সফর ১৪৪৫   ||   সেপ্টেম্বর ২০২৩

ফিরে আসার গল্প
একটি মূল্যবান সফর

শামসুদ্দীন

[সাবেক কাদিয়ানী ভাই শামসুদ্দীন সাহেব। কাদিয়ানীদের বর্তমান দলনেতা মির্যা মাসরুরের  রেযায়ী ভাতিজা (দুধ-ভাতিজা)। তার সাথেই ঘটে যাওয়া আযাদ কাশ্মীরের একটি ঘটনা- এ নিবন্ধের প্রতিপাদ্য।

অনুবাদ করেছেন : মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ। ]

 

১৪ই রবিউল আউয়াল ১৪২৬হিজরী। মুহাম্মাদ মাকসুদ সাহেব আমাকে খতমে নবুওত সংক্রান্ত একটি কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য কাশ্মীরে দাওয়াত করলেন। যখন আমি কাশ্মীর পৌঁছলাম, সেখানের লোকজন আমার বেশ খাতির-যত্ন করল। মনে হল যেন, নিজ বাড়িতেই আছি। একপর্যায়ে আমরা সেখানকার তাহাফ্ফুযে খতমে নবুওত সংক্রান্ত নানা কারগুজারি শোনা শুরু করলাম। কথা প্রসঙ্গে তাদের একজন বলল, আযাদ কাশ্মীরের এক জায়গায় কাদিয়ানী মুরব্বীদের সাথে সাধারণ কাদিয়ানীদের পরস্পরের মধ্যে একটা বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে।

আমি তাদের কাছে দরখাস্ত করলাম, আপনারা যদি আমাকে একটু সেখানে যাওয়ার পথ বাতলে দিতেন! সেই কাদিয়ানীদের সাথে মুলাকাতের ব্যবস্থা করে দিতেন!!

তারা বলল, সে তো অনেক দূরের পথ। জারাহি থেকে বাসে যেতে লাগবে কমপক্ষে ৪/৫ ঘণ্টা। তাছাড়া একদম পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হবে। কিন্তু এরপরও মাকসুদ সাহেব আমাকে সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।

সেখানে পৌঁছে প্রায় ৬০ জন কাদিয়ানীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তারাও আমাকে পেয়ে খুব খুশি। আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম, আপনাদের নাকি কাদিয়ানী মুরব্বীদের সঙ্গে কী বিষয়ে মতানৈক্য চলছে?

তারা বলতে লাগল, আগে আমরা মির্যা সাহেবকে মাসীহে মাওউদ আর ইমাম মাহদী জানতাম। আমাদের বাপ-দাদারাও আমাদেরকে এমনটাই শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু তিন সপ্তাহ আগের ঘটনা। জুমার সময় মির্যা মাসরুরের খুতবা শুনছিলাম। তিনি বললেন, ‘মির্যা গোলাম আহমদ নিজেকে নবী বলেছেন।এর পরই এখানকার কাদিয়ানী মুরব্বীদের সাথে আমাদের মতানৈক্য হয়ে যায়। তারা বলে, মির্যা মাসরুর যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন। তখন আমরা বললাম, আমরা তো তাকে নবী মানি না।

এরপর আমি তাদেরকে বললাম, মির্যা কাদিয়ানী শুধু নবী নয়, নিজেকে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেও দাবি করেছে। (নাউযুবিল্লাহ) কাদিয়ানীরা আরও বলে, ‘আমার সত্তা হুবহু তাঁরই (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর) সত্তা।’ -কালিমাতুল ফছল, (মির্যাপুত্র বশির আহমাদ এম এ কৃত) পৃ. ১৪

সেখানের বাসিন্দারা ততক্ষণে ইস্তেগফার পড়া শুরু করে দিল। মির্যা গোলাম আহমদকে চরম মিথ্যুকবলে গালাগাল করতে লাগল। এরপর আমি তাদের সামনে মির্যা কাদিয়ানীর বই থেকেই নবুওত দাবি সংক্রান্ত তার পরস্পর বিরোধী কয়েকটি কথা তুলে ধরলাম। পাঠকের সুবিধার্থে কিছু এখানেও তুলে দিচ্ছি।

নবুওত দাবি অস্বীকারের কিছু উদ্ধৃতি

কুরআনুল কারীম খাতামুন নাবিয়্যীনের পরে কোনো রাসূলের আগমনকে জায়েয রাখেনি। চাই নতুন রাসূল হোক বা পুরোনো। -ইযালাতুল আওহাম, রূহানী খাযায়েন (মির্যা কাদিয়ানীর রচনা সমগ্র) খ. ৩, পৃ. ৫১১

হাদীসে যে এসেছে- ‘আমার পর কোনো নবী আসবে না। এখানে নাব্যাপকতার অর্থে। (অর্থাৎ কোনো ধরনের নবীই আসবে না। -আইয়ামুস সুলহ, রূহানী খাযায়েন, খ. ১৪, পৃ. ৩৯৩

আমি নবুওতের দাবিদার নই...

আমাদের সরদার শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর কেউ যদি নবুওত বা রিসালাতের দাবি করে আমি তাকে কাফের মনে করি। -মাজমুআয়ে ইশতেহারাত (মির্যা কাদিয়ানীর প্রচারপত্র) খ. ১, পৃ. ২১৪ (নতুন সংস্করণ)

এ বক্তব্যগুলো দেখলে বোঝা যায়, তিনি নিজে নবুওত দাবি করেননি, বরং অস্বীকার করছেন। আসলে এগুলো মির্যা কাদিয়ানীর নবুওত দাবির আগের বক্তব্য। তিনি মূলত নবুওত দাবি করেছেন ১৯০১ সালে।

এবার নবুওত দাবির কিছু উদ্ধৃতি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

নবুওত দাবি সংক্রান্ত কয়েকটি বক্তব্য

আমার দাবি হল, আমি নবী এবং রাসূল। -মালফুযাত (মির্যা কাদিয়ানীর বাণী সংকলন) খ. ৫, পৃ. ৪৪৭ (নতুন সংস্করণ)

প্রকৃত সত্য খোদা তিনিই, যিনি কাদিয়ানে তাঁর রাসূল পাঠিয়েছেন। -দাফিউল বালা, রূহানি খাযায়েন, খ. ১৮, পৃ. ২৩১

যেভাবে ফেরাউনের কাছে রাসূল পাঠানো হয়েছিল, সেই একই শব্দে আমার কাছেও ইলহাম আসে যে, তুমিও একজন রাসূল। -মালফুযাত, খ. ৫, পৃ. ১৭ (নতুন সংস্করণ)

উভয় বক্তব্যের মধ্যে তুলনা-

মির্যা সাহেব নিজেই নবুওত দাবিদারের ওপর লানত করেছে আবার নিজেই নবুওত দাবি করেছে- এটা স্পষ্ট স্ববিরোধিতা। আর স্ববিরোধী বক্তব্য সম্পর্কে সে নিজেই লিখেছে- যার বক্তব্যের মাঝে স্পষ্ট স্ববিরোধিতা পাওয়া যায় তার অবস্থা এক নির্বোধ ব্যক্তির মতো।” -হাকীকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন, খ. ২২, পৃ. ১৯১

মির্যা কাদিয়ানী অন্যত্র আবার লিখেছে- এক অন্তর থেকে দুটি বিপরীতমুখী কথা বের হতে পারে না। কেননা এর মাধ্যমে হয় মানুষকে পাগল বলা হয় অথবা মুনাফিক। -সাত বচন, রূহানী খাযায়েন, খ. ১০, পৃ. ১৪৩

এ সবকিছু যখন এখানকার কাদিয়ানী লোকেরা মির্যা কাদিয়ানীর বই থেকে নিজেরাই পড়ে দেখল তখন সকলে বলতে লাগল, মির্যা সাহেব তো নবুওতের দাবি করে নিজেই নিজের ওপর লানত করল! এরপর তারা সবাই সাচ্চা দিলে তওবা করে মুসলমান হয়ে গেল। তারা প্রতিজ্ঞা করল, নিজেদের পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততিকেও সঠিক পথ দেখাবে। সঠিক দ্বীন শেখাবে।

এরপর আমাকে অনুরোধ করে বলল, আপনি আমাদের এখানে একটা মসজিদ নির্মাণ করে দিন। এর কিছুদিন পর জারাহিথেকে খতমে নবুওতের মুবাল্লিগ সাথী ভাইয়েরা গেলেন এবং তাদের সহায়তায় একটি মসজিদ নির্মাণ হল। নাম রাখা হল, মসজিদে খাতামুন নাবিয়্যীন। সাথীদের অনুরোধে আমি অধম এর ভিত্তি-প্রস্তর রাখি। আলহামদু লিল্লাহ। 

 

 

advertisement