মূল্যায়নের মূল্য
মাওলানা আবরারুয যামান
আমার গন্তব্য কলাতিয়া থেকে আলীপুর। সবকিছু সুন্দরমতোই চলছিল। একটি যাত্রীটানা অটোরিকশাও পেয়ে গেলাম সহজেই। পরিবেশটাও বেশ মনোরম। বৃষ্টিধোয়া প্রকৃতি। অনেকটাই নীরব পথঘাট। পেছনের আসনে দুজন যাত্রী। আমি চালকের বাম পাশে। ডান পাশে একটি আসন এখনো খালি। রিকশা চলছে মধ্যম গতিতে। ভালো লাগার ফুরফুরে অনুভূতি। একজন হাত দেখাল ‘ব্রীজের ওপার যাবেন?’ চারপাশের সবকিছুর সমস্ত সাধারণের মাঝে এ-ও এক সাধারণ প্রশ্ন। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলল। কোথাও কোনো বিপত্তি বাঁধল না। মনের মধ্যে কাঁটা বিঁধার মতো কিছুই ঘটল না। ঘটল তখন, যখন ‘অটোওয়ালা’র উত্তরটা কানে এল, ‘আহেন আহেন’। ‘আহেন’ ‘আসেন’ বা ‘আসুন’-এর বিষয় না। বিষয়টা হল, কথার পুনরাবৃত্তি।
‘আহেন’ বা ‘আসেন’ একবার না বলে দুবার কেন? গাড়ি চলছে, তারচেয়ে অনেক বেশি গতিবেগে চলছে আমার চিন্তার চাকা। হয়তো তেমন কিছুই না; কিংবা হয়তো অনেক বড় কিছু।
শব্দের এ তাকরার বা পুনরাবৃত্তির মাঝে কি কিছু লুকিয়ে নেই? আছে। অবশ্যই আছে। কথা যে বলছে, জিজ্ঞেস করলে সে হয়তো কোনো উত্তর দিতে পারবে না। কিন্তু অবচেতন মন বলতে একটা বিষয় আছে। সে অবচেতন মন থেকেই আমরা অনেক সময় এ ‘পুনরাবৃত্তি’র জালে আটকা পড়ি। আমিও হয়তো জানি না এবং কোনোদিন জানতেও পারি না, আমার কথায় কিছু মানুষের হৃদয়ে চোট লাগছে।
শব্দের চেয়ে সুরের গভীরতা যে অনেক বেশি! একই শব্দ, সুরের বিভিন্নতায় কত না অর্থ ধারণ করে। পুনরাবৃত্ত শব্দ– এমনি একটি বাস্তবতার নাম।
***
রেলস্টেশনে রেলের অপেক্ষায় বসে আছি। আমার পাশে আরেকজন লোকের বসার মতো জায়গা আছে। কেউ নেই বলে আমি একটু জায়গা নিয়ে বসেছি। হঠাৎ কানে এল কারো শব্দ ‘চাপেন চাপেন’। আবারও বলি, চাপেন, চাপুন বা চেপে বসুন-এর বিষয় না; বিষয় হল, ঐ পুনরাবৃত্তি। চাপেন শব্দের এ পুনঃপুনঃ উচ্চারণ কী বোঝায়? যা বোঝায়, তা কি আমার বা আপনার জন্য সুখকর? উচ্চারণকারীর জন্য একটি সুসভ্য পরিচয়ের ধারক?
তাহলে কীভাবে বলা উচিত ছিল? সেটিও বুঝিয়ে বলার বিষয় না। একজন শরীফ ও সুসভ্য মানুষ জীবনে যা কিছু উচ্চারণ করে, সেটির নিয়ন্ত্রক হয় অস্তিত্বে মিশে থাকা তার শারাফাত ও ভদ্রতা। আমাদের যবানের উচ্চারণ এরই এক প্রকাশক্ষেত্র।
একজন সুসভ্য মানুষের তাই আলাদাভাবে শিখে নিতে হয় না অনেক কথা। উচ্চারণের সুর ও স্বরের সবক নিতে তাকে করতে হয় না আলাদা কসরত। মানুষের প্রতি যার আছে শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ, আছে মূল্যায়নের সুতীব্র ইহসাস, তাকে কথার সুর শিখিয়ে দিতে হয় না। শব্দের নির্বাচনেও তাকে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। হৃদয়ের স্বচ্ছতা তার বাইরের অবস্থাকে করে আরও বেশি স্বচ্ছ ও সাবলীল।
কখনো এটি হয় ফিতরী ও স্বভাবজাত। কখনো হয় কাসবী ও স্ব-অর্জন। এ হল কথায় মিষ্টতা ও তিক্ততার উৎসস্থল। এজন্য কথাকে সুন্দর করার জন্য শব্দ ও সুরের যেমন সবক নিতে হয়, তারও আগে হৃদয়ে অর্জন করতে হয় কিছু গুণ, কিছু সিফাত। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সীরাত সে শিক্ষাই আমাদের দেয়।
এমনই একটি গুণ হল, মানুষের প্রতি মূল্যায়নের দৃষ্টি। যে মানুষটি আমার সামনে আছে, আমি তাকে মূল্যায়ন করা শিখব। আমার সাথে তার সম্পর্কের সূত্র ও পরিধি যাই হোক, আমি ভাবব, তিনি আল্লাহর এক বান্দা। তার কাছে আমার কিংবা আমার কাছে তার কোনো প্রয়োজনের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এ সম্পর্ক বড় দামি সম্পর্ক। আমি তাকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখতে পারি না। তার কথার প্রতি আমি মনোযোগহীন হতে পারি না। তার সাথে আমি বলতে পারি না এমন সুরে কথা, যে কথায় সচেতন বা অবচেতনভাবে ফুটে ওঠে তাচ্ছিল্য। না, এমনটি আমি কিছুতেই করতে পারি না। আমি জানি না, আল্লাহর কাছে এ মানুষটির মূল্য কত। জানি না, পরিণাম দিবসে কার অবস্থান কোথায় হবে।
এমনভাবে চিন্তা করলে মূল্যায়নের শক্তিটি অর্জন করা সহজ। এ শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কথার বহু গতি ও প্রকৃতি। এমনকি এ শক্তি দিয়ে হারানো সম্পর্ক পুনরুদ্ধারও সম্ভব। সত্যিই সম্ভব।
***
এ পর্যন্ত লিখে শেষ করে দিয়েছিলাম লেখাটা। আমার সৌভাগ্য, লেখাটি তখনই নযরে পড়ল একজনের। অনেক বড় মনের মানুষ তিনি। এ লেখায় যে আলোকিত মানুষদের সন্ধান আমি করেছি, তাদেরই সমুজ্জল উদাহরণ তিনি। আল্লাহ তাঁকে উত্তম জাযা দান করুন। লেখাটি পড়ে ছোট্ট দুয়েকটি মন্তব্য তিনি করলেন। তারপর পরামর্শ দিলেন, লেখাটিতে আরও কিছু বিষয় থাকলে ভালো হবে। মানুষের প্রতি মানুষের মূল্যায়নের দৃষ্টি, এর কিছু উদাহরণ থানভী রাহ.-এর কিতাব থেকে আনা যেতে পারে। পাশাপাশি ‘আসসাহিবু বিল জামব’-এর ওপর কিছু আলোকপাত হতে পারে।
উপরে যার কথা বলছিলাম তিনি হলেন মাওলানা তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব। তিনি নিজেই হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের একটি ঘটনা শোনালেন। সেটি ছিল অনেক দিন আগের একটি ছোট্ট ‘সফরনামা’। পথের দূরত্বও অতি সামান্য। আলীপুর থেকে কাছাকাছি দূরত্বের কোনো জায়গা। ভাড়ায় চালিত যাত্রীবাহী সিএনজি। পেছনে তিনজনের আসন। পেছনের আসন পুরো হয়ে গেছে। হযরত আমীনুত তালীম ছাহেব, মাওলানা তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব এবং আরও একজন। চালকের বাম পাশের আসনেও যাত্রী। খালি আসন একটি। পুরো গাড়ির মধ্যে সেটিই সবচেয়ে অসুবিধার আসন। এমন সময় নতুন যাত্রীর আগমন। তিনি সামনের ঐ আসনে বসবেন না। চালক চট করে পিছনে ফিরে আমীনুত তালীম ছাহেবকেই বলে বসলেন, ‘হুজুর! সামনে বসেন’।
কন্ঠে কিছুটা হুকুমের সুর। হুজুরের তখন কোমরে ব্যথা। সামনের ঐ আসনে বসা অনেক কষ্টকর। মাওলানা তাওহীদ লক্ষ করলেন, হুজুর সামনের আসনে বসার জন্য নেমে যাচ্ছেন। মাওলানা তাওহীদ বললেন, হুজুর, আপনি এখানে বসুন, আমি সামনে বসছি। কিন্তু হুজুর নিজেই নামলেন। সামনের আসনে বসলেন। গন্তব্যে পৌঁছার পর মাওলানা তাওহীদ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হুজুরকে তাসাল্লীর স্বরে বললেন, লোকটা আপনাকে চিনতে পারলে এ কাজটা করত না। হুজুর তখন একটুও দেরি না করে কী উত্তর দিলেন! হুজুর বললেন, ‘আমাকে চিনতে পারলে সিএনজিওয়ালা তার গাড়িতেই আমাকে চড়তে দিত না!’
***
আল্লাহ জাযা দান করুন ভাই তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিবকে। এমন একটি গল্প শুনিয়ে তিনি আমার মুর্দা লেখাকে যিন্দা করে দিলেন! হৃদয়ের গভীরে অনুভূতির কোন্ উৎস থেকে সৃষ্টি হয় মূল্যায়নের এমন নজিরবিহীন গল্পের! আমাদের উস্তাযে মুহতারামের এ তো একটি ঘটনামাত্র। আসলে পুরো জীবনটাই তাঁদের সাজানো এমন সব অমূল্য রতন দিয়ে। গোটা সৃষ্টির মাঝে নিজেকে সবচেয়ে ছোট, সবচেয়ে ক্ষুদ্র মনে করা এবং মনে করতে পারা– এ-ই না হলে কী করে সম্ভব মূল্যায়নের এ নূর-দৃষ্টিকে সৃষ্টিময় প্রসারিত করা!
***
যেখানেই প্রয়োজন সংঘবদ্ধতার, সেখানেই প্রয়োজন মূল্যায়নের। একটি সুন্দর পরিবারের জন্যও চাই মূল্যায়নের এ সিফাত। একজন ছোট্ট মানুষ, হয়তো আপনার ছেলে বা নাতির বয়সী, তাকে এবং তার মুখের কথাকে যদি আপনি মূল্যায়ন করতে শেখেন, এ মূল্যায়নের মূল্য আপনিও পাবেন– জীবনেও, মরণের পরেও।
আরব সাগরের পাড়ে নৈসর্গিক শহর ‘জেদ্দা নগরী’। নগরীর একজন প্রবাসী বাসিন্দা মাওলানা ইলিয়াস। সাজানো সংসার। বড় সন্তানটার বয়স পাঁচ কি ছয়। নামটা মনে নেই। এক সফরে তাঁর বাড়িতে মেহমান হওয়ার সুযোগ হল। আমার আব্বা হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. এবং আম্মাও ছিলেন সে সফরে। দস্তরখানে বিরাট বাহারি আয়োজন। দুপুরের খাবার চলছে। আব্বা, আমি ও মাওলানা ইলিয়াস, সাথে তাঁর পাঁচ বছরের সন্তান। আমরা এ ক’জন দস্তরখানে বসা। এতসব আয়োজনের মধ্যে একটি বিষয় আমার দৃষ্টি কাড়ল এবং আমার মনে মুগ্ধতার একটা স্থায়ী রেখা টেনে দিয়ে গেল। আমি লক্ষ করলাম, ইলিয়াস ভাই তার পাঁচ বছরের ছেলের সাথে ‘পরামর্শ’ করছেন, আগামীকাল খাবারের মেনুটা কী হতে পারে। ছেলেটাও বড় আগ্রহের সাথে বাবাকে ‘পরামর্শ’ দিচ্ছে! আমার মুগ্ধতা বা বিস্ময়ের দৃষ্টি দেখেই হয়তোবা ইলিয়াস ভাই এর ব্যাখ্যাও দিলেন। বললেন, আমি এমন করি। আমার ছেলের সাথে পরামর্শ করে বাজারের মেনু সাজাই। এতে আমার মনে হয়, সে আমাকে আরও বেশি আপন ভাবতে শিখবে। আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে।
এ মূল্যায়ন একটি সন্তানের মনকে কতটা বড় করে দেয়! এমন বাবার প্রতি সন্তান কতটাই না কৃতজ্ঞতার অনুভূতি নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে! এমন পিতা ও পুত্রের মধ্যে কখনো তৈরি হতে পারে না অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব।
***
সেদিন কথা হল আমার এক সাথির সাথে। কথার বিষয়বস্তু নাযুক। বড়ই স্পর্শকাতর। বাবার ওপর তার অভিমান। বাবা তার কথা শোনেন না। কোনো পরামর্শের মূল্য দেন না। মূল্য দেওয়া দূরের কথা; কথা শুনতেই চান না। বাবাকে কিছু বলতে গেলেই বাবার এককথা, ‘তুই কী বুঝিস, চুপ থাক’।
ছেলের মনে তাই ভীষণ অভিমান। সে অভিমান থেকে পিতা-পুত্রের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব। ছেলেটারও এখন তাই গ্রহণ করতে ইচ্ছে করে না বাবার অনেক উপদেশ।
কেন হল এমন? উত্তর হয়তো অনেক কিছুই আছে। সাথে আছে এ কথাও যে, সন্তান তার কোনো কথার ‘মূল্য’ পাচ্ছে না বাবার কাছে। সামান্য একটু মৌখিক মূল্যায়নের অভাবে সন্তানটা হাঁসফাঁস করছে। সে পারে না আপন হতে। যেমন আপন হওয়া দরকার একজন পিতার কাছে একজন সন্তানের। বাবার অসংখ্য ইহসান ও অনুগ্রহের কথাও সে ক্রমাগত বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে।
***
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুরোটা জীবন এমন হাজারো ঘটনায় ভরপুর, যেখানে আছে মূল্যায়নের জীবন্ত সবক। বড়-ছোট সকলের কথাকে মূল্যায়ন করার অগণিত নজির। আল্লাহ রাব্বে কারীমের সাথে যার সরাসরি ওহী ও প্রত্যাদেশের সম্পর্ক, সেই নবীকেই সাহাবায়ে কেরাম রা. বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। নবী হয়েও উম্মতীর সেই পরামর্শ তিনি কীভাবে কতটা সাদরে, কতটা মূল্যায়নের সাথে গ্রহণ করেছেন, সেটিই আমাদের শেখার বিষয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মূল্যায়নের এ মহান গুণটি অর্জন করার তাওফীক দান করুন– আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন!