সূরাসমূহের নামের অর্থ
কামরুল আনাম খান
(পূর্ব প্রকাশের পর)
৯৭। সূরাতুল কদর
‘কদর’ (الْقَدْر) দ্বারা উদ্দেশ্য রমযান মাসের শেষ দশকের মহিমান্বিত ও ফযীলতপূর্ণ কদরের রাত। এ সূরায় আল্লাহ তাআলা হাজার মাসের চেয়ে মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ সে রাতের কথাই বলেছেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
اِنَّاۤ اَنْزَلْنٰهُ فِیْ لَیْلَةِ الْقَدْرِ، وَمَاۤ اَدْرٰىكَ مَا لَیْلَةُ الْقَدْرِ، لَیْلَةُ الْقَدْرِ خَیْرٌ مِّنْ اَلْفِ شَهْرٍ، تَنَزَّلُ الْمَلٰٓىِٕكَةُ وَالرُّوْحُ فِیْهَا بِاِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ اَمْرٍ، سَلٰمٌ هِیَ حَتّٰی مَطْلَعِ الْفَجْرِ.
নিশ্চয়ই আমি এটা (অর্থাৎ কুরআন) শবে কদরে নাযিল করেছি। তুমি কি জান, শবে কদর কী? শবে কদর এক হাজার মাস অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়। সে রাত (আদ্যোপান্ত) শান্তি– ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত। –সূরা কদর
এ হিসেবেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল কদর’।
৯৮। সূরাতুল বায়্যিনাহ
‘বায়্যিনাহ’ (بَیِّنَة) অর্থ দলীল, সাক্ষ্য, প্রমাণ ইত্যাদি। এ সূরার প্রথম ও চতুর্থ আয়াতে শব্দটি রয়েছে। সূরার শুরুতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন–
لَمْ یَكُنِ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا مِنْ اَهْلِ الْكِتٰبِ وَالْمُشْرِكِیْنَ مُنْفَكِّیْنَ حَتّٰی تَاْتِیَهُمُ الْبَیِّنَةُ، رَسُوْلٌ مِّنَ اللهِ یَتْلُوْا صُحُفًا مُّطَهَّرَةً، فِیْهَا كُتُبٌ قَیِّمَةٌ.
যারা কুফরী করেছে সেই কিতাবী ও মুশরিকগণ ততক্ষণ পর্যন্ত নিবৃত্ত হওয়ার ছিল না, যতক্ষণ না তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ আসে। অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ হতে একজন রাসূল, যে পবিত্র গ্রন্থ পড়ে শোনাবে। যাতে সরল-সঠিক বিষয় লেখা থাকবে। –আয়াত ১-৩
এখানে বায়্যিনাহ তথা সুস্পষ্ট প্রমাণ বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনকে বোঝানো হয়েছে।
এ সূরায় উল্লেখিত আলবায়্যিনাহ (الْبَیِّنَة) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল বায়্যিনাহ’।
৯৯। সূরাতুয যিলযাল
‘যিলযাল’ (زِلْزَال) অর্থ ভূকম্পন বা ভূমিকম্প। এ সূরার প্রথম আয়াতে যিলযাল (زِلْزَال) শব্দ এবং যিলযাল মাসদার থেকে যুলযিলাত (زُلْزِلَت) ফেয়েল ব্যবহৃত হয়েছে। এর দ্বারা কিয়ামত বোঝানো উদ্দেশ্য।
সূরার শুরুতে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের সময়কার অবস্থা বর্ণনা করে তারপরে বলেছেন–
یَوْمَىِٕذٍ یَّصْدُرُ النَّاسُ اَشْتَاتًا لِّیُرَوْا اَعْمَالَهُمْ، فَمَنْ یَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَیْرًا یَّرَهٗ، وَ مَنْ یَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا یَّرَهٗ.
সেদিন মানুষ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে, কারণ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখানো হবে। সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করে থাকলে সে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করে থাকলে তাও দেখতে পাবে। –আয়াত ৬-৮
প্রথম আয়াতে উল্লেখিত যিলযাল (زِلْزَالٌ) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুয যিলযাল’।
১০০। সূরাতুল আদিয়াত
‘আদিয়াত’ (عَادِيَاتٌ) শব্দটি আদিয়াতুন (عَادِيَةٌ) শব্দের বহুবচন, অর্থ দৌড়রত বা ধাবমান। এটি স্ত্রীবাচক ইসমে ফায়েলের শব্দ। সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে। তাতে ঘোড়ার দৌড়ের অবস্থা বোঝাতে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
এ সূরার প্রথম দিকের আয়াতসমূহে ঘোড়ার বিভিন্ন অবস্থা উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য, ঘোড়া মালিকের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও ভক্ত হয়; মালিকের আদেশ পালনে যে কোনো ঝুঁকি নিয়ে থাকে। এর দ্বারা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ঘোড়া তো নিজ মালিকের ভক্ত ও বিশ্বস্ত, অথচ মানুষ হয়েও সে নিজ স্রষ্টা ও মালিকের অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে না, বরং নাফরমানী করছে।
৬ নং আয়াত থেকে সে কথাই বলা হয়েছে যে, মানুষ তার প্রতিপালকের বড়ই অকৃতজ্ঞ। সে নিজেই এ বিষয়ে সাক্ষী এবং বস্তুত সে ধন-সম্পদের ঘোর আসক্ত।
প্রথম আয়াতে উল্লেখিত আলআদিয়াত (الْعٰدِیٰت) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল আদিয়াত’।
১০১। সূরাতুল কারিআহ
কারিআহ (اَلْقَارِعَةُ) অর্থ মহা প্রলয়, কিয়ামত, বড় দুর্যোগ ইত্যাদি। সূরাটির প্রথম তিন আয়াতেই শব্দটি রয়েছে। এখানে আলকারিআহ (اَلْقَارِعَةُ) বলে কিয়ামত বোঝানো উদ্দেশ্য। সূরাটির শুরুতে কিয়ামতের অবস্থা বর্ণনা করে তারপরে বলা হয়েছে, আখেরাতে যার আমলের পাল্লা ভারী হবে, সে তো সন্তোষজনক জীবনে থাকবে আর যার আমলের পাল্লা হালকা হবে, তার ঠিকানা হবে উত্তপ্ত আগুন।
সূরায় উল্লেখিত আলকারিআহ (اَلْقَارِعَةُ) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল কারিআহ’।
১০২। সূরাতুত তাকাছুর
তাকাছুর (التَّكَاثُرُ) অর্থ বেশি পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করা, আধিক্যের জন্য প্রতিযোগিতা করা। সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে। সূরার শুরুতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
اَلْهٰىكُمُ التَّكَاثُرُ، حَتّٰی زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ، كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُوْنَ، ثُمَّ كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُوْنَ.
(পার্থিব ভোগসামগ্রীতে) একে অন্যের ওপর আধিক্য লাভের প্রচেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে। যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে পৌঁছ। কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। আবারও (শোন), কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। –আয়াত : ১-৪
প্রথম আয়াতে উল্লেখিত আততাকাছুর (التَّكَاثُرُ) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুত তাকাছুর’।
১০৩। সূরাতুল আসর
আসর (عَصْر) অর্থ সময় বা কাল। সূরার শুরুতেই শব্দটি রয়েছে। এ সূরায় আল্লাহ তাআলা কাল বা সময়ের শপথ করে বলেছেন, (তরজমা) ‘মানুষ অতি ক্ষতির মধ্যে আছে। তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং একে অন্যকে সত্যের উপদেশ দেয় এবং একে অন্যকে সবরের উপদেশ দেয়।’
অর্থাৎ সব মানুষই ক্ষতির মধ্যে আছে, কেবল তারা ছাড়া, যাদের মধ্যে ঈমান ও নেক আমলসহ উল্লেখিত গুণাবলি রয়েছে।
সূরার শুরুতে উল্লেখিত আলআসর (الْعَصْر) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল আসর’।
১০৪। সূরাতুল হুমাযাহ
হুমাযাহ (هُمَزَة) অর্থ কারো অগোচরে তার নিন্দাকারী। সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে। সূরার শুরুতে ইরশাদ হয়েছে–
وَیْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةِ،نِ الَّذِیْ جَمَعَ مَالًا وَّعَدَّدَهٗ، یَحْسَبُ اَنَّ مَالَهٗۤ اَخْلَدَهٗ، كَلَّا لَیُنْۢبَذَنَّ فِی الْحُطَمَةِ.
বহু দুঃখ আছে প্রত্যেক এমন ব্যক্তির, যে পেছনে অন্যের বদনাম করে (এবং) মুখের ওপরও নিন্দা করে। যে অর্থ সঞ্চয় করে ও তা বারবার গুনে দেখে। সে মনে করে, তার সম্পদ তাকে চিরজীবী করে রাখবে। কক্ষনো নয়। তাকে তো এমন স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, যা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলে। –আয়াত : ১-৪
প্রথম আয়াতে উল্লেখিত হুমাযাহ (هُمَزَة) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল হুমাযাহ’।
১০৫। সূরাতুল ফীল
ফীল (فِیْل) অর্থ হাতি। সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে। এ সূরায় আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের কিছুদিন আগের ঐতিহাসিক একটি ঘটনা খুবই সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন।
ঘটনাটি এরকম– রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের আগে একবার ইয়েমেনের কাফের বাদশাহ আবরাহা কা‘বা শরীফ ধ্বংস করার ঘৃণ্য বাসনায় এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কায় এসেছিল। তার বাহিনীতে হাতিও ছিল। মক্কা মুকাররমায় পৌঁছার পর যেদিন সে বাইতুল্লাহ শরীফের ওপর আক্রমণ করতে চাইল, সেদিন আল্লাহ তাআলা তাদের রিুদ্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে এক জাতের ছোট পাখি পাঠালেন। পাখিগুলো আবরাহার বাহিনীর ওপর দিয়ে আকাশ ছেয়ে ফেলল। প্রতিটি পাখি কঙ্কর বহন করছিল। তারা সেগুলো সৈন্যদের ওপর ফেলল। এর আঘাতেই আবরাহার বাহিনীর হাতিগুলো পালাতে শুরু করল। বহু সৈন্য সেখানেই মারা গেল। এভাবে আল্লাহ তাআলা ছোট ছোট পাখির মাধ্যমে আবরাহার বিশাল হস্তীবাহিনীকে ধ্বংস করলেন। সে ঘটনাই আল্লাহ তাআলা সংক্ষেপে এ সূরায় বলেছেন। (বিস্তারিত জানার জন্য দ্রষ্টব্য : সূরা ফীলের তাফসীর)
এ থেকেই এ সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল ফীল’।
১০৬। সূরাতু কুরাইশ
কুরাইশ (قُرَیْش) হল মক্কার সম্ভ্রান্ত একটি গোত্র। কুরাইশ গোত্রেরই শাখা গোত্র বনু হাশেমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছেন।
কুরাইশ গোত্র যেহেতু বাইতুল্লাহ শরীফের আশপাশে বাস করত এবং এ পবিত্র ঘরের সেবা করত; তাই আরবের সবাই তাদেরকে সম্মান করত। তারা যখন শীত ও গ্রীষ্মকালে বাণিজ্যিক সফর করত, কেউ তাদের ক্ষতি করত না।
আল্লাহ তাআলা এ সূরায় তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, সারা আরবে তাদের যে সম্মান এবং তারা যে শীত ও গ্রীষ্মকালে নিরাপদে বাণিজ্যিক ভ্রমণ করতে পারে, সকলে তাদেরকে বিশেষ সম্মান ও খাতির করে– তা এই বাইতুল্লাহ শরীফেরই বরকত এবং এ ঘরের প্রতিবেশী হওয়ার কারণেই। সুতরাং তাদের উচিত এ ঘরের মালিক অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার ইবাদত করা ও মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করা। কেননা তিনিই তাদেরকে রিযিক দেন এবং শান্তি ও নিরাপত্তা দান করেন।
এ হিসেবেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতু কুরাইশ’।
১০৭। সূরাতুল মাঊন
মাঊন (مَاعُوْن) শব্দের অনেক অর্থ। এরমধ্যে একটি অর্থ হল মামুলী জিনিস বা সাধারণ জিনিস। সূরার শেষ আয়াতের শেষ শব্দটি হল আলমাঊন (الْمَاعُوْن)। এ সূরায় আল্লাহ তাআলা যারা কর্মফল দিবস তথা কিয়ামতকে অস্বীকার করে, তাদের কিছু স্বভাবের কথা বলেছেন। সেগুলো হল–
ক. কোনো এতীম তাদের কাছে সাহায্য চাইলে তারা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
খ. অভাবী মিসকীনদেরকে তারা খাবার দেওয়ার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে না।
গ. তারা নামাযে উদাসীনতা করে।
ঘ. তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নয়; বরং লোকদেখানো কাজ করে।
ঙ. তারা অন্যকে সামান্য জিনিসও দিতে চায় না।
শেষ আয়াতে উল্লেখিত আলমাঊন (الْمَاعُوْن) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল মাঊন’।
১০৮। সূরাতুল কাউসার
কাউসার (كَوْثَر) শব্দের অর্থ ‘প্রচুর পরিমাণ বা প্রভূত কল্যাণ’ ইত্যাদি। আরবী ভাষায় কোনো কিছুর সমষ্টি বোঝাতেও কাউসার শব্দ ব্যবহৃত হয়। আবার জান্নাতের একটি বিশেষ নদীর নামও কাউসার। কিয়ামতের দিন জান্নাতের সেই কাউসার নামক নদীর পানি প্রবাহিত হয়ে হাশরের মাঠে একটি হাউজে জমা হবে। সেই হাউজটি হল হাউজে কাউসার। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের মধ্যে যারা তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে চলবে, তারা এখান থেকে পানি পান করে পরিতৃপ্ত হবে।
আল্লাহ তাআলা যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাউসার দান করেছেন, তা এ সূরায় বলেছেন।
এ হিসেবেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল কাউসার’।
জান্নাতের কাউসার নদী সম্পর্কে এক হাদীসে বর্ণিত আছে, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জানো, কাউসার কী?
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।
তখন নবীজী বললেন–
فَإِنَّهُ نَهْرٌ وَعَدَنِيهِ رَبِّي عَزَّ وَجَلَّ، عَلَيْهِ خَيْرٌ كَثِيرٌ، هُوَ حَوْضٌ تَرِدُ عَلَيْهِ أُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، آنِيَتُهُ عَدَدُ النُّجُومِ.
এটা এমন এক নদী, যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, তাতে বিপুল কল্যাণ রয়েছে। এটা এমন এক হাউজ, কিয়ামতের দিন আমার উম্মত যার পাশে একত্র হবে। তার পেয়ালা সংখ্যা তারকারাজির সমান। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪০০
আরেক হাদীসে বর্ণিত আছে–
الكَوْثَرُ نَهْرٌ فِي الجَنَّةِ، حَافَّتَاه مِنْ ذَهَبٍ، وَمَجْرَاهُ عَلَى الدُّرِّ وَاليَاقُوتِ، تُرْبَتُه أَطْيَبُ مِنَ المِسْكِ، وَمَاؤُه أَحْلَى مِنَ العَسَلِ، وَأَبْيَضُ مِنَ الثَّلْجِ.
কাউসার জান্নাতের একটি নদী, যার দুই তীর স্বর্ণের, যা মুক্তা ও ইয়াকুতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত, যার মাটি মেশকের চেয়েও সুগন্ধময়, যার পানি মধুর চেয়েও মিষ্টি এবং বরফের চেয়েও সাদা। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৬১।
১০৯। সূরাতুল কাফিরূন
কাফিরূন (كافِرُوْن) শব্দটি কাফিরুন (كَافِرٌ) শব্দের বহুবচন, অর্থ কাফেররা। সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে।
মক্কার কয়েকজন কাফের নেতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রস্তাব দিয়েছিল, এক বছর আপনি আমাদের দেবতাদের উপাসনা করবেন আর এক বছর আমরা আপনার রবের ইবাদত করব।
তাদের প্রস্তাবের জবাবে আল্লাহ তাআলা এ সূরায় ইরশাদ করেছেন– [তরজমা] (হে নবী) বলে দাও, হে সত্য-অস্বীকারকারীরা! আমি সেইসব বস্তুর ইবাদত করি না, যাদের ইবাদত তোমরা কর এবং তোমরা তাঁর ইবাদত কর না, যাঁর ইবাদত আমি করি।
এ হিসেবেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল কাফিরূন’।
১১০। সূরাতুন নাসর
নাসর (النَّصْر) অর্থ সাহায্য, সহযোগিতা ইত্যাদি। সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে। এ সূরায় আল্লাহ তাআলা বলেছেন–
اِذَا جَآءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ، وَرَاَیْتَ النَّاسَ یَدْخُلُوْنَ فِیْ دِیْنِ اللهِ اَفْوَاجًا.
(যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং তুমি মানুষকে দেখবে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে। –আয়াত ১-২)
এখানে সাহায্য ও বিজয় দ্বারা মক্কা নগরী বিজয় উদ্দেশ্য।
প্রথম আয়াতে উল্লেখিত নাসর (نَصْر) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুন নাসর’।
১১১। সূরাতুল লাহাব
লাহাব (لَهَبٍ) বলে মক্কার তৎকালীন কাফের নেতা আবু লাহাবকে বোঝানো উদ্দেশ্য। আবু লাহাব ও তার স্ত্রী ছিল ইসলাম ও নবীজীর ঘোর শত্রু। তারা সব সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামকে নানাভাবে কষ্ট দেওয়ার পাঁয়তারা করত।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওত লাভের কিছুদিন পর সাফা পাহাড়ে উঠে নিজ বংশের লোকজনকে ডাকেন এবং ইসলাম গ্রহণের আহ্বান করেন। তখন আবু লাহাব বলে উঠল–
تَبَّا لَكَ، مَا جَمَعْتَنَا إلَّا لِهَذَا؟
(ধ্বংস হও! তুমি কি এজন্যই আমাদেরকে ডেকেছ?)
তার এ কথার প্রত্যুত্তরে সূরা লাহাব নাযিল হয়। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮০১, ৪৯৭১-৪৯৭২; তাফসীরে তবারী, সূরা লাহাবের তাফসীর
এ সূরায় আল্লাহ তাআলা আবু লাহাবের নাম উল্লেখ করে তার ও তার স্ত্রীর প্রতি অভিসম্পাত করেছেন।
এ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল লাহাব’।
১১২। সূরাতুল ইখলাস বা সূরাতু কুল হুওয়াল্লাহ
সূরাতুল ইখলাস নামেই সূরাটি বেশি প্রসিদ্ধ। ইখলাস (إخْلاَصٌ) শব্দের অনেক অর্থ, যেমন, খাঁটি, বিশ্বস্ততা, বিশুদ্ধতা, আন্তরিকতা, সততা, বাছাইকরণ ইত্যাদি। এ শব্দটি এই সূরায় নেই। এ নামটি নেওয়া হয়েছে সূরায় অন্তর্নিহিত ভাব থেকে। সূরাটিতে আল্লাহ তাআলার বিশুদ্ধ তাওহীদকে তুলে ধরা হয়েছে। কাফেররা আল্লাহ তাআলার সত্তা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। এর জবাবে আল্লাহ তাআলা এই সূরা নাযিল করেন এবং খাঁটি তাওহীদের কথা বর্ণনা করেন।
এখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর সত্তা সম্পর্কে পাঁচটি বিষয় বলেছেন-
ক. আল্লাহ সব দিক থেকে এক। কোনো ক্ষেত্রেই তাঁর সঙ্গে কোনো শরীক নেই।
খ. বিশ্ব জগতের সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন।
গ. তাঁর কোনো সন্তান নেই।
ঘ. তিনিও কারো সন্তান নন।
ঙ. কোনো বিচারেই তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই।
এ হিসেবেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরা ইখলাস’।
আবার সূরাটির প্রথম আয়াত হল–
قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ.
আপনি বলুন, সেই আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়।
আয়াতের প্রথম অংশ থেকে সূরাটি ‘সূরাতু কুল হুওয়াল্লাহ’ নামেও পরিচিত।
১১৩। সূরাতুল ফালাক
ফালাক (فَلَق) অর্থ ভোর, প্রভাত। সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে।
এ সূরায় চার জিনিসের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে–
ক. সৃষ্টিকুলের অনিষ্ট থেকে,
খ. অন্ধকার রাতের অনিষ্ট থেকে,
গ. যারা জাদু করে সুতার গিরায় ফুঁ দেয়, তাদের অনিষ্ট থেকে,
ঘ. হিংসুকের অনিষ্ট থেকে।
প্রথম আয়াতে উল্লেখিত আলফালাক (الْفَلَق) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল ফালাক’।
১১৪। সূরাতুন নাস
নাস (النَّاس) শব্দের অর্থ মানবজাতি। এটা ইনসান (إنْسَانٌ) শব্দের বহুবচন। এ সূরার প্রায় প্রতিটি আয়াতের শেষে নাস শব্দটি রয়েছে। এ সূরায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ، مَلِكِ النَّاسِ، اِلٰهِ النَّاسِ، مِنْ شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ، الَّذِیْ یُوَسْوِسُ فِیْ صُدُوْرِ النَّاسِ، مِنَ الْجِنَّةِ وَ النَّاسِ.
বল, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি সমস্ত মানুষের প্রতিপালকের, সমস্ত মানুষের অধিপতির, সমস্ত মানুষের মাবুদের –সেই কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট থেকে, যে পেছনে আত্মগোপন করে, যে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়, সে জিন্নদের মধ্য হতে হোক বা মানুষের মধ্য থেকে। –সূরা নাস
কুরআন মাজীদের শেষের এই সূরাদুটি নাযিলের প্রেক্ষাপট হল, ইহুদীরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর জাদু করার চেষ্টা করেছিল। তখন এ সূরাদুটি নাযিল করা হয়। জাদু-টোনা এবং আসমান-যমীনের সকল বালা-মসিবত থেকে হেফাজতের জন্য এ সূরাদুটির মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কুরআন কারীমের শেষ তিনটি সূরা অর্থাৎ সূরাতুল ইখলাস, সূরাতুল ফালাক ও সূরাতুন নাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ সূরা। হাদীসে বিভিন্ন সময়ে এই তিন সূরা পড়ার নির্দেশনা রয়েছে, যেমন-
১। এক হাদীসে আছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাহাবীকে বলেছেন–
قُلْ: قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ، وَالمُعَوِّذَتَيْنِ حِينَ تُمْسِي وَتُصْبِحُ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ تَكْفِيكَ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ.
তুমি সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ , সূরা ফালাক ও নাস পড়বে, এটা তোমার সকল বিষয়ের জন্য যথেষ্ট হবে। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৭৫, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০৮২
২। এক সাহাবী নবীজীকে বললেন, আমি এ সূরাকে (অর্থাৎ সূরা ইখলাসকে) মহব্বত করি। তখন নবীজী বললেন-
حُبُّكَ إِيَّاهَا أَدْخَلَكَ الْجَنَّةَ.
এটার প্রতি তোমার মহব্বত তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। –সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৭৯২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৪৩২, ১২৫১২; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯০১
৩। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমানোর আগে এবং অসুস্থতার সময় এই তিন সূরা পড়ে শরীরে মুছে নিতেন। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০১৬, ৫০১৭