দশটি আত্মিক রোগ ও চিকিৎসা
الحمد لله وكفى، وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد.
فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم، بسم الله الرحمن الرحيم.
وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوْبِهَا. صدق الله مولانا العظيم.
আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর বান্দাদেরকে তাসবীহ পাঠ করার হুকুম করেছেন। সূরা নাসরের শেষ আয়াতেও এ হুকুম এসেছে–
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّکَ وَاسْتَغْفِرْہُ اِنَّہٗ کَانَ تَوَّابًا.
আপনি আপনার রবের প্রশংসার সাথে তাসবীহ পাঠ করুন। তাঁর কাছে ইস্তেগফার করুন। নিশ্চয় তিনি তওবা কবুলকারী। –সূরা নাসর (১১০) : ০৩
আল্লাহ তাআলা যখন মানুষ সৃষ্টি করার ইচ্ছা করলেন, তখন ফেরেশতাদের সাথে কথা বললেন। ফেরেশতারা তখন বলেছিলেন, আল্লাহ! আপনি মানুষ সৃষ্টি করবেন! আপনার তাসবীহ পাঠ করার জন্য আমরাই তো আছি। আমরাই তো আপনার তাসবীহ পাঠ করি। আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করি!
ফেরেশতাদের অন্যতম প্রধান কাজই হল, আল্লাহ তাআলার তাসবীহ পাঠ করা। অবিরাম আল্লাহ তাআলার গুণগান গেয়ে চলা।
সহীহ বুখারীর সর্বশেষ হাদীসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ তাসবীহের কথাই বলেছেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন–
كَلِمَتَانِ حَبِيبَتَانِ إِلَى الرَّحْمٰنِ، خَفِيفَتَانِ عَلَى اللِّسَانِ، ثَقِيلَتَانِ فِي الْمِيزَانِ: سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهٖ، سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيمِ.
এমন দুটি কালেমা আছে, যা রহমানের প্রিয়, যবানে হালকা, মিযানে ভারি–
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهٖ، سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيْمِ.
[পরম পবিত্র মহান আল্লাহ, তাঁরই জন্য সব প্রশংসা। তিনি মহান, তিনি সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী পবিত্র সত্তা।] –সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৫৫৯
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তিন গুণবিশিষ্ট দুটি কালেমা– উচ্চারণে খুবই সহজ, আবার মিযানে অনেক ভারি, কিন্তু আল্লাহর কাছে বড় বেশি প্রিয়। সেই দুটি কালিমা কী? কালিমাদুটিও সেই তাসবীহ–
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِه، سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيمِ.
বোঝা গেল, তাসবীহ এমন একটি আমল, যা আল্লাহ তাআলা ভীষণ পছন্দ করেন। আল্লাহর ফেরেশতাদের সারা জীবনের আমল। তো আমাদের কাজ হল, এ তাসবীহে নিজেদেরকে অভ্যস্ত করে নেওয়া।
সহীহ বুখারীর আরেক জায়গায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
مَنْ قَالَ: سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِه، فِي يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ، حُطَّتْ خَطَايَاهُ، وَإِنْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ البَحْرِ.
যে ব্যক্তি দিনে এক শ বার ‘সুবহাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’ পড়বে, তার জীবনের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণও হয়। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪০৫
তাসবীহের এত গুরুত্ব। আল্লাহর কাছে তাসবীহ এত প্রিয়। তাসবীহ আল্লাহর কাছে বড় প্রিয়।
বনী আদম সৃষ্টির সেরা; কিন্তু কখন?
از ملائک بهره داري واز بهائم نيزهم
بگزر از حظ بهائم کز ملائک بگذري
অর্থাৎ তোমার মধ্যে ফেরেশতার আখলাকও আছে, জানোয়ারের স্বভাবও আছে। তুমি যদি জানোয়ারের স্বভাবগুলো দমন করতে পারো, ফেরেশতাদের থেকেও আগে বেড়ে যাবে।
ফেরেশতারা মাসুম। ফেরেশতাদের কোনো গুনাহ নেই। তাঁরা নিষ্পাপ। মানুষের তো কত গুনাহ আছে। নবীগণ ছাড়া সবাই তো গুনাহগার। সবারই তো গুনাহ আছে। কিন্তু এ মানুষও যখন তার আখলাক দুরস্ত করে, পশুর স্বভাব থেকে নিজেদেরকে পবিত্র করে, তখন এই গুনাহগার মানুষ নিষ্পাপ ফেরেশতাদের থেকেও আগে বেড়ে যায়; ফেরেশতারা পেছনে পড়ে যায়। বিরামহীনভাবে আল্লাহর তাসবীহ জপতে থাকা ফেরেশতারাও মানুষ থেকে পেছনে পড়ে যায়।
বনী আদমকে সৃষ্টির সেরা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন–
وَلَقَدۡ کَرَّمۡنَا بَنِيۡۤ اٰدَمَ
আমি বনী আদমকে সম্মানিত করেছি। –সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৭০
আল্লাহ বলেছেন, তিনি বনী আদমকে সম্মানিত বানিয়েছেন। তাকে আশরাফুল মাখলুকাত বানিয়েছেন। কিন্তু কখন মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত? মানুষ তখনই আশরাফুল মাখলুকাত, যখন সে তার মধ্য থেকে পশুর স্বভাব বিদায় করতে পারবে, দমন করতে পারবে। ঠিক তখন সে আশরাফুল মাখলুকাত। তখন সে সৃষ্টির সেরা; বরং সে তখন ফেরেশতাদেরও ছাড়িয়ে যায়।
তবে যদি সে তার মধ্যে থাকা পশুর স্বভাব দমন করতে না পারে, তখন সে পশুর থেকেও আরও নিচে নেমে যায়। তখন সে পশুর থেকেও নিকৃষ্ট হয়ে যায়। কবি বলেন–
خواهي که شود دل تو چوں آينه
ده چيز برو کن از درون سينه
حرص و امل و غضب وکذب وغيبه
بخل وحسد و ريا و کبر وکينه
অর্থাৎ, তুমি যদি চাও যে, তোমার হৃদয়টা আয়নার মতো স্বচ্ছ হয়ে যাক, তাহলে তোমার সীনার মধ্য থেকে দশটি রোগ বের কর।
সেই দশ রোগ হল– লোভ, দীর্ঘ আশা, রাগ, মিথ্যা, গীবত, কৃপণতা, হিংসা, লৌকিকতা, অহংকার ও বিদ্বেষ-শত্রুতা।
দশ রোগের বিবরণ
এক : লোভ
দুনিয়ার লোভ হল এক নম্বর রোগ। এই যে দুনিয়ার লোভ আমাদের মধ্যে, এটা অন্তরের বিরাট রোগ। দুনিয়ার লোভ অন্তরে জায়গা দেওয়া যাবে না। অন্তর থেকে দুনিয়ার লোভ বের করতে হবে।
দুনিয়ার ভালবাসা ও দুনিয়ার লোভকে বলা হয়েছে সকল অনিষ্টের মূল। সমস্ত খারাবির আসল হল দুনিয়ার মহব্বত, দুনিয়ার লোভ লালসা।
দুই : দীর্ঘ আশা
আরবী শব্দটা হল أمل (আমাল), যার অর্থ হল, দীর্ঘ আশা। একটা গাড়ির মালিক হয়েছেন, চাহিদা মেটেনি; আরেকটা গাড়ি লাগবে। একটা বাড়ির মালিক হয়েছেন, পেট ভরেনি; আরেকটা বাড়ি লাগবে। একটা ফ্যাক্টরির মালিক হয়েছেন, যথেষ্ট না; আরও লাগবে, আরও লাগবে।
هل من مزيد؟ هل من مزيد؟
[আরও চাই!?, আরও চাই!?]
পেট ভরে না। একে বলে দীর্ঘ আশা। এটা আরেকটা রূহানী রোগ।
তিন : রাগ ও গোস্সা
আরবী শব্দটা হল, غضب (গযব)। মানে গোস্সা, রাগ। একেকজনের কী রাগ ওঠে, রাগ ওঠার পর সে মানুষ নাকি জানোয়ার, ফরক থাকে না। জানোয়ারের স্বভাব যে আমাদের ভেতর আছে, ওই স্বভাবটাই তখন ফুটে ওঠে।
এই রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সীমাহীন গোস্সা– এটা একটি রূহানী রোগ। এর চিকিৎসা করতে হবে। এই রোগ নিয়ে চলা যাবে না।
একজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আবেদন করলেন–
أوصني يا رسول الله!
ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে একটি নসীহত করুন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নসীহত করে বললেন–
لا تغضب.
রাগ ও গোস্সাকে নিয়ন্ত্রণ কর।
সাহাবী আবারও বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে আরেকটি নসীহত করুন।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবারও বললেন–
لا تغضب.
রাগ ও গোস্সা নিয়ন্ত্রণ কর।
অর্থাৎ সীমাহান গোস্সা যে তোমার মধ্যে আছে, এটা ছাড়ো।
সাহাবী তৃতীয় বারের মতো আবারও দরখাস্ত করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে নসীহত করুন।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবারও বললেন–
لا تغضب.
তুমি তোমার রাগ ও গোস্সা দমন কর।
فَرَدَّدَ مِرَارًا.
অর্থাৎ যতবারই সাহাবী নসীহত চাইলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিবার একই কথা বললেন, গোস্সা ছাড়ো, গোস্সা ছাড়ো, গোস্সা ছাড়ো। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১২০)
চার : মিথ্যা
আরেকটা রোগের নাম হল, ‘কাযিব’। কাযিব মানে মিথ্যা। মিথ্যা কথা বলা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, মিথ্যা কসম করা, মিথ্যা ওয়াদা করা, মিথ্যার যত প্রকার সব এ মিথ্যা নামক রোগের অন্তর্ভুক্ত। স্বভাব হয়ে গেছে, আমরা কথায় কথায় মিথ্যা বলে ফেলি। এ মিথ্যা ছাড়তে হবে।
পাঁচ : গীবত
আমার দাদা রাহ. বলতেন, গীবত এখন আমাদের কাছে ‘ঘি-ভাত’ হয়ে গেছে। গরম ভাতের সাথে ঘি মেখে খেতে যেমন স্বাদ, আমাদের কাছে গীবত এমন হয়ে গেছে। গীবত ছাড়তে হবে।
আমি একসময় আমার কামরার দেয়ালে লিখে রেখেছিলাম, ‘গীবতমুক্ত এলাকা’। আমার কামরাটা ছিল গীবতমুক্ত এলাকা। মানে এ কামরায় গীবত হয় না। গীবতের সুযোগ দেওয়া হয় না। এখানে এসে কোনো গীবত করা যাবে না। এটি গীবতমুক্ত কামরা, গীবতমুক্ত এলাকা। কোনো লোক যখন আমার কামরায় প্রবেশ করত, প্রবেশ করলেই দেয়ালের লেখাটা তার নযরে পড়ত। ইচ্ছা থাকলেও এখানে গীবত করার আর সুযোগ পেত না। এভাবেই গীবত থেকে বাঁচতে হবে।
কুরআনে আল্লাহ বলেছেন–
وَلَا یَغۡتَبۡ بَّعۡضُکُمۡ بَعۡضًا اَیُحِبُّ اَحَدُکُمۡ اَنۡ یَّاۡکُلَ لَحۡمَ اَخِیۡہِ مَیۡتًا فَکَرِہۡتُمُوۡہُ.
একজন আরেকজনের গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? এটাকে তো তোমরা ঘৃণা করে থাক। –সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১২
অন্যকে গীবত থেকে বাঁচানোর কৌশল
নিজেও গীবত থেকে বাঁচতে হবে, অন্যকেও গীবত থেকে বাঁচাতে হবে। আমিও গীবত করব না, আমার সামনেও যেন কেউ গীবত করতে না পারে।
অন্যকে গীবত থেকে বাঁচাব কীভাবে? এর পদ্ধতি কী? এর পদ্ধতি হল, আমার সামনে যখন কেউ গীবত করবে, আমি তার কাছে দুআ চাইব এভাবে–
ভাই আমি নিয়ত করেছি, আমি কারো গীবত করব না। আপনি আমার জন্য দুআ করবেন, আমি যেন গীবত থেকে বাঁচতে পারি। আমার দিকে খেয়াল রাখবেন, আমি যদি কারো গীবত করি, আমাকে সতর্ক করে দেবেন।
এভাবে আপনা-আপনি ঐ লোকের গীবত বন্ধ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তাকে দুষব না, তাকে বলব না যে, আপনি কেন গীবত করছেন? বরং আমি যেন গীবত থেকে বাঁচতে পারি– দুআ চাইব। এটি হিকমত ও কৌশল। এভাবে নিজেও গীবত থেকে বাঁচা হয়ে যাবে, অন্যকেও গীবত থেকে বাঁচতে সাহায্য করা হয়ে যাবে। এ কথা শুনলে সে আর গীবত করতে হিম্মত করবে না।
ছয় : কৃপণতা
কৃপণতা ছাড়তে হবে। কবি বলেন–
بخیل گر بود زاهد بر وبحر
بهشتی نباشد به حکم خبر
অর্থাৎ কারো মধ্যে যদি কৃপণতা থাকে, যত বড় দরবেশই হোক, জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
হাদীসে এসেছে–
لا يَدْخُلُ الجَنَّةَ خِبٌّ ولا بخيلٌ ولا منَّانٌ.
জান্নাতে প্রবেশ করবে না– কোনো ধোঁকাবাজ, কোনো কৃপণ, কোনো খোঁটাদানকারী। –জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৬৩
উপরের কবিতায় কবি বলেছেন–
به حكم خبر
‘বা হুকমে খবর।’
‘খবর’ মানে হাদীস। অর্থাৎ এ কথাটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
অনেক কাজ করি, অনেক আমল করি, কিন্তু কৃপণতাও ছাড়ি না। এমনটা হওয়া যাবে না। কৃপণতা থাকলে বেহেশতে যাওয়া যাবে না। খুব বড় দান করতে হবে– জরুরি না। অল্প অল্পই করি। এতে রিয়া থেকেও বাঁচা যায়। মনের মধ্যে রিয়া আসে না।
সাত : হিংসা
হিংসা কাকে বলে? কারো মধ্যে ভালো কিছু দেখার পর কল্পনা করা, তার থেকে এটা দূর হয়ে যাক। এর নাম হিংসা। এটা হারাম। এটা গুনাহ। আর এমন আশা করা যে, এটি তার মধ্যেও থাকুক, আমার মধ্যেও আসুক– আরবীতে এর নাম ‘গিব্তা’। গিব্তা জায়েয, তবে হিংসা রাখা যাবে না মনের মধ্যে। তাড়াতাড়ি চিকিৎসা করিয়ে ফেলতে হবে।
আট : রিয়া
রিয়া মানে লোক দেখানো। ইবাদত-বন্দেগী যা কিছু করি, মনের মধ্যে নিয়ত এমন থাকে যে, মানুষ আমাকে দেখুক। এতে আমার ইজ্জত বাড়বে, সম্মান বাড়বে। না, না, এমন নিয়ত যেন না থাকে।
অনেক সময় রিয়ার ওয়াসওয়াসা আসে। নিয়ত লোক-দেখানো না, কিন্তু আমল শুরু করলে রিয়ার ভাব আসে। তখন কী করতে হবে?
থানভী রাহ. বলেছেন, তখন তুমি সেই কাজটা বেশি বেশি কর। করতে করতে একসময় তোমার আমলটা থেকে যাবে, রিয়ার ভাবটা চলে যাবে।
যে কাজ মানুষের সামনে করলে রিয়া আসে, সেই কাজটা মানুষের সামনে বেশি বেশি করতে হবে। পরে একসময় দেখা যাবে, কাজটা করার সময় ‘মানুষ দেখুক’ এই ভাবটা আর আসবে না। এটা চিকিৎসা। খুবই মুফীদ ও উপকারী চিকিৎসা। এভাবে করতে থাকলে কাজের আদত ও অভ্যাস হয়ে যাবে। কোনো কাজ আদতে পরিণত হয়ে গেলে তখন আর রিয়া থাকে না।
নয় : অহংকার
কিব্র বা অহংকার। অহংকার হল, মনে মনে নিজেকে বড় মনে করা। কিছু কিছু জানোয়ার যেমন কুকুর ইত্যাদির নাম নিয়ে হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. আল্লাহর নামে কসম করে বলতেন, ‘আমি নিজেকে এসব জানোয়ার থেকেও নিকৃষ্ট মনে করি।’
তো কিব্র বা অহংকার যদি আসতে চায়, এর চিকিৎসা করতে হবে।
নিজের মধ্যে এমন একটা ফিকির সব সময় রাখতে হবে– আল্লাহ কি আমাকে মাফ করবেন, আমার ঠিকানা কোথায় হবে! জাহান্নামই যদি আমার ঠিকানা হয়, তাহলে আমার থেকে কতই না শ্রেষ্ঠ এই জানোয়ারগুলো! এভাবে চিন্তা করলে আর নিজের মধ্যে অহংকার আসে না, ফখর আসে না, বড়াই আসে না।
দশ : কীনা
‘কীনা’ কী জিনিস? কীনা হিংসার কাছাকাছি। কারো মধ্যে ভালো কিছু দেখার পর মনের মধ্যে এমন প্রশ্ন আসা যে, এ জিনিস কেন তাকে দেওয়া হল? এজন্য মনে মনে কষ্ট লাগতে থাকা। এর নাম ‘কীনা’। এটিও একটি রূহানী রোগ। এরও চিকিৎসা করতে হবে।
তো এই হল দশটি রূহানী রোগ। রূহানী আমরায বা আত্মিক ব্যাধি তো অনেক আছে, এ দশটি হল বড় রোগ। এসব রোগের অবশ্যই চিকিৎসা করতে হবে। এ রোগগুলো রেখে দেওয়া যাবে না। এ রোগগুলো আরও অসংখ্য রোগ সৃষ্টি করবে। এ রোগগুলোর চিকিৎসা যখন মানুষ করবে, তখনই মানুষ ফেরেশতা থেকে আগে বেড়ে যাবে।
হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর বিশেষ হাল
আমার শায়েখ ও মুরশিদ হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর সামনে যদি কেউ হযরতের প্রশংসা করত, হযরত মাথাটা একদম নিচু করে বসে থাকতেন। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে বলতেন, ‘তোমরা আমাকে এগুলো বল, আমার তো লজ্জা লাগে। আমি তো কিছুই না, আমি তো কিছুই না, এগুলো আমার সামনে বলবা না।’
হযরত সব সময় আল্লাহর যিকির করতেন। হযরত বলতেন, ইস্তেঞ্জাখানায় কীভাবে যিকির করবে? সেখানে তো যিকির করা যাবে না!
হযরত বলতেন, যিকরে লিসানীই না নিষেধ, যিকরে ক্বলবী তো কখনোই নিষেধ না। যেখানে মুখে আল্লাহকে ডাকা যাবে না, সেখানে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে হবে।
তালিবুল ইলমদের ‘বিশেষ যিকির’
হযরত তালিবুল ইলমদের মজলিসে বলতেন, তোমরা লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে যিকিরে লেগে যেয়ো না। মীযান-মুনশাইবের গর্দানই তোমাদের যিকির। তোমরা সরফের গর্দান দিতে থাকবে, ইলমের পেছনে মেহনত করতে থাকবে। এটাই তোমাদের জন্য অনেক অনেক উত্তম যিকির। একজন মেহনতী তালিবুল ইলমের আমলনামায় দেখা যাবে অনেক যিকিরের নেকী।
হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে আঠারো বছর
হযরত হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে আঠারো বছর ছিলাম। সব সময় আল্লাহর যিকির করনেওয়ালা এই এক আল্লাহর বান্দা আমি দেখেছি। স-ব সময় আল্লাহর যিকির। স-ব সময় আল্লাহর যিকির।
মাগরিবের পর আওয়াবীনে তিন পারা কুরআন শরীফ পড়তেন। তাহাজ্জুদে তিন পারা পড়তেন। এই ছয় পারা, আর হাঁটাচলায় তিন পারা পড়তেন। প্রতিদিন এই নয় পারা হযরতের তিলাওয়াত হতই। এছাড়াও কুরআন শরীফ দেখে তো হযরত তিলাওয়াত করতেই থাকতেন।
হাফেযদেরও উচিত কুরআন কারীম দেখে পড়া
একটা বড় আকারের কুরআন কারীম (মুসহাফ) ছিল হযরতের। হযরত ঐ মুসহাফ দেখে দেখে তিলাওয়াত করতেন।
হাফেজদেরকেও বলতেন, কুরআন কারীম দেখে দেখে তিলাওয়াত করবে। তুমি তো কুরআন কারীম মুখস্থ করেছ, কিন্তু তিলাওয়াত করার সময় দেখে দেখে পড়বে।
হযরত হিফযখানার পরীক্ষা নিতেন। তখন ছাত্রদেরকে এ নসীহত করতেন। হযরত বলতেন, দেখে দেখে পড়লে সওয়াবও বেশি, ইয়াদও মজবুত হয়।
আমিও হযরতের এ নসীহতটা হাফেয ছাত্রদেরকে করি।
জিহ্বার একটাই কাজ– আল্লাহর যিকির
আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন অঙ্গ দুটি দুটি দিয়েছেন। হাত দুটি। পা দুটি। কান দুটি। কিন্তু জিহ্বা একটি কেন? আল্লাহ বোঝালেন, বান্দা! তোমার সমস্ত অঙ্গের কাজ বেশি। যবানের কাজ কিন্তু কম, মাত্র একটা কাজ– আল্লাহর যিকির।
যখন হাঁটাচলা করি, দু-পায়ে হাঁটাচলা করি। দু-হাতে কাজ করি। দু-হাত ব্যস্ত থাকে। এক হাতে ছাতা, আরেক হাতে ব্যাগ। কিন্তু যবানের কী কাজ? যবানের কাজ হল, ব্যস, আল্লাহর যিকির, আল্লাহর যিকির।
উস্তাযও তালিবুল ইলম
যে পড়ে, সেও তালিবুল ইলম; যিনি পড়ান, তিনিও তালিবুল ইলম। হযরত আনওয়ার শাহ কাশ্মীরি রাহ.-কে কেউ যখন তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করত, তিনি বলতেন, ম্যায় দারুল উলূম দেওবন্দ কা এক তালিবুল ইলম হোঁ’। [আমি দারুল উলূম দেওবন্দের একজন তালিবুল ইলম।]
তালিবুল ইলমদের ‘কাসীরুয যিকর’ হওয়া দরকার। বেশি বেশি আল্লাহর যিকিরের অভ্যাস এখন থেকেই গড়ে নেওয়া দরকার।
হাফেজ্জী হুজুর রাহ. বলতেন–
جز ذکر خدا ہر چہ کنی عمر ضائع
جز حرف عشق ہر چہ خوانی بطالت است
অর্থাৎ আল্লাহর যিকির ছাড়া তুমি যত যা-ই কর, তোমার জীবন বরবাদ। আল্লাহর ইশক ও মহব্বত ছাড়া যত কিছু পড়, সবই বেকার।
যিকিরের দুটি বৈশিষ্ট্য
যিকিরের দ্বারা কয়টা ফায়দা? কয়টা লাভ? একইসঙ্গে দুটি লাভ। যিকিরের দ্বারা আল্লাহর মহব্বতও বাড়বে, আল্লাহর ভয়ও বাড়বে। বেশি বেশি যিকিরের দ্বারা একসাথে এ দুটি লাভ। আল্লাহর ভয় আমাদের মধ্যে নাই। আল্লাহর ভয় থাকলে তো আমরা গুনাহ করতে পারতাম না!
যার মধ্যে আল্লাহর ভয় আছে, সে আল্লাহর নাফরমানী করতে পারে না। গুনাহের ইচ্ছা যখন মনে জাগ্রত হয়, তখনই তার সামনে আল্লাহর আযাবের দৃশ্য ভেসে ওঠে। কবরের আযাব, জাহান্নামের আযাব চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তখন সে আর গুনাহ করতে পারে না। গুনাহ থেকে বাঁচা তার জন্য সহজ হয়ে যায়।
‘কাছরাতে যিকির’ (বেশি বেশি যিকির) দ্বারা আল্লাহর ভয় বাড়ে এবং আল্লাহর মহব্বত বাড়ে। আল্লাহর ভয় বাড়লে গুনাহ আস্তে আস্তে ছুটতে থাকে। আর মহব্বত বাড়লে নেকীর কাজ সহজ হতে থাকে, নেকী আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। বোঝা গেল, বেশি বেশি যিকির করার দ্বারা গুনাহ ছাড়া আর নেকী ধরা– দুটি কাজই সহজ হয়ে যাবে।
হযরত হাফেজ্জী হুজুরের স্মৃতি
ঊনিশ শ পঁচাত্তর সনে হযরতের সঙ্গে হজ্বের সফরের সৌভাগ্য হয়েছিল। সে সফরে হযরতের কাছে পূর্ণ সহীহুল বুখারী পড়ারও আমার সৌভাগ্য হয়েছিল। মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে কুবা– তিন জায়গায় হযরতের কাছে আমি সহীহুল বুখারী পড়েছি।
মসজিদে নববীতে হযরতের কাছে আমার সহীহুল বুখারী পড়ার সময় ছিল সকাল দশটায়। আমি দশটায় উপস্থিত হতাম। তখন দেখতাম, মসজিদের প্রথম কাতারে একেবারে পশ্চিম মাথায় এক বুজুর্গ নামায পড়ছেন। চাশতের নামায। ঠিক একই সময়ে মসজিদের পূর্ব মাথায় আরেক বুজুর্গ নামায আদায় করছেন। দুজনই থানভী রাহ.-এর খলীফা। একজন হযরত কারী ফাতাহ মুহাম্মাদ ছাহেব রাহ., আরেকজন হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.। মনে হত যেন আপন দুই ভাই। কারো খবর কারো কাছে নাই। হাফেজ্জী হুজুরও জানেন না ফাতাহ মুহাম্মাদ ছাহেবের কথা, ফাতাহ মুহাম্মাদ ছাহেবও জানেন না হাফেজ্জী হুজুরের কথা। আমি পেছনে বসে বসে তাদের নামাযের দৃশ্য দেখতাম। রুকু করার সময় মনে হত যেন, আল্লাহকে দেখে আল্লাহর সামনে ঝুঁকে পড়ছেন। যেমন হাদীসে আছে, ‘তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত কর, যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ’।
কারী ফাতাহ মুহাম্মাদ ছাহেব রাহ. এবং হাফেজ্জী হুজুর রাহ. মসজিদে নববীতে যে রুকু-সিজদাগুলো করতেন, মনে হত যেন, আল্লাহকে দেখে দেখে রুকু-সিজদাগুলো করছেন।
জেদ্দা থেকে মক্কার পথে
সেই সফরে জেদ্দা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে আমরা দশজন সফরসঙ্গী একটি গাড়ি ভাড়া করলাম। হযরত সামনের আসনে বসলেন। হযরতের ঠিক পেছনে আমি বসলাম। আমি তো হযরতের খাদেম। হযরতের কখন কী প্রয়োজন হয়, হযরত চাইলেই যেন আমি দিতে পারি। আমি হযরতের খেদমত কী আর করব, হযরতের কাইফিয়্যাত দেখতে দেখতেই আমার সময় পার হয়ে গেল।
সারাটা পথ দেখলাম, হযরতের দু-চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে। পথে হযরতকে কিছু জিজ্ঞেস করার মতো হালত ছিল না। পরে মসজিদে হারামে হযরতের কাছে যখন সহীহুল বুখারী পড়তাম, তখন কোনো একদিন হযরতকে জিজ্ঞেস করলাম– সেদিন এমনভাবে আকুল হয়ে কান্নার রহস্য কী।
হযরত বললেন, তুমি দেখেছ?
আমি বললাম, আমি তো সারাটা পথ আপনার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।
হযরত বললেন, আমি রাস্তার দুই পাশে পাহাড়গুলো দেখছিলাম আর মনের মধ্যে এ ভাবনা জাগ্রত হচ্ছিল যে, হায়রে এইসব পাহাড় আমি মুহাম্মাদুল্লাহ দেখছি! এই তো সেসব পাহাড়, যেগুলোর প্রতি প্রিয়নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টি পড়েছিল।
এ কথা আমার মনের মধ্যে জাগ্রত হচ্ছিল, তাই আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না।
নামাযের আশেক হযরত হাফেজ্জী হুজুর
হযরতের সাথে চিটাগাং সফর করেছি। নোয়াখালি সফর করেছি। রেলগাড়িতে। রেলের সফরেও হযরতের আজীব আজীব হাল। রেলগাড়িতে নামায পড়া কঠিন। রেলের ঝাঁকুনিতে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল। হযরত রেলের সিটেও নফল পড়তে থাকতেন। তাহাজ্জুদও পড়তেন। শুরু করতেন বসে বসে। কিছুক্ষণ বসে থেকে দাঁড়িয়ে যেতেন। তারপর রুকু-সিজদা করে আবার কিছুক্ষণ বসতেন। বসে আবার দাঁড়িয়ে যেতেন। আহা, নামাযী যিন্দেগী ছিল হযরতের যিন্দেগী।
কিশোরগঞ্জের হযরত মাওলানা আতহার আলী ছাহেব রাহ. বলতেন, আমি আতহার আলী হাফেজ্জীর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে টক্কর দিতে পারি; কিন্তু দুটি বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমি পারি না। দুটি বিষয়ে তাঁর সঙ্গে টক্কর দেওয়ার আমি আতহার আলীর হিম্মত হয় না।
একটা হল, কাছরাতে যিকির, আরেকটা হল, কাছরাতে সালাত। কাছরাত মানে আধিক্য। হাফেজ্জী হুজুর যিকির ও নামাযে যত বেশি পরিমাণ ডুবে থাকতেন, আতহার আলী ছাহেব বলেন যে, তাঁর সাথে এ বিষয়ে টক্কর দেওয়ার হিম্মত আমার হয় না।
হযরত নফল নামায অনেক বেশি পড়তেন। ইন্তেকালের মাত্র চার-পাঁচদিন আগের কথা। হযরত ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতালে ভর্তির কয়েকদিন আগে মাদরাসায়ে নূরিয়ায় হযরতের একটা লেখা আমাকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমার এ লেখাটা তুমি সুন্দর করে গুছিয়ে পরিষ্কার করে লিখে আমাকে দিয়ো। আমি সুন্দর কাগজে পরিষ্কার করে লেখাটি লিখলাম। এর মধ্যে হযরত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলেন। আমি হাসপাতালে গিয়েই হযরতের হাতে লেখাটা পেশ করলাম। হযরতকে পড়ে শুনালাম।
হযরত খুব খুশি হলেন! মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ সাহেব সামনে ছিলেন। হযরত খুশি হয়ে বললেন, দেখলেন মুহিব্বুল্লাহ সাহেব! মওলভী আবদুল হাই আমার মনের কথাটা কত সুন্দরভাবে লিখে নিয়ে এসেছে! কত সুন্দরভাবে সাজিয়ে লিখেছে! একেবারে আমি যা বলতে চেয়েছি, তাই সে লিখেছে।
আমি বললাম, হযরত! লেখা তো শেষ হয়েছে, আপনার দস্তখত লাগবে। এ কথা বলে আমি গুনাহগারের কলমটাই হযরতের হাতে দিলাম। আমার কলমটা দিয়ে হযরত তাঁর যিন্দেগীর শেষ দস্তখতটা করলেন। এটাই হযরতের শেষ দস্তখত এবং শেষ লেখা। এরপর হযরত আর কলম হাতে নেননি।
এই যামানায়, এই কালে হাফেজ্জী হুজুরের মতো এক নিআমত আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দান করেছিলেন।
হাফেজ্জী হুজুর রাহ. সম্পর্কে হাকীম ইফহামুল্লাহ রাহ.-এর অভিমত
আল্লাহওয়ালাদের কথা উঠলে তাঁদের হাজারো স্মৃতি আমার মাথায় ভিড় করে। মনের মধ্যে তাদের কথার ঢেউ খেলতে থাকে। বাংলাদেশ সফরে হযরত আবরারুল হক ছাহেব রাহ.-এর অন্যতম সফরসঙ্গী ছিলেন তাঁরই বেয়াই হযরত হাকীম ইফহামুল্লাহ ছাহেব রাহ.। হিন্দুস্তান ফিরে যাওয়ার পর তিনি একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠি দীর্ঘদিন আমার কাছে সংরক্ষিত ছিল। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর কোথায় যে হারিয়ে গেছে! সেই চিঠিতে হাকীম সাহেব হাফেজ্জী হুজুর রাহ. সম্পর্কে লেখেন–
تاریخ کے اوراق میں ہم نے ہمارے اکابرین کے زندگی جو پڑھے الحمدللہ بنگلہ دیش میں جا کر حضرت حافظ جی حضور رحمت اللہ علیہ کو اپنی آنکھوں سے دیکھا تو سمجھا ہمارے اکابرین ایسے تھے۔
‘আমাদের আকাবির বুজুর্গগণ কেমন ছিলেন, যা আমরা ইতিহাসের পাতায় পড়েছি। আলহামদু লিল্লাহ, বাংলাদেশে গিয়ে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-কে স্বচক্ষে দেখে বুঝেছি, আমাদের আকাবির বুজুর্গগণ এমনই ছিলেন।’
কাসেম নানূতবী রাহ. কেমন ছিলেন, রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ. কেমন ছিলেন, দেওবন্দের আকাবিরীন কেমন ছিলেন, দেখতে চাইলে বাংলাদেশের হাফেজ্জী হুজুরকে গিয়ে দেখে আস, ঠিক আকাবির-আসলাফের বাস্তব নমুনা ছিলেন।
আমার প্রতি হযরত হাফেজ্জী হুজুরের শফকত ও মহব্বত
হাদীসে আছে–
من لم يشكر الناس لم يشكر الله.
মানুষের কৃতজ্ঞতা যে আদায় করে না, তার দ্বারা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় হয়ে ওঠে না। –জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৫৫
شکر نعمتہائے تو چنداں کہ نعمتہائے تو
عذر تقصیرات ما چنداں کہ تقصیرات ما
অর্থাৎ আল্লাহর নিআমত যত বেশি, শুকরিয়াও তত বেশি করা লাগে।
হাফেজ্জী হুজুরের শুকরিয়া আমি কী আদায় করব। আমার প্রতি হযরতের যে সীমাহীন ইহসান, শফকত ও মহব্বত– তার শোকর আদায় করা কি আমার পক্ষে সম্ভব। তবু আমি হাফেজ্জী হুজুরের শোকর আদায় হিসেবে হুজুরের কিছু ওয়াকেয়া (ঘটনা) শোনাই। হুজুর আমাকে কী পরিমাণ যে মহব্বত করতেন, তার একটা নমুনা আমি শোনাই।
একবার কামরাঙ্গীরচর থেকে হুজুর হুইল চেয়ারে লালবাগ যাচ্ছেন। হুজুরের খাদেম আবদুল মান্নান হুইল চেয়ার চালাচ্ছেন। পেছনে পেছনে আমি হযরতের আরেক খাদেম হিসেবে আছি। হযরত আমাকে ডাকলেন, মওলভী আবদুল হাই!
: জী হযরত! আমি পেছনে আছি।
: আপনি সামনে আসেন।
আমি সামনে গেলাম। হুজুর বললেন, আবদুল মান্নান! হুইল চেয়ার থামাও।
আবদুল মান্নান হুইল চেয়ার থামালেন। হযরত আমাকে বললেন, আপনি বসেন।
আমি হযরতের সামনে মাটিতেই বসে পড়লাম। হযরত আমাকে কিছুই বললেন না; শুধু আমার মাথাটাকে দু-হাতে ধরে আমার কপালে চুমু খেলেন।
এভাবে হযরত আমার প্রতি তাঁর স্নেহ, শফকত, মহব্বত ও হৃদয়ের সম্পর্কের প্রকাশ ঘটালেন।
একদিন হযরতের মেজো ছাহেবযাদা হাজ¦ী ওবায়েদ ভাইকে বললেন, ওবায়েদ! জানো তোমরা কয় ভাই?
ওবায়েদ ভাই অবাক হয়ে বললেন, কেন আব্বা, আমরা চার ভাই!
হযরত মুচকি হেসে বললেন, না, তোমরা পাঁচ ভাই, মওলভী আবদুল হাই তোমাদের এক ভাই।
এত মহব্বত হযরত আমাকে করতেন। তো আমি সেই হযরতের আদনা গোলাম, খাদেম। আঠারো বছর হযরতের কদমের কাছে ছিলাম। কিন্তু আমার দিকে লক্ষ করলে আমার আফসোস লাগে, এত বড় নিআমত পেয়ে আমি কী অর্জন করলাম। কিছুই তো অর্জন করতে পারিনি। আমার জন্য আপনারা দুআ করবেন, হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর মহব্বতের লাজ যেন রক্ষা পায়। যেন হযরতের কোনো অসম্মান আমার দ্বারা না হয়।
কামরাঙ্গীরচর নূরিয়ার মসজিদসংলগ্ন যে খানকাহ হযরত বানিয়েছেন, তার একটা কামরায় আমি থাকতাম। একদিন খানকায় বসে আমি তাফসীরে বায়যাবী মুতালাআ করছি। অনুভব করছি, কে যেন দরজার সামনে দাঁড়ানো। আমি মুতালাআ করেই চলেছি, মাথা তুলছি না। ভাবছি, যে এসেছে, আমার কাছে তার কোনো প্রয়োজন থাকলে সে নিজেই কথা বলবে, আমি আমার মুতালাআ করতে থাকি।
কিছুক্ষণ পর লক্ষ করলাম, মানুষটা আমার কাছেই চলে এসেছে। আমি বুঝলাম, আমার কাছেই তার কোনো প্রয়োজন। আমি মাথা তুলেই চমকে উঠলাম, ‘হযরত আপনি!’
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি হযরতকে জায়নামায বিছিয়ে দিলাম। হযরত বসলেন। আমি হযরতের সামনে বসলাম। হযরত বললেন, আমি তো আপনাকে বারো হাজার বার আল্লাহ আল্লাহ যিকিরের ওযিফা দিয়েছিলাম। আমি জানতে পারলাম, আপনি অনেক বেশি মুতালাআ করেন। এখন এসেও দীর্ঘক্ষণ যাবৎ আপনাকে মুতালাআয় ডুবে থাকতে দেখলাম। তো আপনার জন্য ‘তাখফীফ’ করে দিচ্ছি। আপনি এখন থেকে তিন হাজার বার আল্লাহ আল্লাহ যিকির করবেন।
আমি আপনাদের সবার কাছে দুআ চাই, হযরতের নসীহত ও অসিয়তগুলোর ওপর যেন আমল করতে পারি।
وَآخِرُ دَعْوَانَا أَنِ الْحَمْدُ لِلهِ رَبِّ ٱلْعَالَمِينَ.