Muharram 1447   ||   July 2025

সূরাসমূহের নামের অর্থ

কামরুল আনাম খান

(পূর্ব প্রকাশের পর)

 

৮৫ সূরাতুল বুরূজ 

বুরূজ’ (بُرُوْج) শব্দটি র্বুজুন (برج) শব্দের বহুবচন অর্থ দুর্গ, উঁচু দালান, বড় নক্ষত্র ইত্যাদি আবার মাসদার বা ক্রিয়ামূল হিসেবে বুরূজ (بُرُوْج) অর্থ উপরে ওঠা, স্পষ্ট হওয়া সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে তাতে ইরশাদ হয়েছে

وَ السَّمَآءِ ذَاتِ الْبُرُوْجِ.

শপথ বুরূজ-বিশিষ্ট আকাশের

এর দ্বারা হয়তো সেই বারোটি মনযিল বোঝানো হয়েছে, যা সূর্য এক বছরে প্রদক্ষিণ করে অথবা আকাশের সেইসব দুর্গকে, যাতে অবস্থান করে ফেরেশতাগণ পাহারাদারি করে অথবা গ্রহ-নক্ষত্রকেও বোঝানো হতে পারে (দ্র. তাফসীরে উসমানী)

এ সূরায় আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে নির্যাতন করেছে, তারপর তওবাও করেনি, তাদের জন্য আছে জাহান্নামের শাস্তি এবং তাদেরকে আগুনে জ¦লার শাস্তি দেওয়া হবে

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত আলবুরূজ (الْبُرُوْج) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল বুরূজ’

৮৬ সূরাতুত ত্বারিক 

ত্বারিক’ (الطَّارِق) অর্থ রাতের আগমনকারী সূরার প্রথম দুই আয়াতেই শব্দটি রয়েছে আয়াতে রাতের আগমনকারী দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য তাও এ সূরায় বলে দেওয়া হয়েছে সূরার শুরুতে ইরশাদ হয়েছে

وَالسَّمَآءِ وَالطَّارِقِ، وَمَاۤ اَدْرٰىكَ مَا الطَّارِقُ، النَّجْمُ الثَّاقِبُ.

শপথ আকাশের ও রাতের আগমনকারীর তুমি কি জান রাতের আগমনকারী কী? উজ্জ্বল নক্ষত্র! আয়াত ১-৩

এ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুত ত্বারিক’

৮৭ সূরাতুল আ‘লা 

আ‘লা’ (الاَعْلَی) অর্থ উচ্চ মর্যাদার অধিকারী, মহত্তম, সমুচ্চ, মহামহিম ইত্যাদি সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে তাতে ইরশাদ হয়েছে

سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلَی، الَّذِیْ خَلَقَ فَسَوّٰی.

তোমার সমুচ্চ প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা কর যিনি (সবকিছু) সৃষ্টি করেছেন ও সুগঠিত করেছেন আয়াত : ১-২

এ সূরায় আল্লাহ তাআলা বলেছেন, (তরজমা) ‘সফলতা অর্জন করেছে সেই ব্যক্তি, যে পবিত্রতা অবলম্বন করেছে, এবং নিজ প্রতিপালকের নাম নিয়েছে ও নামায পড়েছে কিন্তু তোমরা পার্থিব জীবনকেই প্রাধান্য দাও অথচ আখেরাত কত বেশি উৎকৃষ্ট ও কত বেশি স্থায়ী

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত আলআ‘লা (الاَعْلَی) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল আ‘লা’

৮৮ সূরাতুল গাশিয়াহ 

গাশিয়াহ’ (الغَاشِیَة) অর্থ দুর্যোগ, মহাপ্রলয়, আচ্ছাদন, এমন কিছু যা অন্য কিছুকে ছেয়ে ফেলে সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে তাতে ইরশাদ হয়েছে

هَلْ اَتٰىكَ حَدِیْثُ الْغَاشِیَةِ.

তোমার কাছে কি পৌঁছেছে সেই ঘটনার সংবাদ, যা সবকিছুকে আচ্ছন্ন করবে?

এর দ্বারা কিয়ামত বোঝানো উদ্দেশ্য এর পরবর্তী আরও কিছু আয়াতে কিয়ামত পরবর্তী অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত আলগাশিয়া (الغَاشِیَة) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল গাশিয়াহ’

৮৯ সূরাতুল ফাজর 

ফাজর’ (الفَجْر) দ্বারা উদ্দেশ্য ফজরের সময় সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে তাতে আল্লাহ তাআলা ফজরের সময়ের শপথ করেছেন

এ সূরায় আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন জাতির ধ্বংসের কথা বর্ণনা করে যারা আল্লাহর অবাধ্যতা করে তাদেরকে সতর্ক করেছেন এবং সময় শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার কথা বলেছেন

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত আলফাজর (الفَجْر) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল ফাজর’

৯০ সূরাতুল বালাদ 

বালাদ’ (البَلَد) অর্থ দেশ, শহর, নগর ইত্যাদি সূরার প্রথম দুই আয়াতে শব্দটি রয়েছে তাতে ইরশাদ হয়েছে

لَاۤ اُقْسِمُ بِهٰذَا الْبَلَدِ،  وَ اَنْتَ حِلٌّۢ بِهٰذَا الْبَلَدِ.

আমি শপথ করছি এই নগরের, যখন (হে নবী!) তুমি এই নগরের বাসিন্দা আয়াত ১-২

আয়াতদ্বয়ে বালাদ বা নগর দ্বারা মক্কা মুকাররমাকে বোঝানো উদ্দেশ্য এ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল বালাদ’ 

৯১ সূরাতুশ শামস 

শামস’ (الشَّمْس) অর্থ সূর্য সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে তাতে আল্লাহ তাআলা সূর্যের ও বিস্তৃত রোদের শপথ করেছেন

তারপরে এ সূরায় আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৎ ও অসৎ কাজের জ্ঞান দিয়েছেন সুতরাং সে-ই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে নেবে আর ব্যর্থ সে-ই হবে, যে নিজেকে গুনাহে লিপ্ত করবে

সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখিত আশশামস (اَلشَّمْس) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুশ শামস’

৯২ সূরাতুল লাইল 

লাইল’ (الَّیْل) অর্থ রাত সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে তাতে আল্লাহ তাআলা রাতের শপথ করেছেন, যখন তা আচ্ছন্ন করে

এরপরে সূরাটিতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি (আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ) দান করে ও তাকওয়া অবলম্বন করে, আল্লাহ তাআলা তাকে স্বস্তিময় গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন আর যে কৃপণতা করে এবং (আল্লাহর প্রতি) বেপরোয়াভাব দেখায়, আল্লাহ তাকে যাতনাময় স্থানে পৌঁছার ব্যবস্থা করে দেবেন

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত আল-লাইল (الَّیْل) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল লাইল’

৯৩ সূরাতুদ দ্বুহা 

দ্বুহা’ (الضُّحٰی) অর্থ পূর্বাহ্ন, দিনের আলো সূরার শুরুতেই শব্দটি রয়েছে প্রথম কয়েকটি আয়াত হল

وَ الضُّحٰی، وَ الَّیْلِ اِذَا سَجٰی، مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلٰی، وَ لَلْاٰخِرَةُ خَیْرٌ لَّكَ مِنَ الْاُوْلٰی،  وَ لَسَوْفَ یُعْطِیْكَ رَبُّكَ فَتَرْضٰی.

(হে রাসূল!) শপথ চড়তি দিনের আলোর এবং রাতের, যখন তার অন্ধকার গভীর হয় তোমার প্রতিপালক তোমাকে পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি নারাজও হননি নিশ্চয়ই পরবর্তী সময় তোমার জন্য পূর্বের সময় অপেক্ষা শ্রেয় অচিরেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে এত দেবেন, তুমি খুশি হয়ে যাবে আয়াত ১-৫

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত আদদ্বুহা (الضُّحٰی) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুদ দ্বুহা’

৯৪ সূরাতু আলাম নাশরাহ বা ইনশিরাহ 

লাম নাশরাহ (لَمْ نَشْرَحْ) শব্দটি আরবী আশশারহু (الشَّرْح) মাসদার থেকে ব্যবহৃত ফেয়েল এর শুরুতে প্রশ্নবোধক হামযাহ যুক্ত হয়ে আলাম নাশরাহ (اَلَمْ نَشْرَحْ) হয়েছে আরবী আশশারহু (الشَّرْح) শব্দের অনেক অর্থ এর মধ্যে একটি অর্থ হল খোলা, উন্মুক্ত বা উন্মোচন করা সূরাটির প্রথম আয়াতে ইরশাদ হয়েছে

اَلَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَ.

(হে রাসূল!) আমি কি তোমার কল্যাণে তোমার বক্ষ খুলে দেইনি

এখানে ‘বক্ষ খোলা’ দ্বারা উদ্দেশ্য মন ও মননের সম্প্রসারণ অর্থাৎ ঈমান ও হেদায়েতের আলোয় অন্তঃকরণকে আলোকিত করা, অন্তর্দৃষ্টির সামনে জ্ঞান-প্রজ্ঞার জগতকে উন্মোচিত করা এবং অন্তরে হিম্মত ও উদারতা প্রভৃতি মহৎ গুণের বিকাশ ঘটানো

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত আলাম নাশরাহ (اَلَمْ نَشْرَحْ) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতু আলাম নাশরাহ’

এ সূরার আরেকটি নাম ‘সূরাতুল ইনশিরাহ’ ইনশিরাহ (الانشراح) শব্দটি আশশারহু (الشَّرْح) শব্দের মূলধাতু থেকেই নির্গত আরেকটি শব্দ ইনশিরাহ শব্দের একটি অর্থ হল খুলে যাওয়া 

এ সূরাটি আশশারহু (الشَّرْح) মাসদার থেকে ‘সূরাতুশ শারহু’ নামেও পরিচিত

৯৫ সূরাতুত তীন 

তীন’ (التِّیْن) দ্বারা উদ্দেশ্য হল তীন ফল, একে আঞ্জিরও বলা হয় সূরার প্রথম আয়াতেই শব্দটি রয়েছে সূরাটির শুরুতে ইরশাদ হয়েছে-

وَالتِّیْنِ وَالزَّیْتُوْنِ، وَ طُوْرِ سِیْنِیْنَ، وَهٰذَا الْبَلَدِ الْاَمِیْنِ، لَقَدْ خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ فِیْۤ اَحْسَنِ تَقْوِیْمٍ.

শপথ আঞ্জির ও যায়তুনের এবং সিনাই মরুভূমির (পাহাড়) তূরের এবং এই নিরাপদ শহরের, আমি মানুষকে উৎকৃষ্ট ছাঁচে ঢেলে সৃষ্টি করেছি আয়াত ১-৪

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত আততীন (التِّیْن) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুত তীন’

৯৬ সূরাতুল আলাক 

আলাক (عَلَق) অর্থ জমাট রক্ত, সংযুক্ত, ঝুলন্ত ইত্যাদি আধুনিক বিজ্ঞান মতে, মাতৃগর্ভে ভ্রƒণের যে ক্রমবিকাশ হয়, তার প্রথম দিকে শুক্র ও ডিম্বাণু জরায়ুর গায়ে যে সংযুক্ত অবস্থায় থাকে, সেটার নাম হল আলাক এটাকে আল্লাহ তাআলা পরে জমাট রক্তে পরিণত করেন এবং এ থেকেই পর্যায়ক্রমে মাতৃগর্ভে মানবদেহের বিকাশ ঘটান সূরাটির দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তিনি আলাক তথা জমাট রক্ত দ্বারাই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন

এ সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াতের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি কুরআন কারীম নাযীলের সূচনা হয়েছে তা হল-

اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِیْ خَلَقَ، خَلَقَ الْاِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ، اِقْرَاْ وَرَبُّكَ الْاَكْرَمُ، الَّذِیْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ، عَلَّمَ الْاِنْسَانَ مَا لَمْ یَعْلَمْ.

পড় তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি (সব কিছু) সৃষ্টি করেছেন তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত দ্বারা পড় এবং তোমার প্রতিপালক সর্বাপেক্ষা বেশি মহানুভব যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না আয়াত ১-৫

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত আলাক (عَلَق) শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে ‘সূরাতুল আলাক’ 

 

advertisement