‘ভাষার মাস’ 
 ভাষার অপব্যবহার বন্ধ হোক
            
            
        ভাষা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। তা শুধু মনের ভাব প্রকাশেরই উপায় নয়, চিন্তা-ভাবনা, জ্ঞান-বিদ্যা, আদর্শ-মতাদর্শ ইত্যাদি বিস্তারেরও গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, গোষ্ঠী থেকে গোষ্ঠী, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই সব কিছু স্থানান্তরিত হয় ভাষার মাধ্যমে। ভাষার গুরুত্ব তাই অপরিসীম।
মানবসমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যত বিকাশ ঘটছে ভাষার ব্যবহারও ততই বাড়ছে। শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞানের নয়, নানাবিধ মতবাদ-মতাদর্শের উৎপত্তি ও বিকাশের সাথে সাথে সেইসব ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহারও বেড়ে চলেছে। এই ব্যবহার যে সবসময় সুস্থ-সুন্দর সুখকর হয়ে থাকে এমন নয়। ভাষাকে ব্যবহার করা হয় নানা অসুস্থ চিন্তা ও মতবাদের বিস্তারের উপায় হিসেবেও।
বর্তমান সময়ের একটি ভয়াবহ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভাষার চানক্যপূর্ণ ব্যবহার। এর ভয়াবহতা বোঝার জন্য শুধু বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পণ্যের বিজ্ঞাপনের দিকে নজর দেয়াই যথেষ্ট হতে পারে। দেশের প্রধান ও ব্যস্ত সড়কগুলোর দুই ধারে স্থাপিত বিজ্ঞাপনগুলোর দিকে তাকালে যে কেউ উপলব্ধি করবেন যে, এগুলো শুধু পণ্যের বিজ্ঞাপনই নয়, মতাদর্শেরও বিজ্ঞাপন। পশ্চিমের ভোগবাদী জীবন-দর্শন ও রিপুপরায়ণতার উন্মুক্ত দৃষ্টান্ত এই সব বিজ্ঞাপন।
ব্যাপক বিস্তারের ফলে এসব বিজ্ঞাপন তার সকল বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও যেন অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। সাধারণত এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য হয় না। কিন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন কারণে খাবার, রিফ্রেশমেন্ট (পানীয় ও আইসক্রিম) ও প্রসাধন সামগ্রী বাজারজাতকারী একটি বহুজাতিক কোম্পানি আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের সাথে যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হওয়া কোম্পানিটি খেলাধুলা, শিল্প-বিনোদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতার সুবাদে দেশের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত অপসংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। এ বিষয়ে সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা দরকার। বিশেষত, রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর এ বিষয়ে দায়িত্বশীল হওয়া খুবই প্রয়োজন। সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে যারা আছেন তারাও আল্লাহর বান্দা। কিয়ামতের ময়দানে তাদেরকেও আল্লাহ তাআলার সামনে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। সমাজের মানুষের জাগতিক উন্নতি-অগ্রগতি সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যেমন তাদের উপর ন্যস্ত, তেমনি ঈমান-আমল, ইসলামী আদব-আখলাকের বিস্তারেও তারা দায়িত্বশীল। কাজেই দেশে কাজ করা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দ্বারা যে অপসংস্কৃতির বিস্তার ঘটছে তা রোধের দায় সবার আগে তাদের উপর বর্তায়। সম্প্রতি উপরোক্ত কোম্পানিটির টুথপেস্ট ব্রান্ড ক্লোজআপের একটি বিজ্ঞাপন সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যে কেউ সাধারণভাবে চিন্তা করলেও বুঝবেন যে, মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শুধু পণ্য বিপণনই নয়, পশ্চিমা মতাদর্শ ও ভোগবাদী উচ্ছৃঙ্খল জীবনধারা প্রবর্তন ও প্রচারেও বড় ভূমিকা রাখছে। আলোচ্য কোম্পানিটির সংশ্লিষ্টতার ক্ষেত্রগুলো লক্ষ্য করলেও বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।
ইউনিলিভার বাংলাদেশ ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল, মহিলা ক্রিকেট দল এবং অনুর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট দলের সাথে ২০১৮-২০ সাল পর্যন্ত মূল পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছিল। (দ্যা ডেইলি স্টার, ০৬-০৯-২০১৮)
২০০৫ সাল থেকে ‘ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ শিরোনামে এনটিভিতে প্রচারিত হতে থাকে দেশের অন্যতম বৃহৎ টেলিভিশন অনুষ্ঠান। এর দ্বিতীয় আসর ২০০৬ সালে, তৃতীয় আসর ২০০৮ সালে ও সর্বশেষ আসর ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত হয়।
এরকমই আরেকটি অনুষ্ঠান লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার। গোটা দেশের সাত বিভাগে রিজিওনাল অডিশনের মাধ্যমে এই জঘন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয় এবং টিভি স্ক্রীনে বিপুলসংখ্যক দর্শকের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময় জুড়ে চলতে থাকে।
আর তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমানে দেশী কোম্পানিগুলোর অনেকেও হাঁটছে একই পথে। ঘটাচ্ছে বেহায়াপনার সয়লাব।
এভাবে শিল্প-সংস্কৃতির ছদ্মাবরণে ও নানা চটকদার শিরোনামে গোটা দেশে পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির যে আগ্রাসন পরিচালিত হচ্ছে এ বিষয়ে সব শ্রেণির সচেতন হওয়া কর্তব্য।
ভবিষ্যত প্রজন্মের ঈমান-আকীদা, চরিত্র ও নৈতিকতা, সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থা রক্ষার ব্যাপারে সর্বশ্রেণির মুসলিমকে স্ব স্ব পরিমণ্ডলে পদক্ষেপ নিতে হবে। শিশু-কিশোর-তরুণ-যুবক সকল শ্রেণির মাঝে কুরআনের আলো বিস্তারের পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি।
একইসাথে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সর্বগ্রাসী প্রভাবকে ব্যবহার করে মুসলিম-সমাজের বিশ্বাস ও নৈতিকতা বিনষ্টের যে ভয়াবহ তৎপরতাসমূহ পরিচালিত হচ্ছে সে ব্যাপারে দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে শক্ত ও সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ জাতীয় যে কোনো সৎ উদ্যোগকে জাতি আন্তরিকভাবেই স্বাগত জানাবে।
ভাষার মাসে ভাষার প্রতি সবধরনের অবিচার বন্ধ হোক। ভাষা হয়ে উঠুক সত্য-সুন্দরের বিস্তারের বাহন। আমাদের মাতৃভাষা সমৃদ্ধ ও সমুজ্জ্বল হয়ে উঠুক ঈমান ও বিশ্বাস শ্বাএবং বিশ্বাস শ্ব সৎকর্ম ও সচ্চরিত্রের বার্তাবাহী জ্যোতির্ময় সাহিত্য সম্ভারে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন। হ