Safar 1447   ||   August 2025

উমদাতুল হুফ্ফায
‖ গরীবুল কুরআনের এক অনন্য কিতাব

মাওলানা সিরাজুস সালেকীন

যেসকল বিষয় জানা ছাড়া কুরআন কারীমের মর্ম বোঝা সম্ভব নয়, তার মধ্যে অন্যতম হল কুরআনের প্রতিটি শব্দ কুরআন নাযিলের সময় আরবরা যে অর্থে ব্যবহার করত, সে অর্থ জানা এবং কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় শব্দটি যেসকল অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোও জানা সেইসঙ্গে শব্দের অর্থ ও কুরআনের মর্মের মাঝে যে নিবিড় সম্পর্ক তা উপলব্ধি করা

কুরআনের গভীর ও বিস্তৃত মর্ম অনুধাবনের জন্য আরবী ভাষার পূর্ণ জ্ঞান থাকা জরুরি এর প্রাথমিক স্তর হল, আরবী শব্দাবলির সঠিক অর্থ ও ব্যবহার জানা যুগে যুগে উলামায়ে কেরাম আলাদাভাবে কুরআন কারীমের শব্দাবলির অর্থ ও ব্যবহার বিষয়ে অনেক কিতাব লিখেছেন ফলে তা উলূমুল কুরআনের স্বতন্ত্র একটি শাখায় পরিণত হয়েছে, যার নাম  غريب القرآن

গরীবুল কুরআন নিয়ে কিতাব লেখার ধারা অনেক প্রাচীন দ্বিতীয় শতাব্দীতে যায়েদ ইবনে আলী রাহ. (১২০ হি.), আবান ইবনে তাগলিব রাহ. (১৪১ হি.) ও মুআররিজ সাদূসী রাহ. (১৯৫ হি.) এই বিষয়ে কিতাব লিখেছেন বলে জানা যায় তৃতীয় শতাব্দীতে এই বিষয়ের লেখকদের তালিকায় নজর ইবনে শুমাইল রাহ. (২০৪ হি.), আবু উবাইদা মা‘মার ইবনে মুসান্না রাহ. (২১০ হি.), আখফাশ রাহ. (২১৫ হি.), আবদুল্লাহ ইবনে ইয়াহয়া ইয়াযদী রাহ. (২৩৭ হি.), ইবনে কুতাইবা রাহ. (২৭৬ হি.) প্রমুখ ইমামের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আবু উবাইদা রাহ.-এর কিতাবটি তো বেশ প্রসিদ্ধ যা مجاز القرآن নামে অনেক আগেই ছেপেছে ইয়াযদী ও ইবনে কুতাইবা রাহ.-এর কিতাবও غريب الحديث নামে ছেপে এসেছে

এরপর প্রতি যুগেই এ বিষয়ে একাধিক কিতাব লেখা হয়েছে, যার অনেকগুলোই ছেপে এসেছে এর মধ্যে ইবনে উযাইয (কারো মতে উযাইর) সিজিস্তানী রাহ. (৩৩০ হি.)-এর

 نزهة القلوب في تفسير القرآن العزيز

মক্কী ইবনে আবু তালিব রাহ. (৪৩৭ হি.)-এর

تفسير المشكل من الغريب

ইবনুল জাওযী রাহ. (৫৯৭ হি.)-এর

تذكرة الأريب في تفسير الغريب

মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর রাযী রাহ. (৬৬৬ হি.)-এর

تفسير غريب القرآن العظيم

আবু হাইয়ান আন্দালুসী রাহ. (৭৪৫ হি.)-এর

 تحفة الأريب بما في القرآن من الغريب

ইবনুল হায়িম রাহ. (৮১৫ হি.)-এর

التبيان في تفسير غريب القرآن

কাসেম ইবনে কুতলুবুগা রাহ. (৮৭৯ হি.)-এর

معجم غريب القرآن

আমীর সানআনী রাহ. (১১৮২ হি.)-এর تفسير غريب القرآن সবিশেষ উল্লেখযোগ্য এ সবগুলো কিতাবই ছেপেছে এখনো ছাপেনি এ বিষয়ের এমন কিতাবের সংখ্যা আরও অনেক বেশি আহমাদ শারকাবী তার معجم المعاجم কিতাবে এই বিষয়ের ৫৩টি কিতাবের নাম উল্লেখ করেছেন এ বিষয়ে লিখিত কিতাবের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এগুলোর পরিচিতি নিয়েও আবার লেখা হয়েছে কয়েকটি কিতাব যেমন, ইবরাহীম ইবনে আবদুর রহীম হাফিজ হুসাইন

علم غريب القرآن: مراحله ومناهجه وضوابطه

নামে কিতাব লিখেছেন

গরীবুল কুরআনের কিতাবগুলোর মধ্যে দুটি কিতাব আপন বৈশিষ্ট্যে অনন্য একটি হল রাগেব আসফাহানী রাহ.-এর (৫০২ হি.) المفردات في غريب القرآنআরেকটি হল সামীন হালাবী রাহ.-এর (৭৫৬ হি.)

عمدة الحفاظ في تفسير أشرف الألفاظ.

সামীন হালাবী রাহ. যার মূল নাম আহমদ ইবনে ইউসুফ ইবনে আবদুদ-দাইম আলহালাবী ছিলেন একজন মুকরী ও আরবী ভাষার ব্যাকরণবিদ তিনি মুফাসসির আবু হাইয়ান আন্দালুসী রাহ.-এর সান্নিধ্য অর্জন করেছেন এবং তাকী আসসায়িগ রাহ. থেকে ইলমুল কিরাআত শিখেছেন তার রচিত গ্রন্থ

الدر المصون في علوم الكتاب المكنون 

কিতাবটি উলূমুল কুরআন বিষয়ক পাঁচটি মৌলিক শাস্ত্র সম্বলিত কিতাব

রাগেব আসফাহানী রাহ.-এর  المفردات في غريب القرآن  কিতাবটি তালিবে ইলমদের কাছে বেশি প্রসিদ্ধ সামীন হালাবী রাহ.-এর  عمدة الحفاظ في تفسير أشرف الألفاظ কিতাবটি তেমন প্রসিদ্ধি না পেলেও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে রাগেব আসফাহানীর কিতাব থেকে কোনো অংশেই কম নয়; বরং তাতে এমন কিছু অতিরিক্ত ফায়েদা রয়েছে, যা রাগেব আসফাহানী রাহ.-এর কিতাবে অনুপস্থিত

المفردات في غريب القرآن  কিতাবের মতো عمدة الحفاظ  কিতাবও শব্দের মাদ্দা অনুযায়ী বিন্যস্ত এবং মাদ্দাগুলো হুরূফে হিজা অনুসারে উল্লেখিত এক মাদ্দা থেকে কুরআনে যত শব্দ উল্লেখ হয়েছে, তা লেখক একে একে উল্লেখ করে প্রতিটি শব্দের ‘সিয়াক-সিবাক’ অনুযায়ী মর্ম তুলে ধরেছেন তারপর তার শাব্দিক অর্থ এমনভাবে পেশ করেছেন যে, কুরআনী মর্মের সাথে তার সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে যায়

সামীন হালাবী রাহ. রাগেব আসফাহানী রাহ.-এর কিতাবটিকে নিজের কিতাবের অন্যতম উৎসগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং রাগেব আসফাহানী রাহ.-এর কিতাবের প্রায় পুরোটাই নিজের কিতাবে নকল করেছেন কুরআন কারীমে উল্লেখিত একাধিক শব্দ, যেগুলোর মাদ্দা রাগেব আসফাহানী রাহ.-এর কিতাবে আসেনি, সেগুলো সামীন হালাবী রাহ. তার কিতাবে এনেছেন এবং কিতাবের ভূমিকায় লিখেছেন, রাগেব আসফাহানী রাহ.-এর কিতাব থাকা সত্ত্বেও নতুন আরেকটি কিতাব লেখার পেছনে তার অন্যতম কারণ ছিল এটি রাগেব আসফাহানী রাহ.-এর কিতাবে যে মাদ্দাগুলো উল্লেখিত হয়নি, সেগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকা পেশ করতে গিয়ে সামীন হালাবী রাহ. লিখেছেন

فمما تركه... مادة (ز ب ن) وهي في قوله تعالى: {سندع الزبانية} [العلق: ১৮]. ومادة (غ و ط) وهي في قوله تعالى: {من الغائط} [المادة: ] ومادة (ق ر ش) وهي في قوله تعالى: {لإيلاف قريش} [قريش: ]. ومادة (ك ل ح) وهي في قوله تعالى: {كالحون} [المؤمنون: ১০৪]. ومادة (هـ ل ع) وهي في قوله تعالى: {هلوعا} [المعارج: ১৯]. ومادة (ل ج أ) وهي في قوله تعالى: {لو يجدون ملجأ} [التوبة: ৫৭]. ومادة (س ر د ق) وهي في قوله تعالى: {أحاط بهم سرادقها} [الكهف: ২৯]... إلى غير ذلك مما لست بصدده الآن.

এছাড়াও সামীন হালাবী রাহ.-এর নাহু, বালাগাত ও কিরাআত বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা থাকায় এই সংক্রান্ত অনেক আলোচনা ও ফাওয়ায়েদ এ কিতাবে এসেছে ফলে এ কিতাব থেকে শব্দের অর্থ বোঝার পাশাপাশি কুরআনের মর্ম অনুধাবন করাটা আরও সহজ হয়ে উঠেছে আবার এক শব্দের বিভিন্ন অর্থ বোঝাতে গিয়ে তিনি অনেক বেশি পরিমাণে গদ্য ও পদ্যাংশও উল্লেখ করেছেন কিতাবের মুহাক্কিক লিখেছেন, তিনি যেসকল কবিতার পঙ্ক্তি উল্লেখ করেছেন, তার পরিমাণ প্রায় ১৯০০

এক মাদ্দা থেকে নির্গত শব্দসমূহের অর্থের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক বর্ণনার ক্ষেত্রে উভয় কিতাবের আলোচনাই অত্যন্ত চমৎকার তবে রাগেব আসফাহানী রাহ.-এর কিতাবে কোথাও কোথাও এ আলোচনা এত সংক্ষিপ্ত আকারে এসেছে যে, তা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয় কিন্তু ওই আলোচনাই সামীন হালাবী রাহ.-এর কিতাব থেকে দেখলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য হাসিল হওয়ার সাথে সাথে অতিরিক্ত অনেক ফায়েদা পাওয়া যায়

তাই স্বাভাবিকভাবেই عمدة الحفاظ কিতাবটি المفردات في غريب القرآن থেকে দুই-তিন গুণ বড় হয়েছে কিতাবটি একাধিক মাকতাবা থেকে বড় বড় চার খণ্ডে ছেপেছে

উভয় কিতাবের তুলনামূলক এই আলোচনা বোঝার জন্য উভয় কিতাব থেকে  و ش ي মাদ্দা, و ض ن  মাদ্দা এবং و ص ي মাদ্দা দেখা যেতে পারে 

 

advertisement