সন্তানের বিয়োগে সবরের প্রতিদান
মাওলানা বাশীরুদ্দীন আদনান
মা-বাবার কত দুআ, কষ্ট ও ধৈর্যের পর সন্তান জন্মলাভ করে। ঘর আলোকিত হয়। মা-বাবা কত শত স্বপ্নের জাল বোনেন।
সন্তানের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে মা-বাবার স্বপ্নও ডালপালা ছড়াতে থাকে। তারপর অনেক সময় এ সন্তানের ব্যাপারেই আল্লাহর ফয়সালা এসে যায়। ছোট্ট সোনামণিকে চলে যেতে হয় পৃথিবী ছেড়ে। কলজে ছেঁড়া ধনকে বিদায় দিতে গিয়ে মা-বাবার মনের যে কী দশা হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যরা বুঝতে পারবে না।
সম্প্রতি আমাদের দেশের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় বহু শিশু-কিশোর মারা গিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাদের মা-বাবাদের উত্তম বদলা দান করুন। তাদের জন্য সবচেয়ে বড় সান্ত্বনার পরশ এটাই হতে পারে যে, আল্লাহ তাদের সন্তানদের শাহাদাতের মর্যাদা দান করবেন এবং সবরের বিনিময়ে তারা মহা প্রতিদান লাভ করবেন।
এই কঠিন পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের কীভাবে সান্ত্বনা দেবে সে বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ্য় চমৎকার দিক-নির্দেশনা রয়েছে। তারা যদি আল্লাহ অভিমুখী হয়ে সবর করেন, তাহলে তাদের প্রতি থাকবে আল্লাহ তাআলার বিশেষ করুণা, দয়া ও পুরস্কার।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক হাদীসে রয়েছে অপূর্ব সান্ত্বনাবাণী! তিনি বলেন–
إِذَا مَاتَ وَلَدُ العَبْدِ قَالَ اللهُ لِمَلاَئِكَتِه: قَبَضْتُمْ وَلَدَ عَبْدِي، فَيَقُولُونَ: نَعَمْ، فَيَقُولُ: قَبَضْتُمْ ثَمَرَةَ فُؤَادِه، فَيَقُولُونَ: نَعَمْ، فَيَقُولُ: مَاذَا قَالَ عَبْدِي؟ فَيَقُولُونَ: حَمِدَكَ وَاسْتَرْجَعَ، فَيَقُولُ اللهُ: ابْنُوا لِعَبْدِي بَيْتًا فِي الجَنَّةِ، وَسَمُّوهُ بَيْتَ الحَمْدِ.
কারো সন্তান মারা গেলে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের বলেন, তোমরা আমার বান্দার সন্তানের রূহ কবজ করে ফেললে!
ফেরেশতাগণ বলেন, জী হাঁ।
আল্লাহ বলেন, তোমরা তার কলিজার ধনকে নিয়ে নিলে?
তারা বলেন, জী হাঁ।
তিনি সুধান, আমার বান্দা কী বলল?
তারা উত্তর দেন, সে আপনার প্রশংসা করেছে এবং বলেছে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।
এরপর আল্লাহ বলেন, তোমরা আমার বান্দার জন্য জান্নাতে একটা ঘর বানাও এবং সে ঘরের নাম রাখ ‘বাইতুল হাম্দ’ বা প্রশংসা-নিবাস। –জামে তিরমিযী, হাদীস ১০২১
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত থেকেও আমরা এ কঠিন মুহূর্তের করণীয় শিখতে পাই। যখন তাঁর পুত্রধন কোলের শিশু ইবরাহীম মৃত্যুবরণ করলেন, তখন তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন–
تَدْمَعُ الْعَيْنُ وَيَحْزَنُ الْقَلْبُ، وَلَا نَقُولُ إِلّا مَا يُرْضِى رَبَّنَا، وَاللهِ يَا إِبْرَاهِيمُ إِنَّا بِكَ لَمَحْزُونُونَ.
চোখ অশ্রুসজল, হৃদয় ব্যথিত, তবে আমরা এমন কিছু বলব না, যা আমাদের রবকে অসন্তুষ্ট করে। আল্লাহর কসম, হে ইবরাহীম! তোমার বিয়োগে আমরা বড়ই ব্যথিত। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩১৫
পাহাড়সম ধৈর্য, সন্তানের প্রতি স্বভাবজাত গভীর স্নেহ-মমতা এবং সবার ওপরে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনার কী অনুপম মিশেল!
একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক কন্যা তাঁর কাছে সংবাদ পাঠালেন, আমার ছেলে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, আপনি আসুন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ খবর শুনে বলে পাঠালেন–
إِنَّ لِلهِ مَا أَخَذَ، وَلَه مَا أَعْطَى، وَكُلٌّ عِنْدَه بِأَجَلٍ مُسَمًّى، فَلْتَصْبِرْ، وَلْتَحْتَسِبْ.
আল্লাহ যা নিয়ে নেন, তা তাঁরই। তিনি যা দেন, তাও তাঁর। তাঁর কাছে সবকিছুরই রয়েছে এক স্থিরীকৃত কাল। কাজেই (তাকে বল,) সে যেন ধৈর্যধারণ করে এবং সওয়াবের আশা রাখে। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৮৪
নারী সাহাবী উম্মু সুলাইম রা. ও তাঁর স্বামী আবু তালহা রা.-এর ঘটনা পড়ুন–
তাঁদের এক ছেলে মারা গেল। সব বাবাদের মতো আবু তালহা রা.-ও ছেলেদের বড় ভালবাসতেন। ছেলের মৃত্যুর সময় উম্মু সুলাইম রা. আশপাশের মানুষকে বললেন, তোমরা আবু তালহাকে কিছু জানিয়ো না, আমিই জানাব। এরপর তিনি ছেলেকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন।
আবু তালহা রা. রাতে ঘরে ফিরে ছেলের খোঁজখবর জানতে চাইলে উম্মু সুলাইম বললেন, আপনার ছেলে অনেক কষ্ট পেয়ে এখন শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে।
এরপর তিনি স্বামীকে খেতে দিলেন, যত্ন-আত্তি করলেন। সব কাজ সেরে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, বলুন তো, আপনার কাছে যদি কেউ কোনো আমানত রাখে আর আপনি তা দ্বারা উপকৃত হন, তারপর সে তা ফিরিয়ে নেয়, আপনি কি তাতে কষ্ট পাবেন?
আবু তালহা রা. বললেন, না তো, কষ্ট পাব না।
তখন উম্মু সুলাইম রা. তাকে জানালেন যে, তাদের কলিজার টুকরা সন্তানকে আল্লাহ উঠিয়ে নিয়েছেন।
পরের দিন আবু তালহা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সব খুলে বললে তিনি বললেন, আল্লাহ তোমাদের এ রাতে বরকত দান করুন!
ঘটনা বর্ণনাকারী আনাস রা. বলেন, উম্মু সুলাইম সে রাতেই গর্ভধারণ করেছিলেন এবং তাঁদের আবার পুত্রসন্তান হয়েছিল। –মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৮৬৫
প্রত্যেক মুমিন-মুমিনার জন্যই এ ঘটনায় রয়েছে গভীর শিক্ষা।
দয়াময় আল্লাহ সন্তানহারা মা-বাবাকে আখেরাতে অভাবনীয় প্রতিদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আনসার নারীদের লক্ষ করে বলেন–
لَا يَمُوتُ لِإِحْدَاكُنَّ ثَلَاثَةٌ مِنَ الْوَلَدِ فَتَحْتَسِبَهُ، إِلّا دَخَلَتِ الْجَنَّةَ.
তোমাদের কারো তিন সন্তান মারা গেলে সে যদি এতে সওয়াবের আশা করে, তাহলে অবশ্যই সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
একথা শুনে এক নারী জানতে চাইল, কারো যদি দুই সন্তান মারা যায়?
জবাবে নবীজী বললেন, হাঁ, এমনকি দুইজন মারা গেলেও। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৩২
আবু হাস্সান রাহ.-এর দুই ছেলে মারা গেল। তিনি আবু হুরায়রা রা.-কে জিজ্ঞেস করলেন, আমার এ অবস্থা-সংশ্লিষ্ট কোনো কথা কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে শুনেছেন, যা শুনে আমি সান্ত্বনা পেতে পারি?
আবু হুরায়রা রা. বললেন, হাঁ, শুনেছি। একবার তিনি বলেছিলেন–
এরূপ সন্তান জান্নাতবাসীদের কনিষ্ঠ সদস্য। হাশরের ময়দানে এদের একেকজন মা-বাবার জামা বা হাত ধরে থাকবে, –যেভাবে আমি তোমার এই জামা ধরে আছি– ছাড়বেই না, যতক্ষণ না আল্লাহ তাদেরসহ তাদের মা-বাবাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৩৫
সেদিন সেই মা-বাবারা কত ভাগ্যবান হবে! এই অবুঝ শিশুই চূড়ান্ত পেরেশানীর সময় মা-বাবার সহায় হবে। তাদের হাত ধরে টানতে টানতে জান্নাতে নিয়ে যাবে।
এক ব্যক্তি তার ছেলেকে নিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসত।
কিছুদিন পরে হঠাৎ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লক্ষ করলেন, সেই ছেলেটির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ নিলেন, কী হয়েছে তার। জানতে পারলেন, সে মারা গেছে। তখন তিনি তার বাবাকে বললেন, তুমি কি পছন্দ কর না যে, তুমি জান্নাতের যে দরজা দিয়েই প্রবেশ করতে চাইবে, দেখবে তোমার সেই ছেলে সেখানেই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে?
এ কথা শুনে উপস্থিত একজন জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ মহা সুসংবাদ কি শুধু তার জন্য, নাকি আমাদের সকলের জন্য?
নবীজী বললেন, সকলের জন্যই। –মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৪১৭
মুসলিম সন্তান মা-বাবার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কী বিশাল রহমত! সে বেঁচে থাকলে মা-বাবার জন্য আনুগত্যের সুখ। বাবা-মা তার জীবদ্দশায় মারা গেলে তার যাবতীয় সৎকর্ম হবে তাদের জন্য সদাকায়ে জারিয়া। আর সে শৈশবেই মারা গেলে সোজা চলে যাবে জান্নাতে। সেখানে অপেক্ষা করতে থাকবে মা-বাবার জন্য। এগিয়ে এসে তাদেরকে নিয়ে যাবে অনন্ত শান্তির ঠিকানা জান্নাতে।
একবার এক নারী তার বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর নবী! আমার এ সন্তানের জন্য দুআ করুন! একে নিয়ে আমার বড় ভয়। ইতিমধ্যেই আমি আমার তিন তিনজন সন্তানকে কবরস্থ করেছি।
এ কথা শুনে তিনি অবাক হয়ে বললেন, তিনজন?
সে বলল, হাঁ, তিনজন।
তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন–
لَقَدِ احْتَظَرْتِ بِحِظَارٍ شَدِيدٍ مِنَ النَّارِ.
তুমি তো জাহান্নামের আগুনের বিপরীতে দুর্ভেদ্য আত্মরক্ষা করে ফেলেছ। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৩৬
এ সৌভাগ্য পৃথিবীর আলো দেখে বিদায় নেওয়া সন্তানের ক্ষেত্রেই সীমিত নয়; বরং পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে পরিণত হওয়ার আগেই যাকে চলে যেতে হয়, তার দুঃখ-ভারাক্রান্ত পিতা-মাতার ব্যাপারেও এরূপ প্রতিদানের কথা বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে–
কিয়ামতের দিন মুসলিম শিশুদের বলা হবে, তোমরা জান্নাতে চলে যাও।
কিন্তু তারা তাদের মা-বাবার গলা জড়িয়ে থাকবে এবং বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের মা-বাবা?
আল্লাহ বলবেন, যাও, তোমাদের মা-বাবাসহই তোমরা জান্নাতে যাও।
এরপর অপূর্ণ মানবশিশু উপস্থিত হবে। তাকেও যখন বলা হবে, যাও জান্নাতে, সে বলবে, ইয়া রব! আমার মা-বাবা!
এরপর তার সাথে তার মা-বাবা-কে জান্নাতে মিলিয়ে দেওয়া হবে। –মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ১০৩৪৪
মুমিন নরনারীর পার্থিব যে কোনো দুঃখ-কষ্টেরই উত্তম প্রতিদান আছে, যদি যাতনাকালে ধৈর্য অবলম্বন করতে পারে। একেকটা কষ্টে ধৈর্যধারণের অর্থ একেকটা গুনাহ মোচন হওয়া। এভাবে গুনাহ মোচন হতে হতে একপর্যায়ে তার আর কোনো গুনাহ থাকবে না।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
مَا يَزَالُ البَلاَءُ بِالمُؤْمِنِ وَالمُؤْمِنَةِ، فِي نَفْسِه وَوَلَدِه وَمَالِه، حَتَّى يَلْقَى اللهَ، وَمَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ.
মুমিন নরনারীর ব্যক্তিসত্তা, সন্তানসন্ততি ও ধনসম্পদে বিপদাপদ আসতেই থাকে, অনন্তর সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এমতাবস্থায় যে, তার আর কোনো গুনাহ্ই থাকে না। –জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৯৯