কোথা সে আযাদী!
জুলাই আন্দোলনের এক বছর পেরিয়ে গেল। অন্দোলনের সেই রক্তস্নাত উত্তাল দিনগুলো এখনো জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে। স্বৈরাচারের হানাদার বাহিনীর বুলেট আর আযাদী-প্রত্যাশী ছাত্র জনতার স্লোগানের আওয়াজ এখনো কানে বাজে– ‘বুকের মাঝে অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’; ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’; ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’; ‘ইনকিলাব ইনকিলাব, যিন্দাবাদ যিন্দাবাদ’; ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’; ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’; ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’।
এমনই একটি বারুদ স্লোগান ছিল– ‘গোলামী না আযাদী, আযাদী আযাদী’!
হাঁ, আমরা আযাদী-প্রত্যাশী। আযাদীর জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, জীবন দিয়েছি; কিন্তু আমরা পেয়েছি কি চূড়ান্ত আযাদী? আর ভবিষ্যতেও কি আমরা আযাদীর দেখা পাব? পাব কি আযাদীর স্বাদ? সকল গোলামী ও দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে হতে পারব কি চির আযাদ?!
এর উত্তর খোঁজার জন্য আমাদেরকে জানতে হবে– আযাদী কাকে বলে? জানতে হবে– কোন্টি আযাদীর পথ? বুঝতে হবে– আযাদী আর গোলামীর পার্থক্য। চিনতে হবে– আযাদীর আসল সুর।
অন্যথায় আন্দোলনের পর আন্দোলন হবে, স্লোগানের পর স্লোগান হবে, রক্তবন্যা বয়ে যাবে, খালি হবে হাজারো মায়ের কোল; কিন্তু দিনশেষে হতে হবে– আযাদীর নামে প্রতারিত এবং গোলামী থেকে গোলামীর ফাঁদে বন্দি।
তাই এসো হে বন্ধু! আযাদীর সন্ধানে ব্রতী হই; চিনে নিই আযাদীর পথ, আযাদীর আওয়াজ–
জাহেলিয়াতের জিঞ্জির চূর্ণ করে, শিরকের পিঞ্জর ভেঙে যে আওয়াজ উচ্চারিত হয়েছিল মরু আরবে–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ– ইবাদত-উপাসনা একামাত্র আল্লাহর, দাসত্বও কেবলই আল্লাহর। অস্বীকার করি সকল ইলাহ, আল্লাহ ছাড়া; ছুঁড়ে ফেলি দাসত্বের সকল শৃঙ্খল, কেবল লা শারীক আল্লাহর দাসত্ব ছাড়া।
যুগে যুগে এ আওয়াজই ছিল আযাদীর আওয়াজ। আল্লাহ ছাড়া সকল বাতিল ইলাহ, মিথ্যা প্রভু, সকল মত, পথ ও ইজম এবং সকল মানব প্রভু ও সাম্রাজ্যবাদের গোলামী ও দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার আওয়াজ।
নাজরানবাসীর প্রতি নবীজীর যে বার্তা ছিল, সেটিই ছিল আযাদীর আওয়াজ, আযাদীর পথে আহ্বান–
فَإِنِّي أَدْعُوكُمْ إِلَى عِبَادَةِ اللهِ مِنْ عِبَادَةِ الْعِبَادِ.
আমি তোমাদেরকে বান্দার দাসত্ব থেকে আল্লাহর দাসত্বের প্রতি আহ্বান করছি। [দ্র. দালাইলুন নুবুওয়াহ, বায়হাকী ৫/৩৮৫; আসসীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ইবনে কাসীর ৪/১০১; আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ৫/৬৪]
নববী যবানে ঘোষিত হয়েছে–
يَا أَيُّهَا النَّاسُ! أَلَا إِنَّ رَبَّكُمْ وَاحِدٌ، وَإِنَّ أَبَاكُمْ وَاحِدٌ، أَلَا لَا فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى عَجَمِيٍّ، وَلَا لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ، وَلَا أَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ، وَلَا أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ، إِلَّا بِالتَّقْوَى.
হে লোকসকল! জেনে রেখো, তোমাদের ‘রব’ এক এবং তোমাদের ‘আব’ (পিতা)-ও এক। জেনে রেখো, অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং আরবের ওপরও অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কালোর ওপর সাদার এবং সাদার ওপরও কালোর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র ভিত্তি তাকওয়া। –মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৪৮৯
বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছিলেন–
فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ، وَأَمْوَالَكُمْ، وَأَعْرَاضَكُمْ، بَيْنَكُمْ حَرَامٌ، كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هذَا، فِي شَهْرِكُمْ هذَا، فِي بَلَدِكُمْ هذَا.
নিশ্চয়ই তোমাদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু তোমাদের ওপর এমনই হারাম, যেমন এই মাসে, এই শহরে আজকের এই দিনটি হারাম (ও সম্মানিত)। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৭
একেই বলে আযাদী। এ-ই তো আযাদীর ফরমান, আযাদীর আহ্বান। এ আহ্বানে যারা সাড়া দিয়েছিল, এ ফরমান যারা তামিল করেছিল, তারাই পেয়েছিল আযাদী। তারাই মুক্ত হয়েছিল দাসত্বের সকল শৃঙ্খল থেকে। তারা মুক্ত হয়েছিল, মুক্ত করেছিল শত লক্ষ বনী আদমকে।
***
মানুষ যখন সত্য প্রভুর দাসত্ব-বিস্মৃত হয়, তখন কেবল প্রভু থেকে প্রভুর বদল হয়। এক প্রভুর দাসত্বের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আযাদীর শিরোনামে আরেক প্রভুর বাহুতলে আশ্রয় নেয়। তারপর যখন বুঝতে পারে, আমি তো দাসত্ব থেকে দাসত্বের শেকলে আটকে গেছি, তখন সে আবার প্রভুর সন্ধানে ছোটে, প্রভু বদলায়।
অবশেষে যদি সে সত্য প্রভুর সন্ধান পেয়ে যায়, তখনই সে হয় আযাদ, লাভ করে আযাদীর স্বাদ। অন্যথায় দাসত্ব থেকে দাসত্বে স্থানান্তরিত হতে হতে হারিয়ে যায় কালের গর্ভে, বিলীন হয় ব্যক্তির অস্তিত্ব, বিলীন হয় জাতির পর জাতির অস্তিত্ব। এভাবে কত লক্ষ কোটি বনী আদম, কত শত সহস্র জাতি বিলীন হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে, হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে। এই হারানো বিস্মৃত ধ্বংসপ্রাপ্ত কতক জাতির চিহ্ন এখনো পৃথিবীতে বিদ্যমান, আবার কত জাতির নাম-নিশানা পর্যন্ত বিলীন হয়ে গেছে। কুরআনে বর্ণিত আদ, ছামূদ, কওমে লূত, ফেরাউন, কারূন, হামান তাদেরই কিছু নাম, কিছু উদাহরণ।
সুতরাং হে আযাদী প্রত্যাশী! হাঁটবে কি আযাদীর পথে!
***
পৃথিবীতে কত লক্ষ লক্ষ বনী আদমই তো জীবন বিসর্জন দিয়েছে আযাদীর জন্য; কিন্তু কেউ আযাদীর নামে ছুটেছে মরীচিকার পেছনে, কেউবা আযাদীর নামে প্রতারিত হয়েছে; হয়েছে অন্যের স্বার্থের বলি! তাই হে আযাদী-চেতা উদ্যমী তরুণ! ভেবে নাও তোমার আযাদীর প্রেরণার উৎস; স্থির কর সঠিক পথ ও গন্তব্য। তবেই মিলবে আযাদীর দেখা, পাবে আযাদীর স্বাদ!
আযাদীর প্রেরণা যখন সঠিক উৎস থেকে উৎসারিত হয়, আযাদী-প্রত্যাশী যখন সঠিক গন্তব্যের সন্ধানী হয়, তখন একদিন না একদিন সে ‘আযাদী’র সন্ধান পেয়েই যায়, লাভ করে গোলামী থেকে চির মুক্তির সনদ।
পারস্যের স্বাধীনচেতা বালক সালমান ফারসী রা.। অগ্নিপূজক বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া সত্যান্বেষী। হকের তালাশে, আযাদীর প্রত্যাশায় ব্যাকুল হয়েছেন। পায়ে শৃঙ্খল পড়েছে নিজ ঘরেই। সে শৃঙ্খল ছিন্ন করে আবার ছুটেছেন পরিবার, সম্পদ, ভিটেমাটি পিছে ঠেলে। হকের দেখা পেয়েও আবার হতাশ হয়েছেন, কখনো প্রতারিত হয়েছেন, হয়েছেন ক্রীতদাস; কিন্তু ক্ষান্ত হননি। অবশেষে পেয়েছেন হকের দেখা, পেয়েছেন আযাদী– অগ্নিপূজা আর মানব-দাসত্ব থেকে আযাদী। হতে পেরেছেন চির স্বাধীন ‘আল্লাহর দাস’!
***
হে মুক্তিকামী! যদি আযাদীর সন্ধান চাও, তাহলে হক ও আযাদীর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা আযাদ মহামানবদের স্মরণ কর–
স্মরণ কর বেলালের আযাদীর আওয়াজ–
তপ্ত মরুর বুকে, উত্তপ্ত লৌহবর্মে চাবুকের পর চাবুক সহ্য করে, লেলিয়ে দেওয়া বালকদের অত্যাচার উপেক্ষা করে উচ্চারিত ‘আহাদ আহাদ’-ই ছিল আযাদীর আওয়ায।
স্মরণ কর খুবাইব রা.-এর আযাদীর আওয়াজ–
প্রতিশোধপ্রবণ কাফেররা যখন তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হল, তিনি দুই রাকাত নামায পড়তে দেওয়ার আরজি জানালেন। দুই রাকাত নামায পড়ে বললেন, আমি মৃত্যুর ভয়ে আরও নামায পড়ছি– তোমরা এমনটি না ভাবলে আমি আরও নামায পড়তাম।... তারপর আবৃত্তি করলেন আযাদীর এ পঙ্ক্তিমালা–
فَلَسْتُ أُبَالِي حِينَ أُقْتَلُ مُسْلِمًا
عَلَى أَيِّ جَنْبٍ كَانَ لِلهِ مَصْرَعِي
وَذَلِكَ فِي ذَاتِ الإِلَهِ وَإِنْ يَشَأْ
يُبَارِكْ عَلَى أَوْصَالِ شِلْوٍ مُمَزَّعِ
মুসলিম অবস্থায় যদি নিহত হই তবে আর কোনো পরোয়া নেই/
যে পার্শ্বদেশেই হোক না কেন, আল্লাহর জন্যই আমার এ ভূমিশয্যা।
এ তো শুধু মাবুদের সন্তুষ্টির জন্য, তিনি যদি চান তবে/
আমার ছিন্নভিন্ন প্রতিটি অঙ্গে
বরকত দান করবেন।
(দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৯৮৯)
স্মরণ কর ফেরাউনের গোলামীর জিঞ্জির ভাঙা জাদুকরদের আযাদীর আওয়াজ–
এইমাত্র হক ও চির আযাদীর সন্ধান পাওয়া বনী আদমের আযাদীর আওয়াজ। সত্য উদ্ভাসিত হলে তারা যখন রাব্বুল আলামীন সমীপে সিজদায় লুটিয়ে পড়ল, তখন ফেরাউন তাদের কঠিন শাস্তির ভয় দেখাল–
قَالَ اٰمَنْتُمْ لَهٗ قَبْلَ اَنْ اٰذَنَ لَكُمْ اِنَّهٗ لَكَبِیْرُكُمُ الَّذِیْ عَلَّمَكُمُ السِّحْرَ فَلَاُقَطِّعَنَّ اَیْدِیَكُمْ وَاَرْجُلَكُمْ مِّنْ خِلَافٍ وَّلَاُصَلِّبَنَّكُمْ فِیْ جُذُوْعِ النَّخْلِ وَلَتَعْلَمُنَّ اَیُّنَاۤ اَشَدُّ عَذَابًا وَّاَبْقٰ.
‘ফেরাউন বলল, আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেওয়ার আগেই তোমরা তার প্রতি ঈমান আনলে! আমার বিশ্বাস, সে-ই (অর্থাৎ মূসা) তোমাদের দলপতি, যে তোমাদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে। সুতরাং আমিও সংকল্প স্থির করেছি তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব এবং তোমাদেরকে খেজুর গাছের কাণ্ডে শূলে চড়াব। তোমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারবে, আমাদের দুজনের মধ্যে কার শাস্তি বেশি কঠিন ও বেশি স্থায়ী।’
কিন্তু আযাদীর সন্ধান পাওয়া জাদুকরদের বাঁধার মতো কোনো শৃঙ্খল কি ছিল দুনিয়ায়? তারা তো এখন আযাদ, মানব-দাসত্বমুক্ত চির স্বাধীন; কার আছে রোখার সাধ্য তাদের! তারা ফেরাউনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রতিউত্তর দিল আযাদীর স্লোগানে–
قَالُوْا لَنْ نُّؤْثِرَكَ عَلٰی مَا جَآءَنَا مِنَ الْبَیِّنٰتِ وَالَّذِیْ فَطَرَنَا فَاقْضِ مَاۤ اَنْتَ قَاضٍ اِنَّمَا تَقْضِیْ هٰذِهِ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَا، اِنَّاۤ اٰمَنَّا بِرَبِّنَا لِیَغْفِرَ لَنَا خَطٰیٰنَا وَمَاۤ اَكْرَهْتَنَا عَلَیْهِ مِنَ السِّحْرِ وَاللهُ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰی.
জাদুকরগণ বলল, যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন সেই সত্তার কসম! আমাদের কাছে যে উজ্জ্বল নিদর্শনাবলি এসেছে, তার ওপর আমরা তোমাকে কিছুতেই প্রাধান্য দিতে পারব না। সুতরাং তুমি যা করতে চাও কর। তুমি যাই কর না কেন, তা এই পার্থিব জীবনেই হবে। আমরা তো আমাদের প্রতিপালকের ওপর ঈমান এনেছি, যাতে তিনি ক্ষমা করে দেন আমাদের গুনাহসমূহ এবং তুমি আমাদেরকে যে জাদু করতে বাধ্য করেছ তাও। আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং চিরস্থায়ী।... –সূরা ত্ব-হা (২০) : ৭১-৭৩
স্মরণ কর আসহাবে কাহফের আযাদীর আওয়াজ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
نَحْنُ نَقُصُّ عَلَیْكَ نَبَاَهُمْ بِالْحَقِّ اِنَّهُمْ فِتْیَةٌ اٰمَنُوْا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنٰهُمْ هُدًی، وَّرَبَطْنَا عَلٰی قُلُوْبِهِمْ اِذْ قَامُوْا فَقَالُوْا رَبُّنَا رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ لَنْ نَّدْعُوَاۡ مِنْ دُوْنِهٖۤ اِلٰهًا لَّقَدْ قُلْنَاۤ اِذًا شَطَطًا، هٰۤؤُلَآءِ قَوْمُنَا اتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِهٖۤ اٰلِهَةً لَوْ لَا یَاْتُوْنَ عَلَیْهِمْ بِسُلْطٰنٍۭ بَیِّنٍ فَمَنْ اَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرٰی عَلَی اللهِ كَذِبًا، وَاِذِ اعْتَزَلْتُمُوْهُمْ وَمَا یَعْبُدُوْنَ اِلَّا اللهَ فَاْوٗۤا اِلَی الْكَهْفِ یَنْشُرْ لَكُمْ رَبُّكُمْ مِّنْ رَّحْمَتِهٖ وَ یُهَیِّئْ لَكُمْ مِّنْ اَمْرِكُمْ مِّرْفَقًا.
আমি তোমার কাছে তাদের ঘটনা যথাযথভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল একদল যুবক, যারা নিজ প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদেরকে হেদায়েতে প্রভূত উৎকর্ষ দান করেছিলাম। আমি তাদের অন্তর সুদৃঢ় করে দিয়েছিলাম। এটা সেই সময়ের কথা, যখন তারা (রাজার সামনেই) দাঁড়াল এবং বলল, আমাদের প্রতিপালক তিনিই, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মালিক। আমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে মাবুদ বলে কখনোই ডাকব না। তাহলে তো আমরা চরম অবাস্তব কথাই বলব। এই আমাদের সম্প্রদায়ের লোকজন তাঁর পরিবর্তে আরও বহু মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে। (তাদের বিশ্বাস সত্য হলে) তারা নিজ মাবুদদের সপক্ষে স্পষ্ট কোনো প্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে? (সাথি বন্ধুরা!) তোমরা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করে তাদের থেকেও, তখন চলো, ওই গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য নিজ রহমত বিস্তার করে দেবেন এবং তোমাদের বিষয়টা যাতে সহজ হয় সেই ব্যবস্থা করে দেবেন। –সূরা কাহ্ফ (১৮) : ১৩-১৬
স্মরণ কর ফেরাউনের স্ত্রীর আযাদীর আওয়াজ। ফেরাউনের দাসত্ব থেকে আল্লাহর দাসত্বে আযাদ হওয়ার আওয়াজ–
وَضَرَبَ اللهُ مَثَلًا لِّلَّذِیْنَ اٰمَنُوا امْرَاَتَ فِرْعَوْنَ اِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِیْ عِنْدَكَ بَیْتًا فِی الْجَنَّةِ وَنَجِّنِیْ مِنْ فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهٖ وَ نَجِّنِیْ مِنَ الْقَوْمِ الظّٰلِمِیْنَ.
আর আল্লাহ মুমিনদের জন্য পেশ করছেন ফেরাউন-পত্নীর দৃষ্টান্ত, যখন সে বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! আমার জন্য আপনার কাছে জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করুন এবং আমাকে ফেরাউন ও তার কর্ম থেকে মুক্তি দিন। আর আমাকে নাজাত দিন জালেম সম্প্রদায় হতে। –সূরা তাহরীম (৬৬) : ১১
স্মরণ কর ‘মাশিতাতুবনাতি ফিরআউন’–ফেরাউন কন্যার কেশবিন্যাসকারী ও খাস খাদেমার আযাদীর আওয়াজ–
ফেরাউন কন্যার সামনে সে আল্লাহর নাম নিলে সেকথা ফেরাউনের কানে পৌঁছল। ফেরাউন তাকে ডেকে বলল–
يَا فُلانَةُ، وَإِنَّ لَكِ رَبًّا غَيْرِي؟
ওহে! আমি ছাড়া কি তোর কোনো রব আছে?
এর উত্তরে প্রবল প্রতাপশালী জালেমের সামনে তাঁর মুখ থেকে বের হল আযাদীর আওয়াজ–
نَعَمْ، رَبِّي وَرَبُّكَ اللهُ.
হাঁ আছেন! তিনি হলেন আমার এবং তোমারও রব আল্লাহ!!
সম্ভাব্য বিপদের কথা জেনেও সে জালেমের সামনে উচ্চারণ করল আযাদীর এ মহান বাক্য। ফলে সন্তানদেরসহ তাকে নিক্ষিপ্ত হতে হল টগবগে গরম তেলের কড়াইয়ে।
(দ্র. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৮২১)
স্মরণ কর জাদু শিক্ষাকারী বালকের আযাদীর আওয়াজ... দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি ফিরে পাওয়া সভাসদের আযাদীর আওয়াজ... ঈমান রক্ষায় আগুনের গর্তে জীবন বিসর্জনকারী ঈমানদারদের আযাদীর আওয়াজ–
রাজার জাদুকরের কাছে জাদু শিখতে যাওয়া বালক যখন রাহেবের কাছ থেকে হক ও আযাদীর সন্ধান পেল। তার দুআয় সুস্থ হতে লাগল অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগী। বালকের সন্ধান পেয়ে জালেম রাজার এক অন্ধ সভাসদ বালকের কাছে গেল। বালক বলল, তুমি সুস্থ হতে পার; যদি তুমি আল্লাহর ওপর ঈমান আনো।
সে ঈমান আনলে বালক দুআ করল; সে দৃষ্টি ফিরে পেল; তারও আগে ফিরে পেল তার অন্তর্দৃষ্টি। রাজা তাকে জিজ্ঞেস করল–
مَنْ رَدَّ عَلَيْكَ بَصَرَكَ؟
কে তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল?
বিপদ জেনেও সে উত্তর দিল–
رَبِّي.
আমার রব আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন।
বাদশাহ বলল–
وَلَكَ رَبٌّ غَيْرِي؟
আমি ছাড়া কি তোমার কোনো রব আছে?
উত্তরে তার মুখ থেকে বের হল আযাদীর আওয়াজ–
رَبِّي وَرَبُّكَ اللهُ.
হাঁ আছেন! তিনি হলেন আমার এবং তোমারও রব আল্লাহ!!
একথা শুনে রাজা তাকে কঠিন শাস্তি দিল। একপর্যায়ে সে বালকের কথা বলে দিল।
হাজির করা হল বালককে। রাজা তাকে বলল, তুমি তো এই পর্যায়ের জাদুবিদ্যা শিখে ফেলেছ যে, জাদুবলে অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকেও তুমি সুস্থ করতে পারছ।
একথা শুনে বালকের মুখ থেকে বের হল আযাদীর উত্তর–
إِنِّي لَا أَشْفِي أَحَدًا، إِنَّمَا يَشْفِي اللهُ.
আমি তো কাউকে সুস্থ করার ক্ষমতা রাখি না; সুস্থ তো করেন আল্লাহ!
একথা শুনে জালেম বাদশাহ রাগে অগ্নিশর্মা হল। বালককে এমন কঠিন শাস্তি দিল যে, বালক রাহেবের কথা প্রকাশ করতে বাধ্য হল।
রাহেবকে হাজির করা হল, হাজির করা হল সভাসদকে। বলা হল, তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরে এসো।
কিন্তু আযাদীর সন্ধানপ্রাপ্ত ব্যক্তি কি জালেমের রক্তচক্ষুকে ভয় পায়? তার শাস্তির হুমকিকে ভয় পায়? তারা অটল থাকল আপন দ্বীনের ওপর। অবশেষে তাদেরকে করাত দিয়ে জীবন্ত চিরে ফেলা হল। তারা হল চির আযাদ!
বালককে হত্যার জন্য পাঠানো হল, পাহাড়ে, সাগরে; কিন্তু বালক জীবিত ফিরে এল; জল্লাদরা মরল।
অবশেষে বালক নিজেই রাজাকে বাতলে দিল তাকে হত্যার পথ। বলল, মানুষকে এক প্রান্তরে জমা করবে, এরপর আমাকে শূলে চড়িয়ে একটি তির নিয়ে বলবে–
بِاسْمِ اللهِ رَبِّ الْغُلَامِ.
বালকের রব আল্লাহর নামে নিক্ষেপ করছি।
রাজা তাই করল। বালক জয়ী হল, রাজা হেরে গেল। সত্য উদ্ভাসিত হওয়ার পর ময়দানে উপস্থিত সকলে সমস্বরে উচ্চারণ করল আযাদীর আওয়াজ–
آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلَامِ، آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلَامِ، آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلَامِ.
আমরা ঈমান আনলাম বালকের রবের প্রতি।...
একথা শুনে রাজা ক্রোধে ফেটে পড়ল। গর্ত খোঁড়ার নির্দেশ দিল। তাতে আগুন জ্বালানো হল। ঈমানদারদের নিক্ষেপ করা হল সে গর্তে। তবুও তারা ঈমানের ওপর অবিচল থাকল। ঈমানের জন্য তারা আগুনের গর্তকে বরণ করে নিল। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩০০৫)
এসকল আযাদীর আওয়াজের সাথে যে আওয়াজ মিলবে, সেটিই প্রকৃত আযাদীর আওয়াজ। এছাড়া অন্য সকল আযাদীর স্লোগান মিছে মরীচিকা। সেগুলো মূলত আযাদীর নামে প্রভু পরিবর্তনের আওয়াজ, গোলামী থেকে গোলামীতে স্থানান্তরিত হওয়ার আওয়াজ, উনুন থেকে উনুনে পতিত হওয়ার আওয়াজ।
***
আযাদী তো আল্লাহর দাসত্বে আযাদ হওয়া। তাঁর দাসত্বের পথে না থাকবে প্রবৃত্তির শৃঙ্খল, না কোনো মত ও পথের বাধা আর না থাকবে কোনো মানব প্রভু বা সাম্রাজ্যবাদের রোষানলে পড়ার ভয়। সকল শৃঙ্খল চূর্ণ করে সকল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কেবল আল্লাহর দাসত্বের পথে মুক্ত-স্বাধীন হতে পারাই আযাদী।
আযাদী প্রত্যাশী যদি মেনে নেয় কোনো মত-পথ-ইজমের শৃঙ্খলকে, কুর্নিশ করে কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে; তাহলে কীভাবে পাবে সে আযাদীর দেখা। সে তো সকল প্রভুকে উপেক্ষা করে সিজদা করবে একমাত্র আল্লাহকে; উপেক্ষা করবে দাসত্বের সকল শৃঙ্খলকে; তবেই তো সে পাবে আযাদীর দেখা, হতে পারবে চির আযাদ!
কবির ভাষায়–
یہ ایک سجدہ جسے تو گراں سمجھتا ہے
ہزار سجدے سے دیتا ہے آدمی کو نجات
যে এক সিজদাকে তুমি কঠিন মনে করো/
সে সিজদাই হাজারো সিজদা থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়।
যদি মানব দাসত্ব থেকে মুক্ত না হওয়া যায়, ঈমান ও একীনের দৌলত লাভ না হয়, তাহলে আযাদীর স্লোগান কোনো কাজে আসে না; যার গলায় দাসত্বের বেড়ি তার তরবারিও হয় ধারহীন, চেষ্টা-মেহনতও হয় নিস্ফল। আযাদীর কবি আল্লামা ইকবালের ভাষায়–
غلامی میں نہ کام آتی ہیں شمشیریں نہ تدبیریں
جو ہو ذوقِ یقیں پیدا تو کٹ جاتی ہیں زنجیریں
যার গলায় দাসত্বের শৃঙ্খল, তার না তরবারি কাজে আসে আর না তদবীর/
যখন হাসিল হয় একীনের দৌলত, তখনই কেবল চূর্ণ হয় দাসত্বের শৃঙ্খল।
মুসলিমের ঈমানের কালিমা-ই আযাদীর কালিমা–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এর মাধ্যমেই মানুষ লাভ করে সেই একীন ও ঈমান, যা চূর্ণ করে দাসত্বের সকল শৃঙ্খল। এ কালিমার ধারকই সন্ধান পায় আযাদীর। আল্লাহ ছাড়া সকল দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে সে-ই পারে কেবল মুক্ত হতে।
সুতরাং হে আযাদী প্রত্যাশী! হে ‘গোলামী না আযাদী’ স্লোগানধারী! আযাদীর পথে এসো! আল্লাহকে একমাত্র মাবুদ হিসেবে গ্রহণ করো। কুরআন সুন্নাহর মাধ্যমে আল্লাহর দেওয়া শরীয়তকে একমাত্র জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করো। সর্বশেষ নবী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাতকে ‘উসওয়ায়ে হাসানাহ’ হিসেবে গ্রহণ করো।