মাওলানা সা‘দ সাহেব ও তার অনুসারীদের বিষয়ে আকাবির উলামায়ে বাংলাদেশের ফতোয়া বিস্তারিত আলোচনা
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
الحمد لله، وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد!
সবক’টি প্রশ্নের উত্তরের পর এখন আমরা মাওলানা সা‘দ সাহেব সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ। সাধারণদের জন্য কেন তার বয়ান শোনা জায়েয নয় এবং কেন তাকে কোনো দ্বীনী কাজের দ্বীনী রাহবার ও যিম্মাদার হিসেবে গ্রহণ করা জায়েয নয়– পূর্বেই এর তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ তিনটি হল–
১. নবীগণের বিষয়ে বিভিন্ন আপত্তিকর কথাবার্তা, যেগুলোতে তাঁদের শানে বেয়াদবি পাওয়া যায়।
২. কাজকে সীরাতের ওপর ওঠানোর নামে দাওয়াত ও তাবলীগ সংক্রান্ত অনেক শরয়ী উসূল ও শরয়ী আহকামে পরিবর্তন ঘটানো এবং দলীলবিহীন নতুন নতুন বিধান তৈরি করা।
৩. বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসের মর্ম ও ব্যাখ্যায় এবং সীরাতের বিভিন্ন ঘটনা ও শরয়ী বিভিন্ন পরিভাষায় তাহরীফ ও বিকৃতি।
নিম্নে এ বিষয়গুলোর অংশবিশেষ নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
নবীগণের বিষয়ে মাওলানা সা‘দ সাহেবের বিভিন্ন আপত্তিকর বক্তব্য, যেগুলোতে তাঁদের শানে বেয়াদবি পাওয়া যায়
১. পূর্ববর্তী সকল নবী আলাইহিমুস সালামের প্রতি এক গলত আপত্তি
মাওলানা সা‘দ সাহেব তার এক বয়ানে নসীহত করছিলেন, এ পথে আগত সমস্ত কষ্ট-মোজাহাদার জন্য একান্তে শোকর আদায় কর। এ পথে আগত কষ্ট-মোজাহাদার বিষয়ে কারো কাছে অভিযোগ করবে না। একথার পর সা‘দ সাহেব বলতে লাগলেন–
سارے انبیاء علیہم الصلاۃ والسلام کی قربانیاں وہ اضطراری ہیں، آپ کی قربانی اختیاری ہے، انبیاء علیہم السلام پر ان کی قوموں کی ہلاکت کو پیش کیا گیا، بلکہ انبیاء علیہم السلام نے اپنی دعائے مستجاب کو قوم کی ہلاکت کے لیے مانگ لیا، استعمال کر لیا، ہر نبی کو دعائے مستجاب دی گئی، چنانچہ انبیاء علیھم السلام نے اس دعائے مستجاب کو نہ ماننے والوں کی ہلاکت کے لیے مانگ لیا، اللہ نے قوموں کو ہلاک کردیا۔
آپ صلی اللہ علیہ وسلم کو بھی دی گئی دعائے مستجاب، ۔۔۔، آپ صلی اللہ علیہ وسلم نے اس دعائے مستجاب کو قیامت کے دن کے لیے اپنی امت کو بخشوانے کے واسطے اٹھاکر رکھ لیا۔
‘সকল নবী আলাইহিমুস সালামের কুরবানী ইযতিরারী। (অর্থাৎ তারা এসব কুরবানী বাধ্য হয়ে করেছেন; স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে নয়।) আর রাসূলুল্লাহ সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুরবানী হল ইখতিয়ারী। (অর্থাৎ তিনি স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব কুরবানী করেছেন।) পূর্ববর্তী নবীগণের সামনে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল যে, তাদের কওমকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে কি না? বরং অন্য নবীগণ নিজ নিজ দুআয়ে মুস্তাজাব (বিশেষ মকবূল দুআ)-কে তাঁদের কওমের ধ্বংসের জন্য চেয়ে নিয়েছেন। সেটাকে ব্যবহার করে ফেলেছেন। সব নবীকে দুআয়ে মুস্তাজাব দেওয়া হয়েছিল। সব নবীকে। অন্য নবীগণ এ দুআয়ে মুস্তাজাবকে অমান্যকারীদের ধ্বংসের জন্য চেয়ে নিয়েছেন। আল্লাহ তাঁদের কওমকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
নবী সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও দুআয়ে মুস্তাজাব দেওয়া হয়েছিল। ... তিনি এ দুআয়ে মুস্তাজাব কিয়ামতের দিনের জন্য নিজের উম্মতের ক্ষমা লাভের উপায় হিসেবে তুলে রেখেছেন।’ (বয়ান ১০/০৯/২০১৮ ঈ., বাদ ফজর, ত্রৈমাসিক মশওয়ারা, ৫২ মিনিট ৩০ সেকেন্ড থেকে)
পর্যালোচনা
এ বয়ানে একাধিক আপত্তিকর বিষয় রয়েছে। আমরা শুধু একটা বিষয়ের পর্যালোচনা উল্লেখ করছি, যেটা এসবের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি এবং যেটা নিঃসন্দেহে গোমরাহী। সেটা হল, এ বয়ানে সমস্ত নবীর শানে বেয়াদবি হয়েছে। কারণ মাওলানা সা‘দ সাহেবের কথার মর্ম হল, আল্লাহর রাস্তায় পূর্ববর্তী নবীগণ যেসমস্ত কুরবানী তথা ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করেছেন, সেগুলোর সবই ছিল অনিচ্ছায় ও বাধ্য হয়ে। স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কুরবানী করেছেন কেবল আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
তার একথায় অন্য সকল নবীকে খাটো করা হয়েছে। তাঁদের প্রতি এ দোষারোপ করা হয়েছে যে, তাঁরা নাকি আল্লাহর রাস্তায় খুশি খুশি কুরবানী পেশ করেননি; বরং নাউযু বিল্লাহ তাঁদের কুরবানী ছিল বাধ্য হয়ে বা অনিচ্ছায়। এটা যে পূর্ববর্তী নবীগণের প্রতি কত বড় অপবাদ, তা খুবই স্পষ্ট।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তো কুরআন কারীমে একেকজন নবীর কীর্তিসমূহ আলোচনা করে তাঁদেরকে ‘মুহসিন’ ও ‘সালেহ’ উপাধি দিয়েছেন। পরবর্তী প্রজন্মসমূহের মধ্যে তাঁদের প্রশংসার ধারা এবং তাঁদের জন্য সালামের তোহফা জারি করে দিয়েছেন। কেবল সূরা আ‘রাফ, সূরা হুদ, সূরা আম্বিয়া, সূরা সাফফাত ও সূরা ছদ-ই দেখুন। এসব সূরায় আল্লাহ তাআলা কত শানদারভাবে একেকজন নবীর বৈশিষ্ট্য ও কীর্তিসমূহ উল্লেখ করেছেন এবং কী কী শব্দে তাঁদের প্রশংসা করেছেন!
আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী নবীগণের কুরবানীসমূহের আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁদের সবরের প্রশংসা করেছেন এবং তাঁদেরকে তাঁর সাবের (ধৈর্যশীল) বান্দা আখ্যা দিয়েছেন। [দ্র. সূরা আম্বিয়া (২১) : ৮৫]
আল্লাহ তাআলা তাঁদের সবরের আলোচনা করেছেন এবং সবরের পরে তিনি যে তাঁদের সাহায্য করেছেন, সে কথাও কুরআন কারীমে বর্ণনা করেছেন।
কয়েকজন নবীর আলোচনা করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
اِنَّهُمْ كَانُوْا یُسٰرِعُوْنَ فِی الْخَیْرٰتِ وَ یَدْعُوْنَنَا رَغَبًا وَّ رَهَبًا وَ كَانُوْا لَنَا خٰشِعِیْنَ.
নিশ্চয়ই তারা সৎকাজে দ্রুতগমন করত এবং আশা ও ভীতির সাথে আমাকে ডাকত আর তাদের অন্তর ছিল আমার সামনে বিনীত। –সূরা আম্বিয়া (২১) : ৯০
যাঁরা ছিলেন এই মহান গুণের অধিকারী, তাঁদের সম্পর্কে এমন কথা বলা কীভাবে সঠিক হতে পারে যে, তাদের কুরবানী ইখতিয়ারী ছিল না, বরং ইযতিরারী ছিল?!
আল্লাহ তাআলা এ উম্মতকে কুরবানী পেশ করার উৎসাহ দিতে গিয়ে পূর্ববর্তী নবীগণ এবং তাঁদের উম্মতের আলোচনা করেছেন। অতএব এটা কীভাবে সম্ভব যে, তাঁদের কুরবানী ইখতিয়ারী ছিল না, বরং অনিচ্ছায় ও বাধ্য হয়ে ছিল? ইরশাদ হয়েছে–
اَمْ حَسِبْتُمْ اَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا یَاْتِكُمْ مَّثَلُ الَّذِیْنَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَاْسَآءُ وَالضَّرَّآءُ وَ زُلْزِلُوْا حَتّٰی یَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مَعَهٗ مَتٰی نَصْرُ اللهِ اَلَاۤ اِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِیْبٌ.
(হে মুসলিমগণ!) তোমরা কি মনে করেছ, তোমরা জান্নাতে (এমনিতেই) প্রবেশ করবে, অথচ এখনও পর্যন্ত তোমাদের ওপর সেই রকম অবস্থা আসেনি, যেমনটা এসেছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর। তাদের স্পর্শ করেছিল অর্থ-সংকট ও দুঃখ-কষ্ট এবং তাদের করা হয়েছিল প্রকম্পিত, এমনকি রাসূল ও তাঁর ঈমানদার সঙ্গীগণ বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? মনে রেখ, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই। –সূরা বাকারা (০২) : ২১৪
সূরা আলে ইমরানে ইরশাদ হয়েছে–
وَكَاَیِّنْ مِّنْ نَّبِیٍّ قٰتَلَ مَعَهٗ رِبِّیُّوْنَ كَثِیْرٌ فَمَا وَهَنُوْا لِمَاۤ اَصَابَهُمْ فِیْ سَبِیْلِ اللهِ وَمَا ضَعُفُوْا وَمَا اسْتَكَانُوْا وَاللهُ یُحِبُّ الصّٰبِرِیْنَ، وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ اِلَّاۤ اَنْ قَالُوْا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَاِسْرَافَنَا فِیْۤ اَمْرِنَا وَثَبِّتْ اَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَی الْقَوْمِ الْكٰفِرِیْنَ، فَاٰتٰىهُمُ اللهُ ثَوَابَ الدُّنْیَا وَ حُسْنَ ثَوَابِ الْاٰخِرَةِ وَاللهُ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَ.
এমন কত নবী রয়েছে, যাদের সঙ্গে মিলে বহু আল্লাহওয়ালা যুদ্ধ করেছে। এর ফলে আল্লাহর পথে তাদের যে কষ্ট-ক্লেশ ভোগ করতে হয়েছে, তাতে তারা হিম্মত হারায়নি, দুর্বল হয়ে পড়েনি এবং তারা নতি স্বীকারও করেনি। আল্লাহ অবিচল লোকদের ভালবাসেন।
তাদের কথা এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না যে, তারা বলেছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের গুনাহসমূহ এবং আমাদের দ্বারা আমাদের কার্যাবলিতে যে সীমালঙ্ঘন ঘটে গেছে তা ক্ষমা করে দিন। আমাদের দৃঢ়পদ রাখুন এবং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের বিজয় দান করুন।
সুতরাং আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়ার পুরস্কারও দান করলেন এবং আখেরাতের উৎকৃষ্টতর পুরস্কারও। আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন। –সূরা আলে ইমরান (০৩) : ১৪৬-১৪৮
এসব স্বতঃস্ফূর্ত কুরবানীও যদি ইখতিয়ারী না হয়, তাহলে ইখতিয়ারী কুরবানী কোন্ জিনিসের নাম? এই কুরবানীসমূহকে ইযতিরারী বললে তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের কুরবানীসমূহকেও নাউযু বিল্লাহ ইযতিরারী বলতে হবে!
পূর্ববর্তী নবীগণের সঙ্গে কাফেরদের যে কথোপকথন হয়েছিল, সূরা ইবরাহীমে তার একটি অংশ আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন। তাতে নবীগণের একথাও উল্লেখ আছে–
وَمَا لَنَاۤ اَلَّا نَتَوَكَّلَ عَلَی اللهِ وَقَدْ هَدٰىنَا سُبُلَنَا وَلَنَصْبِرَنَّ عَلٰی مَاۤ اٰذَیْتُمُوْنَا وَعَلَی اللهِ فَلْیَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُوْنَ.
কেনইবা আমরা আল্লাহর ওপর নির্ভর করব না, যখন তিনি আমাদের সেই পথ প্রদর্শন করেছেন, যে পথে আমাদের চলা উচিত? তোমরা আমাদেরকে যে কষ্ট দিচ্ছ আমরা তাতে অবশ্যই সবর করব। যারা নির্ভর করতে চায়, তারা যেন আল্লাহরই ওপর নির্ভর করে। –সূরা ইবরাহীম (১৪) : ১২
এটা তো স্পষ্ট দলীল যে, নবীগণ তাঁদের কুরবানীসমূহ পুরোপুরি স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গেই করেছিলেন।
আরও ইরশাদ হয়েছে–
وَ قَالَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا لِرُسُلِهِمْ لَنُخْرِجَنَّكُمْ مِّنْ اَرْضِنَاۤ اَوْ لَتَعُوْدُنَّ فِیْ مِلَّتِنَا فَاَوْحٰۤی اِلَیْهِمْ رَبُّهُمْ لَنُهْلِكَنَّ الظّٰلِمِیْنَ، وَلَنُسْكِنَنَّكُمُ الْاَرْضَ مِنْۢ بَعْدِهِمْ ذٰلِكَ لِمَنْ خَافَ مَقَامِیْ وَخَافَ وَعِیْدِ.
যারা কুফুর অবলম্বন করেছিল, তারা তাদের নবীগণকে বলেছিল, আমরা তোমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বের করে ছাড়ব। অথবা তোমাদেরকে আমাদের দ্বীনে ফিরে আসতে হবে। অতঃপর তাদের প্রতিপালক তাদের প্রতি ওহী পাঠালেন, আমি অবশ্যই এ জালেমদের ধ্বংস করে দেব এবং তাদের পর যমীনে তোমাদেরকেই প্রতিষ্ঠিত করব। এটা প্রত্যেক ওই ব্যক্তির পুরস্কার, যে আমার সামনে দাঁড়ানোর ভয় রাখে এবং ভয় রাখে আমার সতর্কবাণীর। –সূরা ইবরাহীম (১৪) : ১৩-১৪
সূরা আহকাফে আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেছেন–
فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ اُولُوا الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلَا تَسْتَعْجِلْ لَّهُمْ، كَاَنَّهُمْ یَوْمَ یَرَوْنَ مَا یُوْعَدُوْنَ لَمْ یَلْبَثُوْۤا اِلَّا سَاعَةً مِّنْ نَّهَارٍ بَلٰغٌ فَهَلْ یُهْلَكُ اِلَّا الْقَوْمُ الْفٰسِقُوْنَ.
সুতরাং (হে রাসূল!) আপনি সবর অবলম্বন করুন, যেমন সবর অবলম্বন করেছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ এবং আপনি তাদের (অর্থাৎ কাফেরদের) বিষয়ে তাড়াহুড়া করবেন না। তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হচ্ছে, তা যেদিন তারা দেখবে, সেদিন (তাদের মনে হবে,) তারা যেন (দুনিয়ায়) দিনের এক মুহূর্তের বেশি অবস্থান করেনি। এটাই সেই বার্তা, যা পৌঁছিয়ে দেওয়া হল। অতঃপর ধ্বংস তো হবে কেবল এমন সব লোক, যারা অবাধ্য। –সূরা আহকাফ (৪৬) : ৩৫
যখন আল্লাহ তাআলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পূর্ববর্তী নবীগণের মতো সবর করতে বললেন, তখন একথা কীভাবে সঠিক হতে পারে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুরবানী তো ইখতিয়ারী ছিল, কিন্তু অন্য নবীদের কুরবানী ইখতিয়ারী ছিল না?
মোটকথা, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই– মাওলানা সা‘দ সাহেব পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূল সম্পর্কে যে কথা বলেছেন যে– তাদের কুরবানী ইযতিরারী ছিল; ইখতিয়ারী ছিল না– এটা তাঁদের প্রতি অপবাদ ছাড়া কিছু নয়। তার এ কথা কুরআন কারীমের সেসব আয়াতের একেবারে খেলাফ, যেগুলোতে আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী নবীগণের কুরবানীর প্রশংসা করেছেন এবং এর বিনিময়ে তাঁদের জন্য পুরস্কারের ঘোষণা করেছেন। উপরন্তু মাওলানা সা‘দ সাহেবের এ কথায় পূর্ববর্তী নবীগণের শানে একধরনের বেয়াদবিও রয়েছে, যা থেকে সকল মুসলিমের বেঁচে থাকা ফরয।
দুআয়ে মুস্তাজাব চেয়ে নেওয়া সমস্যার কিছু নয়
এখানে এ কথা আরয করে দেওয়া মুনাসিব যে, মাওলানা সা‘দ সাহেবের এ দাবি এই চিন্তার ভিত্তিতেও হতে পারে যে, তার কথা মোতাবেক সকল নবী-রাসূল নিজ নিজ দুআয়ে মুস্তাজাব নিজেদের কওমের ধ্বংসের জন্য চেয়ে নিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁদের দাওয়াত অমান্যকারীদের ধ্বংসের জন্য চেয়ে নিয়েছেন এবং নাউযু বিল্লাহ মাওলানা সা‘দ সাহেবের মতে সেটা এ কারণে যে, তাঁরা আল্লাহর রাস্তার কষ্ট-মুজাহাদা স্বেচ্ছায় বরণ করেননি। আর এ কারণেই তাঁরা আল্লাহ তাআলার কাছে নিজেদের কওমের বিরুদ্ধে আভিযোগ দায়ের করেছেন এবং দুনিয়াতেই তাদের কওমের জন্য ধ্বংসের দুআ করেছেন। যদি তাঁরা স্বেচ্ছায় কষ্ট মুজাহাদা করতেন, তাহলে তাঁরা তাঁদের কওমের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলার কাছে অভিযোগ দায়ের করতেন না!!
যদি মাওলানা সা‘দ সাহেবের চিন্তাধারা এমন হয়, তাহলে তো সেটা আরও বেশি আপত্তিকর। এর মধ্যে একাধিক অবাস্তব ও অমূলক কথা রয়েছে।
সেজন্য তার বক্তব্যের এমন ব্যাখ্যা করা হলেও তা একদম ভুল এবং এ ব্যাখ্যার পরেও এর মধ্যে নবীগণের শানে বেয়াদবি হয়েছে। কারণ–
ক. জালেম ও হঠকারীদের বিরুদ্ধে বদদুআ করা কোনো নাজায়েয বা অনুত্তম কাজ নয় যে, একে শেকায়েত বলা হবে। তেমনিভাবে হঠকারীদের সম্পর্কে বদদুআ করা এমন কোনো বিষয় নয় যে, একারণে কারো কুরবানী ও কষ্ট-মুজাহাদাকে ইযতিরারী বা গায়রে ইখতিয়ারী বলা যাবে।
হাদীস ও সীরাতের বিভিন্ন কিতাব থেকে জানা যায়, খোদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও অনেক জালেম ও হঠকারী কাফেরের বিরুদ্ধে বদদুআ করেছেন এবং আল্লাহ তাআলা সেটা কবুলও করেছেন। হাঁ, কোনো বিশেষ কওমের বিরুদ্ধে বদদুআ করতে যদি আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেন, সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু নবীগণকে আল্লাহ তাআলা কওমের বিরুদ্ধে বদদুআ করতে নিষেধ করেছেন, এর পরও তাঁরা বদদুআ করেছেন– এমন কথার কোনো প্রমাণও নেই এবং এটা কল্পনা করাও নাজায়েয। তাছাড়া সকল ফিকহী মাযহাবেই জালেম ও ইসলামের দুশমনদের জুলুমের মোকাবেলায় কুনূতে নাযেলার আমল বৈধ। শরীয়তের এই বিধান তো হাদীস ও সীরাত থেকেই নেওয়া।
খ. এ কথা ঠিক নয় যে, সকল নবী-রাসূল নিজেদের কওমের বিরুদ্ধে ধ্বংসের দুআ করেছেন এবং আল্লাহ তাআলা তাদের ধ্বংসও করে দিয়েছেন। কেননা এ বিষয়ে কোনো দলীল নেই যে, ইবরাহীম আলাইহিমুস সালামের কওমকে আল্লাহ তাআলা ধ্বংস করে দিয়েছেন। তেমনিভাবে ঈসা আলাইহিস সালামের কওমকে ধ্বংস করে দেওয়ার বিষয়েও কোনো দলীল নেই। বরং মূসা আলাইহিস সালামের পরের নবীদের বিষয়ে এ কথা প্রমাণিত নয় যে, তাঁরা দাওয়াত অস্বীকারকারীদের জন্য বদদুআ করেছেন এবং আল্লাহ তাআলা তাদের সমস্ত কওমকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
মাওলানা সা‘দ সাহেব এ সম্পর্কে যে হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন তার পাঠ এই–
لِكُلِّ نَبِيٍّ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ، فَتَعَجَّلَ كُلُّ نَبِيٍّ دَعْوَتَه، وَإِنِّي اخْتَبَأْتُ دَعْوَتِي شَفَاعَةً لِأُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَهِيَ نَائِلَةٌ إِنْ شَاءَ اللهُ مَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِي لَا يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا.
প্রত্যেক নবীর জন্য একটি (বিশেষ মাকবুল) দুআ আছে। সকল নবী তাদের দুআ আগেই করে ফেলেছেন। আমার দুআ আমি তুলে রেখেছি কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফাআতের জন্য। আমার উম্মতের যে ব্যক্তিই আল্লাহর সঙ্গে কোনো শিরক না করে মৃত্যুবরণ করবে, সে-ই এই শাফাআত লাভ করবে, ইনশাআল্লাহ। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩০৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৯
হাদীসে আছে, সকল নবী তাদের খাস দুআ দুনিয়াতেই ব্যবহার করে ফেলেছেন। কিন্তু তাতে এ কথা নেই যে, তাদের সকলেই নিজেদের খাস দুআ কওমের ধ্বংসের জন্যই ব্যবহার করেছেন। সুতরাং মাওলানা সা‘দ সাহেবের দাবির এ ব্যাপকতা ভিত্তিহীন।
গ. পূর্ববর্তী নবীগণের মধ্যে যারা নিজেদের অবাধ্যতাকারী কওমকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে বদদুআ করেছিলেন, তাঁদের এ বদদুআ আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার খেলাফ ছিল না। এমনও হয়নি যে, আল্লাহ তাআলা তাঁদের বদদুআ করাটা অপছন্দ করেছেন; বরং তা আল্লাহ তাআলার মর্জি মোতাবেক ছিল। তাদের বদদুআ করার কথা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তা কবুল হওয়ার কথা আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে আলোচনা করেছেন এবং পূর্বাপর থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ তাআলা তাদের বদদুআ সমর্থনও করেছেন। যেমন সূরা ইবরাহীমের ১৩-১৪ নং আয়াত, যা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখান থেকেও জানা যায়।
অতএব বদদুআ করার কারণে পূর্ববর্তী নবীদের কুরবানী ও কষ্ট-মুজাহাদাকে ইযতিরারী আখ্যা দেওয়া কিছুতেই সঠিক নয়।
বিষয়টি আরও স্পষ্ট হওয়ার জন্য আরয করা হচ্ছে, উদাহরণস্বরূপ হযরত নূহ আলাইহিস সালামের বদদুআর কথা কুরআন মাজীদে আছে। আর সেটা অনেক প্রসিদ্ধও বটে। কুরআন কারীমের যত জায়গায় এ ঘটনার আলোচনা রয়েছে, কোথাও স্পষ্টভাবে বা ইঙ্গিতে এই বদদুআর বিষয়ে আল্লাহ তাআলা কোনো অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি; বরং সূরা হূদে ইরশাদ হয়েছে–
وَاُوْحِیَ اِلٰی نُوْحٍ اَنَّهٗ لَنْ یُّؤْمِنَ مِنْ قَوْمِكَ اِلَّا مَنْ قَدْ اٰمَنَ فَلَا تَبْتَىِٕسْ بِمَا كَانُوْا یَفْعَلُوْنَ،وَاصْنَعِ الْفُلْكَ بِاَعْیُنِنَا وَ وَحْیِنَا وَلَا تُخَاطِبْنِیْ فِی الَّذِیْنَ ظَلَمُوْا اِنَّهُمْ مُّغْرَقُوْنَ.
এবং নূহের কাছে ওহী পাঠানো হল যে, এ পর্যন্ত তোমার সম্প্রদায়ের যেসকল লোক ঈমান এনেছে, তারা ছাড়া আর কেউ ঈমান আনবে না। সুতরাং তারা যা-কিছু করছে সে জন্য তুমি দুঃখ করো না। এবং আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার ওহীর সাহায্যে তুমি নৌকা তৈরি কর। আর যারা জালেম হয়ে গেছে তাদের সম্পর্কে তুমি আমার সঙ্গে কোনো কথা বলো না। এবার তারা অবশ্যই নিমজ্জিত হবে। –সূরা হূদ (১১) : ৩৬-৩৭
বোঝা গেল, এই হঠকারীদের বিষয়ে নূহ আলাইহিস সালামের বদদুআ আল্লাহ তাআলার মর্জি মোতাবেক ছিল। এটাকে শেকায়েত আখ্যা দেওয়া ঠিক নয়। তেমনিভাবে এ কারণে তাঁর কুরবানীকে ইযতিরারী বলাও ঠিক নয়।
২. হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে গলত বয়ান
১৩ রবিউল আওয়াল ১৪৩৮ হি. মোতাবেক ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ঈ. ফজর বাদ বয়ানে মাওলানা সা‘দ সাহেব হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন–
یوسف علیہ السلام بڑے سخت حالات میں تھے، تہمت لگی تھی عزیز مصر کے گھر سے اور بہت سخت حالات تھے، لیکن دو چیزیں اللہ دیکھنا چاہتے ہیں داعی سے:
ایک تو یہ دیکھنا چاہتے ہیں کہ حالات سے متاثر ہوکر دعوت الی اللہ چھوڑ تو نہیں دیتا۔
ایک یہ دیکھتے ہیں اللہ انبیاء علیہم السلام کو کہ یہ حالات سے پریشان ہوکر ہمارے غیر سے مدد تو نہیں چاہتے؟
دوسرے یہ دیکھنا چاہتے ہیں کہ حالات سے متاثر ہوکر دعوت الی اللہ کا عمل چھوڑ تو نہیں دیتے۔
دوسری بات یہ کہ پھر یوسف علیہ السلام نے ان کو ان کے خواب کی تعبیر بھی بتلادی اور یہ خیال ہوا کہ ان میں سے ایک آدمی جیل سے رہا ہو کر اور باعزت بری ہوکر بادشاہ کے پاس جائیگا، لہذا بادشاہ کے پاس پیغام پہنچادوں۔
سنو دھیان سے کہ یوسف علیہ السلام اتنے عرصے سے جیل میں ہیں، کچھ ان کے مقدمے پر غور کر لیا جائے اور ان کو جیل سے رہا کر دیا جائے، اللہ کی شان یوسف علیہ السلام کو شیطان نے اللہ کی یاد بھلادی، یوسف علیہ السلام کو شیطان نے اللہ کی یاد بھلادی، یوسف علیہ السلام کو شیطان نے اللہ کی یاد بھلادی کہ یوسف علیہ السلام نے جیل سے نکلنے کے لیے ہم سے کیوں نہ کہا؟
داعی کے لیے یہ دو چیزیں انتہائی ضروری ہیں، انتہائی ضروری کہ جب راستے میں کوئی حال آئے تو وہ اپنےحال کو اس سے کہے جس کی طرف سے پیغام لے کر بھیجا ہوا ہے۔
دنیا میں آپ کسی ادنی سے ادنی ملازم کو کسی ادنی سے ادنی کام کے لیے بھیجیں، اگر اس کے کام میں کوئی رکاوٹ پیش آئے گی، یا اسے کوئی دقت پیش آئے گی، تو وہ رجوع کرےگا اور رابطہ کرے گا بھیجنے والے سے جس نے کام کے لیے بھیجا ہے، اس سے ہی رابطہ کرےگا کہ آپ بتائیے میں کیا کروں؟ میرے کام میں رکاوٹ پیش آگئی میں کیا کروں؟
یوسف علیہ السلام نے رہا ہونے والے سے فرمایا: اذْكُرْنِيْ عِنْدَ رَبِّكَ کہ میرا تذکرہ کردینا بادشاہ کے سامنے، فَأَنْسَاهُ الشَّيْطَانُ ذِكْرَ رَبِّه، شیطان نے یوسف علیہ السلام کو یوسف علیہ السلام کے رب کی یاد بھلادی، اس کے بعد یوسف علیہ السلام عرصہ جیل میں رہے۔
এখানে সা‘দ সাহেব বলেছেন–
‘ইউসুফ আলাইহিস সালাম বড় করুণ হালতে ছিলেন। মিশরের গভর্নরের ঘর থেকে অপবাদ লেগেছিল। আরও কঠিন অবস্থা ছিল। কিন্তু দুইটি বিষয় আল্লাহ দাঈর থেকে দেখতে চান–
প্রথমত এটা দেখতে চান যে, পরিস্থিতির কারণে প্রভাবিত হয়ে দাওয়াত ছেড়ে দেয় কি না?
দ্বিতীয়ত আল্লাহ নবীদের থেকে এটা দেখতে চান যে, তাঁরা এসব পরিস্থিতিতে পেরেশান হয়ে আমি ব্যতীত অন্য কারো কাছে সাহায্য চায় কি না?
আরেকটি বিষয় দেখতে চান যে, হালাতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দাওয়াত ইলাল্লাহ-এর আমল ছেড়ে দেয় কি না?
দ্বিতীয় কথা হল, এরপর ইউসুফ আলাইহিস সালাম তাদেরকে (অর্থাৎ কারাসঙ্গীদ্বয়কে) তাদের স্বপ্নের তাবীর বলে দেন এবং তাঁর এ ধারণা হয় যে, তাদের একজন সসম্মানে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বাদশাহর নিকট থাকবে। সেজন্য বাদশাহর কাছে সংবাদ পৌঁছিয়ে দিই।
শোনো মনোযোগ দিয়ে! ইউসুফ আলাইহিস সালাম এতদিন যাবৎ জেলে আছে। তাঁর মোকাদ্দমার বিষয়ে চিন্তা করা হোক এবং তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হোক।
আল্লাহর শান! ইউসুফ আলাইহিস সালামকে শয়তান আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিল। ইউসুফ আলাইহিস সালামকে শয়তান আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিল। ইউসুফ আলাইহিস সালামকে শয়তান আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিল। অর্থাৎ ইউসুফ আলাইহিস সালাম জেল থেকে বের হওয়ার জন্য আমাকে কেন বলল না?
দাঈর জন্য এ দুই বিষয় অত্যন্ত জরুরি, অত্যন্ত জরুরি। অর্থাৎ যখন রাস্তায় কোনো হালত আসে, তখন নিজের হালত তাকে বলবে, যার পক্ষ থেকে পয়গাম নিয়ে তাকে পাঠানো হয়েছে।
দুনিয়াতে আপনি যদি অতি সাধারণ কর্মচারীকে অতি সাধারণ কাজে পাঠান, তাহলে তার কাজে কোনো প্রতিবন্ধকতা এলে কিংবা কোনো সমস্যা হলে, যে তাকে পাঠিয়েছে সে তার শরণাপন্ন হবে এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। যে তাকে কাজের জন্য পাঠিয়েছে তার সঙ্গেই যোগাযোগ করবে যে, আপনি বলুন, আমি কী করব? আমার কাজে প্রতিবন্ধকতা এসে গেছে, আমি কী করব?
যে মুক্তি পেয়েছিল, তাকে ইউসুফ আলাইহিস সালাম বললেন–
اذْكُرْنِیْ عِنْدَ رَبِّكَ.
অর্থাৎ বাদশাহর সামনে আমার সম্পর্কে আলোচনা করবে।
فَاَنْسٰىهُ الشَّیْطٰنُ ذِكْرَ رَبِّهٖ.
‘শয়তান ইউসুফ আলাইহিস সালামকে ইউসুফ আলাইহিস সালামের রবের স্মরণ ভুলিয়ে দিল।’
এরপর ইউসুফ আলাইহিস সালাম লম্বা সময় জেলখানায় ছিলেন। (বয়ান ১৩ রবিউল আওয়াল ১৪৩৮ হি. মোতাবেক ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ ঈ., বাদ ফজর)
পর্যালোচনা
এই হল হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে মাওলানা সা‘দ সাহেবের সমালোচনা। একটু খেয়াল করে দেখুন, তিনি কী বলেছেন!
সা‘দ সাহেব বলেছেন, যে নীতি ও যে বিধান দুনিয়ার সাধারণ থেকে সাধারণ কর্মচারী জানে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে, হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সেটাও করতে পারেননি।
সা‘দ সাহেব বলেন, দুনিয়ার সাধারণ থেকে সাধারণ কর্মচারীকে কোনো কাজে পাঠালে, সে যদি ওই কাজে কোনো প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়, তাহলে যে তাকে পাঠিয়েছে তার সঙ্গে সে যোগাযোগ করে এবং তার শরণাপন্ন হয়, সে অন্য কারো শরণাপন্ন হয় না।
সা‘দ সাহেব বলতে চাইছেন, কিন্তু ইউসুফ আলাইহিস সালাম, যাকে আল্লাহ তাআলা নবী ও দাঈ বানিয়ে পাঠিয়েছেন, তিনি যখন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হলেন, তিনি আল্লাহর দিকে রুজু না করে বরং গায়রুল্লাহ্র শরণাপন্ন হলেন। শয়তান তাকে আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিল। তাই তিনি আল্লাহর দিকে রুজু করার পরিবর্তে গায়রুল্লাহ্র শরণাপন্ন হলেন!
লক্ষ করুন, কোনো নবী সম্পর্কে এটা কত মারাত্মক সমালোচনা। সা‘দ সাহেব হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে দুনিয়ার অতি সাধারণ কর্মচারীর সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং বার্তা দিয়েছেন, যে ভুল অতি সাধারণ কর্মচারী করে না, হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সে ভুল করে বসলেন!! তাকে যিনি পাঠিয়েছেন তার কাছে সাহায্য না চেয়ে তিনি অন্যের কাছে সাহায্য চেয়ে বসলেন!! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
প্রশ্ন হল, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা, আল্লাহর দিকে রুজু করা, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া, আল্লাহর কাছে দুআ করতে থাকা এবং পাশাপাশি জায়েয আসবাব ও মাধ্যম গ্রহণ করার মধ্যে কী বিরোধ? যিনি কাজের জন্য পাঠিয়েছেন তিনিই তো শিখিয়েছেন, তাওয়াক্কুল, দুআ ও ইনাবাতের সঙ্গে জায়েয আসবাব ও মাধ্যমও গ্রহণ কর। অতএব এটাই সকল নবীর সুন্নত যে, তাঁরা তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ (তথা আল্লাহর ওপর ভরসা) ও ইনাবাত ইলাল্লাহ (তথা আল্লাহমুখিতা)-এর ক্ষেত্রে সবার আগে ছিলেন। সেইসঙ্গে তাঁরা আল্লাহ প্রদত্ত জায়েয আসবাব ও মাধ্যমও গ্রহণ করতেন। হাদীস ও সীরাত দ্বারা প্রমাণিত, স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতের ক্ষেত্রে আসবাব ও মাধ্যম গ্রহণ করেছেন এবং বিভিন্ন গোত্রের কাছে সাহায্য চেয়েছেন।
তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ ও ইনাবাত ইলাল্লাহ্র পাশাপাশি জায়েয আসবাব ও মাধ্যম গ্রহণ করার মাসআলাটি তো আমাদেরকে নবীগণ থেকে শিখতে হবে। এই নয় যে, উল্টো তাঁদেরকেই শেখানো শুরু করবে যে, এটা ঠিক নয় অথবা এটা করা অনুত্তম।
৩. হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম সম্পর্কে সমালোচনা
মাওলানা সা‘দ সাহেব ২৪ মহররম ১৪৪১ হি. মোতাবেক ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ঈ. তারিখের এক বয়ানে আসবাব (উপায়-উপকরণ) সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম সম্পর্কেও সমালোচনা করেন। তিনি বলেন–
انبیاء کو بھی اسباب اسی لیے ملتے ہیں، سنو تو سہی میں کیا کہہ رہا، انبیاء کو بھی اسباب اسی لیے ملتے ہیں، ہماری تو کیا حیثیت ہے، انبیاء کو بھی اسباب اللہ اسی لیے دیتے ہیں۔ سنو غور سے انبیاء کو بھی اللہ اسباب اسی لیے دیتے ہیں کہ دیکھنا چاہتے ہیں کہ اس وقت یہ اس سبب کی وجہ سے مجھے یاد رکھتے ہیں یا سبب کی وجہ سے میرا حکم ضائع ہوجاتا ہے !
سوچو تو سہی سلیمان علیہ السلام کو ایسے گھوڑے دیے اللہ نے، ایسے گھوڑے، نادر ونایاب، جو کبھی نہ اس سے پہلے رہے اور نہ اس کے بعد کبھی ہوئے، ایسے گھوڑے بڑے خوبصورت، ہوا میں اڑتے تھے سوار کو لے کر، اتنے اڑنے میں قوی کہ ہوا میں اڑتے تھے،سمندر میں تیرتے تھے، اورزمین پر دوڑتے تھے ، بڑے خوبصورت گھوڑے۔
سلیمان علیہ السلام ان گھوڑوں کو دیکھنے میں مشغول ہو گئے، گھوڑوں کو دیکھنے میں مشغول ہو گئے،سلیمان علیہ السلام گھوڑوں کو دیکھنے میں مشغول ہو گئے، اور ایسے مشغول ہوئے کہ عصر کی نماز قضا ہوگئی اور سورج ڈوب گیا، گھوڑے دیکھنے میں! اللہ نے بنایا، اللہ نے کیسے بنایا، اللہ نے ایسے بنایا، بات یہ ہے کہ اللہ نے جو کچھ بنایا ہے، اللہ نے جوکچھ بنایا ہے وہ بنے ہوئے کا تاثر پیدا کرنے کے لیےنہیں بنایا ہے، بلکہ بنانے والے کا تاثر پیدا کرنے کے لیے بنایا ہےکہ اس سے بنانے والے کا تاثر پیدا ہو۔
بس کفار وہ ہیں جو بنے ہوئے سے متاثر ہوتے ہیں، اور مسلمان و ہ ہیں جو بنانے والے سے متاثر ہوتے ہیں، بنا ہوا بنانے والے کے تعارف کے لیے ہے، اس وقت اللہ کو یاد کرتے، اس وقت اللہ کو یاد کرتے، ان کو دیکھنے میں مشغول ہو گئے، اور عصر کی نماز قضا ہو گئی۔
دیکھا وقت، ارے عصر نہیں پڑھی، اتنا غم اتنا غم عصر کی نماز کی قضا ہونے کا، تلوار منگائی، سارے گھوڑے کاٹ کر ختم کر دیے، کوئی باقی نہیں رکھا کہ ان کی نسل ہی ختم کر دو، اس لیے کہ ان گھوڑوں کے دیکھنے کی وجہ سے عصر کی نماز قضا ہو گئی، سوچو، جنہیں اپنے عمل کے ضائع ہونے کا غم ہوتا ہے، اللہ اس کے عمل کو ضائع نہیں کرتے، جنہیں اپنے عمل کے ضائع ہونے کا غم ہوتا ہے، اللہ اس کے عمل کو ضائع نہیں کرتے، کہا تلوار لاؤ، اور سارے گھوڑے ختم، کہا اے اللہ! مجھے آج کی عصر پڑھنی ہے، مجھے نہیں چاہیےگھوڑے، آج کی عصر مجھے چاہیے۔
‘নবীদেরও আসবাব (উপায়-উপকরণ) এজন্যই লাভ হয়। খেয়াল করে শোনো আমি কী বলছি। নবীদেরও আসবাব এজন্যই লাভ হয়। আমাদের মূল্যই বা কী; নবীদেরও আসবাব আল্লাহ এজন্যই দিয়ে থাকেন। শোনো মনোযোগ দিয়ে, নবীদেরকেও আল্লাহ আসবাব এজন্যই দান করেন যে, আল্লাহ দেখতে চান, এখন এ আসবাবের কারণে সে আমাকে স্মরণ রাখে, নাকি আসবাবের কারণে আমার হুকুম নষ্ট হয়।
একটু তো ভেবে দেখো, সুলায়মান আলাইহিস সালামকে আল্লাহ এমন ঘোড়া দিলেন, এমন বিরল দুষ্প্রাপ্য ঘোড়া, এর আগেও এমন ঘোড়া মিলত না, পরেও আর মিলবে না। এমন সুন্দর ঘোড়া। আরোহীকে নিয়ে বাতাসে উড়ত। এত শক্তিশালী যে, আরোহীকে নিয়ে বাতাসে উড়ত, সমুদ্রে সাঁতার কাটত এবং জমিন দাপিয়ে বেড়াত। বড় সুদর্শন ঘোড়া।
সুলায়মান আলাইহিস সালাম সেই ঘোড়াগুলো দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। ঘোড়াগুলো দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। সুলায়মান আলাইহিস সালাম সেই ঘোড়াগুলো দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। এবং এমন ব্যস্ত হলেন যে, আসরের নামায কাযা হয়ে গেল এবং সূর্য ডুবে গেল ঘোড়া দেখতে দেখতে। আল্লাহ বানিয়েছেন! আল্লাহ কীভাবে বানিয়েছেন; আল্লাহ এভাবে বানিয়েছেন!
কথা হল, আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, সেটা সৃষ্টির প্রভাব তৈরির জন্য বানাননি; বরং স্রষ্টার প্রভাব তৈরির জন্য বানিয়েছেন। যেন এর দ্বারা স্রষ্টার প্রভাব পয়দা হয়।
ব্যস, কাফের তারা, যারা সৃষ্টির প্রভাব গ্রহণ করে আর মুসলমান তারা, যারা স্রষ্টার প্রভাব গ্রহণ করে। সৃষ্টি তো স্রষ্টার পরিচয়ের জন্য।
এসময় তো আল্লাহকে স্মরণ করার কথা, এসময় আল্লাহকে স্মরণ করার কথা, কিন্তু ঘোড়া দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন এবং আসরের নামায কাযা হয়ে গেল!
সময় দেখলেন, আরে! আসর তো পড়া হয়নি! এত দুঃখ! এত দুঃখ আসরের নামায কাযা হওয়ার যে, তিনি তলোয়ার আনিয়ে সব ঘোড়া খতম করে দিলেন। একটাও জীবিত রাখলেন না। এই ঘোড়ার প্রজন্মই শেষ করে দাও। এজন্য যে, এই ঘোড়াগুলো দেখতে দেখতে আসর কাযা হয়ে গেছে!’
চিন্তা করো, আমল নষ্ট হওয়ার দুঃখ যাদের আছে, আল্লাহ তাদের আমল নষ্ট হতে দেন না। আমল নষ্ট হওয়ার দুঃখ যাদের আছে, আল্লাহ তাদের আমল নষ্ট হতে দেন না। তিনি বললেন, তলোয়ার আনো! এবং সমস্ত ঘোড়া খতম! সবগুলো শেষ করে দিলেন। বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে আজকের আসর পড়তে হবে, আমি ঘোড়া চাই না, আমি আজকের আসর চাই!’ (বয়ান ২৪/১২/২০১৯ ঈ. মোতাবেক ২৪/১/১৪৪১হি., ১ ঘণ্টা ৩ মিনিট থেকে)
পর্যালোচনা
হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম জিহাদ, দাওয়াত ও অন্যান্য কল্যাণকর কাজ ও নেক মাকসাদে যেসব ঘোড়া পালন করতেন, সেসব ঘোড়ার দেখভাল (যা খালেস নেক আমল) সংক্রান্ত একটি ঘটনা কুরআন মাজীদে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের প্রশংসা হিসেবে। ‘সূরা ছদ’-এর ৩০-৩৩ নম্বর আয়াতে এর আলোচনা রয়েছে। মাওলানা সা‘দ সাহেব এই আয়াতগুলোর সহীহ তাফসীর –যা নবীগণের সম্মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ– না খুঁজে তার অভ্যাস মোতাবেক এখানেও হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের এই ঘটনায় নিজের পক্ষ থেকে কথা বানিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এমনকি তিনি নবীকে কেবল পরীক্ষায় অকৃতকার্য আখ্যা দেননি, বরং তাঁর কাজকে কাফেরদের কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
এখানে যে বিষয়টা লক্ষণীয় তা হল, নবীগণের কোনো ঘটনা পর্যালোচনা করার সময় সা‘দ সাহেবের কথার ধরন কেমন হয়। আগে-পরে তিনি নিজের পক্ষ থেকে কী কী কথা যোগ করেন এবং কী ভয়ংকর ভঙ্গিতে সমালোচনা করেন।
একদিকে তো সা‘দ সাহেব বলছেন, কাফের হল তারা, যারা সৃষ্টির দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর মুসলমান তারা, যারা স্রষ্টার দ্বারা প্রভাবিত হয়। অপরদিকে তিনি সুলায়মান আলাইহিস সালাম সম্পর্কে এ বার্তা দিচ্ছেন যে, তিনি সৃষ্টির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গেছেন। এসময় তার কর্তব্য ছিল, স্রষ্টাকে স্মরণ করা অথচ তিনি সৃষ্টি অর্থাৎ ঘোড়া দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন! (নাউযু বিল্লাহ)
এভাবে একজন নবীর কাজকে কাফেরদের কাজের সঙ্গে তুলনা করার পর যদি বলা হয় যে, ‘সুলায়মান আলাইহিস সালামের আসর কাযা হওয়ার কারণে অনেক দুঃখ হল। আর আমল নষ্ট হওয়ার দুঃখ যাদের আছে, আল্লাহ তাদের আমল নষ্ট হতে দেন না’ তাহলে এর দ্বারা কি আগের ভয়ংকর সমালোচনা ও বেয়াদবির অপরাধ শেষ হয়ে যাবে?
এখানে এ বিষয়টিও লক্ষণীয় যে, নবীর ঘোড়াসমূহকে নিছক দুনিয়াবী উপকরণ আখ্যা দেওয়াটাও (যেমনটা তার কথার পূর্বাপর থেকে বোঝা যায়) বেয়াদবি। কারণ ঘোড়াগুলো তো আরাম-আয়েশের জন্য ছিল না। সেগুলো ছিল দাওয়াত ও জিহাদের উপকরণ। সেগুলোর লালন-পালন ও দেখভাল করাও ইবাদতের মধ্যে শামিল। উপরন্তু এ বার্তা দেওয়া যে, আসবাবের পরীক্ষায় সুলায়মান আলাইহিস সালাম অকৃতকার্য হয়ে গেছেন– এটা তো আরও বড় বেয়াদবি!!
৪. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি ঘটনা ও সা‘দ সাহেবের সমালোচনা
২০১৮ সালের আওরঙ্গবাদের ইজতেমায় মাওলানা সা‘দ সাহেব ওলিমার বিষয়ে আলোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতের একটি ঘটনা নিয়ে কথা বলেন এবং সেখানেও তিনি আপত্তিকর উপস্থাপন করেন।
যাহোক ওলিমার বিষয়ে তিনি বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ওলিমাতে শুধু পনির খাওয়াতেন। কখনো শুধু খেজুর বা খুরমা খাওয়াতেন– তার দাবি অনুযায়ী। গোশত-রুটির ওলিমা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো করেননি। বরং তার মামুলই ছিল খেজুর-পনির জাতীয় জিনিস দ্বারা ওলিমা করা। একবার শুধু ব্যতিক্রম হয়েছিল। একবার শুধু গোশত-রুটির ওলিমা করেছিলেন। মাওলানা সা‘দ সাহেবের ভাষায়–
شادیوں میں اسراف سے بچو ، جتنا اسراف زیادہ ہو گا اتنی اذیت زیادہ ہو گی۔ حضور اکرم صلی اللہ علیہ وسلم نے تمام شادیوں میں کہیں پنیر کھلایا، کہیں کھجوریں تقسیم کر دیں، کہیں چھوارے بکھیر دیئے۔ فرمایا کھاؤ تمہاری ماں کا ولیمہ ہے۔ آج اگر کوئی چھوارے کھلادے و لیمہ میں تو کوئی ولیمہ نہ مانے گا، کوئی اس کو ولیمہ نہیں مانے گا، حالانکہ یہ عین سنت ہے، آپ کی ایک شادی نہیں ساری شادیاں ایسی ہی ہوئی ہیں، سوائے حضرت زینب رض کے کہ اس میں آپ نے گوشت روٹی کا انتظام کیا، حضرت زینب رض اس پر فخر کرتی تھی کہ میرے نکاح میں گوشت روٹی کا انتظام ہوا ہے ، اللہ کی شان کہ آپ کی جو شادی آپ کے معمول سے ہٹی اسی شادی میں آپ کو اذیت ہوئی۔
عجیب بات ہے جو شادی آپ کی آپ کے معمول سے ہٹی اسی میں آپ کو اذیت ہوئی، سوچنے کی بات ہے ہم غور کریں کہ اگر محمد صلی اللہ علیہ وسلم کو گوشت روٹی کے انتظام کی وجہ سے آکر بیٹھنے والوں کے انتظار سے اذیت ہوئی، اس سے اندازہ کر لو کہ ہم آپ کی گوشت روٹی کی سنت سے کتنے آگے بڑھ گئے ہیں۔ اب اذیتوں کی قرضوں کی پریشانیوں کی سود کی اور قرضوں میں دب جانے کی کتنی قسم کی اذیتیں آگئیں۔ اگر محمد صلی اللہ علیہ و سلم کو گوشت روٹی کی وجہ سے اذیت ہو سکتی ہے، تو ہم آپ کے اس طریقۂ سنت سے کتنے دور گئے؟!
‘বিয়ে-শাদিতে অপচয় থেকে দূরে থাক। অপচয় যত বাড়বে কষ্ট তত বাড়বে। হুজুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত বিয়েতে– কোনোটাতে পনির খাইয়েছেন, কোনোটাতে খেজুর বিতরণ করেছেন, কোনোটাতে খুরমা ছিটিয়েছেন। বলেছেন, খাও! তোমাদের মায়ের ওলিমা।
বর্তমানে যদি কেউ ওলিমায় খুরমা খাওয়ায়, তাহলে কেউ সেটাকে ওলিমা মানবে না। কেউ সেটাকে ওলিমা মানবে না। অথচ ঠিক এটাই সুন্নত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক বিয়ে নয়, বরং সব বিয়ে এমনই হয়েছে। কেবল হযরত যয়নব রা.-এর বিয়েতে তিনি গোশত-রুটির ব্যবস্থা করেন। হযরত যয়নব রা. এ নিয়ে গর্ব করতেন যে, আমার বিয়েতে গোশত-রুটির ব্যবস্থা হয়েছিল। আল্লাহর শান! তাঁর যে বিয়ে তাঁর মামুল থেকে সরে গেল, সে বিয়েতেই তাঁর কষ্ট হল।
আজব কথা! তাঁর যে বিয়ে তাঁর মামুল থেকে সরে গেল, সে বিয়েতেই তাঁর কষ্ট হল। ভাববার বিষয়। আমরা চিন্তা করি, যদি গোশত-রুটির ইন্তেজামের কারণে আগত ব্যক্তিদের অপেক্ষার দ্বারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কষ্ট হয়, তাহলে এ থেকে বুঝে নাও, আমি-আপনি গোশত-রুটির সুন্নত থেকে কত আগে বেড়ে গেছি। এখন করযের পেরেশানি, সুদের দুশ্চিন্তা ও ঋণের মধ্যে দেবে যাওয়াসহ কত ধরনের কষ্ট এসে গেছে। যদি গোশত-রুটির কারণে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কষ্ট হতে পারে, তাহলে আমরা তাঁর এই ‘তরিকায়ে সুন্নত’ থেকে কত দূরে চলে গেছি?!’ (বয়ান ২৪/২/২০১৮, মজলিসে নিকাহ, আওরঙ্গবাদের ইজতেমা, ২৭ মিনিট থেকে)
পর্যালোচনা
সা‘দ সাহেব বলেছেন, শুধু যয়নব রা.-এর বিয়েতে গোশত-রুটির আয়োজন হয়েছিল। এটাও বলেছেন যে, স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের মামুল থেকে সরে গেলেন। শুধু এক বিয়েতে তিনি নিজের মামুল থেকে সরে গেলেন। মামুল মানে এতদিন তিনি যেভাবে আমল করে এসেছেন। তাহলে সা‘দ সাহেবের কথার অর্থ দাঁড়াল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোশত-রুটি দিয়ে ওলিমা করে নিজের عین سنت তথা মূল সুন্নত থেকে সরে গিয়েছিলেন আর সে কারণেই ওই বিয়েতে তাঁর কষ্ট হয়েছিল।
‘নিজের মামুল, যেটা তাঁর মূল সুন্নত ছিল, সেটা থেকে সরে যাওয়ার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কষ্ট হয়েছিল’– এমনটা বলার মানে হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আপত্তি করা। অথচ নবীজীর থেকেই আমাদের সুন্নত শিখতে হবে এবং তাঁর সীরাত থেকেই সুন্নত হাসিল করার উৎসাহ দিতে হবে। এই নয় যে, উল্টো তাঁর সম্পর্কেই আপত্তি করা হবে যে, তিনি নিজের মামুল থেকে সরে আসার কারণে কষ্টের শিকার হয়েছেন!!
এটাও ভেবে দেখুন, সহীহ হাদীসে আছে–
أَوْلِمْ وَلَوْ بِشَاةٍ.
একটি ছাগল দিয়ে হলেও ওলিমা কর। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৭২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪২৭
এর দ্বারা বোঝা যায়, গোশত-রুটির ওলিমাও সুন্নত। সুতরাং যখন গোশত-রুটির ওলিমাও সুন্নত, তখন সেটাকে কষ্টের কারণ আখ্যা দেওয়ার কী অর্থ?
কথার শুরুতে সা‘দ সাহেব বলেছেন, ‘অপচয় যত বাড়বে কষ্ট তত বাড়বে।’ এর সঙ্গে তার এ কথাটাকে মেলান– ‘আল্লাহর শান! যে বিয়েতে তিনি নিজের মামুল থেকে সরে গেলেন, সে বিয়েতেই তিনি কষ্টের শিকার হলেন।’ যেন তিনি রাসূলের রুটি-গোশতের ওলিমাকে অপচয় সাব্যস্ত করছেন! (নাউযু বিল্লাহ)
সামনে গিয়ে আবার তিনি নিজেই গোশত-রুটিকে সুন্নত বলছেন। বলছেন, ‘আমি-আপনি গোশত-রুটির সুন্নত থেকে কত দূরে সরে গেছি।’ তাহলে স্বয়ং তার কথা অনুযায়ী গোশত-রুটিও সুন্নত। অর্থাৎ খেজুর-খুরমাও সুন্নত, গোশত-রুটিও সুন্নত। যদি উভয়টাই সুন্নত হয়, তাহলে সা‘দ সাহেব এমন কথা কীভাবে উচ্চারণ করলেন যে, এ কাজ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কষ্টের মধ্যে পড়েছেন?! হযরত যয়নব রা.-এর বিয়েতে গোশত-রুটির ইন্তেজাম করাটাও যদি সুন্নত হয় –এবং বাস্তবেও সুন্নত– তাহলে কি এর কারণে কোনো কষ্ট আসতে পারে? সুন্নত অনুযায়ী আমল করাটা কি কখনো কষ্ট আসার কারণ হতে পারে?
একটু ভেবে দেখুন, আমরা যাঁর সুন্নত অনুসরণে আদিষ্ট, তাঁর বিষয়ে মন্তব্য করা হচ্ছে, তিনি নিজের মামুল থেকে সরে যাওয়ার কারণে কষ্টের শিকার হয়েছেন। এই কথার মধ্যে এই বার্তাটাও আছে যে, তাঁর উচিত ছিল এমনটা না করা!! অথচ কষ্ট তো আল্লাহর হুকুমে আসে। তার কত কারণই তো হতে পারে। কোথায় কী কারণে কষ্ট হয়েছে, সেটা তো আল্লাহ্ই ভালো জানেন। কিন্তু এটা কেমন উম্মতি; নবীর কষ্টের এমন ব্যাখ্যা দেয়, যা থেকে মনে হয় যে, নবী এমন কোনো কাজ করেছেন, যার কারণে তিনি কষ্টের মধ্যে পড়েছেন!
আফসোসের কথা হল, মাওলানা সা‘দ সাহেবের এই কথা কুরআন কারীমেরও খেলাফ। কারণ এখানে তিনি যে কষ্টের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, সেটার কারণ তো কুরআন কারীম এই বলছে যে, মেহমানদের কেউ কেউ দাওয়াতের একটি আদব খেয়াল না করার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কষ্ট হয়েছিল। তারা দস্তরখান থেকে ফারেগ হওয়ার পরও দীর্ঘক্ষণ বসেছিলেন। এই কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কষ্ট হয়েছিল। কুরআন কারীম তাদেরকে এই আদবের প্রতি সতর্ক করেছে। দেখুন সূরা আহযাব (৩৩)-এর ৫৩ নং আয়াত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন–
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُیُوْتَ النَّبِیِّ اِلَّاۤ اَنْ یُّؤْذَنَ لَكُمْ اِلٰی طَعَامٍ غَیْرَ نٰظِرِیْنَ اِنٰىهُ وَ لٰكِنْ اِذَا دُعِیْتُمْ فَادْخُلُوْا فَاِذَا طَعِمْتُمْ فَانْتَشِرُوْا وَلَا مُسْتَاْنِسِیْنَ لِحَدِیْثٍ اِنَّ ذٰلِكُمْ كَانَ یُؤْذِی النَّبِیَّ فَیَسْتَحْیٖ مِنْكُمْ وَاللهُ لَا یَسْتَحْیٖ مِنَ الْحَقِّ وَ اِذَا سَاَلْتُمُوْهُنَّ مَتَاعًا فَسْـَٔلُوْهُنَّ مِنْ وَّرَآءِ حِجَابٍ ذٰلِكُمْ اَطْهَرُ لِقُلُوْبِكُمْ وَقُلُوْبِهِنَّ وَمَا كَانَ لَكُمْ اَنْ تُؤْذُوْا رَسُوْلَ اللهِ وَ لَاۤ اَنْ تَنْكِحُوْۤا اَزْوَاجَهٗ مِنْۢ بَعْدِهٖۤ اَبَدًا اِنَّ ذٰلِكُمْ كَانَ عِنْدَ اللهِ عَظِیْمًا.
হে মুমিনগণ! নবীর ঘরে (অনুমতি ছাড়া) প্রবেশ করো না। অবশ্য তোমাদেরকে আহার্যের জন্য আসার অনুমতি দেওয়া হলে ভিন্ন কথা। তখন এভাবে আসবে যে, তোমরা তা প্রস্তুত হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকবে না। কিন্তু যখন তোমাদের দাওয়াত করা হয় তখন যাবে। তারপর যখন তোমাদের খাওয়া হয়ে যাবে তখন আপন-আপন পথ ধরবে; কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়বে না। বস্তুত তোমাদের এ আচরণ নবীকে কষ্ট দেয়, কিন্তু তিনি তোমাদেরকে (তা বলতে) সঙ্কোচবোধ করেন। আল্লাহ সত্য বলতে সঙ্কোচবোধ করেন না। নবীর স্ত্রীগণের কাছে তোমরা কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এ পন্থা তোমাদের অন্তর ও তাদের
অন্তর অধিকতর পবিত্র রাখার পক্ষে সহায়ক হবে। নবীকে কষ্ট দেওয়া তোমাদের জন্য জায়েয নয় এবং এটাও জায়েয নয় যে, তাঁর (মৃত্যুর) পর তোমরা তাঁর স্ত্রীদের কখনো বিবাহ করবে। আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা গুরুতর ব্যাপার। –সূরা আহযাব (৩৩) : ৫৩
কিন্তু মাওলানা সা‘দ সাহেব এই কষ্টের দায় খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আরোপ করছেন! বলছেন, তিনি নিজের মামুল থেকে সরে যাওয়ার কারণে কষ্টের শিকার হয়েছেন!!
যাহোক, কুরআন কারীমের আয়াত থেকে জানা গেল, আগত কয়েকজন মেহমান একটি আদবের প্রতি লক্ষ না রাখার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কষ্ট হয়েছিল। কুরআন কারীমে ওই আদবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু মাওলানা সা‘দ সাহেব এই কষ্টের কারণ খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলকেই সাব্যস্ত করেছেন। বলেছেন, তিনি নিজের মামুলের খেলাফ করেছেন বিধায় কষ্টের মধ্যে পড়েছেন।
মোটকথা, সায়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘটনা আলোচনা করতে গিয়েও সা‘দ সাহেবের ওই মেযাজটাই কাজ করেছে যে, নবীগণের সীরাত আলোচনার সময়ও নিজের ‘বুঝ’ অনুযায়ী মন্তব্য করা যায়, মতামত দেওয়া যায়! অথচ সীরাতের আলোচনা করতে হবে হেদায়েত নেওয়ার জন্য; ত্রুটি খোঁজার জন্য নয় এবং সমালোচনা করার জন্যও নয়। কোনোকিছু বুঝতে না পারলে ফুকাহায়ে কেরামের শরণাপন্ন হতে কী সমস্যা!
এখানে এ বিষয়টিও লক্ষণীয়– যদি গোশত-রুটির ওলিমাই কষ্ট পাওয়ার কারণ হয়ে থাকে, তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীকে কেন বললেন–
أَوْلِمْ وَلَوْ بِشَاةٍ.
‘একটি ছাগল দিয়ে হলেও ওলিমা কর?’
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোশত দিয়ে ওলিমা করার পরামর্শ দিচ্ছেন। আর সা‘দ সাহেব এটাকে কষ্টের শিকার হওয়ার কারণ হিসেবে পেশ করছেন। এমনকি এ সুন্নতের ওপর স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমল করছেন তখনো। কোনো সন্দেহ নেই, এটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমালোচনা এবং বেয়াদবি।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)