রবিউল আউয়াল ১৪২৯   ||   মার্চ ২০০৮

উম্মাহ-১ : উর্দিমুক্ত শাসনের পথে পাকিস্তান

খসরূ খান

শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনা ও আশংকার সমাপ্তি ঘটিয়ে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচন একচেটিয়াভাবে কাউকে ক্ষমতায় বসানোর মতো কোনো ফলাফল না নিয়ে আসলেও একচেটিয়া বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে প্রেসিডেন্ট মোশাররফপন্থী মুসলিম লীগ [কিউ]কে। মোট ২৭২ আসনের সংসদে ওই দলটি আসন পেয়েছে চল্লিশটিরও কম। অপরদিকে নিহত বেনজির ভুট্টোর দল পিপিপি আসন পেয়েছে নববইটির মতো। মুসলিম লীগ [নওয়াজ] পেয়েছে প্রায় সত্তরটির কাছাকাছি। অন্য দল ও গ্রুপগুলো পেয়েছে সব মিলিয়ে ৭৬টির মতো। বড় ও বিরোধী দুইটি দল এক সাথে হলেই সরকার গঠনের উপযোগী আসনের চেয়ে বেশি আসন তারা পেয়ে যান। হিসেবে ১৩৭টি আসন লাগলেও তাদের হাতে থাকছে প্রায় একশ সত্তরটির মতো আসন। কোয়ালিশনের মাধ্যমে এর সাথে আরো দশটি আসন যোগ হলে দুই তৃতীয়াংশের আধিক্য সংসদে নব গঠিত সরকার পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব। সে হিসেবে পিপিপি সংসদে ১০ আসনের অধিকারী আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির সাথে কথা বলেছে। অর্থাৎ পিপিপি, মুসলিম লীগ [নওয়াজ] এবং আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি কোয়ালিশন গড়ে তুলতে পারলে এমন একটি সরকার গঠন করা সম্ভব, যারা বর্তমান প্রেসিডেন্ট মোশারফকেও বিদায় করে দিতে পারে এবং সাংবিধানিক সংশোধনী এনে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে যে কোনো রকম আইনি শক্তির প্রকাশ ঘটাতে পারে।

পাকিস্তানে সামরিক আইন চালু থাকায় এবং সামরিক প্রশাসকের অধীনে গঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনের দীর্ঘ দিন পর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনটি নানা কারণেই ছিল আগ্রহের বিষয়। বিশেষ তাৎপর্যের ধারক। প্রধান দুটি দলের দুই প্রধান ও দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসেন। সেটি নিয়েও নানা রকম উত্তেজনা হয়। এর মধ্যে একটি জনসভা শেষে বোমার আঘাতে পিপিপি প্রধান সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো নিহত হন। প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের পক্ষ থেকে আর্মি চিফের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ইত্যাদি নিয়ে একটি জটিল ও কৌতূহল-উদ্দীপক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায়। টান টান এ পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর নির্বাচনের ফলাফলও একটি নতুন কৌতূহলের জন্ম দেয়।

আজীবন বিরোধী দুটি দলের বর্তমান প্রধানরা মুহূর্তের মধ্যেই একসঙ্গে বসতে পারেন, কোয়ালিশন করতে পারেন- অনভ্যস্ততা, তিক্ত অতীতের দূরত্ব ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে এটা সহজে কল্পনা করা না গেলেও সেটি সম্ভব হয়েছে এবং সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পিপিপি ও নওয়াজের মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠন করছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পিপিপির এক নেতার নাম শোনা যাচ্ছে। এ লেখা যখন পাঠকের সামনে যাবে তখন পরিস্থিতির আরো কিছু দূর এগিয়ে যাবে। তখন হয়তো সরকার গঠিত হয়ে যাবে, নতুন প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা শপথ নিয়ে ফেলবেন। তবে এ বিষয়ক চূড়ান্ত কথা এ মুহূর্তে বলা এজন্য কঠিন যে, দেখা যাচ্ছে পিপিপিকে চাপে রাখতে ইতোমধ্যেই প্রেসিডেন্ট শাসনাধীন সরকারের পক্ষ থেকে পিপিপি নেতা বেনজির-স্বামী জারদারির বিরুদ্ধে সুইস দুর্নীতি মামলা পুনরায় চালু করার উদ্যোগে নেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো রিপোর্টে এটাও দেখা যাচ্ছে যে, জারদারি নিজেও প্রেসিডেন্ট মোশাররফকে চটাতে চাচ্ছেন না। তিনিও রয়ে সয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এরই মধ্যে মার্কিন এম্বাসেডরের সঙ্গেও বসেছেন। অপরদিকে মার্কিন আশির্বাদপুষ্ট মোশাররফের প্রতিও বুশ সাহেবের নিরাপত্তা ফোন এসেছিল বলে খবর বেরিয়েছে।

পাকিস্তানের জনগণ তাদের দেশে রাজনীতিকদের আরেকবার ফিরিয়ে আনার পক্ষে রায় দিয়েছে এই নির্বাচনে। তারা সেনাশাসন এবং সদ্য উর্দি ছেড়ে দেওয়া সেনাপ্রধানের অধীনতা মেনে নিতে অসম্মতি ব্যক্ত করে দিয়েছে। মার্কিন আশির্বাদপুষ্ট রাজনীতি এবং সন্ত্রাসের নামে ইসলামকে রুখে দেওয়ার সরকারি কারসাজির বিরুদ্ধে এবার গণরায় এসেছে। দেখা যাচ্ছে, ভোট কাস্ট হওয়ার হার ছিল ৫০%এর মতো। এর মানে অনেক সাধারণ নাগরিক ভোট দিতে আসেননি। তারপরও যে রায় এসেছে সেটি বর্তমান প্রেসিডেন্টের গদি উল্টে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। যদি কাস্টিং ভোটের হার আরো বেশি হতো তাহলে ফলাফল আরো তাক লাগানো হতে পারতো। পাকিস্তানের রাজনীতিতে উর্দির যে প্রভাব ও দাপট এ নির্বাচনে সেই দাপটের বৃত্ত ভাঙ্গার একটা তীব্র চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। প্রধান বিচারপতিসহ বরখাস্তকৃত কয়েকজন বিচারপতিকে পুনর্বহালের দাবি এবং লাল মসজিদ হত্যাকান্ডসহ কিছু জায়গায় ইসলামপন্থীদের হত্যার দায় এ নির্বাচনে সরকারি হিসাব-নিকাশ মারাত্মকভাবে উল্টে দিয়েছে।#

 

 

advertisement