মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনা ও কামালে মৃত্যুদণ্ড
‖ এখন প্রয়োজন দ্রুত বাস্তবায়ন
গত ১৭ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সুস্পষ্ট কিছু অপরাধের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করেছেন। এ মামলার অপর আসামী সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনকেও পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। দুপুর ১২টা ৩৪ থেকে ২টা ৫৪ পর্যন্ত তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারক বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদার ৪৫৩ পৃষ্ঠাব্যাপী লিখিত রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই বিচারক ছিলেন, বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এ মামলায় হাসিনা ও তাঁর উক্ত দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে যে পাঁচটি মৌলিক অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ :
১. উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া।
২. হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’ দেওয়া।
৩. রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্বব্যিালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদ হত্যার ঘটনায় প্ররোচনা, উসকানি, ষড়যন্ত্র, সহায়তা, সম্পৃক্ততার অভিযোগ।
৪. গত বছরের পাঁচই আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা ছয়জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ।
৫. আশুলিয়ায় জীবিত একজনকেসহ মোট ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগে। (আমার দেশ অনলাইন, ১৭ নভেম্বর ২০২৫)
এদেশের একজন সাধারণ মানুষও জানে, হাসিনা ও তাঁর মন্ত্রীগণ এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত উপরোক্ত অভিযোগগুলো বিগত ১৫-১৬ বছর ধরে তাদের দ্বারা সংঘটিত গুম, হত্যা ও নির্যাতনগুলোর সাথে মেলালে অনেকটা প্রতীকীই মনে হবে। দীর্ঘদিন অবৈধভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রেখে হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের অনেকটা পৈশাচিকতা পেয়ে বসেছিল। তাঁর চালচলন, কথাবার্তা ও আচার-আচরণে প্রায়শই ফেরাউনিয়াত ফুটে উঠত। সেই দুর্দান্ত অহংকারী ও প্রতাপশালী শাসক এখন ফাঁসির রশির দ্বারপ্রান্তে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বিচারপ্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছ ও প্রমাণনির্ভর হয়েছে। বিশেষত জাতিসংঘ কর্তৃক তদন্ত হওয়ায় এবং হত্যা ও দমন সংক্রান্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ফরেনসিক রিপোর্টে প্রমাণিত হওয়ায় হাসিনার আশ্রয়দাতা এবং সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ভারত সরকারও এ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার সাহস পায়নি। যদিও হাসিনা ও তাঁর দলের লোকদের প্রতিক্রিয়া যা ভাবা হয়েছিল, তাই ছিল– তাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি, এগুলো একপেশে ও পক্ষপাতপূর্ণ রায় ইত্যাদি।
আসলেই কি তাই? হাসিনাকে কি কেউ বাংলাদেশে এসে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের জবাব দিতে বাধা দিয়েছিল। উল্টো তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারত সরকারকে বহুবার তাঁকে বাংলাদেশের হাতে সোপর্দ করার দাবি করা হয়েছে। হাসিনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি কেবল গুম খুনে হাসিনার প্রধান সহযোগী ছিলেন না; বরং এ লোকটি আলেমদের বন্ধু বেশ ধরে ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ক্ষতি করে গেছেন কওমী মাদরাসা বোর্ড, মাদরাসা কেন্দ্রিক রাজনীতি এবং হাক্কানী উলামায়ে কেরামের। এ দৃষ্টিকোণ থেকেও আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে আসা রায়টি কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। এ ভদ্রলোক হেফাজতে ইসলাম, আলহাইয়াতুল উলইয়া, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া এবং দেশের বিভিন্ন বড় বড় মাদরাসাগুলো নিয়ে যে চক্রান্ত ও ক্ষয়ক্ষতি করে গেছেন, সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সহজে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হাসিনা-কামাল তো পলাতক। তাঁদের বিরুদ্ধে দেওয়া ফাঁসির আদেশ বাস্তবায়িত হবে কীভাবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, যেহেতু ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। সেটি সম্ভবত হাসিনাই করে গেছেন। অন্যদিকে হাসিনার বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, তাই দেরিতে হলেও ভারতকে হয়তো মাথা নোয়াতে হবে। ভারত চাইলেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের আগামী সরকারগুলোর সাথে বৈরিতা অব্যাহত রাখতে পারবে না। যদি এমনই হয়, তাহলে বাংলাদেশে নতুন ইতিহাস তৈরি হবে। ফাঁসির রশিতে ঝুলবেন একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আরেকজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সেদিন যদি এসে যায়, তাহলে নিশ্চয় অসংখ্য সন্তানহারা মায়ের চোখে আবার অশ্রু বয়ে যাবে। সেটি হবে শুকরিয়া ও আনন্দের অশ্রু। এদেশের বহু মানুষ সেই দিনের অপেক্ষা করে যাবেন নিশ্চয়।
অত্যাচারী জালেম শাসকদের আসল বিচার তো মহান রব্বুল আলামীন হাশরের দিনে করবেন। তবুও দুনিয়ার জীবনেও পৃথিবীর অসংখ্য জালেমশাহীর নির্মম পরিণতি হয়েছে। তাদের অনেকেরই দফারফা হয়েছে অন্য ক্ষমতাবানদের হাতে। কারও কারও ন্যায়-বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে। কিছুসংখ্যক জালেম শাসকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু শেষ জীবন তাদের কেটেছে কঠিন যন্ত্রণাদায়ক রোগ-বালাইয়ে। তবুও স্বৈরাচারী শাসকরা ইতিহাস থেকে কমই শিক্ষা নেয়।
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আলোচিত মামলাটির তৃতীয় আসামী তাঁরই নিয়োগ করা চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। এই লোকগুলোর মাধ্যমেই হাসিনা নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছে নাগরিকদের ওপর। আব্দুল্লাহ আল-মামুনের কিন্তু মৃত্যুদণ্ড হয়নি। তাঁকে দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। কারণ তিনি শুধু নিজে দোষ স্বীকার করেননি, বরং হাসিনার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছেন। এটি ইতিহাসের শিক্ষা। আপনি চাকর-বাকরদের দিয়ে, বিশ্বস্ত অধীনদের ওপর আস্থা রেখে তাদের মাধ্যমে অপকর্ম করে বেঁচে যেতে চাইলেও একসময় এই বিশ্বস্তরাই হয়তো আপনার অপকর্ম ফাঁস করে দেবে। যার ওপর ভর করে আপনি কাউকে খুন করবেন, কারও ওপর নির্যাতন চালাবেন, তার মাধ্যমেই হয়তো এর পরিণতিও ভোগ করবেন। হাসিনার নিয়োগ করা তাঁর বিশ্বস্ত পুলিশ প্রধান আব্দুল্লাহ আল-মামুন সে দৃষ্টান্তই আবার রাখলেন।
আমরা আগেও বহুবার বলেছি, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের একটি গোষ্ঠীকে বিদায় দিলে প্রকৃত সফলতা আসবে না, যদি না সে ফ্যাসিবাদ ও তার বিভিন্ন শ্রেণির প্রকৃত দোসরদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। ফ্যাসিবাদের কিছু লোক পালিয়ে গেলেও তাদের অনেকেই এখনো দেশেই রয়ে গেছে। কেউ কেউ বন্দিও আছে। এসকল লোকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এবং এখনো যারা তাদের পক্ষে এদেশে সাফাই গাওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে, তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা দেশ ও জনগণের ভবিষ্যতের জন্য অতিব জরুরি।
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের শাসক মহল এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষমতাবানেরা এ রায় থেকে কিছুটা হলেও শিক্ষা নিলে তা এ দেশ এবং অন্যান্য দেশের সাধারণ মানুষের জন্য সুখকর হওয়ার আশা করা যায় নিশ্চয়।
ভূমিকম্প <br> ‖
প্রয়োজন সতর্কতা ও আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া
২১ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। এতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দালানকোঠা ও স্থাপনার ক্ষতির পাশাপাশি প্রাণহানিও ঘটেছে বেশ কয়েকজন বনী আদমের। আহত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছেন শত শত মানুষ। ভূমিকম্প নিয়ে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। কিয়ামতের আগে ভূমিকম্পের পরিমাণ বেড়ে যাবে– এমন কথাও ইরশাদ করে গেছেন। বাস্তবেই যত দিন যাচ্ছে, পূর্বের তুলনায় বিভিন্ন দেশে ভূমিকম্পের পরিমাণ ও ক্ষয়ক্ষতি বেড়েই চলেছে।
ভূমিকম্পের মতো কঠিন পরিস্থিতিতে যেমনিভাবে সতর্কতা, ধৈর্যধারণ ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন, তেমনি আবশ্যকীয় কর্তব্য হল, মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা। তওবা-ইস্তেগফার করা এবং তাঁর সাহায্য চাওয়া। আল্লাহ তাআলা এ দেশ, এ দেশের মানুষ এবং বিশ্ববাসীকে যেকোনো বিপর্যয় থেকে রক্ষা করুন।