সফর ১৪৪৫   ||   সেপ্টেম্বর ২০২৩

নির্মম নিষ্ঠুরতা : ইসলামের পথেই সমাধান

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

স্বার্থপর ও জুলুমবাজির এই দুনিয়ায় যতই দিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে, শিষ্টের দমন দুষ্টের লালন বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি চোখ বন্ধ করে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো বদ্ধ ঘরে থাকা যেত! আশপাশের খবর না আসত। পেপার-পত্রিকা, গণমাধ্যমের সাথে যদি যোগাযোগ না থাকত, তাহলে মনে হয় অনেক কিছু থেকে বেঁচে যাওয়া যেত। এমন এমন খবর শুনতে হয়, দেখতে হয়, যেগুলো শুনলে, দেখলে শরীর-মন বিবশ হয়ে যেতে চায়। জুলুমবাজি ও স্বার্থপরতা বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, যেসমস্ত অন্যায়-অবিচার মানুষ একসময় কল্পনা করেনি, সভ্য সমাজ চিন্তা করেনি, ইসলামে তো প্রশ্নই আসে না- সেগুলো এখন অহরহ ঘটছে। স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, পিতা-মাতার হাতে সন্তান খুন- এসবও এখন দেখতে হচ্ছে। এধরনের ঘটনা এখন মাঝে মাঝেই ঘটছে। তাই মনে হয়েছে এ বিষয় নিয়ে আলকাউসারের পাঠকদের সঙ্গে কিছু কথা আলোচনা করি।

মাসখানেক বা তারও কিছু সময় আগের নিউজ। এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে খাদ্যের সাথে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলার পাঁয়তারা করতে গিয়ে স্ত্রীর সাথে ঔরসজাত শিশুসন্তানকেও মেরে ফেলেছে। এধরনের কর্মকাণ্ড কতটা পৈশাচিক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সবাই এটা বোঝেন। এগুলো যে বড় ধরনের অপরাধমূলক কাজ, তা কেউ অস্বীকার করবে বলে মনে হয় না। আর ইসলামে তো বলা হয়েছে, একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার অর্থ হল, পুরো মানবজাতিকে হত্যা করা। কুরআন কারীমে বলা হয়েছে-

مَنْ قَتَلَ نَفْسًۢا بِغَیْرِ نَفْسٍ اَوْ فَسَادٍ فِی الْاَرْضِ فَکَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِیْعًا.

কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয়- তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। -সূরা মায়েদা (৫) : ৩২

আল্লাহ তাআলার কথার মর্ম পর্যন্ত পৌঁছার চেষ্টা করা দরকার, একজন মানুষকে হত্যা করলে পুরো মানবসমাজ কী করে খুন হয়? একজন মানুষ যদি সত্যিকার অর্থে মানুষ হয়, বিনা কারণে অর্থাৎ শরীয়ত নির্দেশিত কারণ ছাড়া অন্য কোনো কারণে হত্যার চিন্তাও সে করতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

فَکَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِیْعًا.

(তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল।)

সেটা সাধারণ হত্যাকাণ্ড। কিন্তু স্বামীর জন্য স্ত্রী, স্ত্রীর জন্য স্বামী সবচেয়ে বিশ্বস্ত। এরা পরস্পরের সব গোপন বিষয় সম্পর্কে অবহিত। তারা একে অন্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে বিষয়টা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! নিজের ঔরসজাত সন্তান, যার জন্য পিতা-মাতা সবকিছু, আবার পিতা-মাতার জন্যও সন্তান সবকিছু। প্রসিদ্ধ আছে, বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ সবচেয়ে ভারী। আসলে একটি সন্তান মারা গেলে পিতা-মাতার কতটুকু কষ্ট হয়- বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সেখানে যদি এমন হয়, একজন স্বামী তার স্ত্রী-সন্তানকে মারার পাঁয়তারা করছে- তাহলে বর্বরতার আর বাকি থাকল কী? তাই মনে চায়, এসব খবর চোখে না পড়ুক। কিন্তু অন্ধ হলেই তো আর প্রলয় বন্ধ থাকে না।

সমাজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে? কেন এসব খবর বারবার আমাদের দেখতে হচ্ছে? মুসলমানদের মধ্যে দেখতে হচ্ছে! মুসলিম দেশগুলোতে দেখতে হচ্ছে! কেন দেখতে হচ্ছে এসব হত্যাকাণ্ডের খবর? দেখতে হচ্ছে অহরহ বিচ্ছেদের খবর! দেখতে হচ্ছে পিতা-মাতা কর্তৃক সন্তান ত্যাজ্য করার খবর। সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে আসার খবর। ইসলাম তো এগুলো শেখায় না। ইসলাম তো এর বিপরীতগুলো শেখায়; ইসলাম তো বন্ধনের কথা শেখায়। শুধু পারিবারিক বন্ধন নয়, সামাজিক বন্ধন, রাষ্ট্রীয় বন্ধন, মিলেমিশে থাকার সবকিছু ইসলাম শেখায়। মুসলমান পরিচয় ধারণ করেও আমরা হারিয়ে যাচ্ছি। নিজেদের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি করছি। আপনজনেরা একে অপরকে সহ্য করতে পারছি না। কেন এমন হচ্ছে?

এসব বিষয় তো বড় বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক সত্য। যে কোনো হৃদয়বান মানুষ শুনলেই ব্যথিত হয়; কিন্তু এই ব্যথা-বেদনা কিছুদিন পরে আমরা ভুলে যাই। জীবনের তালে অন্যান্য কাজে আটকে যাই। আবার আরেকটা ঘটনা ঘটে।

আমাদের বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা, দীর্ঘসূত্রতা, গরীবের বিচার পাওয়া নিয়ে জটিলতা এবং সনাতনী পদ্ধতি- এসবের দরুন অপরাধীদের অপরাধ করার সাহস বাড়ে। তারা বিভিন্নভাবে ছাড় পেয়ে যায়। এদেশে হত্যার দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা রাষ্ট্রপতির বিশেষ করুণায় খালাস পেয়ে যাচ্ছে। এজন্য আসলে বিষয়গুলো গোড়া থেকে ভাবা দরকার। সমাজপতি, সমাজচিন্তক, সমাজের কল্যাণকামী, সমাজ নিয়ে যাদের কিছু করার সুযোগ আছে; সর্বোপরি ইমাম, খতীব ও উলামায়ে কেরাম, লেখক, আলোচক- সকলের ভাবনার বিষয়। এর প্রতিকার নিয়ে চিন্তার প্রয়োজন। এগুলো কেন ঘটছে- খতিয়ে দেখা এবং এসব বিষয় নিয়ে কাজ করা- অন্য সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে হয়। এসব ঘটনার পেছনের কারণগুলো দেখা। সেগুলো প্রতিকারের চেষ্টা করা। মানুষের মাঝে মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করা। মানবিক মূল্যবোধের মূল জায়গাটিই হল, তার দ্বীন-ধর্ম-ইসলাম-আল্লাহভীতি-তাকওয়া। এই মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে না পারলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন কথা বলেন। তারা মানুষের স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, বিচ্ছিন্নতাবোধকে এসব ঘটনার পেছনের কারণ হিসেবে দায়ী করেন। সন্দেহ নেই, এসব কিছু এর ভেতরে আছে। কিন্তু স্বার্থপরতা বা লোভ-লালসা মানুষের মাঝে এমনি এমনি জাগ্রত হয় না। হাদীস শরীফে দেখতে পাই, মানুষের মাঝে দুধরনের প্রবণতা কাজ করে। একটা তাকে সৎ কাজে উদ্বুদ্ধ করে, আরেকটা তাকে হিংস্র জীব-জন্তুর মতো আচরণে উদ্বুদ্ধ করে।

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:إن للشَّيطانِ لَلَمَّةً بابنِ آدمَ، ولِلْمَلك لَمَّةٌ، فأمَّا لمَّةُ الشَّيطانِ فإيعادٌ بالشَّرِّ وتَكْذيبٌ بالحقِّ، وأمَّا لَمَّةُ الملَكِ فإيعادٌ بالخيرِ وتصديقٌ بالحقِّ. فمَن وجدَ ذلِكَ فليعلم أنَّهُ منَ اللهِ، فليحمَدِ اللهَ، ومن وجدَ الأخرى فليتعوَّذ منَ الشَّيطانِ. ثمَّ قرأَ : اَلشَّیْطٰنُ یَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَ یَاْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَآءِ، وَ اللهُ یَعِدُكُمْ مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَ فَضْلًا الآيةَ

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আদম সন্তানের প্রতি শয়তানের এক স্পর্শ রয়েছে এবং ফেরেশতারও এক স্পর্শ রয়েছে। শয়তানের স্পর্শ হচ্ছে, সত্য অস্বীকার ও মন্দ কাজের প্ররোচনাদান। ফেরেশতার স্পর্শ হচ্ছে, কল্যাণের কাজে উৎসাহিত করা এবং সত্যকে স্বীকার করার প্রেরণাদান। কাজেই যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে এমন নেকীর স্পর্শ অনুভব করে সে যেন বোঝে, এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে। সে যেন আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করে। কেউ নিজের মধ্যে এর বিপরীত স্পর্শ উপলব্ধি করলে সে যেন শয়তান থেকে আল্লাহ তাআলার নিকট আশ্রয় চায়। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন-

اَلشَّیْطٰنُ یَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَ یَاْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَآءِ، وَ اللهُ یَعِدُكُمْ مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَ فَضْلًا.

[শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেয়। আর আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তাঁর ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। -সূরা বাকারা (২) : ২৬৮] -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯৮৮

বনী আদমের দায়িত্ব হল, যেটা তাকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে সেদিকে ধাবিত হওয়া। কিন্তু জানা কথা, কোনো ব্যক্তি হঠাৎ করেই সেদিকে উদ্বুদ্ধ হয় না। তার চারপাশের পরিবেশ যখন এমন হয়- যা তাকে লোভ-লালসার হাতছানি দিতে থাকে। ধর্ম-কর্ম, স্রষ্টার ভয়, তাঁর বিধি-বিধান মানার বালাই তার মধ্যে এবং তার পরিবার ও পরিবেশের মধ্যে না থাকলে হঠাৎ করেই ওই জিনিস আসে না। উল্টো ধীরে ধীরে পরিবেশ সমাজ তাকে স্বার্থপরতার দিকে নিয়ে যায়। সে তখন ভাবতে থাকে- কীভাবে বেশি কিছু লাভ করা যায়। তার মধ্যে সম্পদের লোভ ঢুকে যায়। প্রবৃত্তি তাকে আকর্ষণ করে। এ তো আমরা আত্মিক দিকটি বললাম। চারদিকে পুঁজিবাদী সমাজ। মানুষকে লোভ-লালসায় ফেলতে যত ধরনের উপকরণ আছে, সব সামনে মেলে ধরা আছে। যে কারণে অনেকে লোভ-লালসা থেকে নিজেকে ফেরাতে পারে না। নিজের লোভ চরিতার্থ করতে জঘন্য থেকে জঘন্য কাজ করতে দ্বিধা করে না।

এছাড়া আরেকটা বড় বিষয় হল, মানুষের প্রবৃত্তি। এই যে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কলহ সৃষ্টি হয়, একে অন্যকে নির্যাতন করে; এমনকি হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। নিজেদের কলহের কারণে নিজের ঔরসজাত সন্তানকেও হত্যা করে ফেলছে। সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা মায়ের কোল। শোনা যায়, মা-ও সন্তানকে হত্যা করে ফেলছে। ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছে। এসব কেন হচ্ছে? এসবের কারণ হচ্ছে কুপ্রবৃত্তি। কুপ্রবৃত্তি তাকে তাড়িত করছে। কেউ বলতে পারেন, কুপ্রবৃত্তির জন্য ঘরে ঘরে ওয়াজ করে দিলেই তো হয়। আসলে কথাটা এমন নয়। শুধুই ওয়াজে হয়ে যায় না। আমরা দেখি, কুরআনে এভাবে আসেনি-

حَرَّمَ اللهُ الزِّنَى.

আল্লাহ তাআলা যিনাকে হারাম করেছেন।

বরং আল্লাহ বলেছেন-

وَ لَا تَقْرَبُوا الزِّنٰۤی.

তোমরা যিনার কাছেও যেয়ো না। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩২

এর মতলব কী? এর মতলব হল, এজাতীয় কুকর্মে জড়িয়ে পড়ার যতগুলো রাস্তা আছে, সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। সে রাস্তাগুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। সে রাস্তাগুলো হল, অবাধ মেলামেশা, পর্দাহীনতা। পর্দা তো দূরের কথা- খোদ স্বামীরা স্ত্রীদেরকে খোলামেলা বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিশতে দিচ্ছে। যাদের সঙ্গে পর্দা করা দরকার তাদের সঙ্গে মিশতে দিচ্ছে। ঘরের মধ্যে যাচ্ছেতাই পোশাক পরলেও বাইরে যাওয়ার সময় সাজগোজ দিয়ে এমনকি পার্লার থেকে সাজিয়ে বের করছে। এভাবে কোনো বেগানা পুরুষ তার স্ত্রীর বলি হচ্ছে। স্ত্রীও কারও বলি হচ্ছে। আবার তারই স্বামীর হাতে বলি হচ্ছে হয়তো অন্য কারও স্ত্রী।

ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়ে আমরা  এ আয়োজনগুলো করছি। একসময় নিজের অজান্তেই স্বার্থপরতার দিকে চলে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে বাড়তে বাড়তে একজন নারী কুপ্রবৃত্তির টানে স্বামী-সন্তানের স্বার্থ না দেখে পরকীয়ায় জড়িয়ে ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। একজন পুরুষ স্ত্রী-সন্তানের কথা না ভেবে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। এই যে ইসলাম যে জিনিসগুলোকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতে বলেছে, যেগুলো থেকে দূরে থাকতে বলেছে, যে বিধি-বিধানগুলো দিয়েছে, চোখ অবনত রাখার কথা বলেছে, কারও ঘরে যাওয়ার আগে অনুমতি নেওয়ার কথা বলেছে, পর্দা করার কথা বলেছে- সেগুলো তো আমরা করছিই না; বরং আমরা জঘন্যভাবে এগুলোর খেলাফ সকল রাস্তা খুলে দিয়েছি। আগে কেউ টিভি অথবা সিনেমা দেখলে ভয়ে ভয়ে চুপিসারে দেখত। এখন হাতে হাতে আমরা সিনেমা দিয়ে দিচ্ছি। আবার এসব দুর্ঘটনার জন্য আফসোস করছি। আসলে নিজেদের উপর আফসোস করা দরকার। আমরাই এসব ব্যবস্থা সমাজের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। ফলে এগুলো হওয়াই তো স্বাভাবিক। এইসব জুলুম-নির্যাতনের রাস্তা খুলে দিয়ে আমরা আফসোস করছি।

সুতরাং মানুষকে আবার মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। মানুষের কুপ্রবৃত্তি দমন করার জন্য গোড়ায় হাত দিতে হবে। মানুষকে স্রষ্টার কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। স্রষ্টার নির্দেশনা মানা, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার দিকে নিতে হবে। তার মধ্যে তাকওয়া দিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

পশ্চিমারা যেসব বিষয় ঘটিয়ে এখন কুড়ে কুড়ে মরছে। তাদের চিন্তাবিদেরা এখন ভেবে ভেবে শেষ। মোবাইল ফোনের আবিষ্কারক এখন আফসোস করে করে শেষ যে, কেন এটা আবিষ্কার করেছেন! তিনি বলছেন, এগুলোর জন্য তো আমি মোবাইল আবিষ্কার করিনি। তাদের সমাজচিন্তকেরা ভাবছেন- কী ঘটে গেল আমাদের! আমরা কোথা থেকে কোথায় গেছি! না আমাদের সমাজ আছে, না বিবাহ-শাদী আছে। আমাদের সন্তানাদি স্বাধীন হয়ে গেছে।

এখন ডাক্তার-ওষুধ-বড়ি বেড়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। মানুষ এখন বেশি দিন বাঁচে বলে হিসাব করে। যত বেশি দিন বেঁচে থাকছে ততই জীবন অভিশপ্ত হচ্ছে। উন্নত রাষ্ট্রে আত্মহত্যার হার বাড়ছে। জাপানে আত্মহত্যার অনুশীলন হয়। আত্মহত্যার আগে জঙ্গলে কিছুদিন থাকে। এসব কেন হচ্ছে? কীসের অভাব তাদের? কেন তারা এমন করছে? তারা তো দারিদ্র্যের কারণে এমন করছে না। তাদের অবস্থা তো আর এদেশের মতো না যে, পাঁচ শ টাকা সরকার দিয়েছে আর মেম্বার তিন শ টাকা মেরে দিয়েছে। সেখানে কেন এগুলো হচ্ছে? তাদের ওখানে তো অভাবের কারণে এসব হচ্ছে না।

একজন বৃদ্ধ মরে যেতে চাচ্ছে- তার বড় কারণটা বুঝতে হবে। সে এই বয়সে যা চায়- তার পরিবার ও সমাজ তাকে সেটা দিচ্ছে না। এ বয়সে তার আপনজনের সাথে সময় কাটানোর কথা। তার স্রষ্টার সাথে সময় কাটানোর কথা। আল্লাহ থেকে তো তারা আরও আগেই দূরে সরে গেছে। আপনজনও কাছে নেই। তারাই তো আইন করেছে ২১ বছর হলে সন্তানাদি স্বাধীন হয়ে যায়। সন্তানাদি নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। দুজনে তিনজনে কামাই করেও তাদের পেট চলে না। তাদের আরও দরকার। তাদের পার্থিব প্রয়োজন, সঙ্গী-সঙ্গীনি নিয়ে ব্যস্ততা, মুরব্বিদের সময় দেওয়ার সময় কোথায়? তাই বৃদ্ধ মানুষটি কুড়ে কুড়ে মরে বৃদ্ধাশ্রম বা নার্সিং হোমগুলোতে। নিজের জীবনাবসনের অপেক্ষায় থাকে তারা। এগুলো তো তাদের একান্ত বিষয় ছিল।

বলছিলাম, এসব পৈশাচিকতা ও নির্মমতার পেছনের কারণগুলো দেখতে হবে। কী কারণে মা-বাবারা, অন্য ভাষায় স্বামী-স্ত্রীরা এত স্বার্থপর হয়ে উঠছে যে, একে অন্যকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এমনকি নিজেদের সন্তানদেরকে নিজেদের স্বার্থে শেষ করে দিচ্ছে; না হয় তাদেরকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বয়স হওয়ার পর সন্তানদেরকে রেখে মায়েরা চলে যাচ্ছে। বাবারা এক সংসার ছেড়ে আরেকজনের সাথে চলে যাচ্ছে। মায়েরা পালাচ্ছে। কেন এত স্বার্থপর হয়ে উঠছে?

মানবিকতা টিকিয়ে রাখার জন্য যে স্বার্থপরতা কমাতে হয়- সে শিক্ষাটা কে দেবে? আমাদেরকে সে শিক্ষার কাছে যেতে হবে। কিন্তু আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। আমাদের এখানে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষিত সমাজের এক শ্রেণি, এমনকি এখনকার গণমাধ্যমগুলোর কেউ কেউ ব্যাপকভাবে সেই বৈদেশিক সংস্কৃতি, যা তাদেরকে ধ্বংস করেছে, সেগুলো এখানে প্রচার করছে। এটা তো এখন ব্যাপক বিষয়। সম্প্রতি বহুল প্রচারিত একটি দৈনিকে এক ভদ্র মহিলার লেখা উপসম্পাদকীয় নজরে পড়ল। এই মহিলা আগেও এ পত্রিকায় লিখে থাকবেন। শিরোনাম ছিল, ‘ঢাকায় ৪০ মিনিটে ১টি তালাক : এত বিবাহবিচ্ছেদের কারণ কী।দেখে মনে হল, তিনি হয়তো ইতিবাচক কিছু বলবেন যে, বিচ্ছেদ হওয়া উচিত নয়, আমাদের ধৈর্য ধরা উচিত, প্রতিকার করা উচিত, পরস্পরে সমঝোতায় আসা উচিত। ভেতরে পড়ার পর দেখলাম, আঁৎকে ওঠার মতো বিষয়। তিনি এগুলোকে উৎসাহিত করছেন। তিনি ভোগবাদকে মজবুত করে উপস্থাপন করছেন। জানি না- ওই পত্রিকার সম্পাদকীয়র দিকগুলো কে দেখে। যা হোক, ঐ লেখার ইনসেটে এ বাক্যগুলো দেওয়া হয়েছে-

সন্তান ও সমাজের কথা ভেবে অসুখী ও অসম বিয়ে টিকিয়ে রেখে জীবন পার করলে তাতে সমাজ জেতে ঠিকই, হেরে যায় মানবতা। জীবন খুব ছোট। পূর্ণতা ও তৃপ্তির সঙ্গে মৃত্যুবরণ প্রতিটি মানুষেরই অধিকার। দুজন মানুষ যখন একসঙ্গে যাত্রা শুরু করেন, নৈতিক মানুষমাত্রই প্রত্যাশা করেন, তাঁরা একসঙ্গে একই গন্তব্যে পৌঁছাবেন। কিন্তু যাত্রাপথে যদি দুজনের গন্তব্য আলাদা হয়ে যায়, সভ্য সমাজ তাঁদের সেই সিদ্ধান্তকে দুঃখজনক মনে করলেও সম্মান করে।

এটা পড়ার পর পাঠককে আর বুঝিয়ে বলতে হয় না- তারা আসলে কী চায়? জনগণের তো জানার অধিকার আছে, এটা ওই পত্রিকারই নীতি কি না? তারা কি চায় ওসব বিষয় এদেশেও চালু হোক? তাহলে তো তাদের আর নারী নির্যাতন, পুরুষ নির্যাতন, শিশুদের এ্যাবিউজের খবর ছাপার প্রয়োজন নেই। কারণ তারাই তো ভোগবাদে উৎসাহিত করার মাধ্যমে এসবের প্রসার ঘটাচ্ছে।

লেখিকা জনগণের টাকায় পরিচালিত একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। এখন কানাডায় পিএইচডি গবেষণারত। কানাডা গিয়েই কি উনার গায়ে এত জোরে হাওয়া লেগে গেছে যে, ওসব দেশের কালচার এখানে প্রচার করতে চাচ্ছেন! একজন নারী হয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হয়ে কী করে এমন কথা বলতে পারেন, ‘সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে কি নিজের জীবন উপভোগ করবেন না।একথা ভেবেই অবাক লাগছে। এগুলো যদি প্রচার করা হয়, এসময়ের ছেলেমেয়েদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, মানবিকতা তাদের মধ্যে জাগ্রত করার চেষ্টা না করা হয়, তাহলে তো আমরা ফলাফল আরও খারাপ দেখব।

একই পত্রিকায় আরেকটি কলাম দেখলাম বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে। সেখানেও বৃদ্ধাশ্রমকে উৎসাহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে মানুষের অনীহার কারণ-টারণ লিখে বৃদ্ধাশ্রমের খুব তারিফ করেছেন। সেখানে লিখেছেন, ‘বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে বৃদ্ধরা নবজীবন পায়। সেখানে পরস্পরে সময় কাটাতে পারে।

বৃদ্ধাশ্রমে গেলে লেখক আসলে বুঝতে পারতেন- বৃদ্ধাশ্রম কী! উচিত ছিল এই লেখকের আগে বৃদ্ধাশ্রমে কিছুদিন কাটিয়ে আসা। আমরা তো দেখেছি, বৃদ্ধাশ্রমে কিছু দিন যারা থাকেন, তারা নিজেদের দুঃখ-কষ্টের কথা বলেন। নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের কাছে না পাওয়ার কষ্টের কথা শোনান। ওই বয়সে শুধু টাকার বিনিময়ে সেবা চান না। তাদের মন বলেও কিছু আছে। মনের চাওয়াটা তারা সেখানে পান না। আমাদের মতো ৯১% মুসলমানের দেশে বৃদ্ধাশ্রমকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, অথচ কুরআনে সবচেয়ে বড় গুনাহ শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য বলা হয়েছে; তার পরই বলা হয়েছে- মা-বাবার সাথে এহসানের আচরণ করো। এভাবে একাধিকবার এসেছে। এখানে আয়াতটি প্রাসঙ্গিক। এর আগেও আলকাউসারে বলা হয়েছে। সূরা বনী ইসরাঈলে বৃদ্ধ বয়সের কথা বলা হয়েছে। এখনকার বৃদ্ধাশ্রমের লোকদের কথাই বলা হয়েছে সে আয়াতের মধ্যে-

وَقَضٰی رَبُّکَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ  اِیَّاهُ وَ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا اِمَّا یَبْلُغَنَّ عِنْدَکَ الْکِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ  اَوْ کِلٰهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَاۤ  اُفٍّ وَّلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَّهُمَا قَوْلًا کَرِیْمًا،  وَ اخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَۃِ  وَقُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا کَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا.

তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনো একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ্পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ২৩

এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, তারা যদি তোমার কাছে বৃদ্ধ হয়ে যায়, তাকে তোমরা উফ্শব্দটিও বলবে না। কষ্টদায়ক কিছু বলবে না। তাহলে কি যুবক বয়সী মা-বাবাকে উফ্বলার সুযোগ আছে? বিষয়টা এমন নয়। আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য হল, বয়স হয়ে গেলে মানুষের মেযাজ বিগড়াতে পারে। একটু খিটখিটে হতে পারে। তিনি এমন আচরণ করতে পারেন, যা কিছুটা বিরক্তিকর লাগতে পারে। সে ক্ষেত্রেও তাদের সাথে সদাচারের প্রতি কুরআন মাজীদে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আর আমরা বয়োজ্যেষ্ঠদের বৃদ্ধাশ্রমে ঠেলে দিচ্ছি। মানুষের মাঝে প্রচার করা হচ্ছে, বৃদ্ধাশ্রমের পক্ষের গল্প। পুঁজিবাদ ও বিদেশী সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ আমাদেরকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!?

আমাদের পেছনের কারণগুলো বের করতে হবে। আর না হয় এ ধরনের নির্যাতন, অমানবিকতা, পৈশাচিকতা বাড়বে বৈ কমবে না।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসলামের শেকড় ধরার তাওফীক দান করুন। অপসংস্কৃতির কারণে অন্য যাদের সমাজ ধ্বংস হয়েছে তার মধ্যে আমাদেরকে না ফেলুন। আমাদের দেশে যারা এসব প্রচার করছে আল্লাহ তাদের হেদায়েত দান করুন। সঠিক কথা প্রচার করার তাওফীক দান করুন। এটাই আজকের নিবেদন

رفعتوں کی جستجو میں ٹھوکریں تو کھا چکے + آستان یار پر اب سر جھکا کر دیکھئے

উন্নতির সন্ধানে অনেক ঠোকরই তুমি খেয়েছ/বন্ধুর আস্তানায় এখন মাথা ঝুঁকিয়ে দেখ। 

 

 

advertisement