শাওয়াল ১৪৩৯   ||   জুলাই ২০১৮

আল্লাহ্র ওয়াস্তে ফিরে আসুন

হযরত মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী

আল্লাহ তাআলা কোনো সম্প্রদায়ের উপর হঠাৎ করে আযাব নাযিল করেন না। বিভিন্নভাবে প্রথমত বান্দাকে সতর্ক করেন। এরপরও যদি বান্দা গাফলতের ঘুম থেকে জাগ্রত না হয় তখন আসমান থেকে ভয়াবহরূপে নেমে আসে আল্লাহ্র আযাব। তখন আর কিছু করার থাকে না। জেগে উঠলেও কোনো লাভ হয় না। দুনিয়াতে যত মসিবত আছে তার সবকিছুই আমাদের বদ আমলীর ফল, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আসমানী সতর্কবার্তা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

وَ مَاۤ اَصَابَكُمْ مِّنْ مُّصِیْبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ اَیْدِیْكُمْ وَ یَعْفُوْا عَنْ كَثِیْرٍؕ.

যে বিপদ তোমাদেরকে স্পর্শ করে তা তোমাদের কৃতকর্মের ফল এবং আল্লাহ (তোমাদের) অনেক অপরাধ ক্ষমা করে দেন। -সূরা শুআরা (৪৬) : ৩০

আল্লাহ তাআলার আযাব বিভিন্নভাবে এসে থাকে। কখনো অভাব-অনটনরূপে, কখনো ঝগড়া-বিবাদরূপে, কখনো বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোক, মামলা-মুকাদ্দামারূপে। আবার কখনো জালেম শাসক, দুর্ভিক্ষ, মহামারী ইত্যাদিরূপে। বান্দার গুনাহ যেমন অসংখ্য তেমনি আল্লাহ তাআলার শাস্তির রূপও বিভিন্ন।

আযাবে ইলাহীর সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ হল যখন তা নিআমতের আকৃতিতে আসে। কারণ এক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষই ভুল করে। আল্লাহ্র শাস্তিতে গ্রেফতার হওয়ার উপলব্ধিই তার থাকে না। আল্লাহ তাআলার অবাধ্য হওয়ার পরও কেউ যদি সম্মান, সম্পদ, সুস্থতা এবং পার্থিব মান মর্যাদা ভোগ করে তাহলে বুঝতে হবে সে মূলত নিআমতরূপে আগত আল্লাহ্র শাস্তিতে গ্রেফতার হয়ে আছে। এক্ষেত্রে যেহেতু আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টির উপলব্ধি হৃদয়ে জাগ্রত থাকে না তাই তাওবা না করে, অনুতপ্ত না হয়ে  বান্দা অবাধ্যতা ও পাপাচারে আরো ডুবে থাকে। আল্লাহ তাআলার নিয়ম হল, ব্যক্তিগত কর্মের প্রতিদান ও শাস্তি ব্যক্তিগতভাবেই দিয়ে থাকেন। কিন্তু যখন গোটা সমাজ কিংবা সমাজের অধিকাংশ লোক নৈতিক অধঃপতন ও চারিত্রিক অবক্ষয়ের শিকার হয় তখন গোটা সমাজের উপর নেমে আসে খোদায়ী গযব। দু-চারজন  লোক যদি তখন ভালো থাকে কিন্তু পতনোম্মুখ সমাজের লাগাম টেনে ধরে ধ্বংসের গহ্বর থেকে তাদেরকে উদ্ধার করে কল্যাণ ও আলোর পথ দেখানোর কোনো চেষ্টা না করে তাহলে তারাও সে গযব থেকে নিস্তার পায় না।

বিষয়গুলো সামনে রেখে আসুন আমরা আমাদের সমাজকে একটু পর্যবেক্ষণ করি। নিঃসন্দেহে আমরা দেশের ও দেশের উন্নয়নের জন্য অনেক শিল্প-কারখানা বানিয়েছি। আকাশচুম্বি বিলাসবহুল দালান গড়ে তুলেছি। সড়ক, জনপথ ও আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ-ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছি। আর এইসকল ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে আল্লাহ্র বিধান পরিপন্থী পথই আমরা অবলম্বন করেছি, যদিও তা আল্লাহ্র বিধানের অনুসরণ করেও সম্ভব ছিল।

আমরা সুদি ঋণ নিয়ে কাল্পনিক উন্নতির স্রাতে গা ভাসিয়েছি। ব্যাংক খুলেছি, ইন্সুরেন্সের জাল বিছিয়েছি, থিয়েটার বানিয়েছি, টিভি স্টেশন ও সিনেমা হলে নগ্নতার পসড়া বসিয়েছি। মোটকথা আল্লাহবিমুখ পথভ্রষ্ট জাতির যা কিছু বৈশিষ্ট্য তার সবই আমরা নিজেদের মাঝে ধারণ করেছি। আমরা কখনো নবীজীর জীবন ও চরিত্র, নবীজীর আখলাক ও আচরণ এবং মাদানী সমাজ-সভ্যতা, মাদানী রাজ্যনীতির দিকে চোখ তুলেও তাকইনি। ধর্মবিদ্বেষী, পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্ত পশ্চিমা জাতিবর্গের চিন্তানৈতিক দাসত্বই যেন আমাদের গর্বের বিষয়। আমরা জুয়া, মদ, গানবাদ্যের ক্ষেত্রে অন্যদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উন্মাদ প্রতিযোগিতায় নেমেছি। নারীদেরকে উলঙ্গ করেছি। চারিত্রিক অধঃপতনের মেলা বসিয়েছি। গায়ক দলের গলায় মালা দিয়ে তাদের স্বাগত জানিয়েছি। নগ্নতা ও অশ্লীলতার প্রসারে লক্ষ-কোটি টাকা খরচ করেছি। প্রতিটি ঘর থেকে এখন নাচ-গানের সুর ভেসে আসে। বাজার-ঘাটে উলঙ্গ-অর্ধউলঙ্গ নারীদের অঙ্গপ্রদর্শনের মেলা বসে। কুফর ও নাস্তিকতার ধারকেরা বুক ফুলিয়ে চলে। আমরা সবকিছুই করেছি। সত্যের গলা টিপে ধরে মিথ্যার জয়গান গেয়েছি। ঘুষের বাজারকে গরম করেছি। ন্যায়কে অন্যায় আর অন্যায়কে ন্যায় বানানোর জন্য সব ধরনের কূটচাল চেলেছি। জালেমদের কুর্ণিশ করে গরীব, মজদুর ও মজলুমের সম্পদ ছিনিয়ে  তাদেরকে পায়ের নিচে পিষে ফেলেছি। মসজিদ বিরান করে সিনেমা হল আবাদ করেছি। আল্লাহ্র ওয়াস্তে বলুন, আল্লাহ্র শাস্তিকে ত্বরান্বিতকারী কোন্ পাপকর্মটি আমরা করিনি? এরপরও কি আমরা পাপাচারে লিপ্ত এ অন্ধকার জীবনে খোদায়ী রহমতের শুভ্র শিশির নেমে আসার দিবাস্বপ্ন দেখি?

আল্লাহ তাআলার নিয়ম-নীতি অলঙ্ঘণীয়। যে বিষ খাবে সে মারা যাবে। যে আগুনে ঝাঁপ দেবে সে জ¦লেপুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আর যে জাতি খোদার অবাধ্য হয়ে বিদ্রোহের পথে চলবে তার উপর খোদায়ী গযব নেমে আসবে।

আজ কৃতকর্মের ফল আমরা ভোগ করছি। শান্তি যেন আজ সোনার হরিণ। কৃষক, শ্রমজীবী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, দোকানদার কারো মনে শান্তি নেই। সুখের স্পর্শ নেই। হৃদয়ের সবুজ বাগানে যেন চৈত্রের খরা। সবকিছু থেকে বরকত উঠে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। সাধ ও সাধ্যের মাঝে কোনো সামঞ্জস্য নেই। দুর্ঘটনার যেন প্লাবন নেমেছে। হাসপাতালে ও আদালতে গিয়ে একটু দেখুন, মনে হবে পুরো শহরবাসী এখানে এসে ভিড় জমিয়েছে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, অপহরণ এবং আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতির কারণে জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু কোনো কিছুরই আজ নিরাপত্তা নেই।

কিন্তু আফসোস! আমরা এখনো প্রবৃত্তির পূজায় আকণ্ঠ ডুবে আছি। কোনো ঘটনার প্রবল ঝাঁকুনিও মুসলমানদের গাফলতের ঘুম ভাঙ্গাতে পারছে না। উপদেশ গ্রহণ করার জন্য কোনোভাবেই চোখ মেলে তাকাচ্ছে না। এ অবস্থা খুবই হৃদয়বিদারক, হতাশাব্যঞ্জক। আল্লাহ তাআলা গোটা জাতির উপর রহম করুন।

সমাজের ছোট-বড় সবার কাছে হাত জোড় করে মিনতি করছি, আল্লাহ্র ওয়াস্তে আল্লাহ্র আযাবকে আর টেনে আনবেন না। শরয়ী পর্দা করা ফরয। বেপর্দা, অর্ধনগ্ন হয়ে রাস্তা-ঘাটে বের হওয়া ইসলামী শরীয়ত ও ইনসানী গায়রত উভয় দিক থেকেই কবীরা গুনাহ। এই ধারা বন্ধ করুন। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা সকল অশ্লীলতার মূল। আর গান-বাদ্য এ অশ্লীলতার ইন্ধন! আল্লাহ্র ওয়াস্তে এ থেকে বিরত হোন। রেডিও-টেলিভিশন ইত্যাদির লা‘নত গোটা সমাজের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে বের করুন। আযাবে এলাহীর প্রবল স্রােত আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। তা থেকে বাঁচার একটিই মাত্র উপায়। তা হচ্ছে নিজের জীবনে পরিবর্তন আনুন। আল্লাহ্র দরবারে সমর্পিত হোন। আহকামে এলাহীর পাবন্দি করুন। অশ্লীলতার আড্ডা বন্ধ করে আল্লাহ্র ঘরকে আবাদ করুন।

ইয়া আল্লাহ! এই দেশ, এই জাতির উপর দয়া করুন। ইয়া আল্লাহ! আমাদের সকল ভুলভ্রান্তি ও গোনাহ ক্ষমা করে দিন। আমাদেরকে আপনার আযাব ও গযব থেকে হেফাযত করুন।

অনুবাদে : মুহাম্মাদ শাহাদাত ছাকিব

 

 

 

advertisement