প্রসঙ্গ ফিলিস্তিন : দুটি নিবন্ধ
জঙ্গলের আইন
হামেদ মীর
কারো এখনো ভুল ধারণা থাকলে তা দূর হওয়া উচিত। ১৩ জুন ইরানে চালানো ইসরাইলের হামলায় আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন ছিল। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, এতে তার সমর্থন ছিল না। আসলে এটি ছিল একটি প্রহসনমাত্র। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মনে করেছিল, কয়েক দিনের মধ্যেই ইরানের সামরিক নের্তৃত্ব ধ্বংস করে দেবে এবং ইরানের জনগণ রাস্তায় নেমে সরকার পতনের ডাক দেবে। নিজেদের শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইরানের কিছু সেনা কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীকে খুব সহজ লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারলেও নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক হিসাব ছিল সম্পূর্ণ ভুল। ইরানের জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে ঠিকই, কিন্তু ‘মারগ বর ইসরাইল’ (ইসরাইল ধ্বংস হোক) শ্লোগান নিয়ে।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরান শুধু শক্ত প্রতিরোধই গড়ে তোলেনি; তাদের মিসাইলগুলো ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অজেয় হওয়ার দম্ভও চূর্ণ করে দিয়েছে। তেল আবিবে ইরানের মিসাইলগুলো আঘাত হানার পরই একদিকে সব মুসলিম দেশ ইরানের পক্ষ নেয়, অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাগে ফেটে পড়েন। কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলন শেষ না করেই ট্রাম্প ওয়াশিংটন ফিরে আসেন এবং ইরানকে বিভিন্ন হুমকিমূলক বিবৃতি দিতে থাকেন। যা তার শান্তিপ্রিয় হওয়ার মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনীকে হত্যা ও নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের হুমকি দেওয়ার পর থেকেই ট্রাম্প কার্যত এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। চীন ট্রাম্পের এসব হুমকিকে যুদ্ধের আগুনে পেট্রোল ছিটানো আখ্যা দিয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের দম্ভোক্তিগুলো মার্কিন কংগ্রেসের অনেক সদস্যই প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার এখতিয়ার শুধু কংগ্রেসের আছে; মার্কিন প্রেসিডেন্টের নয়।
একথা সত্য যে, আমেরিকা ও ইউরোপে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গ্রহণযোগ্য কেউ নয়; কিন্তু অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ তার পাশে দাঁড়িয়েছে। ফলে ইসরাইলের চালানো আগ্রাসনের পর জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আইন উপহাসের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। গাজায় ৫৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনীকে হত্যাকারী নেতানিয়াহু জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছে। আর আজ শুধু ইরান নয়; জাতিসংঘের বিরুদ্ধেও ইসরাইল হামলা চালাচ্ছে। অথচ এই জাতিসংঘের সাধারণ সভার ১৮১ নং প্রস্তাবের মাধ্যমেই ইসরাইল প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। কিন্তু আজ ইসরাইলই জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভাবনার বিষয় হল, জাতিসংঘ যদি পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, তাহলে এই বিশ্ব কীভাবে চলবে? বাস্তবতা হল, বর্তমান বিশ্বে কার্যত জঙ্গলের আইনই চলছে; যার শক্তি আছে, তাকেই শুধু মান্য করা হচ্ছে। দুনিয়ার দুর্বল রাষ্ট্রগুলো যদি এখনো বিভ্রান্তিতে থাকে, তবে তাদের বুঝে নেওয়া উচিত যে, ইসরাইল ‘যার লাঠি, তার গরু’– নীতিতেই পথ চলছে। এই নীতি জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন। সুতরাং বিশ্বকে জাগতে হবে এবং জাতিসংঘকে বাঁচাতে হবে। অন্যথায় পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলে ইসরাইলের মতো কেউ না কেউ নিজের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লালসাকে আইন বানিয়ে চাপিয়ে দেবে। জাতিসংঘকে বাঁচানোর উপায় একটাই– ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের চালানো আগ্রাসনের প্রতিবাদকারী দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধভাবে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় সম্মিলিত প্রস্তাব আনা যে, ইসরাইল সাধারণ সভার ১৮১ নং প্রস্তাবের অধীনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু ইসরাইল এই প্রস্তাব মানছে না। সুতরাং প্রস্তাবটি বাতিল করা হোক। এখানে প্রশ্ন হল, জাতিসংঘ কি তার প্রস্তাব বাতিল করতে পারে?
জী, এমন নজির আছে। ১০ নভেম্বর ১৯৭৫ সালের সাধারণ সভার ৩৩৭৯ নং প্রস্তাবের মাধ্যমে জায়নবাদকে বর্ণবাদের একটি প্রকার আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট ছিল ৭২টি। বিপক্ষে ছিল ৩৫টি। আর ৩২ টি দেশ ভোট প্রদান থেকে বিরত ছিল। এর আগে ১৯৭৩ সালে সাধারণ সভার ৩১৫১ নং প্রস্তাবের মাধ্যমে বর্ণবাদের নিন্দা করা হয়েছিল।
১৯৯১ সালে মাদ্রিদে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন নের্তৃবৃন্দের মাঝে আলোচনা শুরু হলে ইসরাইল ৩৩৭৯ নং প্রস্তাব বাতিলের শর্তারোপ করে। তখন সাধারণ সভা ওই প্রস্তাব বাতিল করে। সে সময় মাদ্রিদে ফিলিস্তিন প্রতিনিধি দলের সাথে ইসরাইলের আলোচনা হয়। এতে জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ার প্রতিনিধিরাও অংশগ্রহণ করেন। মাদ্রিদ আলোচনার পর ‘অসলো’ আলোচনা শুরু হয় এবং একটি দুর্বল ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা সামনে আসে। কিন্তু ১৮১ নং প্রস্তাবটি আর আমলে নেওয়া হয়নি। কেননা এই প্রস্তাব অনুযায়ী যেসব অঞ্চল ফিলিস্তিনের ভূমি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার বড় অংশই ছিল ইসরাইলের দখলে। আর ১৮১ নং প্রস্তাব অনুযায়ী মসজিদে আকসা জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা ছিল। কিন্তু মসজিদে আকসাও ছিল ইসরাইলের অধীন। জাতিসংঘ সাধারণ সভার গৃহীত ৩৩৭৯ নং প্রস্তাবটি যদি বাতিল করা যায়, তবে ১৮১ নং প্রস্তাবটিও বাতিল করা যেতে পারে। ৩৩৭৯ নং প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দিয়েছিল ৭২টি দেশ। আর ১৮১ নং প্রস্তাবে ভোট প্রদানকারী দেশের সংখ্যা মাত্র ৩৩টি। যার মধ্যে কোনো মুসলিম দেশ নেই। ২৪ অক্টোবর ১৯৪৭ সালে ১৮১ নং প্রস্তাবটি যখন গৃহীত হয় তখন এর উদ্দেশ্য ছিল দুটি পৃথক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। সে সময় জাতিসংঘের সদস্য দেশের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫৬টি। যার মধ্যে ৩৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ও ১৩টি দেশ বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। আর ভোট প্রদান থেকে বিরত থেকেছিল ১০টি দেশ। বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্য দেশের সংখ্যা ১৯৩।
অনেক আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞই মনে করেন, ১৮১ নং প্রস্তাবটি জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী। তাই প্রস্তাবটি বাতিল করে জাতিসংঘে ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে পুনঃআলোচনা করা এবং ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে নতুন প্রস্তাব আনা দরকার।
মনে রাখা উচিত, পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কয়েদে আযম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহও ১৮১ নং প্রস্তাবটি নাকচ করেছিলেন এবং ৮ ডিসেম্বর ১৯৪৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকে লেখা এক চিঠিতে প্রস্তাবটিকে জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থি আখ্যা দিয়েছিলেন। ১৮১ নং প্রস্তাবে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, জেরুজালেম ইসরাইলেরও অংশ নয় এবং ফিলিস্তিনেরও অংশ নয়। এটির ব্যবস্থাপনা জাতিসংঘ পরিচালনা করবে। কিন্তু ১৯৬৭ সাল থেকেই ইসরাইল জেরুজালেম ও মসজিদে আকসা দখল করে রেখেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২২ নভেম্বর ১৯৬৭ সালে ২৪২ নং প্রস্তাবের মাধ্যমে ইসরাইলকে জেরুজালেমসহ অধিকৃত সকল আরব ভূখণ্ড খালি করে দিতে বলেছে; কিন্তু ইসরাইল এই প্রস্তাবও আমলে নেয়নি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার আগের মেয়াদে ১৪ মে ২০১৮ সালে জেরুজালেমে আমেরিকার দূতাবাস স্থানান্তর করার মধ্য দিয়ে মূলত ১৮১ নং প্রস্তাবের শেষ সম্মানটুকুও ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন।
ব্যক্তি ট্রাম্প ও তার ভূমিকা শুধু পাক-ভারত দ্বন্দ্বের আলোকে বিচার না করে আরো বিস্তৃতভাবে বিবেচনা করা উচিত। একটি শক্তিশালী জাতিসংঘ ছাড়া ফিলিস্তিন ও কাশ্মীর সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। জাতিসংঘকে শক্তিশালী করতে ১৮১ নং প্রস্তাবটি বাতিল করা সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। ওআইসি যদি কাজটি শুরু করে, তাহলে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যই নয়; বরং লাতিন আমেরিকার অনেক দেশও ওআইসির পক্ষে থাকবে এবং পৃথিবী থেকে জঙ্গলের আইন বিলুপ্ত হবে।
জাতি নিধনের খঞ্জরে শুধু একটু ঠান্ডা পানি ঢেলে নিন
ওয়াসআতুল্লাহ খান
স্পেন কয়েক মাস আগে ইসরাইলের সাথে অস্ত্র ও অন্যান্য পণ্যের বাণিজ্য স্থগিত করেছিল। যদিও এই স্থগিতাদেশ ছিল কার্যত প্রতীকী। কেননা স্পেনের সাথে ইসরাইলের বৃহৎ বাণিজ্য আগে থেকেই ছিল না। নরওয়ে বহু বছর থেকেই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জোরালো সমর্থক। আয়ারল্যান্ড গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরাইলী তৎপরতার ঘোর বিরোধী; কিন্তু তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহাল তবিয়তেই আছে।
গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন ফ্রান্সেরও খুব অপছন্দের। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ম্যাখোঁ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজা পরিস্থিতি নিয়ে প্রায়ই কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে থাকেন। মাঝেমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ম্যাখোঁ এতটাই বিচলিত হয়ে ওঠেন যে, নেতানিয়াহুর সাথে টেলিফোনে আলাপকালে বলেই বসেন যে, আপনার গৃহীত পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার প্রতি আপনার উদাসীনতায় ফ্রান্স খুবই উদ্বিগ্ন। কিন্তু ফ্রান্স কি আজ পর্যন্ত ইসরাইলের সাথে বাণিজ্য কিংবা অস্ত্র সরবরাহ আংশিক হলেও হ্রাস করার কোনো বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে? হয়তো কোনো ‘গোপন পদক্ষেপ’ নিয়েছে।
জার্মানিতে ফিলিস্তিনী পতাকা ধারণ ও বহন করাও গ্রেফতারযোগ্য ও ইহুদীবিদ্বেষ অপরাধের শামিল। কিন্তু জার্মান চ্যান্সেলরও মাঝেমধ্যে শুধু মুখের স্বাদ বদলানোর জন্য পশ্চিম জর্ডান ও গাজায় চলমান ইসরাইলের পদক্ষেপ সম্পর্কে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করে।
ব্রিটেন তো অবশেষে বিবেকের তাড়নায় বাধ্য হয়ে গত বছর সেপ্টেম্বরে ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহকারী ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর ৩০টির নতুন লাইসেন্স প্রদান স্থগিত করে দিয়েছে। আর গত সপ্তাহে ইসরাইলকে ‘পছন্দের বাণিজ্যিক রাষ্ট্র’ হিসেবে বিবেচনা করার আলোচনাও স্থগিত করে দিয়েছে। এছাড়া তারা আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণেরও হুমকি দিয়েছে।
কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় এই হয়েছে যে, গত শুক্রবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বাণিজ্য বিষয়ক কমিটির প্রধান লিয়াম বাইরন দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী ডগলাস আলেকজান্ডার ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে গত বছর ইসরাইল ও ব্রিটেনের বাণিজ্যিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছেন। কারণ সরকারি পরিসংখ্যান অধিদপ্তর সম্প্রতি যে প্রতিবেদন ও জরিপ প্রকাশ করেছে, তা সরকারের এই দাবির সম্পূর্ণ বিপরীত যে, ব্রিটেন ইসরাইলে অস্ত্র রপ্তানি স্থগিত করেছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর নতুন লাইসেন্স স্থগিত করার পরবর্তী তিন মাসে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো ইসরাইলকে প্রায় ১২৭ মিলিয়ন পাউন্ডের সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে। যা গত ২০২০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে ইসরাইলকে সরবরাহকৃত সামরিক বাণিজ্যের চেয়েও বেশি।
সংসদে ‘শেম শেম’ আওয়াজ উঠলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি এই যুক্তি দেয় যে, সরকার ইসরাইলের কাছে যে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে, তা গাজায় ব্যবহারের জন্য নয়; কিন্তু এই অসার যুক্তির কারণে ‘শেম শেম’ আওয়াজ আরও জোরালো হয়। সংসদের গ্যালারিতে থাকা জনৈক সাংবাদিক স্পষ্টতই বলেছেন, সরকারের নীতি হল, ইসরাইল গাজায় জাতি নিধন ও গণহত্যা চালাক, কিন্তু তা হতে হবে আমাদের থেকে কেনা খঞ্জরে ঠান্ডা পানি ঢেলে।
আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রেড কমিশনার তো বারবার দাবি জানিয়ে আসছে যে, ইসরাইলের সাথে বাণিজ্য স্থগিত করার ‘সম্ভাবনা’র বিষয়ে ইউনিয়নের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। আর ইউনিয়ন এতটুকুও করতে পারেনি যে, ইউরোপীয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতা ‘ইউরোভিশনে’ ইসরাইলের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করবে। গত বছরের মতো এবারও ইসরাইলের সঙ্গীতশিল্পীরা নির্দ্বিধায় ইউরোভিশনে অংশগ্রহণ করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিকাংশ সদস্যই আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেরও সদস্য। কিন্তু আজ পর্যন্ত ইউরোপীয় কোনো দেশ স্পষ্ট করে বলেনি যে, আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা দুই অভিযুক্ত নেতানিয়াহু ও ইউভ গিল্যান্ট (সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী) আমাদের আকাশ সীমায় প্রবেশ করলে আমরা তাদের গ্রেফতার করে আদালতের হাতে তুলে দিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।
অবশ্য হাঙ্গেরি এই পরোয়ানা জারি হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত থেকে নিজেদের সদস্যপদই প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জার্মানি গ্রেফতারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করেছে। আর আমেরিকা আদালতটির কর্মকর্তাদের তার দেশে প্রবেশই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ইতিমধ্যেই নেতানিয়াহু দুইবার ওয়াশিংটন ও একবার হাঙ্গেরি সফর করে এসেছে। তাদের বার্তা স্পষ্ট যে, আমরা আন্তর্জাতিক আদালতকেও ওই জুতার নিচে রাখি, যা পশ্চিমা বিশ্বই আমাদেরকে পরিয়েছে।
পশ্চিমারাইবা আর কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে? যেসব মুসলিম দেশগুলোর ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে, তাদের কেউই তো সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। উপরন্তু রেড সী রুটে ইয়ামানের হুথিদের অবরোধের কারণে ইসরাইলের ‘ইলাত’ বন্দর অচল হয়ে পড়লে ইসরাইল এখন উপসাগরীয় দেশ ও জর্ডানের রুট ব্যবহার করে এশিয়ার দেশগুলোর সাথে আমদানি-রপ্তানি চালিয়ে যাচ্ছে।
উপসাগরীয় তিনটি দেশে ট্রাম্প ৫ দিনের সফরে গিয়ে সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি করেছে। স্বাগতিক কোনো দেশের মুখ থেকে একটিবারও উচ্চারিত হয়নি, জাহাপনা! আপনার সব কথাই শিরোধার্য। শুধু একটু যুদ্ধবিরতিটা করিয়ে দিন। যেন দেড় শ কোটি মুসলমানের অন্তত একটু সান্ত্বনা দেওয়া যায়।
গত দুই বছর সাত মাসে পশ্চিমা কোনো দেশ ইসরাইলের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে ৫৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনীর গণহত্যার অন্তত একটি প্রতিবাদও জানায়নি। গত বুধবার প্রায় ৩০ সদস্যের একটি আন্তর্জাতিক কূটনীতিক প্রতিনিধি দল অধিকৃত পশ্চিম তীর সফর করে; এ সময় ইসরাইলী সেনারা তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে তারা সফরটি বাতিল করতে বাধ্য হয়। এই ঘটনায় ইউরোপীয় রাজধানীগুলোতে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে কঠোর প্রতিবাদ জানানো হয়।
ইসরাইলের সেনাবাহিনী অবশ্য পরে জানিয়েছে, প্রতিনিধি দলের নিরাপত্তার স্বার্থেই তারা এই ফায়ারিং করেছিল। এতে যদি প্রতিনিধি দলের কোনো সদস্য মানসিক আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে আমরা এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।
এই প্রেক্ষিতে আগামীতে আমরা দেখব, গত দুই বছর সাত মাসে জনসাধারণের অর্থনৈতিক বয়কট আন্দোলন ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের দেওয়া প্রতিশ্রুতির পরও ইসরাইলের বৈশ্বিক বাণিজ্য কতটা প্রভাবিত হয়েছে।
[বিদেশি দৈনিক থেকে অনূদিত।
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ]