মুহাম্মাদ নাজমুল হক - হাটহাজারী মাদরাসা

প্রশ্ন

আমি শরহে বেকায়া জামাতের ছাত্র। ইতিহাস তেমন কিছু জানি না। বিশেষকরে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, ভারতবর্ষে মুসিলম শাসনের সূচনা ও সমাপ্তির ইতিহাস, বৃটিশ শাসন এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাস, বৃটিশ বেনিয়া কর্তৃক মুসলমানদের শোষণ ও নিপীড়ন ইত্যাদি বিষয়ে জানার জন্য নির্ভরযোগ্য বাংলা ও উর্দূ গ্রন্থগুলোর নাম জানতে চাই।

উত্তর

উত্তর : ভারত উপমহাদেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নিয়ে কিতাব তেমন একটা রচিত হয়নি। যা কিছু হয়েছে তন্মধ্যে আলীগড় থেকে প্রকাশিত মৌলভী যাকা উল্লাহ দেহলভীর তারীখে হিন্দুস্তান’-এর কথা প্রথমে বলা যায়। সমকালীন এক ইতিহাস লেখকের ভাষায়-এটি উর্দূ ভাষায় ভারতের ইতিহাসের উপর সর্বাধিক বিস্তৃত গ্রন্থ। ফার্সী ভাষায় লিখিত প্রায় সকল ইতিহাস-গ্রন্থের সারনির্যাস এতে এসে গেছে। উপরন্তু ইংরেজি মাসাদির থেকেও সাহায্য নেওয়া হয়েছে। দশ খণ্ড মোট নয়টি ভলিউমে প্রকাশিত হয়েছে। ভারতে আরবদের আগমনগজনভী ও ঘোরী যুগ থেকে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহর যুগ পর্যন্ত সময়ের ঘটনাবলি এতে সন্নিবেশিত হয়েছে।’ (ছরওয়াত ওলত মিল্লাতে ইসলামিয়া কী মুখতাছার তারীখ ২/৫৪৪)

এছাড়া আরো কিছু কিতাব রয়েছে। যেমন-১. তারীখে ফেরেশতামুহাম্মাদ কাসেম ফেরেশতা রাহ.। ফার্সী ভাষায় রচিত এই কিতাবটি হিন্দুস্তানের ইতিহাসের একটি মৌলিক ও নির্ভরযোগ্য কিতাব। যা উর্দূতে অনুদিত হয়ে চার খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এই কিতাবে মাহমুদ গজনভী থেকে আকবর পর্যন্ত গোটা হিন্দুস্তানের ইতিহাস রয়েছে।

২. তারীখে ফায়রুয শাহীজিয়াউদ্দীন বরনী। মূল কিতাব ফার্সীতেউর্দূতে এর অনুবাদ হয়েছে। এই কিতাবে বলবানের যুগ থেকে ফায়রুয শাহ তুঘলক এর শাসনের প্রথম যুগের ইতিহাস সংকলিত হয়েছে।

৩. মুনতাখুবত তাওয়ারীখআবদুল কাদের বদীওয়ানী। মাহমুদ গজনভী থেকে আকবর পর্যন্ত যুগের ইতিহাস। মূল কিতাব ফার্সীতে। উর্দূতে অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।

৪. মুনতাখাবুল লুবাবখানী খান। ফার্সী থেকে উর্দূতে অনুবাদ হয়ে চার খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। বাবর থেকে মাহমুদ শাহর যুগের ইতিহাস।

৫.আইনায়ে হাকীকতনুমাআকবর শাহ খান নজীবাবাদী। শুরু থেকে তুঘলকের শাসনামলের শেষ পর্যন্তের ইতিহাস। কিতাবটি এই কারণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেএখানে অমুসলিম ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন প্রপাগাণ্ডার বিস্তৃত ও প্রামাণিক খণ্ডন রয়েছে।

৬. সালাতীনে হিন্দমুফতী ইনতিজাম উল্লাহ শিহাবী। শুরু থেকে সুলতান বাহাদুর শাহ পর্যন্ত হিন্দুস্তানের সুলতানদের নিয়ে। উর্দূতে রচিত এই কিতাবের দুই খণ্ড মূলত তারীখে মিল্লাত’ নামক সিলসিলার শেষ অংশযা তিনি এবং কাযী যাইনুল আবিদীন মিরাঠী রাহ. কর্তৃক লিখিত হয়েছে।

এতো গেল পুরো উপমহাদেশের ইতিহাস নিয়ে রচিত পূর্ণাঙ্গ কিছু গ্রন্থ। এছাড়া বিশেষ যুগ ও শাসনামল যেমনঘোরী,মোঘলমুসলিম ও বৃটিশ যুগ নিয়ে আলাদা আলাদা কিছু গ্রন্থও রয়েছে। যেমন- মাওলানা রিয়াসত আলী নদভী লিখিত আহদে ইসলামী কা হিন্দুস্তান। এছাড়া দারুল মুসান্নিফীন আজমগড় থেকে প্রকাশিত সাবাহ উদ্দীন আবদুর রহমানের বযমে মামলুকিয়াবযমে তায়মুরিয়াবযমে সুফিয়া ও আহদে মুঘলিয়া গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ

তাছাড়া বিভিন্ন যুগের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রচুর কিতাব রয়েছে। এক্ষেত্রে শায়খ মুহাম্মদ ইকরামের তিনটি কিতাব আবে কাওসাররোদে কাওসার ও মওজে কাওসার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

লাহোরের পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাকশিত তারীখে আদাবিয়াতে মুসলমানানে পাক ও হিন্দ-পাঁচটি খণ্ডও অনেক পরিশ্রম করে তৈরি করা হয়েছে।

হযরত মাওলানা হাকীম আবদুল হাই রাহ.-এর আস সাক্বাফাতুল ইসলামিয়া ফিল হিন্দ’ এবং তাঁর সুযোগ্য সন্তান হযরত মাওলানা আলী মিয়া নদভীর আলমুসলিমুনা ফিল হিন্দও প্রত্যেকের পড়ার মতো কিতাব।

বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ-সেনাপতি ও তাদের রাজ্যশাসনের উপর আলাদা আলাদা গ্রন্থ রচিত হয়েছে। বাদশাহ আওরঙ্গজেব,শহীদ টিপু সুলতান ও বাদশাহ আকবরসহ এই ধরনের মনীষীদের উপর স্বতন্ত্র গ্রন্থও কম রচিত হয়নি। এগুলোও মূলত ইতিহাসের একটি অংশ।

তদ্রূপ বড় বড় ফকীহমুজাদ্দিদ ও মুহাদ্দিসের খেদমত ও তাজদীদী কারনামা সম্পর্কে অনেক কিতাব লেখা হয়েছে। এঁদের মধ্যে মুজাদ্দিদে আলফে সানীশাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীসাইয়েদ আহমদ শহীদ ও কাসেম নানুতুবী রাহ.সহ অন্যান্য আকাবিরে দেওবন্দ উল্লেখযোগ্য। হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. তারীখে  দাওয়াত ওয়া আযীমত দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড। সীরাতে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ এবং মাওলানা মানযুর নুমানী রাহ.-এর তাযকিরায়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানী’ প্রত্যেকের পড়ার মতো কিতাব।

এক বিষয়ের মনীষীদের জীবনীর উপর তাবাকাত’ শ্রেণীর কিতাব যেমন ফুকাহায়ে হিন্দ’, ‘আওলিয়ায়ে হিন্দ’ ও আতিব্বায়ে আহদে মুঘলিয়া’ কিংবা এর কাছাকাছি বিষয়ে যেমন হিন্দুস্তান কী কদীম ইসলামী দরসগাহেঁ ইত্যাদি কিতাবও এই তালিকায় আসতে পারে।

সবশেষে হযরত আলী মিয়া নদভী রাহ.-এর আব্বাজান মাওলানা হাকীম আবদুল হাই রাহ.-আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের উচ্চাসনে সমাসীন করুন- যে বিশাল কারনামা’ আঞ্জাম দিয়েছেন তাতো এক কথায় বেনজীর

তেরশ বছরে হিন্দুস্তানের রাজা-বাদশাহআলিম-ফকীহচিকিৎসকপ্রকৌশলীকবি-সাহিত্যিক মোটকথা সর্বশ্রেণীর বড় বড় প্রায় সকল মনীষীর জীবনীমূলক একটি বিশাল এনসাইক্লোপিডিয়া (বিশ্বকোষ) তিনি পৃথিবীবাসীকে উপহার দিয়েছেন।নুযহাতুল খাওয়াতির’ নামক এই অনন্য কিতাবটি বড় বড় আটটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।

আক্ষরিক অর্থে ইতিহাস না হওয়া সত্ত্বেও আপনার প্রশ্নের উত্তরে সীরাত-রিজাল-আলামসহ বিভিন্ন বিষয়ের কিতাবাদির আলোচনা কয়েকটি কারণে করেছি। প্রথমত: এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেশাব্দিক অর্থে না হলেও এগুলোও ইতিহাসেরই এক একটি অংশ। দ্বিতীয়ত: সঠিক ইতিহাস জানা-পড়ার জন্য শুধু এক ধরনের কিতাবাদি কিংবা নির্দিষ্ট কারো তথ্য নিয়ে যাতে বসে থাকতে না হয়। চাইলেই অন্যান্য বিভিন্ন কিতাব থেকেও এই ইতিহাস ও তথ্য সংগ্রহ করা যায়।

উপমহাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় নিয়ে বর্তমান বেশ চমৎকার ও প্রশংসনীয় কাজ করে যাচ্ছেন ভারতের মাওলানা নূরুল হাসান রাশেদ কান্ধলভী। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত ত্রৈমাসিক আহওয়াল ও আসার’-এর প্রতি সংখ্যাতেই গবেষণাধর্মী বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। আগ্রহীরা এই পত্রিকাটির গ্রাহক হয়ে এই বিষয়ে বেশ উপকৃত হতে পারেন।

উপমহাদেশের ইতিহাস নিয়ে স্বতন্ত্র ও ধারাবাহিক ইতিহাস গ্রন্থ কম হলেও এই বিষয়ের মাওয়াদ’ কিন্তু কম নয়। বিক্ষিপ্তভাবে যা বিভিন্ন কিতাবপত্রশিলালিপিসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক সূত্রগুলোতে ছড়িয়ে রয়েছে। এখন যে কাজটি করতে বড় কোনো লাজনার এগিয়ে আসা দারকার তা হলশুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়ের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সম্পর্কিত সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা যাচই-বাছাই করে ইতিহাস লিখনীর মানদণ্ডে উত্তীর্ণ বস'নিষ্ঠ একটি কালজয়ী বিশ্বকোষ তৈরি করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের কোনো জামাতকে এ কাজের জন্য কবুল করে নিন। আমীন।

শেয়ার লিংক

মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ - নোয়াখালি

প্রশ্ন

তারীখে মিল্লাত (খিলাফাতে রাশেদা) ও তারীখে মিল্লাত (খিলাফাতে বনী উমাইয়া) কিতাব দুটি দরসে নিজামীতে আছে। উভয় কিতাবের   মুসান্নিফ মাওলানা যাইনুল আবেদীন মিরাঠী। কিন্তু অনেক খুঁজেও তার জীবনী পাইনি। হযরতের নিকট আকুল আবেদন এই যে, তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী উৎসসহ জানাবেন। এতে আমরা অনেকে উপকৃত হব। ইনশাআল্লাহ। 

উত্তর

হযরত মাওলানা কাযী যাইনুল আবেদীন মিরাঠী রাহ. (১৩২৮ হি.-১৪১১হি.) আনুমানিক ১৩২৮ হিজরীতে মিরাঠের ঐতিহ্যবাহী কাযী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মিরাঠের দারুল উলূম মাদরাসা ও ইমদাদুল ইসলাম মাদরাসায় তার পড়াশোনা। ১৩৪৫ হিজরীতে দারুল উলূম দেওবন্দে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। তিনি আল্লামা কাশ্মিরী রাহ. ও হযরত মাদানী রাহ. উভয়ের কাছ থেকে ইলমে হাদীস অর্জন করেন। ১৩৫৭ হিজরীতে যখন দিল্লীতে নদওয়াতুল মুসান্নিফীন’ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তিনিও সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এখানে অবস্থানকালীন তিনি তারীখে মিল্লাতের প্রথম তিনটি খণ্ড যথাক্রমে নবীয়ে আরবীখিলাফতে রাশেদা ও খিলাফতে বনী উমাইয়া রচনা করেন। এ কিতাবগুলো ভালো ও সহজ। কিন্তু এর বেশ কিছু জায়গায় নযরে সানীর প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়াও তাঁর রচনাবলির মধ্যে বয়ানুল লিসান (আরবী-উর্দূ অভিধান) কামূসুল কুরআনআখলাকে নববী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ১৩৮২ হিজরীতে তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের মজলিসে শুরার সদস্য নির্বাচিত হন।

১৪১১ হিজরীর ১৪ রমযানুল মুবারক মোতাবেক ৩১ মার্চ ১৯৯১ ঈ. তাঁর ইন্তিকাল হয়। ভারত-পাকিস্তানের সমসাময়িক দ্বীনী পত্রপত্রিকায় তাঁর জীবনী পাওয়া যাওয়ার কথা। উপরে উল্লেখিত তথ্যগুলো মাহনামা দারুল উলূম’ এর ওয়াফায়াত নম্বর১৩৩-১৩৪ পৃ. থেকে নেওয়া হয়েছে।

শেয়ার লিংক