Rabiul Ahkir 1447   ||   October 2025

নেপালের গণঅভ্যুত্থান ও ডাকসু নির্বাচন : প্রাসঙ্গিক কথা

Mufti Abul Hasan Muhammad Abdullah

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতেই আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটে গেল দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপালে ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ঈ. তারিখে ব্যাপক জনরোষের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি এর আগে তাঁর মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য একে একে পদত্যাগ করেছিলেন তাঁদের হয়তো আশা ছিল এর দ্বারা পরিস্থিতি শান্ত হবে; কিন্তু কাজ হয়নি দেশের সাধারণ জনগণ বিশেষত তরুণ ও যুব সমাজের বিক্ষোভের মুখে সরকার প্রধানও একপর্যায়ে পদ ছাড়তে বাধ্য হন আন্দোলনকারীদের হাতে এতদিন ক্ষমতার উচ্চাসনে থাকা বড় বড় রথী-মহারথী কুৎসিতভাবে লাঞ্ছনার শিকার হন পুড়িয়ে দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ বড় বড় রাষ্ট্রীয় স্থাপনা অনেক বেসরকারি ভবনেও আগুন দেওয়া হয় ইতিমধ্যেই সেখানে সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে আগামী মার্চ মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে

২০২৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের দীর্ঘ সময় ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে থাকা ফ্যাসিবাদী স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটেছিল এমনই বিক্ষোভ ও গণরোষের মুখে অনেকেই সেই আন্দোলন এবং নেপালের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির মধ্যে মিল খুঁজে পান আসলে এখানে মিল-অমিল দুটোই রয়েছে বাংলাদেশের আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা কেন্দ্র করে নেপালে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভের সূত্রপাত কিন্তু দুটির পরিণতি এক জায়গায় গিয়েই শেষ হয় বিক্ষুব্ধ জনতা কর্তৃক সরকারের পদত্যাগের দাবি এবং দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাবানদের লাঞ্ছনাকর প্রস্থান আরেকটি বড় মিল হচ্ছে দু’দেশের আন্দোলনেরই নেতৃত্বে ছিল তরুণ ও যুবসমাজ যাদেরকে মিডিয়ার ভাষায় জেন-জি (জেনারেশন জেড) বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে কিন্তু দুই দেশের ঘটনাপ্রবাহে অমিলও রয়েছে কয়েক দিক থেকে বাংলাদেশে যেখানে পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ব্যাপকভাবে আন্দোলন শুরু হওয়ার পরও অনেক দিন পর্যন্ত ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছিল, যার দরুন হাজার হাজার মানুষ হতাহতের শিকার হয় দেশের কোটি জনতা চরম দুরবস্থায় দিনাতিপাত করে; কিন্তু নেপালে আন্দোলন চরমে ওঠার দ্বিতীয় দিনেই সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেয় যার দরুন সেখানে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম সঙ্গত কারণেই যত মন্দই হোক, সে দেশের পতিত ক্ষমতাসীনদের এদেশীয় ফ্যাসিবাদের তুলনায় ‘ভালো’ই বলতে হবে

নেপালের আন্দোলন চরমে পৌঁছা এবং একসময় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে চলে যাওয়ার পেছনে ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট এবং স্বজনপ্রীতিকে বেশি দায়ী করা হচ্ছে, যা আমাদের দেশের সাথে কিছুটা মিল আছে যদিও এখানকার পরিস্থিতি নেপাল থেকে অনেক ভয়াবহ ও শোচনীয় হয়ে উঠেছিল খবরে যা জানা গেছে, নেপালের ক্ষমতাসীনদের সন্তানদের ব্যাপক বিলাসিতা ও দম্ভ, তরুণ সমাজকে দ্রুত বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল বাংলাদেশের জনগণ তো এই পরিবার ও স্বজনপ্রীতির মহড়া স্বাধীনতার পর থেকেই সকল দলীয় সরকারের আমলেই দেখে আসছে

যাহোক কিছু মিল-অমিল এর মধ্যেও নেপালের সরকার পতন আন্দোলনকে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের সাথে তুলনা করেছেন অনেকেই নেপালে এমন এক সময়ে জনবিস্ফোরণের মুখে সরকারের পতন ঘটল, যখন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী বিক্ষোভকারী যুবসমাজ ও সাধারণ মানুষ অনেকটা হতাশার শিকার তাদের কেউ কেউ যখন ভাবা শুরু করেছে, জান বাজি রেখে  আন্দোলন করে দুর্নীতিবাজ ফ্যাসিবাদীদের একটি গোষ্ঠীকে ক্ষমতাচ্যুত করে লাভ কী? ঘুরেফিরে তো তাদের কাছাকাছি লোকদেরই ক্ষমতায় বসার রাস্তা খোলে আর ক্ষমতাচ্যুতদের তাবৎ সহযোগী ও দোসররা তো বহাল তবিয়তে থেকে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যায় হয়তো তাদের অনেকেই শুধু ভোল পাল্টায় দলীয় আনুগত্যের পরিবর্তন করে এই যা! এতে সাধারণ মানুষের কতটুকুই আর লাভ!

এই নিবন্ধের শেষ দিকে আমরা উপরিউক্ত প্রতিক্রিয়া নিয়ে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ এর আগে বাংলাদেশ ডাকসু নির্বাচন নিয়ে দুয়েকটি কথা হয়ে যাক

ডাকসু নির্বাচন

বেশ কয়েক বছর পর আবার অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অন্যান্য বড় বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে কিছু কিছু চিন্তক মানুষের কাছে এবারের নির্বাচনের ফলাফল ব্যতিক্রমী হবে বলে আগের থেকে অনুমেয় হলেও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে দাপট দেখানো লোকজনের কাছে ডাকসুর ফলাফল ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কারণ এবারের নির্বাচনে অল্প কয়েকটি পদ ছাড়া ভিপি, জিএস ও এজিএসসহ সবগুলো আসনই জিতে নিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি প্রথম ঘটনা সঙ্গত কারণেই একেবারে আসমান থেকে ধপাস করে পড়েছে কায়েমি স্বার্থবাদী সকল মহল ক্ষমতাপ্রত্যাশী বড় রাজনৈতিক দল, ইসলামবিদ্বেষী সকল মতলবি বামপন্থিরা, মিডিয়া জগৎকে আঁকড়ে রেখে মিথ্যা ও অপপ্রচারে মানুষকে বিভ্রান্ত করা গোষ্ঠী এবং মুক্তিযুদ্ধকে হাতিয়ার বানিয়ে অর্ধশতকাল যাবৎ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারে লিপ্ত থাকা ধান্দাবাজেরা

এ বিজয়ের নেপথ্যে কী?

আসলেই কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের এত সদস্য রয়েছে? সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, একেবারেই নয় যাদের ভোটে শিবির নেতারা জয়ী হয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই শিবির নয়; বরং সাধারণ নিরীহ ছাত্রসমাজ ওইসকল ছাত্রের ভোটই এবারের নির্বাচনে নিয়ামক শক্তি হয়েছে, যারা কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করে না যারা নিরীহ বলে পরিচিত

তাহলে প্রশ্ন হল, আরও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্যানেল থাকতে এবং আরও পরিচিত বড় বড় প্রার্থী থাকতে কেন তারা এই প্যানেলকে ভোট দিল এর বিশ্লেষণ চলছে এখন দেশের বিভিন্ন মহলে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও দেশের সে চেনা গোষ্ঠীরা তো তাদের মতো করেই আওড়ে যাচ্ছে, কারচুপি হয়েছে, অনিয়ম হয়েছে, প্রশাসন নিরপেক্ষ ছিল না ইত্যাদি আরও বিভিন্ন কথা এগুলো বলে মুখ ঢাকার চেষ্টা করছেন তারা

এমনকি তারা এত আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন যে, কয়েকদিন পরের জাকসু (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচনের ফলাফল ডাকসুর মতো হবে ধারণা করে তা বয়কটও করিয়ে বসে এমনকি নির্বাচনের সাথে জড়িত শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের কেউ কেউ পদত্যাগ করেন যেন সেখানেও যদি একই রকম ফলাফল হয়, তাহলে নির্বাচনটিকে বিতর্কিত আখ্যা দেওয়া যায় তাদের কেউ কেউ হয়তো ডাকসু নির্বাচনের কিছুটা আগেই পরিস্থিতি আঁচ করেছিলেন তাই পুরোনো কৌশলে ডাকসু নির্বাচনের দুয়েক দিন আগে শেষ চেষ্টাও করেছেন

দেশের বহুল প্রচারিত দৈনিকটিতে একটি কলাম প্রকাশিত হয় ডাকসু নির্বাচনের এক দিন আগে “ডাকসু ও জাতীয় নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধ কি ‘বস্তাপচা’ ইস্যু” শিরোনামে যদিও ভদ্রলোকের অন্যান্য লেখা সাধারণত সেই ঘরানার লোকদের মতো একপেশে এবং দালালিপূর্ণ হয় না মাঝে মাঝে বাস্তবমুখী ও হক কথাও লিখে থাকেন তিনি কিন্তু ঐদিনের তার কলাম দেখে হাসি এসে গিয়েছিল বোঝাই যাচ্ছিল, এটা শেষ রক্ষার চেষ্টা যদিও তার বয়স এত নয় যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বা প্রত্যক্ষ করেছেন তবুও তিনি সেই এতদিনের ফ্যাসিবাদীদের মূল হাতিয়ারটিকেই সামনে এনেছেন

তিনি কি জানেন না, মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দিয়ে এদেশকে দুর্নীতিবাজ মতলবি লোকেরা কীভাবে শোষণ করেছে এত বছর? যাদের বড় বড় নেতারা সকলেই মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরো সময়টি বিদেশে আরাম-আয়েশে বাস করেছেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা হয়ে গেছেন মূল মুক্তিযোদ্ধা অন্যান্য সেক্টর কমান্ডাররা তো তাদের কাছে পাত্তা পায়নি এমনকি প্রধান সেনাপতি উসমানীকেও পেছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত প্রকারের ব্যবসা যে তারা চালু করেছিল কতবার যে নতুন নতুন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ঘরে বসে তৈরি করে ফেলা হয়েছে, তার অন্ত নেই স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় যোগ-বিয়োগ চলছেই আর মুক্তিযুদ্ধের নামে ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাই নয়; বরং রাষ্ট্রীয় পদবি ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার মহড়া তো চলছেই অথচ কে না জানে যে, সত্যিকারের দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার ও লোভ-লালসার জন্য যুদ্ধ করেননি

এ নিয়ে বেশি বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না কারণ ইতিমধ্যেই এদেশের জনগণ জেনে গেছেন, মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুটি গৌরবের হলেও মতলবি লোকেরা এটিকে আসলে ‘বস্তাপচা’ই করে ফেলেছে

যাহোক শেষ প্রচারণা ও চেষ্টাও বিফলে গেছে সাধারণ ছাত্র সমাজ তাদের যা জবাব দেওয়ার দিয়ে দিয়েছে তারা আসলে ভোটের মাধ্যমে কী বোঝাতে চেয়েছে? অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, তারা স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫ দশকেরও বেশি সময় যাবৎ দেশ শাসন করা সকল গোষ্ঠীর প্রতি অনাস্থার প্রকাশ করেছেন

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠকে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাবানেরা তাদের দলীয় দালাল গোছের ভিসি ও একশ্রেণির শিক্ষকের মাধ্যমে যেভাবে অধঃপতনে নামিয়ে এনেছে এ নির্বাচন ছিল তার নীরব প্রতিবাদ বিশেষত ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যেভাবে দেশবাসী ও ছাত্রসমাজ একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল, তা যখন তারা এক বছর যেতে না যেতেই অঙ্কুরেই বিনাশ হতে দেখছে, তখন সাধারণ ছাত্র সমাজ এ ভোটের মাধ্যমে তাদের অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে এটি হয়তো আরও অনেকদিন চলবে যারা ইতিমধ্যে সংবিৎ হারিয়ে ফেলেছেন, তারাও হয়তো পুরোনো বিভিন্ন কৌশল দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করবেন এ নিয়ে আজ আর বেশি বলতে চাই না

একটি প্রশ্ন : ডাকসুর বিজয় কি জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে?

ডাকসুতে শিবিরের বিজয় কি ভবিষ্যতে জামায়াতের জয়ী হওয়াকে ইঙ্গিত করে?

যেহেতু ছাত্রশিবির জামায়াতের সহযোগী সংগঠন, তাই কেউ কেউ এটিকে আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর জয়ী হওয়ার ইঙ্গিতবাহক বলে প্রচার করছেন কিন্তু অভিজ্ঞ মহল তেমনটা মনে করেন না এর কারণ সুস্পষ্ট জাতীয় নির্বাচন ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন এক কথা নয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে যারা ভোট দেয়, তারা শিক্ষিত পেশিশক্তি বা অন্যভাবে প্রভাবিত না করা হলে সাধারণ ছাত্ররা তাদের সুচিন্তিত মতামত এ নির্বাচনে প্রকাশ করে থাকে কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচনের ধারণাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন যেখানে ভোটদাতাদের সিংহভাগই অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত তাদের অনেকেই দরিদ্র বা অবুঝ হওয়ায় টাকাওয়ালা প্রার্থীদের খপ্পরে পড়ে যায় তাই সাধারণ নির্বাচন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে একভাবে তুলনা করা বাস্তবসম্মত নয় এছাড়া জামায়াতে ইসলামী ইসলামী দল বলে পরিচিত হলেও তাদেরকে অনেকেই সঠিক ইসলামী চিন্তার দল বলে মনে করেন না যে উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সে পাক-ভারত-বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য উলামায়ে কেরাম জামায়াত প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর বহু চিন্তা-চেতনা ও কুরআন-সুন্নাহ্র ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে ভুল বলে আখ্যায়িত করেছেন জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা ভারত যেখানকারই হোক, ইসলামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তাদের আদর্শ কিন্তু মরহুম মওদুদী সাহেবই সুতরাং তারা ক্ষমতায় গেলে কোন্ ইসলাম কায়েম করবে, তা নিয়ে এদেশের জনগণের সংশয় এখনো কেটেছে বলে মনে হয় না তারাও এমন কেনো ঘোষণা দেননি যে, এখন তারা মওদুদী সাহেবের চিন্তা-চেতনা থেকে বের হয়ে গেছেন

অতএব শিবিরের বিজয় আগামী জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের বিজয় ধরে নেওয়া অভিজ্ঞ মহল বাস্তবসম্মত মনে করেন না তবে একথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না, সাধারণ ছাত্ররা যে উদ্দেশ্যে বা যে কারণেই শিবিরের প্যানেলকে ভোট প্রদান করুক, এটি জামায়াতে ইসলামীর জন্য অনেক বড় বাড়তি পাওনা হয়েছে অন্যদিকে যারা আগামী ফেব্রুয়ারির ঘোষিত নির্বাচনে ক্ষমতার আসনে নিজেদেরকে পাকাপোক্তভাবে আসীন বলে ধরে নিয়েছিল এবং বিগত ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর যেসকল দোসর-দালাল ভোল পাল্টে ওদের শিবিরে যোগ দিয়েছে তাদেরকেও চরম ভাবনায় ফেলে দিয়েছে এ নির্বাচন সব কথার বড় কথা হল, সাধারণ ছাত্রসমাজ ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষোভের নীরব বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে নিরীহ সাধারণ ছাত্রসমাজ মতলববাজ দুর্নীতিবাজে পরিপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে নিরীহ লোকেরা সঠিক সুযোগ পেলে এভাবেই সদ্ব্যবহার করে থাকে

প্রাপ্তি, হতাশা ও আশাবাদ

বলতে গেলে কয়েক শতাব্দী থেকেই পুরো পৃথিবীর শাসনব্যবস্থা সংখ্যালঘু মুষ্টিমেয় মানুষের পক্ষেই কাজ করছে সম্পদ ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের চরম বৈষম্য যেমন চলছে, তেমনি দেশে দেশে ক্ষমতাবানেরা নিজেদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থকে বরাবরই জাতীয় স্বার্থের ওপরে প্রাধান্য দিয়ে আসছে এর ফলে লুটপাট ও জুলুম নির্যাতন, দমন ও দাবিয়ে রাখার অপকৌশল তো রয়েছেই; সাধারণ জনগণ অধিকাংশ দেশেই তাদের যাতাকলে পিষ্ট অনেক দেশে মানুষ ভোট দিয়ে অন্য পক্ষকে ক্ষমতায় আনে; কিন্তু ফলাফল কাছাকাছিই থাকে তাদের দশা একই রকম থেকে যায় একসময় মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে, আর বুঝি এদেরকে নামানো যাবে না এ জুলুমের বুঝি অন্ত নেই কিন্তু হঠাৎ করেই বিভিন্ন জায়গায় আলোর মশাল জ্বলে ওঠে পতন ঘটে যায় কোনো এক স্বৈরাচারের

বিগত প্রায় দুই দশক থেকে আরব বসন্ত থেকে শুরু করে উপমহাদেশে শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশ এবং সর্বশেষ নেপালের পরিস্থিতি ও ঘটনাপ্রবাহ প্রায় একই সূত্রে গাঁথা সব জায়গায় দীর্ঘ হতাশার পর আশার আলো হয়ে দেখা দেয় কিছু অপশক্তির বিদায় কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার ভিন্নরূপে আসে শোষকগোষ্ঠীর আগ্রাসন এসব দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছেন অনেকে কেউ কেউ বলেও বসছেন, তাহলে আগের ওয়ালাকে সরিয়ে লাভ হয়েছে কী? যদি আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরানো অব্যাহতই থাকে আন্দোলন অভ্যুত্থান করে কী ফায়েদায়ই বা হল?

কেউ কেউ এমনও বলে ফেলেন, ভবিষ্যতে মানুষ আর আন্দোলনেই নামবে না একটি দুষ্ট চক্রকে সরিয়ে আরেকটি দুষ্ট চক্রকে বসালে লাভই বা কীসের?

আসলেই কি তাই?

পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী এবং যুগে যুগে ক্ষমতাসীনদের উত্থান-পতনের ইতিহাসে যাদের চোখ রয়েছে, তারা কিন্তু এমনটি মনে করেন না তাঁরা হতাশার মধ্যেও আশার আলো খুঁজে নেন দেশে দেশে ফ্যাসিবাদ স্বৈরাচারদের একেকটি গোষ্ঠীর পতন যদিও চূড়ান্ত কোনো বিজয় নয়; বরং প্রচলিত জুলুমতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে সত্যিকারের ইনসাফভিত্তিক শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েমই মূল সমাধান তবুও এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সফলতাকেও তারা মূল্য দিতে চান

তারা মনে করেন, এভাবেই বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত সাধারণ মানব সমাজ বিশেষত মুসলিম দেশগুলোর জনসাধারণ ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠবে এবং দেশ, জনগণ ও ইসলামের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের জন্য একসময় পুরোপুরি প্রস্তুত হবে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সচেতন হয়ে ওঠে, যদি বর্তমান ব্যবস্থাসমূহের মিথ্যা ও প্রতারণার ফাঁদ থেকে তাদেরকে বের  করে আনা যায়, মুসলিম দেশগুলোতে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইবাদত-বন্দেগী, পরিবার, সমাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেন এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে ইসলামের সত্যিকারের অনুসারী হয়ে ওঠে, তাহলে চূড়ান্ত বিজয়ও একদিন হাতে ধরা দেবে

আলোর মধ্যে অন্ধকার মাঝে মাঝেই আসে; কিন্তু পৃথিবীর নিরীহ নিপীড়িত কোটি মানুষ যেদিন ক্ষুদ্র জোনাকি হয়ে জ্বলে উঠবে, সে সম্মিলিত আলোতেই দমিত হয়ে যাবে সকল অন্ধকার

وَقُلۡ جَآءَ الۡحَقُّ وَزَہَقَ الۡبَاطِلُ  اِنَّ الۡبَاطِلَ کَانَ زَہُوۡقًا.

এবং বল, সত্য এসে গেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, নিশ্চয়ই মিথ্যা এমন জিনিস, যা বিলুপ্ত হওয়ারই সূরা বানী ইসরাইল (১৭) : ৮১ 

 

advertisement