ দিলে আমি অনেক দান করব। কিন্তু সম্পদ অর্জিত হলে দান করতে কার্পণ্য করি।
সতর্ক হওয়া দরকার, যেন আল্লাহ আমাদের এহেন দ্বিচারিতার কারণে নেফাককে আমাদের মনে স্থিত করে না দেন। যেমন হয়ে গেছে মুনাফিকদের। তাহলে কী দুর্ভাগ্য হবে আমাদের! আমরা আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে বঞ্চিত হব।
আমাদের এভাবে চিন্তা করা দরকার যে, আল্লাহ আমাকে যতটুকু সম্পদ দিয়েছেন, তা থেকেই সাধ্যমতো দান করা আমার কর্তব্য। নিজের চাহিদা সীমিত করতে পারলেই দেখব, আমার কাছে দান করার অনেক সম্পদ আছে। আর যদি স্বভাবে কার্পণ্য লালন করি, তাহলে আল্লাহ আমাকে যতই দেন, তবুও সৎকাজে অর্থ ব্যয়ের জন্য আমার হাত খুলবে না।
তাই আল্লাহ তাআলার কাছে এই দুআ করব, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছেন–
اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ البُخْلِ.
হে আল্লাহ! আমি কৃপণতা থেকে আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩৬৫
হাদীসে এ-ও বর্ণিত হয়েছে, প্রতিদিন দুইজন ফেরেশতা আল্লাহর কাছে দুআ করেন, হে আল্লাহ! যে দান করে তাকে আপনি আরও দিন, আর যে সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখে, তার সম্পদ ধ্বংস করে দিন। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৪২
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কৃপণতা থেকে রক্ষা করে দানশীলতার গুণ দান করুন– আমীন।