রবিউল আখির ১৪৪৪   ||   নভেম্বর ২০২২

মাসিক দ্বীনী মাহফিলের বয়ান
ঈমান শেখার মেহনত ও ঈমান হেফাযতের মেহনত

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

الحمدُ لله نَحْمَدُه ونَستَعينُه وَنَستَغْفِرُه، وَنُؤمِنُ به ونَتَوكّلُ عَلَيهِ، وَنَعوذُ باللهِ مِن شرُورِ أنفُسنا ومِن سيّئاتِ أعمالنا، مَنْ يهدِهِ اللهُ فلا مُضِلّ له، وَمَن يّضلل فلا هَاديَ له، وأشهدُ أن لّا إله إلا الله وَحْدَه لا شريكَ له، وأشهدُ أن مُحمّدًا عبدُه وَرَسُولُه، اللهم صلِّ على سيدنا ومولانا محمدٍ النبيِّ الأميِّ وعلى آله وصَحْبِه وسلّم تسليما، اللّهُمّ اجْعَلْ صَلَوَاتِكَ وَرَحْمَتَكَ وَبَرَكَاتِكَ عَلَى سَيِّدِ الْمُرْسَلِينَ، وَإِمَامِ الْمُتّقِينَ، وَخَاتَمِ النّبِيِّينَ، مُحَمّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُولِكَ إِمَامِ الْخَيْرِ، وَقَائِدِ الْخَيْرِ وَرَسُولِ الرّحْمَةِ، اللّهُمّ ابْعَثْهُ مَقَامًا مَحْمُودًا يَغْبِطُهُ بِهِ الْأَوّلُونَ وَالْآخِرُونَ.

اَلَمْ تَرَ كَیْفَ ضَرَبَ اللهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَیِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَیِّبَةٍ اَصْلُهَا ثَابِتٌ وَّ فَرْعُهَا فِی السَّمَآءِ،تُؤْتِیْۤ اُكُلَهَا كُلَّ حِیْنٍۭ بِاِذْنِ رَبِّهَا وَ یَضْرِبُ اللهُ الْاَمْثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ یَتَذَكَّرُوْنَ .

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মেহেরবানী, তিনি আমাদেরকে আরেকটি দ্বীনী মাহফিলে হাজির হওয়ার তাওফীক দান করেছেন- আলহামদু লিল্লাহ। সকাল-সন্ধ্যায় আমাদের আল্লাহর শোকর আদায় করা উচিত। কারণ তিনি আমাদেরকে নিজ পরিচয় দান করেছেন। আমরা তাঁকে চিনতে পেরেছি। তাঁর প্রতি ঈমান আনতে পেরেছি। তিনি আমাদের রব আর আমরা তাঁর আব্দ ও বান্দা।

তিনি আমাদেরকে দ্বীন ইসলাম কবুল করার তাওফীক দান করেছেন, তিনি আমাদেরকে মুসলিম ও মুমিন বানিয়েছেন, আলহামদু লিল্লাহ।

আমরা তাঁর আরো শোকর আদায় করি, তিনি আমাদেরকে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত বানিয়েছেন, আলহামদু লিল্লাহ।

যদি আমরা সকাল ও সন্ধ্যায় এই দুআ তিন বার করে পাঠ করতে পারি-

رَضِيْتُ بِاللهِ رَبًّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِيْنًا، وَبِمُحَمَّدٍ رَسُوْلاً.

(আমি রব হিসেবে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, দ্বীন হিসেবে ইসলামের প্রতি সন্তুষ্ট, রাসূল হিসেবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সন্তুষ্ট।) তাহলে আমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব।

হাদীসে আছে, যে এই দুআটি সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ অবশ্যই তাকে সন্তুষ্ট করবেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৯৬৭

তিনটি কথা :

এক. আল্লাহ আমাদের রব, আমরা তাঁর বান্দা।

দুই. আমরা মুসলিম, ইসলাম আমাদের ধর্ম।

তিন. আমরা সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত।

আমাদের প্রতি আল্লাহর যেসব নিআমত রয়েছে, এই তিনটি নিআমত অনেক বড়। আমাদেরকে ইসলাম ও দ্বীন-শরীয়ত জানাবার ও শেখাবার জন্য আল্লাহ তাআলা আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সর্বশেষ আসমানী কিতাব আলকুরআনুল কারীম অবতীর্ণ করেছেন। এই কুরআন কারীম যেভাবে তিনি অবতীর্ণ করেছেন সেভাবে সংরক্ষিত আছে, কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে। এতে কেউ একটা অক্ষর পর্যন্ত বাড়াতে বা কমাতে পারে না এবং পারবে না- ইনশাআল্লাহ। এই কুরআন আল্লাহর অনেক বড় নিআমত। এসব নিআমতের জন্য তাঁর শোকর আদায় করা খুব জরুরি।

শোকর কীভাবে আদায় হবে?

যবানে বলব- আলহামদু লিল্লাহ। অন্তরে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থাকবে, তিনি মেহেরবানী ও দয়া করে আমাদের এই নিআমত দান করেছেন। শোকর আরো আদায় হবে- এসব নিআমতের কদর, যত্ন ও মূল্যায়নের মাধ্যমে।

কীভাবে এসব নিআমতের কদর ও যত্ন নেব?

কুরআন শিখতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত ও সুন্নাহ শিখতে হবে, জানতে হবে। নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِیْ رَسُوْلِ اللهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ.

অর্থাৎ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের মধ্যে আল্লাহ আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রেখেছেন।

-সূরা আহযাব (৩৩) : ২১

নবীজীর সীরাত ও জীবন আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। নির্ভুল আদর্শ; যাতে ভুল-ত্রুটির কোনো আশঙ্কা নেই এবং  যে আদর্শের কোনো বিকল্প নেই। কাজেই এই সীরাত ও সুন্নাহ শিখতে হবে, শিখে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে।

আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে আমাদের বিভিন্ন নাম রেখেছেন। যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে তাদেরকে তিনি বিভিন্ন গুণবাচক নামে সম্বোধন করেছন। যেমন তিনি আমাদের নাম রেখেছেন- মুসলিম। বলেছেন-

هُوَ سَمّٰىكُمُ الْمُسْلِمِیْنَ.

আমাদের নাম- মুমিন। কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

وَ الْمُؤْمِنُوْنَ وَ الْمُؤْمِنٰتُ بَعْضُهُمْ اَوْلِیَآءُ بَعْضٍ.

-সূরা তাওবা (৯) : ৭১

এভাবে আরো অনেক নাম আছে। যেমন মুত্তাকী, মুহসিন ইত্যাদি।

নাম তো অনেক আছে, কিন্তু এসব নামের অধিকারী কে? যে নামের মধ্যে যে নুকতা ও গুণের কথা বলা আছে, আমি যদি সেই গুণ অর্জন করতে পারি তবেই আমি সেই নামের অধিকারী হতে পারব- ইনশাআল্লাহ।

মুসলিম নামের মধ্যে ইসলামের কথা বলা হয়েছে। মুমিন নামের মধ্যে ঈমানের কথা বলা হয়েছে। মুত্তাকী নামের মধ্যে তাকওয়ার কথা বলা হয়েছে। মুহসিন নামের মধ্যে ইহ্সানের কথা বলা হয়েছে।

এভাবে একেকটা নামের মধ্যে একেকটা সিফাত। আমাদেরকে এই সিফাতগুলো অবশ্যই অর্জন করতে হবে। আমি যেহেতু মুসলিম, তাই আমাকে ইসলামের মধ্যে থাকতে হবে। আমি যেহেতু মুমিন, তাই আমার মধ্যে ঈমান থাকতে হবে।

কাকে বলে ঈমান? কাকে বলে ইসলাম?

আমরা ছোটবেলায় মক্তবেই ঈমানের মৌলিক কিছু শাখার কথা পড়ে এসেছি।

آمَنْتُ باللهِ كَمَا هُوَ بِأَسْمَائِه وَصِفَاتِه، وَقَبِلتُ جَمِيْعَ أحْكَامِه.

آمَنْتُ بِاللهِ، وَمَلَائِكَتِهِ، وَكُتُبِهِ، وَرُسُلِهِ، والْيَوْمِ الْآخِرِ، والْقَدْرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ مِنَ اللهِ تَعَالى، وَالْبَعْثِ بَعْدَ الْمَوْتِ.

আমরা কি এগুলোর অর্থ বুঝি? এখানের প্রত্যেকটা আকীদা আমাকে বিস্তারিতভাবে বুঝতে হবে। আকীদা যদি আমি ভালোভাবে না জানি, না বুঝি, তাহলে অজান্তেই আমার ঈমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যে কোনো সময় যে কোনো প্রতারক এসে ধোঁকা দিয়ে আমাকে ইসলাম থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এজন্য ইসলামের আকীদাগুলো ভালোভাবে শেখা জরুরি।

আজ আমরা একটি আকীদা বিষয়ে একটু আলোচনা করি। সংক্ষেপে আলোচনার চেষ্টা করা হবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলাই তাওফীক দেওয়ার মালিক।

সকল নবী-রাসূলের প্রতি ঈমান আনব

আমরা জানি, ইসলামের একটি মৌলিক আকীদা সকল নবী-রাসূলদের প্রতি ঈমান আনা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের হেদায়েতের জন্য যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন সকলকে সত্য বলে বিশ্বাস ও স্বীকার করা। অর্থাৎ, সবাই আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল- একথা বিশ্বাস ও স্বীকার করা। এটা ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এক নবীকে মানা হল আরেক নবীকে মানা হল না, অথবা এক নবীকে বিশ্বাস করা হল আরেক নবীকে বিশ্বাস করা হল না- সেটি ঈমান হতে পারে না। সকল নবীকেই বিশ্বাস ও স্বীকার করতে হবে। কুরআন কারীমে অনেক নবীর নাম এসেছে। যেমন-

আদম আলাইহিস সালাম, ইদরীস আলাইহিস সালাম, নূহ আলাইহিস সালাম, হূদ আলাইহিস সালাম, সালেহ আলাইহিস সালাম, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, লূত আলাইহিস সালাম, শুআইব আলাইহিস সালাম, ইসমাঈল আলাইহিস সালাম, ইসহাক আলাইহিস সালাম, ইয়াকুব আলাইহিস সালাম, ইউসুফ আলাইহিস সালাম, আইয়ূব আলাইহিস সালাম, যুলকিফ্ল আলাইহিস সালাম, ইউনুস আলাইহিস সালাম, মূসা আলাইহিস সালাম, হারূন আলাইহিস সালাম, ইলয়াস আলাইহিস সালাম, ইয়াসা আলাইহিস সালাম, দাউদ আলাইহিস সালাম, সুলাইমান আলাইহিস সালাম, যাকারিয়া আলাইহিস সালাম, ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম ও খাতামুন নাবিয়্যীন সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। (দ্র. সূরা আলে ইমরান ৩৩, ১৪৪সূরা আনআম ৮৩-৮৬; সূরা হূদ ৫০, ৬১, ৮৪)

এর বাইরেও অনেক নবী আল্লাহ পাঠিয়েছেন, কিন্তু তাঁদের বিস্তারিত বিবরণ আমাদের জানা নেই। আমরা এককথায় বলে দেব, আল্লাহ যাঁকে নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন তিনি সত্য নবী।

সর্বশেষ নবী ও রাসূল

এই নবী-রাসূলগণের মধ্যে সর্বশেষ নবী হলেন আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমরা তাঁর উম্মত। ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আকীদা- হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আখেরী নবী ও রাসূল (অর্থাৎ সর্বশেষ নবী ও রাসূল) বিশ্বাস করা। তাঁর পরে আর কেউ নবী বা রাসূল হবে না। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন, আমি নবুওত ও রিসালাতের ধারা এখানেই শেষ করে দিয়েছি। সূরা আহযাবে ইরশাদ হয়েছে-

مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَ لٰكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَ خَاتَمَ النَّبِیّٖنَ، وَ كَانَ اللهُ بِكُلِّ شَیْءٍ عَلِیْمًا.

(হে মুমিনগণ!) মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন, তবে তিনি আল্লাহর রাসূল এবং নবীদের মধ্যে সর্বশেষ। আল্লাহ সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞাত। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৪০

অর্থাৎ, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সর্বশেষ নবী। নবুওতের ধারা তাঁর মাধ্যমেই সমাপ্ত। তাঁকে আল্লাহ তাআলা যে শরীয়ত দান করেছেন তা-ই সর্বশেষ শরীয়ত। কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো শরীয়ত আসবে না। হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে আমরা যে শরীয়ত পেয়েছি, ইসলামী শরীয়ত, এটাই কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। তাঁর প্রতি আল্লাহ হেদায়েতের যে কিতাব নাযিল করেছেন, সেটাই সর্বশেষ কিতাব। কিয়ামত পর্যন্ত এই কুরআনের হেদায়েতই চলতে থাকবে। এর পরে আর কোনো হেদায়েতের কিতাব আল্লাহ নাযিল করবেন না। এককথায় তিনি সর্বশেষ নবী, তাঁকে যে শরীয়ত দেওয়া হয়েছে এটাই সর্বশেষ শরীয়ত। তাঁর প্রতি হেদায়েতের যে কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছে সেটাই সর্বশেষ হেদায়েতের কিতাব এবং তাঁর উম্মত সর্বশেষ উম্মত।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী ও রাসূল- এই এক আকীদার মধ্যে একথাও আছে, তাঁকে আল্লাহ যে শরীয়ত দান করেছেন তা বিশ্বাস করতে হবে এবং মানতে হবে। তাঁকে আল্লাহ তাআলা যে কুরআন দান করেছেন তা বিশ্বাস করতে হবে, শিখতে হবে, কুরআনের বিধান মেনে চলতে হবে।

তিনিই আমাদের আদর্শ

দ্বিতীয়ত, তাঁর সীরাত ও সুন্নত আমাদের জন্য জীবনাদর্শ। আল্লাহ তাআলা কুরআনে ঘোষণা করেছেন-

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِیْ رَسُوْلِ اللهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ.

অর্থাৎ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের মধ্যে আল্লাহ আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রেখেছেন।  -সূরা আহযাব (৩৩) : ২১

আয়াতের মর্মকথা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উসওয়াতুন হাসানা। অর্থাৎ সুন্দর নমুনা। উত্তম ও নির্ভুল আদর্শ। আমাদের জীবন চলার ব্যবস্থা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত এবং তাঁকে আল্লাহ তাআলা যে শরীয়ত দান করেছেন সেই শরীয়ত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুরো সীরাত বা জীবনটাই সুন্নত। তাঁকে আল্লাহ যে শরীয়ত দিয়েছেন, বা কুরআন-হাদীসের মধ্যে আল্লাহ যত বিধান দিয়েছেন, সবকিছুই নবীজীর সীরাতের মধ্যে আছে। এজন্য আমাদেরকে নবীজীর সীরাতও পড়তে হবে।

আর ইসলামী শরীয়তকে বিশ্বাস ও গ্রহণ করা এবং ইসলামী শরীয়ত মেনে চলার বিষয়ে আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গিকারবদ্ধ হওয়া ঈমান ও ইসলামের মূলকথা। কখনো কোনো ভুল হয়ে গেলে তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। নিজেকে অপরাধী মনে করা। ঈমানে মুজমালের মধ্যে আছে-

وقَبِلْتُ جَمِيعَ أحْكامِه.

আল্লাহর দেওয়া পুরো শরীয়ত, রাসূলুল্লাহর সব সুন্নত আমি মেনে নিয়েছি ও গ্রহণ করেছি। এর পরও যদি কখনো শয়তানের ধোঁকায়, নফসের ওয়াসওয়াসায় কোনো গোনাহ হয়ে যায় তখন নিজেকে অপরাধী মনে করে সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাব। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আগে আমাকে এই পুরো শরীয়ত গ্রহণ গ্রহণ করা এবং মেনে চলার অঙ্গিকার করতে হবে; না হয় ঈমানই হবে না। কিন্তু যেহেতু আমরা মানুষ, আমাদের অনেক দুর্বলতা। তাই কখনো কোনো ভুল হয়ে যেতে পারে। ভুল হওয়া মানেই অঙ্গিকার ভঙ্গ হয়ে যাওয়া নয়। সেই ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইব। অর্থাৎ তাওবার মাধ্যমে ঈমানের নবায়ন করব।

হাদীস অস্বীকারের ফেতনা

আকীদার এ কথাগুলো খুব ভালোভাবে আমাদের জানা জরুরি। কেউ যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত অস্বীকার করে, তাহলে কি তার ঈমান থাকে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত রয়েছে হাদীসের মধ্যে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করে করে আমাদের কুরআন কারীম শিখিয়েছেন আল্লাহর হুকুমে। কোন্ আয়াতের কী অর্থ, কী মর্ম, কোন্ আয়াতে আল্লাহ তাআলা কী বিধান দিয়েছেন, সেই বিধান কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সেগুলো নবীজী আমাদেরকে সব হাতেকলমে শিখিয়েছেন এবং দেখিয়ে দিয়েছেন। কুরআনে আছে-

هُوَ الَّذِیْ بَعَثَ فِی الْاُمِّیّٖنَ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیْهِمْ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ .

তিনিই উম্মীদের মধ্যে তাদেরই একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, যে তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবে -সূরা জুমুআ (৬২) : ২

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে কুরআনের যে বিধানগুলো শিখিয়েছেন সেগুলো হাদীস শরীফে সংরক্ষিত আছে। নবীজীর সকল সুন্নতই হাদীসে সংরক্ষিত। কুরআন-হাদীস সবচেয়ে বেশি বুঝেছেন সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন এবং মাযহাবের ইমামগণ। যাদের মধ্যে আছেন ইমাম আবু হানীফা রাহ., ইমাম মালেক রাহ., ইমাম শাফিয়ী রাহ. এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ.-সহ আরো অনেকে। এখন কেউ যদি এসে হাদীস অস্বীকার করে এবং বলে, কুরআন নিজে নিজেই বুঝে ফেলবে, হাদীসের সহযোগিতা লাগবে না, তার ঈমান থাকবে?

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  সুন্নত ও সীরাত, যেগুলোকে আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য আদর্শ বানিয়েছেন, সেগুলো তার দরকার নেই, সে কুরআনের অনুবাদ পড়ে পড়ে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করবে, নিজে যা বুঝবে সেটাকেই বানিয়ে দেবে আল্লাহর হুকুম- এমন চিন্তা লালনকারী ব্যক্তির কি ঈমান থাকতে পারে? কাজেই এমন কোনো লোক যদি দাওয়াত নিয়ে আসে তার কথা শোনা যাবে না। এদেশে এখন এমন অনেক লোক তৈরি হয়ে গেছে, যারা হাদীস অস্বীকার করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত অস্বীকার করে। কুরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা করে। যাকে বলা হয় অপব্যাখ্যা। সত্যি কথা হল, এদের আসলে কুরআনের প্রতিও ঈমান নেই, রাসূলের প্রতিও ঈমান নেই। এরা বরং কুরআনকে নিয়ে তামাশা করে। আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, কুরআন যাতে তাঁর নবীর কাছে শেখা হয়। আল্লাহর নির্দেশ হল তাঁর নবী যেভাবে কুরআন শেখাবেন এবং বুঝাবেন সেভাবেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু তা বাদ দিয়ে নিজের মতো করে যদি কুরআনের ব্যাখ্যা করা হয়, সেটি আল্লাহর হুকুম মানা হবে, নাকি শয়তানী হবে? এরা আহলে কুরআন নামধারী, কিন্তু বাস্তবে এরা হল রাসূল অবমাননাকারী এবং হাদীস অস্বীকারকারী। এরা ইসলামের গণ্ডি থেকে বাইরে। এদের কথায় কান দেয়া যাবে না।

কাদিয়ানী ফেতনা

ঠিক এরকম কিছু লোক আছে, যারা মানুষের কাছে দাওয়াত নিয়ে যায় যে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানী হল মাহদী ও মাসীহ। এরা আসলে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের লোক। নিজেদের নাম দেয় আহমদিয়া মুসলিম জামাত, নাউযুবিল্লাহ। অথচ তারা মুসলিম নয়; তারা বেঈমান। প্রতারণা করে নিজেদের মুসলিম পরিচয় দেয়। এই কাদিয়ানীরা যখন মানুষকে তাদের ধর্মের দিকে দাওয়াত দিতে আসে, প্রথমেই মানুষকে তার নবী দাবির বিষয়ে কিছু বলে না। বলে, মির্যা সাহেব হলেন প্রতিশ্রুত মাসীহ ও মাহদী। অথচ মাহদী আসার কথা কিয়ামতের আগমুহূর্তে। সে যদি মাহদীই হত, এতদিনে কিয়ামত এসে দুনিয়াই শেষ হয়ে যেত। কারণ তার মৃত্যুর তো একশ এগারো বছরের মতো পার হয়ে গেছে। এরা আসলে কঠিন ধোঁকাবাজ। সে নিজেকে নবী দাবি করেছে, অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী। তাহলে কি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ১২শ বছর পরে এসে কারো জন্য নবী হওয়া সম্ভব? সে তো নবী দাবি করেছে, কিন্তু তার অনুসারীরা মানুষকে গিয়ে প্রথমেই একথা বলে না। প্রথমেই একথা বললে তো মানুষ সঙ্গে সঙ্গেই ধরে ফেলবে। এজন্য ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়। প্রতারণা করে প্রথমে মানুষকে একথা গেলাবার চেষ্টা করে যে, তিনি মাহদী। তিনি মাসীহ। নাউযুবিল্লাহ। আবার কখনো বলে, তিনি মুজাদ্দিদ। অথচ সে একজন প্রতারক ও নবুওতের মিথ্যা দাবিদার। কুরআন-সুন্নাহ ও শরীয়তের অস্বীকারকারী। কুরআন বলে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী। এটি শরীয়তের অকাট্য বিধান। এই বিধানকে প্রত্যাখ্যান করে কেউ যদি নিজেকে নবী দাবি করে তার মুসলমান হওয়ার নূন্যতম কোনো অবকাশ নেই। সে নিশ্চিত অমুসিলম ও বেঈমান। তাকে যদি কেউ মানে বা গ্রহণ করে, কেউ যদি তাকে মাহদী বা মাসীহ মনে করে- তারও ঈমান থাকবে না।

ঈমানের হেফাযত ফরয

ভাই ও বন্ধুগণ! ঈমান আনা যেমন ফরয, হেফাযত করাও ফরয। কিন্তু এখন ঈমানের ওপর আক্রমণ চলছে বিভিন্নভাবে। মানুষের ঈমান নষ্ট করার জন্য এবং তাদেরকে গোমরাহ করার জন্য বিভিন্ন প্রতারক বিভিন্নভাবে অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এজন্য ঈমান গ্রহণ করে তার ওপর যেমন আল্লাহর শোকর আদায় করতে হবে, তেমনি ঈমানের ওপর অটল অবিচল থাকার জন্য আল্লাহর কাছে সবসময় দুআও করতে হবে। কুরআনে বর্ণিত একটি দুআ সবসময় পাঠ করতে হবে-

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ اِذْ هَدَیْتَنَا وَ هَبْ لَنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً،  اِنَّكَ اَنْتَ الْوَهَّابُ.

অর্থাৎ আল্লাহ, আপনি মেহেরবানী করে হেদায়েত দান করেছেন। ঈমানের দৌলত দান করেছেন। কাজেই আল্লাহ, আপনি মেহেরবানী করে আমাদেরকে পরিপূর্ণ মুসলিম বানিয়ে দিন। আপনি মেহেরবানী করে আমাদের ঈমান ও ইসলামকে হেফাজত করুন। ঈমানের ওপর অটল ও অবিচল রাখুন।

[দুআর অনুবাদ : হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদেরকে যখন হেদায়েত দান করেছেন তারপর আর আমাদের অন্তরে বক্রতা সৃষ্টি করবেন না এবং একান্তভাবে নিজের পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয়ই আপনিই মহা দাতা। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৮]

ইসলামী আকীদা শিখব ও জানব

এভাবে আল্লাহর কাছে দুআ করব। আর ইসলামী আকীদাগুলো ভালো করে শেখার চেষ্টা করব। বারবার চর্চা করব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

جَدِّدُوا إِيمَانَكُمْ.

তোমরা ঈমান নবায়ন কর।

একবার কালিমা পড়ে ঈমান আনলে, তারপর বেখবর বসে থাকলে কাজ হবে না। তোমাকে ঈমানের নবায়ন করতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেছেন-

يَا رَسُولَ اللهِ، وَكَيْفَ نُجَدِّدُ إِيمَانَنَا؟

আল্লাহর রাসূল! আমরা ঈমানের নবায়ন কীভাবে করব?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

أَكْثِرُوا مِنْ قَوْلِ لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ.

বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়!

লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর যিকির ও আলোচনা বেশি বেশি কর। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর মর্ম ভালো করে অনুধাবন কর। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৭১০; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৬৫৭)

কালিমা তায়্যিবাহ্র দৃষ্টান্ত

ছোট্ট এই বাক্যের মধ্যে আল্লাহ তাআলা কী দিয়ে রেখেছেন, তা বেশি বেশি চর্চা কর। খুব ভালো করে বোঝার এবং জানার চেষ্টা কর।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইরশাদ করেন-

اَلَمْ تَرَ كَیْفَ ضَرَبَ اللهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَیِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَیِّبَةٍ اَصْلُهَا ثَابِتٌ وَّ فَرْعُهَا فِی السَّمَآءِ.

তোমরা কি দেখনি, আল্লাহ কালেমা তায়্যিবার কেমন দৃষ্টান্ত দিয়েছেন? তা এক পবিত্র বৃক্ষের মত, যার মূল (ভূমিতে) সুদৃঢ়ভাবে স্থিত, তার শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ২৪

এই যে আমাদের ঈমান, এ তো একটা পবিত্র গাছ। জমিনে যখন আমরা গাছ লাগাই, আমাদেরকে তার হেফাজত করতে হয়। গরু-ছাগল যাতে নষ্ট করতে না পারে সেজন্য বেড়া দিয়ে রাখি। তারপর এ গাছের গোড়ায় পানি দেওয়া হয়। আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। এভাবে যে গাছের যত্ন যেভাবে নিতে হয় আমরা সবই করি। সেভাবে যত্ন নিই। একসময় এই গাছ বড় হয়। তার মধ্যে ফল ধরে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, পবিত্র কালিমার (ঈমানের কালেমাই তো সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কালেমা- অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহূ লা-শারীকালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহূ ওয়া রাসূলুহ) দৃষ্টান্ত হল পবিত্র একটি বৃক্ষ। ফলের জন্য গাছ লাগানো হয় জমিনে আর ঈমানের গাছের জায়গা হল মানুষের কলব ও অন্তর। ঈমান নামক বৃক্ষের চারা মানুষের দিলের মধ্যে লাগানো হয়েছে।

اَصْلُهَا ثَابِتٌ.

যত তুমি ঈমান ও ইসলামের ইল্ম হাসিল করবে, এর জন্য যত ফিকির ও মেহনত করবে, যত আমল করবে এবং দাওয়াত দেবে, যত এই দ্বীনের তালীমের কাজ করবে এবং তালীম হাসিল করবে, ততই গাছের গোড়া মজবুত হতে থাকবে।

وَ فَرْعُهَا فِی السَّمَآءِ.

একদিকে গোড়া মজবুত হবে, অন্যদিকে তার শাখাপ্রশাখা বের হতে থাকবে। দুনিয়ার গাছের আমরা কত ডালপালা বের হতে দেখি। একটা থেকে আরো কতটা ছড়ায়। কত সুন্দর পাতা! কত সুন্দর ফল, ফুল! তো ঈমানের যে গাছ কলবের মধ্যে লাগালাম, গোড়া মজবুত হচ্ছে, তার ডালাপালাগুলো কোথায়? তার ডলাপালা হল নেক আমল। প্রতিটা নেক আমলই একেকটা ডাল। জমিনের গাছের ডাল ওপরের দিকেও যায় আবার ডানেবামেও ছড়ায়। কিন্তু ঈমানের গাছের ডালগুলো আল্লাহ তাআলা কবুল করে আসমানের দিকে নিয়ে যান। আল্লাহ তাঁর দরবারে উঠিয়ে নেন। ইরশাদ হয়েছে-

اِلَیْهِ یَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّیِّبُ وَ الْعَمَلُ الصَّالِحُ یَرْفَعُهٗ.

-সূরা ফাতির (৩৫) : ১০

অর্থাৎ পবিত্র কালেমা তাঁরই দিকে আরোহণ করে। সৎকর্মকে আল্লাহ উঠিয়ে নেন এবং ঈমান ও আমলের যিন্দেগী অবলম্বনকারীদের ইয্যত আল্লাহ বুলন্দ করেন।

আসলে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত রাখা হলে তাঁর রহমত ও মেহেরবানী হতে থাকবে। ফলে এই গাছ থেকে যেমন ডাল বের হতে থাকবে, তার থেকে ফলও আসতে থাকবে। ফল মানে নেকআমল। আল্লাহর যিকির, তিলাওয়াত। আল্লাহর দরবারে দুআ-রোনাজারি। মানুষকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ, আল্লাহর মাখলুকের হক আদায় ইত্যাদি। আমার ওপর যার যে হক রয়েছে, সেগুলো যথাযথ আদায় করা। লেনদেন পরিষ্কার রাখা। জুলুম, অন্যায়-অবিচার, সুদ-ঘুসসহ সকল হারাম থেকে বেঁচে থাকা। সকল কবীরা গোনাহ পরিহার করা। এসব হল ঈমানের গাছের ফল।

তুমি যদি এই ঈমানের কদর ও মূল্যায়ন কর, যদি এই নিআমতের শোকর আদায় কর- আল্লাহ মুসলিম বানিয়েছেন, তাই ইসলামের বিধানগুলো যদি মেনে নেওয়ার চেষ্টা কর, আল্লাহ মুমিন বানিয়েছেন, তাই ঈমানের আকীদাগুলো ভালোভাবে শিখে হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা কর এবং অন্তরে মজবুত কর, তাহলে আল্লাহ তোমাকে তাওফীক দেবেন। চেষ্টা করলে আল্লাহ অবশ্যই তাওফীক দেবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

یُثَبِّتُ اللهُ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ فِی الْاٰخِرَةِ.

অর্থাৎ তুমি চেষ্টা চালিয়ে যাও এবং আল্লাহর কাছে চাইতে থাক, তিনি তোমাকে দুনিয়া আখেরাতের সকল জায়গায় ঈমানের কালিমার ওপর মজবুত রাখবেন- ইনশাআল্লাহ। দুনিয়াতেও কেউ তোমার ঈমানের গাছ নষ্ট করতে পারবে না। তোমার কলবের মধ্যে ঈমানের গাছের যে শেকড় মজবুত হয়ে আছে, সেটি উঠিয়ে কেউ তোমার কলব থেকে ঈমান বের করতে পারবে না। তোমাকে ইসলাম থেকে কেউ বের করে নিতে পারবে না। বিচ্যুত করতে পারবে না। তুমি কবরে গেলে সেখানেও মুনকার-নাকীর তোমাকে আটকাতে পারবে না- ইনশাআল্লাহ। তোমাকে প্রশ্ন করলে তখন তুমি তাওহীদের কালিমা এবং কালিমা শাহাদাত পড়ে নিতে পারবে- লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।

এই যে বললাম, ঈমান হেফাজত করতে হয়। ঈমান হেফাজত হয় আমলের মাধ্যমে। যতেœর সাথে নেকআমল করা এবং গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা।

ঈমান শেখার মেহনত যেভাবে করতে পারি

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ঈমান শেখা। ফরযে আইনের ইলম শিখতে হবে। আল্লাহ কী কী ফরয করেছেন, ইসলামী আকীদাগুলোর কোন্টার কী ব্যাখ্যা, সেগুলো ভালো করে জানতে হবে, যাতে কেউ এসে অপব্যাখ্যা করে আপনাকে গোমরাহ করতে না পারে। হালাল-হারামের মাসআলাগুলো, জায়েয-নাজায়েযের মাসআলাগুলো জানতে হবে। আমার ওপর কার কী হক রয়েছে, কীভাবে আদায় করতে হবে- তা জানতে হবে। এগুলো এক-দুদিনে শেখা যায়? শুধু চল্লিশ দিনে শেখা যায়? এর জন্য আমাদেরকে ভালো করে মেহনত করতে হবে। মেহনতের সহজ রাস্তা আল্লাহ খুলে দিয়েছেন।

এক তো তিন দিন, দশ দিন, এক চিল্লা, তিন চিল্লা করে তাবলীগে সময় লাগানো। সময় বের করতে পারলে চিল্লা দিলাম। বছরে এক চিল্লা, মাসে তিন দিন। আপনার যদি প্রশ্ন হয়, তিন দিন-ই কেন লাগাতে হবে, আপনি তাহলে পাঁচ দিন লাগান বা দুই দিন লাগান; এমনকি এক দিনই লাগান না! তিন দিন- এটা একটা নিয়ম বানানো হল আর কি। এই না যে, এটা বিধান। তিন দিনের কম লাগালে আপনাকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে- এমন কথা নয়।

দ্বিতীয় হল, আমাদের তালীমুদ্দীনে গিয়ে দ্বীন শেখা। দ্বীন শেখার ব্যবস্থা অনেক মসজিদেও থাকে। না থাকলে আপনি আপনার মহল্লায় শুরু করুন। আর মারকাযুদ দাওয়াহ থেকে তো এলান করে রাখা হয়েছে, আপনি ফজরের পরে আসলেও আমরা হাজির। মাগরিবের পরে আসলেও আছি। আসরের পরে আসলেও আমরা শেখানোর জন্য প্রস্তুত আছি- ইনশাআল্লাহ। এখন তো আমাদের মারকাযুদ দাওয়াহর মুদীর (পরিচালক) মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব হুজুর পূর্বদিকে কাঁচা রাস্তার সাথে লাগানো একটা জমিনে তালীমুদ্দীনের ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন- আলহামদু লিল্লাহ। দুআ করি, আল্লাহ তাআলা খায়ের ও বরকতের সাথে এই কাজকে পূর্ণতায় পৌঁছে দিন। অতি দ্রুত বরকতের সঙ্গে কাজটা পূর্ণ করে দিন।  যে জন্য এই ভবন, সেই মাকসূদ আল্লাহ তাআলা পূরণ করে দিন- আমীন।

এই তালীমুদ্দীন ভবন কী জন্য? আমাদের চব্বিশ ঘণ্টা দ্বীন শেখার জন্য। এমনিক কেউ যদি রাত দুইটা-তিনটায় দ্বীন শেখার জন্য রীতিমত আসতে চায় সেও আসতে পারবে- ইনশাআল্লাহ। এই সময় তো সাধারণত কেউ আসে না। কিন্তু কথার কথা, কেউ তাহাজ্জুদের জন্য উঠেছে, উঠে চিন্তা করল, এখন গিয়ে ঘুরে আসি, ইনশাআল্লাহ, তিনিও এসে এখান থেকে শিখতে পারবেন। এমনিতে ফজরের পর থেকে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত তো কোনো কথাই নেই। কিন্তু কেউ যদি চায়, তাহাজ্জুদের সময় এসে পড়বে, তিনিও পারবেন- ইনশাআল্লাহ। এটা হল চব্বিশ ঘণ্টার মেহনত। যখন যে আসবে সে-ই পাবে। একজন হঠাৎ এল, তাকে একথা বলা হবে না যে, এক সপ্তাহ পর নতুন একটা ব্যাচ শুরু হবে, আপনি সেই ব্যাচের সঙ্গে শুরু করুন। না, এমন বলা হবে না।

আচ্ছা, তাহলে কি এই ঘর হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা বসে থাকব? না, বসে থাকব না। এখানে এখনো প্রতিদিন তালীমের কাজ চলে। আপনারা সবাই আসতে পারেন। আপনাদের জন্য আলাদা করে লোক রাখা নেই, কিন্তু আপনি আসলে অন্য ব্যস্ততার মাঝেও আপনাকে তাঁরা সময় দেবেন। এটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত। কেউ যদি দ্বীন শিখতে আসে, আপনার যত ব্যস্ততাই থাকুক, তাকে সময় দিতে হবে। একটা হল, এমনিতে কোনো কিছু জানতে এসেছে, তাৎক্ষণিক জানা জরুরি নয়, পরে জানলেও হবে, সেটা ভিন্ন কথা। তখন হয়তো বলা যেতে পারে, আচ্ছা ভাই, আমার একটু ব্যস্ততা আছে, আপনি পরে আসেন। এটা হতে পারে। কিন্তু কেউ যদি ফরযে আইন ইলম শিখতে আসে তাহলে আর দেরি করা যায় না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা দিচ্ছিলেন, ওই সময় একজন এসে বলেছেন, আমার শিখতে হবে, আমার জানার আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৎক্ষণাৎ খুতবা বন্ধ করে দিয়েছেন। খুতবা বন্ধ করে যেখানে সে বসা ছিল তাকে শেখানোর জন্য নবীজী সেখানে চলে গেছেন। সেটা দেখে কোনো এক সাহাবী নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বসার জন্য একটা কুরসি (চেয়ার) এনে দিয়েছেন। নবীজী সেখানে বসে তাকে তালীম দিয়েছেন।

ফরয ইলম কেউ শিখতে চাইলে দেরি করা যায় না। এরকম আরো অনেক ঘটনা আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যস্ততার মাঝে কেউ এসেছে, তিনি ব্যস্ততা ছেড়ে তাৎক্ষণিক তাকে সময় দিয়েছেন। ফরয পর্যায়ের তাৎক্ষণিক বিষয় জানার ক্ষেত্রে নীতি এটা। এজন্য এখানকার সবাই ব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও আপনাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন। আপনি কুরআন শিখতে এসেছেন, নামায শিখতে এসেছেন, হালাল-হারাম সম্পর্কে জানতে এসেছেন, কীভাবে আপনার ব্যবসা হালাল হয়, ব্যবসাকে হারামমুক্ত কীভাবে করা যায়, আপনি জানতে এসেছেন, আপনাকে তাৎক্ষণিক সময় দেওয়া হবে। একজন বিয়ে করবে, স্ত্রীর সঙ্গে তার আচরণ কেমন হবে, তার ওপর স্ত্রীর কী হক- জানতে এসেছে; তাকে সময় দেওয়া হবে। কারণ এগুলো নগদ শিখতে হয়। নগদ ইলমে দেরি করা যায় না। এজন্য ব্যস্ত হুজুররাও আপনাকে সময় দেবেন- ইনশাআল্লাহ।

তাহলে তাবলীগ আর তালীমুদ্দীন- এ দুটো থেকে আমরা ফায়দা ওঠাব তো?

দ্বীন শেখার তৃতীয় সহজ রাস্তা হল দ্বীনী মাহফিল। যেখানেই শুনবেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের অনুসারী, আহলে হক উলামায়ে কেরাম আল্লাহওয়ালা বুযুর্গদের অধীনে কোনো দ্বীনী মাহফিল হচ্ছে সেখানে গিয়ে হাজির হবেন। দ্বীনী মাহফিল ও মজলিসে অংশগ্রহণ করা ঈমান তাজা করার একটা উপায়। ঈমান হেফাজতের জন্য ফরয ইলম শেখা সবচেয়ে জরুরি বিষয়। দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে আমি উম্মতের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে গাট্টি নিয়ে জায়গায় জায়গায় ঘুরব।

এমনিতে দেখুন, আমি কোথাও দ্বীনের কোনো কাজে যাচ্ছি, সেটা নিজের কাছে স্বাভাবিক। কিন্তু একসঙ্গে আট-দশ জন, পনের-বিশজন মানুষ, সবার হাতে গাট্টি, এদিকে চুলা, ওদিকে অন্যান্য জিনিস-পত্র, সব নিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, নতুনদের অনেকের মধ্যে, প্রথমে নিজের মধ্যে একধরনের কিছুটা খারাপ খারাপ লাগে। লাগে কি না? এই যে একটু লজ্জা লাগছে, তার পরও আমি যাচ্ছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে এই আমল পছন্দ হয়ে যেতে পারে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে কবুল করুন। তাওফীক দান করুন- আমীন।

وآخرُ دعوانا أنِ الحمدُ للهِ ربِّ العالمين.

 

[মাসিক দ্বীনী মাহফিল, মারকাযুদ দাওয়াহ জামে মসজিদ, হযরতপুর, কেরাণীগঞ্জ

৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৪ হি., ৩ অক্টোবর ২০২২ ঈ., সোমবার

শ্রুতলিখন : মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম]

 

 

advertisement