মুহাররম ১৪৪৫   ||   আগস্ট ২০২৩

রাষ্ট্র যেখানে দায়িত্বহীন
পাঁচ কোটি নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস এবং ইসলামে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখনো এদেশে আইডি কার্ডের কাজ শুরু হয়নি। একদিন একটি নম্বর থেকে বার বার ফোন আসছিল। মনে হচ্ছিল, কোনো অফিসিয়াল নম্বর। ফোনটি ওঠাতেই অপর প্রান্ত থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে উঠল। তিনি কুশল বিনিময় করতে চাইলেন। একটু বিরক্তি লাগল। কারণ তখন কাজের সময় ছিল। তখনকার কোনো একটা উদীয়মান ব্যাংক থেকে তিনি ফোন করেছেন। মিনতি করে বললেন তার ব্যাংকে একাউন্ট খোলার জন্য।

খুব অবাক হলাম। তিনি আমার নম্বর কোত্থেকে পেলেন! মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলেও সবিনয়ে এড়িয়ে গেলেন। নম্বর তো বেশি লোককে দেওয়া হত না। খুব কম মানুষের সাথেই ফোনে যোগাযোগ হত। এরপর আমি খোঁজ করতে থাকি, কোথায় কীভাবে নম্বর গিয়ে থাকতে পারে? দেশের একটি বহুজাতিক ব্যাংকে আমার একাউন্ট ছিল। কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই সেই ব্যাংকের অফিসারকে গিয়ে বললাম, আপনারা আমাদের নম্বর বাইরে দিয়ে দেন! নাহলে অন্য ব্যাংক থেকে আমাদেরকে ফোন করে কীভাবে? আপনাদের লোকেরা আমাদের নম্বর বাইরে দেয়?

তাঁর সুর নরম। তিনি কাউকে বকাঝকা করছেন। বলছেন, কিছু দুষ্ট লোক আছে, তারা এ কাজ করে।

বুঝলাম, তারা বিষয়টি অবগত। তাদের কোনো মাধ্যমেই এ কাজটি ঘটে। সেই থেকে বুঝে উঠেছি, যেসব ব্যক্তিগত তথ্য বিভিন্ন জায়গায় যায়, সেগুলো পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এরপর দেশের সচেতন নাগরিকেরা আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন যখন জনগণের আঙুলের ছাপ ও আইডি কার্ড মোবাইল কোম্পানিগুলোর হাতে দিয়ে দেওয়া হল। তখন অনেকেই বলেছিলেন, এটা নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত ঝঁুকিপূর্ণ। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের নিরাপত্তার নামে এটাই করা হয়েছে। যখন জাতীয় পরিচয়পত্র করা হয় তখনই দেশের অভিজ্ঞ মহলে অনেকেই বুঝতে পেরেছেন, আমাদের মতো দেশের সরকারের কর্তাব্যক্তি ও লোকজনের রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের ব্যাপারে যতটুকু দায়বদ্ধতা, বাস্তবে দেখা যায় তাতে এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সুরক্ষিত থাকার বিষয়ে কিছুতেই নিশ্চিত থাকা যায় না। বরং যেকোনো সময় অবহেলা, কাজের ত্রুটি অথবা অর্থের বিনিময়ে নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ এ তথ্যগুলো বেহাত হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে এবং হয়েও যাচ্ছে।

একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই যেখানে রাষ্ট্রের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা করতে পারে না; বরং একাউন্ট থেকে চুরি হয়ে যায়, সেখানে সাধারণ নাগরিকদের তথ্য-উপাত্তের নিরাপত্তার বেহাল দশা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

সচেতন মহলের এই আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তাগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রেই বাস্তবে দেখা গিয়েছে। কিন্তু এ যাবৎকালের সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপারটি ঘটেছে গত ২৭ জুন ২০২৩-এ। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সেদিন বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি লোকের ব্যক্তিগত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সরকারের একটি ওয়েবসাইট থেকে ফাঁস হওয়া সেসব তথ্যের মধ্যে ছিল, পূর্ণাঙ্গ নাম, ফোন নম্বর, ইমেইল আইডি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরের মতো বিষয়গুলো। শুধু এনআইডির হিসাব ধরা হলে পাঁচ কোটি অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা। কারণ, এনআইডি তো কেবল ১৮ বছরের ঊর্ধ্বের লোকেরা পায়। সম্ভবত তা এখনো ১০ কোটিতে পৌঁছায়নি। একটি রাষ্ট্রের অর্ধেকেরও বেশি (এনআইডির হিসেবে) নাগরিকের তথ্য ফাঁসের পরেও দায়িত্বশীল কারও কোনো মাথাব্যথা দেখা যাচ্ছে না। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকা ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানটি যখন প্রথম এ বিষয়টি দেখতে পায় তখন তার সিকিউরিটি কন্সালটেন্ট ভিক্টর বাংলাদেশী কতৃর্পক্ষের সাথে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন। ভিক্টর বলেছেন, তিনি ২৮ জুন, , , ৫ ও ৭ জুলাই তারিখেও বাংলাদেশী কতৃর্পক্ষের কাছে ইমেইল করেছিলেন। কিন্তু কেউ সাড়া দেননি। এরপর বিষয়টি যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হয়ে যায় এবং সেখান থেকে দেশীয় সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে তখন সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবং আরও দুয়েকটি সংস্থা দায়সারা গোছের দু-চারটি কথা বলেন।

এ পর্যন্ত যা জানা গেছে, তাতে বলা হচ্ছে, এটি কোনো সাইবার সিকিউরিটি হামলা নয়; বরং সরকারের সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটের চরম দুর্বলতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটির কারণেই ঘটেছে। অর্থাৎ যে ওয়েবসাইটটিতে নাগরিকদের মূল্যবান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্যাদি সংরক্ষণ করা হয়েছে, সেটির নিরাপত্তার জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এ বেহাল দশা দেশের একটি সেক্টরের নয়; বরং ভুক্তভোগী মহলমাত্রই জানেন, অন্যান্য অনেক সেক্টরের অবস্থাও এর চেয়ে কম ভঙ্গুর নয়।

প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে, বিগত এক দশকেরও বেশি সময় থেকে দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ ও ই-গভর্নমেন্টের হাঁকডাক চলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের মাঠবক্তা প্রতিমন্ত্রী পলক তো রাস্তায় রাস্তায় যুবক-যুবতীদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নেতা-নেত্রীই বানিয়ে ফেলেছেন তাঁর বক্তৃতাগুলোতে। বলে যাচ্ছেন, আগামী শিল্পবিপ্লবের (ডিজিটাল) নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ। এখন তো আবার শোনা যাচ্ছে, স্মার্ট বাংলাদেশের কথা। অর্থাৎ তাদের দৃষ্টিতে ডিজিটাল বাংলাদেশ তো পূর্ণাঙ্গতা পেয়েই গেছে এখন সেটি স্মার্ট হবে। যদিও ওবায়দুল কাদের সাহেব স্মার্ট বাংলাদেশ প্রথম উচ্চারণ করতে গিয়ে মঞ্চশুদ্ধ ভেঙে পড়ার পর এ নিয়ে মাতামাতি একটু কমে এসেছিল। তবুও আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্মার্ট বাংলাদেশের আওয়াজ আবার বড় হচ্ছিল। এরইমধ্যে তথ্য ফাঁসের এই ঘটনা সামনে এল। যা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে ডিজিটাল, স্মার্ট, -গভর্নমেন্ট সবই ফাঁকা বুলি; নাগরিকদের হয়রানি ও অনিরাপত্তার রাষ্ট্রীয় আয়োজনমাত্র। ই-গভর্নমেন্টের আওতায় আসা বিভিন্ন সেবা নিতে যাওয়া এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সেগুলো সংশোধন করতে যাওয়া (যদিও সে ভুল হয়ে থাকে সরকারি লোকদের গাফলতিতেই) ব্যক্তিরাই জানেন, এখনো এসব ক্ষেত্রে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়।

বিশাল ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের এই বিতর্কের মধ্যে আজ (১৩ জুলাই ২০২৩) একটি জাতীয় পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয় কলামের শিরোনাম করেছে, দায় স্বীকার নয় দায় নিতে হবে। সেখানে একপর্যায়ে বলা হয়েছে, ইসি ও প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য বুঝতে অসুবিধা হয় না, নাগরিকের মূল্যবান তথ্য সুরক্ষার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে কতটা তাৎপর্যহীন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, নিয়মিত ই-মেইল চেক করা এবং তার জবাব দেওয়া যে একটি দায়িত্ব ও নিয়মিত কাজের অংশ, সে বিবেচনা বোধটিই এত দিনে গড়ে ওঠেনি।... বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও প্রাইভেসি নিয়ে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইনের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করার এবং ভিন্ন মত দমনের নানা ঘটনা ঘটছে।... অথচ ডিজিটাল পরিসরে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার মূল প্রশ্নটি উপেক্ষা করে আসা হচ্ছে।

কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে, নাগরিকদের তথ্যাবলি ও তাদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত চিহ্নাবলি (ফিঙ্গারপ্রিন্ট, আই স্ক্রিন ইত্যাদি) যে সরকার নিয়েছে ও নিচ্ছে তা কি আসলেই নাগরিক সেবা সহজিকরণ ও বাড়ানোর স্বার্থে, নাকি শুধুই সরকারের নিজের স্বার্থে? ডিজিটাল বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে তো দ্বিতীয়টিই মনে হয়। কারণ, তিনি যদিও বলেছেন, দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। তার সাথে এও বলেছেন, ফাঁস হওয়া তথ্য জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, ব্যক্তিপর্যায়ের সাইবার অপরাধ হতে পারে। অর্থাৎ তাদের কাছে ব্যক্তি ছাড়াই জাতি হয়ে যায়। ব্যক্তির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সরকারের স্বার্থটাই মুখ্য হিসেবে বিবেচ্য হয়। এমনিতেই ইন্টারনেটের  ছড়াছড়ির এই সময়ে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন অনেকটা হুমকির মধ্যে পড়েছে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করাটা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। অন্যদিকে অর্থ লেনদেনের বিভিন্ন সেক্টর স্বয়ংক্রিয় পন্থায় আসার পর থেকে ডিজিটাল আর্থিক জালিয়াতির হারও বেড়ে চলছে ব্যাপকভাবে। সেখানে যদি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের কাছেই গণমানুষের তথ্যগুলো অনিরাপদ হয়ে যায়, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়?

আমাদের মতো রাষ্ট্র, যেখানে জান, মাল, ইজ্জত কোনো কিছুই সে অর্থে নিরাপদ নয়। এই তো কদিন আগেও পত্রিকায় হিসাব বের হয়েছে, ঢাকা শহরের ৩৮৮ জন নাগরিক প্রতি একজন ডাকাত রয়েছে। এছাড়া চুরি, হামলা, মামলা, গুম এবং একশ্রেণির নেতা ও পাতি নেতা কতৃর্ক জনগণের ইজ্জত-আব্রু ও জান-মালের অনিরাপত্তার বিষয়টি তো গোপনীয় কিছু নয়; সেখানে যদি অর্ধেকের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্যাবলিও সরকারি মহল তাদের গাফলতিতে ফাঁস করে দেয়, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়?

সেখান থেকেই প্রশ্ন দাঁড়ায়, আসলে এসব তথ্য নাগরিকদের স্বার্থের জন্য নেওয়া হয়, নাকি নিজেদের ক্ষমতা সুদৃঢ় করা এবং নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল হিসেবে নেওয়া ও সংরক্ষণ করা হয়। যেখানে একটি দেশের আইসিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলে দেন, তথ্য ফাঁস হয়েছে ওয়েবসাইটের দুর্বলতায়, সেখানে নাগরিকদের ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার জন্য আর কিছু তো দরকার হয় না। এই ঘটনা বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সাইবার সন্ত্রাসীদের জন্য এদেশের সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটগুলোতে সহজে হামলা করার রাস্তা আরও সহজ করে দেয়নি তো?

দৈনিক বণিক বার্তা ১১ জুলাইয়ের প্রতিবেদনে বলছে, তথ্য ফাঁসের ঘটনা জাতীয় নিরাপত্তার বেহাল দশাই প্রকাশ পায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ বেহাল দশার জন্য কি এখন পর্যন্ত কারও চাকরি গিয়েছে? কোনো অফিসার বদলি হয়েছেন? কোনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ইস্তফা দিয়েছেন? অথবা কারও থেকে ইস্তফা নেওয়া হয়েছে? যদিও মন্ত্রী ও তাদের আত্মীয়দের (অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হওয়া) জমি কেনার কথা প্রকাশ করে দেওয়া এবং বাধা দেওয়ার কারণে কোনো কোনো ডিসি এবং সরকারি কর্মকর্তা তৎক্ষণাৎ বদলি হয়ে যান। কিন্তু এক্ষেত্রে কি এমন কিছু ঘটেছে? উল্টো দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ হাস্যকর কথাও বলে যাচ্ছেন। যেমন : এনআইডির ডিজি বলেছেন, সার্ভার সুরক্ষিত আছে। পাঁচ কোটি লোকের এনআইডির তথ্য ফাঁস হওয়ার পরও যদি সার্ভার সুরক্ষিত থাকে, তাহলে তো বাহবাই দিতে হয়।

মোটকথা, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা কোনো কিছুই এ পর্যন্ত জনগণ দেখতে পায়নি।

সবশেষে আমরা বলতে চাই, আমাদের পবিত্র ধর্ম ইসলামে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনো মানুষের গোপনীয়তা যেন নষ্ট না হয়, তা ব্যক্তি ও সরকার পর্যায়ে হোক; কুরআন-সুন্নাহ্য় বিভিন্ন নির্দেশনার মাধ্যমে তা সুনিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলামের মুআশারাতি নেযাম তথা সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত ব্যক্তিমাত্রই জানবেন যে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে কত গুরুত্বের সাথে নিয়েছে ইসলাম। কারও ঘরে বিনা অনুমতিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে এবং তাজাসসুস তথা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অন্যের গোপন দুর্বলতা বের করা বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা তো পবিত্র কুরআনেই রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ  اٰمَنُوا اجْتَنِبُوْا کَثِيْرًا مِّنَ الظَّنِّ اِنَّ  بَعْضَ الظَّنِّ  اِثْمٌ وَّ لَا تَجَسَّسُوْا وَلَا يَغْتَبْ بَّعْضُكُمْ بَعْضًا.

হে মুমিনগণ! অনেক রকম অনুমান থেকে বেঁচে থাক। কোনো কোনো অনুমান গোনাহ। তোমরা কারও গোপন ত্রুটির অনুসন্ধানে পড়বে না এবং তোমাদের একেঅন্যের গীবত করবে না। সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১২

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُيُوْتًا غَيْرَ بُيُوْتِكُمْ حَتّٰي تَسْتَاْنِسُوْا وَ تُسَلِّمُوْا عَلٰۤي اَهْلِهَا ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَکَّرُوْنَ،  فَاِنْ  لَّمْ تَجِدُوْا فِيْهَاۤ  اَحَدًا فَلَا تَدْخُلُوْهَا حَتّٰي يُؤْذَنَ لَكُمْ وَ اِنْ قِيْلَ لَكُمُ ارْجِعُوْا فَارْجِعُوْا هُوَ اَزْکٰي لَكُمْ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ

হে মুমিনগণ! নিজ ঘর ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না অনুমতি গ্রহণ কর এবং

তার বাসিন্দাদেরকে সালাম দাও। এ পন্থাই তোমাদের জন্য শ্রেয়। আশা করা যায়, তোমরা লক্ষ রাখবে। তোমরা যদি তাতে কাউকে না পাও, তবুও যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদেরকে অনুমতি দেওয়া না হয়, তাতে প্রবেশ করো না। তোমাদেরকে যদি বলা হয়, ফিরে যাও তাহলে ফিরে যেও। এটাই তোমাদের পক্ষে শুদ্ধতর। তোমরা যা-কিছুই কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞাত। সূরা নূর (২৪) : ২৭-২৮

এমনিভাবে বিভিন্ন হাদীসেও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার প্রতি তাগিদ এসেছে। যেমন একটি হাদীস শরীফে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন

مَنِ اسْتَمع إلى حَديثِ قَوْمٍ وهُمْ له كارِهُونَ، أوْ يَفِرُّونَ منه؛ صُبَّ في أُذُنِهِ الآنُكُ يَومَ القِيامَةِ.

যে ব্যক্তি এক দল মানুষের কথার প্রতি কান পাতল, অথচ এটা তারা পছন্দ করে না অথবা বলেছেন, তারা তার থেকে পলায়নপর; কিয়ামতের দিন তার কানে সীসা ঢেলে দেওয়া হবে। সহীহ বুখারী, হাদীস ৭০৪২

সাঈদ মাকবুরী রাহ. বলেন

مَرَرْتُ عَلَى ابْنِ عُمَرَ، وَمَعَهُ رَجُلٌ يَتَحَدَّثُ، فَقُمْتُ إِلَيْهِمَا، فَلَطَمَ فِي صَدْرِي فَقَالَ: إِذَا وَجَدْتَ اثْنَيْنِ يَتَحَدَّثَانِ فَلَا تَقُم مَعَهُمَا، وَلَا تَجْلِسْ مَعَهُمَا، حَتَّى تَسْتَأْذِنَهُمَا، فَقُلْتُ: أَصْلَحَكَ اللهُ يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ، إِنَّمَا رَجَوْتُ أَنْ أَسْمَعَ مِنْكُمَا خَيْرًا.

সাঈদ আলমাকবুরী রাহ. বলেন, আমি ইবনে উমর রা.-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি একজনের সাথে কথা বলছিলেন। আমি তাদের কাছে দাঁড়ালাম। তিনি আমার বুকে থাপ্পড় দিয়ে বললেন, দুজনকে কথা বলতে দেখলে অনুমতি না নিয়ে তাদের কাছে দাঁড়িয়ো না, তাদের সাথে বসতে যেয়ো না।

আমি বললাম, হে আব্দুর রহমানের বাবা! আমি তোমাদের কাছ থেকে ভালো কিছু শোনার আশায়ই শরীক হয়েছিলাম। আলআদাবুল মুফরাদ, বর্ণনা ১১৬৬

শুধু তাই নয়, বরং কে না জানে যে, ইসলামী অর্থনীতির একটি বড় স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। ইসলামী সরকার যাকাত উসূল ও বিতরণ অর্থাৎ শুধু যাকাত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের দারিদ্র্য বিমোচনের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়টি অনেকটা সুরাহাও করে থাকে। সামর্থ্যবান নাগরিকদের থেকে যথাযথ হিসাব করে যাকাত আদায় করে তা দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। রাষ্ট্র সে দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে গিয়ে প্রয়োজনে কঠোরও হতে পারবে। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও কারও গোপন সম্পদ, যেমন অলঙ্কারাদি অথবা নিজের কাছে গোপনে গচ্ছিত নগদ অর্থসম্পদের যাকাত আদায়ের দায়িত্ব বা অধিকার রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়নি; বরং তা মুমিন বান্দার নিজের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সে তার ঈমান ও তাকওয়ার দাবি থেকে এ ধরনের সম্পদের যাকাত হিসাব করে আদায় করবে। কিন্তু রাষ্ট্র তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এগুলোর হিসাব বের করবে না। এ ধরনের আরও অনেক উদাহরণই টানা যায়।

খলীফা হযরত উমর রা.-এর শাসনামলে একবার একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল, তিনি তার ঘরে গোপনে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে শরাব পান করে। অভিযোগ শুনে হযরত উমর রা. একদিন না জানিয়েই ওই ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে ওঠেন; কিন্তু তিনি এমন কিছু দেখতে পাননি। লোকটিকে তিনি যখন এ বিষয় জিজ্ঞেস করেন তখন জবাবে সে বলে, আমীরুল মুমিনীন! আপনি নিষিদ্ধ কাজ করছেন! কুরআনে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানুষের অপরাধ খোঁজ করতে নিষেধ করা হয়েছে। খলীফা উমর রা. তখন সেখান থেকে চলে আসেন।

ভাবার বিষয় সেকালের প্রায় অর্ধ জাহানের শাসক! আজও সাহস, দৃঢ়তা, ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতায় পৃথিবী তার সমকক্ষ কাউকে দাঁড় করাতে পারেনি। যার আগমনের শব্দ শুনলে শয়তানও সে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হত। তিনিও কিন্তু একজন নাগরিকের মৃদু প্রতিবাদ শুনেই তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি সহজেই মেনে নিয়েছেন। আজকের পৃথিবী কি পারবে এমন কোনো নজীর দেখাতে? মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার কত বুলিই তো আওড়ানো হয়, কিন্তু ইসলামের স্বর্ণযুগের নাগরিকেরা যে ব্যক্তি-নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার নিশ্চয়তা পেত, শুধু আমাদের দেশ নয়, বরং কথিত উন্নত বিশে^র কোনো দেশও তার ধারে কাছেও যেতে পেরেছে?

মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা সুস্পষ্ট; কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে, ৯১ ভাগ মুসলিমের দেশে আজকে রাষ্ট্রের হাতেই নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যাদি অনিরাপদ ও গুরুত্বহীন! আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। 

 

 

advertisement