খোলা দুটি পৃষ্ঠা পড়ি
জাগ্রত হই, অভিমুখী থাকি
যে কোনো কাজে দেহের সবগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যখন একসাথে সক্রিয় হয়– ফল হয় অন্যরকম। যে কথা মুখে উচ্চারিত হচ্ছে, তা যদি হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায় এবং মস্তিষ্কও তাতে সাড়া দেয়, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় ব্রতী হয়, তাহলে এর বহুমুখী প্রভাব পড়ে বক্তার ওপর, পাঠক ও শ্রোতামণ্ডলীর ওপর এবং কারী ও মুসল্লীর ওপর। একে বলে যিকিরের সঙ্গে ফিকির এবং ফিকিরের সঙ্গে যিকির। অর্থাৎ মুখে যা বলা হচ্ছে বা পাঠ করা হচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও সজ্ঞান উপলব্ধি। আবার যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে, যবানেও তার উচ্চারণ এবং হৃদয়েও তার অনুধাবন।
কুরআনের আয়াত পড়তে পড়তে প্রতিটি আয়াতের অর্থ ও মর্ম, ডাক ও শিক্ষা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা; আবার আল্লাহর সৃষ্টিজগৎ নিয়ে চিন্তা করতে করতে রব্বে কারীমের সৃষ্টিকুশলতায় অভিভূত হয়ে যবানে তাঁর যিকির জারি হয়ে যাওয়া– প্রথমটি হল যিকিরের সঙ্গে ফিকিরের সংযুক্তি ও একাত্মতা। দ্বিতীয়টি, ফিকিরের সঙ্গে যিকিরের যোগ হওয়া ও মিলেমিশে যাওয়া।
আল্লাহর কালাম পবিত্র আলকুরআন আর এই মহাবিশ্ব ও বিশাল সৃষ্টিজগৎ– দুটি আসলে আমাদের সামনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রেখে দেওয়া দুই কিতাব, দুই মহাগ্রন্থ। একটি পাঠ করি, অন্যটি অবলোকন করি। কিন্তু দুটোর সঙ্গেই জড়িত যিকির ও ফিকির এবং ফিকির ও যিকির।
আমাদের পূর্ববর্তীরা এ দুই কিতাবের নামকরণ করেছিলেন এভাবে–
كتاب الله المقروء وكتاب الله المنظور.
অর্থাৎ আল্লাহর সেই কিতাব, যা পাঠ করা হয় এবং আল্লাহর সেই কিতাব, যা চোখের সামনে দেখি।
আবার কেউ এভাবেও বলেছেন–
آيات الله في الكتاب وآيات الله في الآفاق.
অর্থাৎ কুরআন কারীমে আল্লাহর আয়াত ও বিধানাবলি এবং মহাকাশ ও মহাজগতে আল্লাহর আয়াত ও নিদর্শনসমূহ। দুটো দিয়েই আল্লাহকে চেনা যায়, আল্লাহকে জানা যায়।
কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উভয় কিতাব ও গ্রন্থ নিয়ে তাদাব্বুর ও চিন্তা-ভাবনার প্রতি উৎসাহিত করেছেন এবং বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরেছেন। যেন আমরা শিখি এবং এ আমলে অভ্যস্ত হই।
আসুন সরাসরি কুরআন থেকে এর কিছু উদাহরণ দেখে নিই–
সূরা আ‘লা ও সূরা ওয়াকিআহ, যা আমরা অনেক বেশি পড়ে থাকি, শুনে থাকি। একটি ৩০ পারার সূরা আরেকটি ২৭ পারার ।
সূরা আ‘লা (৮৭)-এর আয়াত ১ থেকে ১০। আর সূরা ওয়াকিআহ (৫৬)-এর আয়াত ৫৮ থেকে ৭৪। একবার মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখুন– আয়াতগুলোতে কী বলা হয়েছে, কী চাওয়া হয়েছে। বোঝার সুবিধার্থে আমরা আয়াতগুলো তরজমাসহ এখানে উদ্ধৃত করছি। একটু সচকিত হলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন, আমাদের এ যাবৎকার বলা কথাগুলোর প্রতিফলন এখানে কোথায় ও কীভাবে। যিকিরের সঙ্গে ফিকির এবং ফিকিরের সঙ্গে যিকির– শব্দবন্ধ দুটো আবার স্মরণ করিয়ে দিলাম। কারণ এ আয়না দিয়েই তো দেখতে হবে। এটা মনে রেখেই সামনের আয়াতগুলো পড়তে হবে।
سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلَی،الَّذِیْ خَلَقَ فَسَوّٰی، وَالَّذِیْ قَدَّرَ فَهَدٰی، وَالَّذِیْۤ اَخْرَجَ الْمَرْعٰی، فَجَعَلَهٗ غُثَآءً اَحْوٰی، سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنْسٰۤی، اِلَّا مَا شَآءَ اللهُ اِنَّهٗ یَعْلَمُ الْجَهْرَ وَمَا یَخْفٰی، وَنُیَسِّرُكَ لِلْیُسْرٰی، فَذَكِّرْ اِنْ نَّفَعَتِ الذِّكْرٰی، سَیَذَّكَّرُ مَنْ یَّخْشٰی.
তোমার সমুচ্চ প্রতিপালকের তাসবীহ পাঠ কর, (তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা কর)। যিনি (সবকিছু) সৃষ্টি করেছেন ও সুগঠিত করেছেন। এবং যিনি (সবকিছুকে এক বিশেষ) পরিমিতি দিয়েছেন, তারপর পথ প্রদর্শন করেছেন এবং যিনি (ভূমি থেকে সবুজ) তৃণ উদ্গত করেছেন। তারপর তাকে কালো আবর্জনায় পরিণত করেছেন। (হে নবী!) আমি তোমাকে দিয়ে পাঠ করাব, ফলে তুমি ভুলবে না; আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া। নিশ্চয়ই তিনি প্রকাশ্য বিষয়াবলিও জানেন এবং গুপ্ত বিষয়াবলিও। আমি তোমার জন্য সহজ শরীয়ত (-এর অনুসরণ) সহজ করে দেব। সুতরাং তুমি উপদেশ দিতে থাক, যদি উপদেশ ফলপ্রসূ হয়। যার অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে, সে উপদেশ গ্রহণ করবে। –সূরা আ‘লা (৮৭) : ১-১০
এখানে দেখুন, কীভাবে আল্লাহর তাসবীহ পাঠের নির্দেশের সঙ্গে তাঁর সৃষ্টিকুশলতা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার প্রসঙ্গকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর কুদরত, তাঁর মারেফত– সকল বিষয়কে এক সুতোয় গাঁথা হয়েছে।
প্রথমে তাঁর তাসবীহ পাঠের নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে–
سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلَی.
[তোমার সমুচ্চ প্রতিপালকের তাসবীহ পাঠ কর।]
এর সঙ্গেই তাঁর কুদরত ও সৃষ্টিকুশলতার আলোচনা–
الَّذِیْ خَلَقَ فَسَوّٰی، وَ الَّذِیْ قَدَّرَ فَهَدٰی، وَ الَّذِیْۤ اَخْرَجَ الْمَرْعٰی، فَجَعَلَهٗ غُثَآءً اَحْوٰی...
[যিনি (সবকিছু) সৃষ্টি করেছেন ও সুগঠিত করেছেন। এবং যিনি (সবকিছুকে এক বিশেষ) পরিমিতি দিয়েছেন, তারপর পথ প্রদর্শন করেছেন এবং যিনি (ভূমি থেকে সবুজ) তৃণ উদ্গত করেছেন। তারপর তাকে কালো আবর্জনায় পরিণত করেছেন...]
এখানে আমরা পেলাম যিকিরের সঙ্গে ফিকির।
এরপর সূরা ওয়াকিআহ (৫৬)-এর আয়াত ৫৮ থেকে ৭৪ লক্ষ করুন– এখানে প্রথমে ফিকিরের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে এরপর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যিকিরের; অর্থাৎ ফিকিরের সঙ্গে যিকির। পড়ুন–
اَفَرَءَیْتُمْ مَّا تُمْنُوْنَ، ءَاَنْتُمْ تَخْلُقُوْنَهٗۤ اَمْ نَحْنُ الْخٰلِقُوْنَ، نَحْنُ قَدَّرْنَا بَیْنَكُمُ الْمَوْتَ وَمَا نَحْنُ بِمَسْبُوْقِیْنَ، عَلٰۤی اَنْ نُّبَدِّلَ اَمْثَالَكُمْ وَنُنْشِئَكُمْ فِیْ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ، وَ لَقَدْ عَلِمْتُمُ النَّشْاَةَ الْاُوْلٰی فَلَوْ لَا تَذَكَّرُوْنَ، اَفَرَءَیْتُمْ مَّا تَحْرُثُوْنَ،ءَاَنْتُمْ تَزْرَعُوْنَهٗۤ اَمْ نَحْنُ الزّٰرِعُوْنَ، لَوْ نَشَآءُ لَجَعَلْنٰهُ حُطَامًا فَظَلْتُمْ تَفَكَّهُوْنَ، اِنَّا لَمُغْرَمُوْنَ، بَلْ نَحْنُ مَحْرُوْمُوْنَ، اَفَرَءَیْتُمُ الْمَآءَ الَّذِیْ تَشْرَبُوْنَ، ءَاَنْتُمْ اَنْزَلْتُمُوْهُ مِنَ الْمُزْنِ اَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُوْنَ، لَوْ نَشَآءُ جَعَلْنٰهُ اُجَاجًا فَلَوْ لَا تَشْكُرُوْنَ، اَفَرَءَیْتُمُ النَّارَ الَّتِیْ تُوْرُوْنَ، ءَاَنْتُمْ اَنْشَاْتُمْ شَجَرَتَهَاۤ اَمْ نَحْنُ الْمُنْشِـُٔوْنَ، نَحْنُ جَعَلْنٰهَا تَذْكِرَةً وَّمَتَاعًا لِّلْمُقْوِیْنَ،فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِیْمِ.
আচ্ছা বল তো, তোমরা যে বীর্য স্খলন কর, তা কি তোমরা সৃষ্টি কর না আমিই তার স্রষ্টা? আমি তোমাদের মধ্যে মৃত্যুর ফয়সালা করে রেখেছি এবং এমন কেউ নেই, যে আমাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে— এ ব্যাপারে যে, আমি তোমাদের স্থলে তোমাদের মতো অন্য লোক আনয়ন করব এবং তোমাদেরকে এমন কোনো রূপ দান করব, যা তোমরা জান না। তোমরা তো তোমাদের প্রথম সৃজন সম্পর্কে অবগত আছ। তা সত্ত্বেও তোমরা কেন উপদেশ গ্রহণ কর না? তোমরা কি ভেবে দেখেছ, তোমরা জমিতে যা-কিছু বপন কর, তা কি তোমরা উদ্গত কর, না আমিই তার উদ্গতকারী? আমি ইচ্ছা করলে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে পারি, ফলে তোমরা হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে—যে, আমরা তো দায়গ্রস্ত হয়ে পড়লাম, বরং আমরা সম্পূর্ণ বঞ্চিত হলাম! আচ্ছা বল তো, এই যে পানি তোমরা পান কর—মেঘ থেকে তা কি তোমরা বর্ষণ করাও, না আমিই তার বর্ষণকারী? আমি ইচ্ছা করলে তা লবণাক্ত করে দিতে পারি। তবুও কি তোমরা শোকর আদায় করবে না? আচ্ছা বল তো, এই যে আগুন তোমরা জ্বালাও, তার বৃক্ষ কি তোমরা সৃষ্টি কর, না আমিই তার স্রষ্টা? আমিই তাকে বানিয়েছি উপদেশের উপকরণ এবং মরুচারীদের জন্য উপকারী বস্তু। সুতরাং (হে রাসূল!) তুমি তোমার মহান প্রতিপালকের নাম নিয়ে তাঁর তাসবীহ পাঠ কর। –সূরা ওয়াকিআহ (৫৬) : ৫৮-৭৪
একের পর এক তাঁর সৃষ্টি ও কুদরত নিয়ে আলোচনার পর উপসংহারে বলেছেন–
فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِیْمِ.
[তুমি তোমার মহান প্রতিপালকের নাম নিয়ে তাঁর তাসবীহ পাঠ কর, (তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা কর।)]
আয়াতগুলোর মর্ম ও শিক্ষা যদিও অনেক গভীর ও বিস্তৃত। আমরা আপাতত এই একটি বিষয় (যিকির ও ফিকির এবং ফিকির ও যিকির-এর বিষয়টি) দেখানোর জন্য আয়াতগুলো উদ্ধৃত করেছি। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও অন্তর্নিহিত শিক্ষাগুলোও আমরা নিজ উদ্যোগে এবং নিজের তাগিদে জেনে নিতে চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
অন্যদিকে সূরা রূম (৩০)-এ আয়াত ১৭ থেকে ২৭ পর্যন্ত আল্লাহর তাসবীহ পাঠের নির্দেশের পর তুলে ধরা হয়েছে তাঁর সৃষ্টির একেকটি অধ্যায়, তাঁর একেকটি নিআমতের কথা, তাঁর একেক রকম কুদরতের আলোচনা। এভাবে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে যিকির থেকে ফিকিরে ধাবিত হতে।
কিন্তু কেন? কারণ যিকির ও ফিকির যখন একত্রিত হয়, তখন অন্তর ঈমানের সকল ভাব ও অর্থময়তায় পরিপূর্ণ হয়ে আল্লাহর প্রতি ঝুঁকে পড়ে, আল্লাহর অভিমুখী রয়ে যায়। আর এটাই তো উদ্দেশ্য সকল আমল ও ইবাদতের।
আল্লাহর ভয় ও ভালবাসা, আল্লাহর কাছে আশা, আল্লাহর ওপর ভরসা, আল্লাহর নিআমতে সন্তুষ্টি এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাসে অবিচলতা, সর্বোপরি সবর ও শোকর, ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা– এগুলো এবং এ ছাড়াও ঈমানের যত শাখা ও যতরকম ঈমানী বৈশিষ্ট্য আছে, সবকিছুর জোয়ার শুরু হয় হৃদয়সমুদ্রে– যখন যিকির ও ফিকিরে একাকার হয়ে হৃদয় ও মস্তিষ্কসহ সমগ্র দেহসত্তা আল্লাহর অভিমুখী হয়। মুমিনের ঈমানী যিন্দেগীতে যার প্রভাব অসীম।
আসুন, আমাদের চোখের সামনে সর্বক্ষণ খুলে রাখা, মেলে ধরা কিতাবদুটি পড়ি। জাগ্রত হই, অভিমুখী থাকি।