ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ
‖ জায়নবাদী অভিশপ্ত কালো হাত রুখে দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়
গত ১৩ জুন (শুক্রবার) ২০২৫ তারিখে ভোরবেলা হঠাৎ করেই ইরানে হামলা করে বসে মধ্যপ্রাচ্যের দখলদার রাষ্ট্র ইসরাইল। হামলার প্রথম দিনই ইরানের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা এবং কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হন। প্রাণ হারায় বহু বেসমারিক মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই ইরানের পক্ষ থেকে ইসরাইলের ওপর পাল্টা আক্রমণ করা হয়। এর পর থেকে উভয় দেশ পরস্পরের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। দুই দিকেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। আজকে যখন এ কথাগুলো লেখা হচ্ছে, সেদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধে শামিল হয়ে গেছে। তারা ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় সরাসরি বোমা হামলা করেছে। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ইরান এর জবাব দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
জায়নবাদী দখলদার ইসরাইল যুগ যুগ থেকে নিরীহ ফিলিস্তীনবাসীর ওপর জুলুম-নির্যাতন করেই ক্ষান্ত থাকছে না; বরং পার্শ্ববর্তী দেশ সিরিয়া, জর্ডান ও লেবাননের বেশ কিছু অংশ ইতিমধ্যে গিলে নিয়েছে। এখন তারা হামলা করে বসল মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ ইরানেও। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ইরানই প্রকাশ্যে স্পষ্ট ভাষায় ইসরাইলের বিরোধিতা করে আসছিল। সেই ইরানের ওপরই হামলা চালিয়েছে তারা। তাদের অভিযোগটি হাস্যকর, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে। যদি তারা হামলা না করত, তাহলে ইরান এ অস্ত্র বানিয়ে ফেলত। অথচ খোদ ইসরাইলেরই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। জাতিসংঘের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যসহ আরও কয়েকটি দেশের কাছে রয়েছে এ মারণাস্ত্র। তাহলে ইরানকে কেন একা নিশানা বানানো হচ্ছে। সন্দেহ নেই, ইরান একটি শিয়াপ্রধান রাষ্ট্র। কিন্তু এখানে তো শিয়া-সুন্নির প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, জালেম ও মজলুমের। এছাড়া ইসরাইল ইরানে শিয়া দেশ হিসেবে আক্রমণ করেনি; মুসলিম দেশ হিসেবে আক্রমণ করেছে। সুতরাং বিশ্বের অন্যান্য শান্তিকামী মানুষের মতো মুসলিম জনগণের সমর্থন ও সহমর্মিতা ইরানের সাথে রয়েছে।
ইরান-ইসরাইলের বর্তমান যুদ্ধে ইরানের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা দুর্বলতার বিষয়টি স্পষ্টভাবে সামনে চলে এসেছে। মোসাদ ইরানের ভেতরে বসেই যেভাবে তাদের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে, তা ছিল অনেকটা নজিরবিহীন ঘটনা। ইরান হয়তো এসব নিয়ে এখন যথাযথ পরিকল্পনা করবে; কিন্তু এবারের ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে অবশ্যই বেশ কিছু ভালো প্রাপ্তি যুক্ত হয়েছে। যারা ভেবেছিল, ইসরাইল অপরাজেয় শক্তি, তাদেরকে কেউ কখনো টোকাও দিতে পারবে না। ইসরাইল ও তার দোসররা যেভাবে নিজ শক্তিমত্তার প্রচার দিয়ে আসছিল; তাতে এমন ভাব দেখানো হচ্ছিল, বাহির থেকে কোনোভাবেই ইসরাইলের ভেতরে আক্রমণ করা সম্ভব নয়। কোনো মিসাইল বা বোমা ইসরাইলের এলাকায় গেলেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তা অকার্যকর করে দেবে। কিন্তু বিশ্ববাসী অবাক হয়ে এ ক’দিনে ভিন্ন চিত্রই দেখেছে। তেল আবিবসহ ইসরাইলের বড় বড় শহরগুলোতে ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র পড়ছে এবং সেসব এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। সে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অনেকে গাজার প্রতিচ্ছবিও খুঁজে পেয়েছে। যুদ্ধ যে শুধু সামরিক শক্তির প্রাধান্যের নাম নয়; বরং সঠিক ইচ্ছাশক্তি ও সাহসের মাধ্যমে তুলনামূলক কম শক্তি নিয়েও শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া যায়– তার প্রমাণ দেখিয়েছে ইরানের সামরিক বাহিনী। সন্দেহ নেই, ইরান এখন ব্যাপক চাপে রয়েছে; বিশেষত এ যুদ্ধে আমেরিকা জড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে ইরানের ওপর মানসিক চাপ আরও বেড়েছে। দুদিন আগেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি এ যুদ্ধে জাড়াবেন কি না সে বিষয়ে আরও দুই সপ্তাহ চিন্তা করবেন। তিনি তেহরানের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু আজ বিশ্ববাসী দেখল, এ সবই ছিল ট্রাম্পের চালাকি। অর্থাৎ তিনিও ভয়ে ভয়েই ইরানের ওপর হামলার বিষয়টিকে গোপন রেখেছেন। একপ্রকার প্রতারণার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি শান্তি চান, তিনি হয়তো যুদ্ধে জড়াবেন না। অথচ তার মনে ছিল ভিন্ন কিছু। যা তিনি আজ করে দেখালেন। এ হামলার মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট বুশেরই পুনরাবৃত্তি করলেন। একই পন্থায় বুশও ইরাকের ওপর হামলা চালিয়েছিল, সাদ্দাম হুসেনের কাছে মারণাস্ত্র থাকার অজুহাতে। সে যুদ্ধে তারা সাদ্দামকে গ্রেফতার করে হত্যা করে এবং ইরাকে তাদের দোসরদের ক্ষমতায় বসায়। অথচ শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো অস্ত্র ইরাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কয়েক বছর পর আমেরিকা ও তার মিত্র ব্রিটেন প্রকাশ্যে স্বীকারও করে নিয়েছিল, আদতে ইরাকে এমন কোনো অস্ত্র ছিল না। এবারও একই পন্থায় যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর হামলা করল। অজুহাতও একই রকম, ইরানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে অথবা তারা বানানোর একেবারে কাছাকাছি পর্যায়ে চলে গেছে। তাই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছে তারা। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলার পর এক দিনের মতো অতিবাহিত হয়েছে, এখন পর্যন্ত সে অঞ্চলে কোনো তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যায়নি। তাহলে কি ইরানের দাবিই সঠিক ধরে নিতে হবে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসাত্মক ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। অন্যথায় ধরে নিতে হবে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে হামলা করলেও তাদের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করতে পারেননি। বরং এর আগেই ইরান গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়েছে।
সে যাই হোক, বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের হামলা চূড়ান্ত বিচারে আমেরিকার জন্য ক্ষতিই ডেকে আনবে। এবার নির্বাচনের পূর্বে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার অনেকগুলোই ইতিমধ্যে ভঙ্গ করেছেন বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। নির্বাচন পরবর্তী সময়ের অনেক সিদ্ধান্তেও তিনি শেষ পর্যন্ত অটল থাকতে পারেননি। ইরানের ওপর গায়ে পড়ে হামলা করতে এসে তিনি আমেরিকার স্বার্থবিরোধী কাজ করেছেন বলে অনেকে মনে করছে। তাহলে কি এটাই ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’? ট্রাম্প কি তাহলে দেশে দেশে বোমা হামলা করে আমেরিকাকে আবার গ্রেট বানাবেন? সেদিন সম্ভবত শেষ হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলো নীরব ভূমিকা পালন করলেও আঞ্চলিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থে ইরানের মিত্রের সংখ্যাও কম নয়। ইরানের হাতে হরমুজ প্রণালি নিয়ন্ত্রণের অস্ত্রও রয়েছে। এছাড়া ইরান থেকে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে হামলা করার মতো অবস্থা ইরানের না থাকলেও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের বিভন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে। এসবকেও কিছুটা অনিরাপদ করে তুললেন ট্রাম্প।
এ লেখা শেষ হওয়ার আগেই খবর এসেছে, ইরানী পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালি বন্ধের অনুমোদন দিয়েছে। এখন হয়তো আমেরিকার মিত্ররাই এ যুদ্ধ বন্ধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। মুখে যতই হাঁকডাক দিক, ব্যবসায়িক স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রও নিজের ও তার ব্যবসায়িক অংশীদারদেরকে অপূরণীয় ক্ষতি থেকে বাঁচাতে যুদ্ধ বন্ধের জন্য উঠেপড়ে লেগে যাবে এবং নিজেদের মান-সম্মান বিসর্জন দিয়ে হলেও কোনো পথ বের করবে।
সবচেয়ে বড় কথা হল, আমেরিকার হামলার দ্বারা ইসরাইলের দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। ইসরাইল যত বড় বুলিই আওড়াক– সে যে ইরানের প্রথম দিনের হামলাতেই কিছুটা কাবু হয়ে পড়েছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল নেতানিয়াহু কর্তৃক আমেরিকা এবং অন্যান্য মিত্রদের কাছে সাহায্য চাওয়া দেখে। হয়তোবা ইসরাইলের পরিণতি আরও খারাপ হতে পারে মনে করে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইরানে বোমারু বিমান পাঠিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুদ্ধ কোন্ দিকে মোড় নেয় আরও কিছু দিন পর বোঝা যাবে। তবে ইসরাইল এবং তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র যে পৃথিবীতে আবার নতুন করে অশান্তির সূত্রপাত করেছে, তা তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।
ইরানের ওপর ইসরাইল কর্তৃক অতর্কিত হামলার পর বাস্তবসম্মত কোনো প্রতিক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে দেখা যায়নি। শুধু মৌখিক নিন্দা জানানো পর্যন্তই শেষ। অনেকে তো সেটিও করেনি। জাতিসংঘও মুখে মুখে বক্তৃতা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। আর ওআইসিভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর কথা বলে লাভ কী? তুর্কিতে একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হলেও কার্যকর কোনো কিছু তারা করছে বলে শোনা যায়নি। আসলে দেশে দেশে মুসলিম নেতাদের যে অবস্থা, ক্ষমতার লিপ্সা তাদেরকে যেভাবে ভীতু করে তুলেছে, শেষ পর্যন্ত তাদের পরিণতি কোন্ দিকে গড়াবে, তা তো অনুমান করতে খুব বেশি অসুবিধা হয় না।
এখানে একটি কথা স্পষ্ট থাকা দরকার, ইরানের প্রতি এ সহমর্মিতার অর্থ কোনোক্রমেই শিয়া মতবাদের প্রতি নম্রতা দেখানো বা শিয়া-সুন্নি ঐক্য জাতীয় কিছুই নয়; বরং এটি এজন্য যে, মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুশমনরা এখন ইরানের ওপর সরাসরি বড় আক্রমণ করে বসেছে। ফিলিস্তিনের বাইরে একমাত্র ইরানই কম হোক বেশি হোক ইসরাইলের ওপর মিসাইল ছোঁড়ার সাহস দেখিয়েছে। এ কাজ যদি রাশিয়া বা চীন করত, তখনো তাদের প্রতি সাধারণ মুসলমানদের সহানুভূতি থাকত।