শাওয়াল ১৪৩৩   ||   সেপ্টেম্বর ২০১২

ইতিহাসের এক ঝলক

মুহাম্মাদ মুনীরুল ইসলাম

আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগের কথা। তখনকার যামানা ছিল ইলমের যামানা। ছিল আমলের যামানা। সেই যামানায় ইলমের যথেষ্ট কদর ছিল। মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এসে ইলম হাসিল করত। যদি সন্ধান পেত, অমুক স্থানে ইলম আছে বা আছে একটি হাদীসের টুকরা, তখন ছুটে যেত সেই ইলমের খোঁজে, সেই হাদীসের অন্বেষণে।

সে যামানায় দরসের আসনে সমাসীন থাকতেন উস্তাদ। আর তাঁর পাশে মৌমাছির ন্যায় ভীড় জমাত ছাত্র। মৌমাছি যেমন মধুর জন্য ঘুরে বেড়ায় ফুলে ফুলে। তারা ঘুরে বেড়াত ইলমের জন্য ছাহিবে ইলমের চারদিকে। উস্তাদগণ একদিকে ছিল ইলমের খাযানা, অপর দিকে আমলের দরিয়া। হযরত শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা রাহ. ছিলেন তাদেরই একজন।

তিনি ছিলেন ইয়ামেনের অধিবাসী। আনুমানিক ১২৭৭ ঈসায়ী সালে তিনি দিল্লীতে আগমন করেন। উদ্দেশ্য ছিল দ্বীন প্রচার করা। তখন ছিল গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমল। লোকজন আল্লাহর এই ওলীর আগমনে সীমাহীন আনন্দিত হলো। সকলেই ভীড় জমাতে লাগল তাঁর দরবারে। এভাবে তাঁর জনপ্রিয়তা একপর্যায়ে বাদশাহর প্রসিদ্ধি ও প্রভাবকেও অতিক্রম করল। অবস্থা বেগতিক দেখে গিয়াসউদ্দিন বলবন হযরত আবু তাওয়ামাকে অনুরোধ করে পাঠিয়ে দেন বাংলায়। তিনি বাংলায় এলেন। এলেন সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা সবুজ বাংলার ভূমিতে। শুরু করলেন ইলমের খেদমত আর দীনের প্রচার। বাংলায় চালু হল ইলমে হাদীসের মারকায।

ঐতিহাসিকদের মতে এটাই হলো উপমহাদেশের ইলমে হাদীসের প্রথম দিককার শিক্ষাকেন্দ্র বা মাদরাসা। যারা অবস্থান প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ অন্তর্গত মোগড়াপাড়া গ্রামে। ধারণা করা হয় তখন ঐ মাদরাসার ছাত্র সংখ্যা ছিল দশ হাজার। তারা সেখানে কুরআন শিখত, শিখত হাদীসে রাসূলের ইলম। আর তারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন ঘটাতো। কিন্তু কালের আবর্তনে হারিয়ে যায় সেই ঐতিহ্য। আর হারিয়ে যান আমাদের উস্তাদ আবু তাওয়ামার দাস্তান। আল্লাহ তার রূহের উপর রহম করুন। তিনি দীর্ঘ ২৩ বছর ইলমে দীনের খেদমত করার পর ১৩০০ সালে সাড়া দেন প্রভুর ডাকে। তিনি চলে যান। কিন্তু একা নয়। সাথে নিয়ে যান তাঁর ইলমের মারকাযও। যতদূর জানা যায় তাঁর মৃত্যুর পর ঐ মাদরাসার স্থায়িত্ব বেশি দিন ছিল না। একসময় তা পরিণত হয় মানুসের আবাসস্থলে। মুছে যায় বাংলার বুক থেকে একজন শায়েখের নাম। সেই সাথে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক মাদরাসাও।

ইতিহাস বিখ্যাত পর্যাটক, অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, শায়খ ইবনে বতুতা রাহ.। তিনি সমগ্র জগত সফর করেছেন। তিনি ছিলেন মরক্কোর অধিবাসী। বাংলায় আগমন করেন ১৩৪৫ সালে। তখন বাংলায় শাসন করতেন সুলতানরা। বাংলায় তখন ফখরুদ্দীন মোবারাক শাহের রাজত্ব। ইবনে বতুতা বাংলায় আগমন করে মুগ্ধ হন। অভিভূত হন রাববুল আলামীনের অপার কুদরতের নিদর্শন দর্শন করে। তিনি বাংলাকে, বেহেশত পুর নেয়ামত তথা ধন-সম্পদের পূর্ণ স্বর্গ বলে অভিহিত করেন। বাংলার অপরূপ দৃশ্যের দেখা মিলে তাঁর লিখিত রেহালায়ে ইবনে বতুতা গ্রন্থে।

আবু তাওয়ামা রাহ.-এর সেই মাদরাসা ও দরসগাহের কথাও তিনি তুলে ধরেছেন আসহাবে সুফ্ফার মত করে। একসময় তিনিও চলে গেলেন। শুধু রেখে গেলেন আমাদের মাঝে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত রেহালায়ে ইবনে বতুতা। চলে গেলেন আমাদের কাছ থেকে আবু তাওয়ামা। চলে গেলেন ইবনে বতুতাও। আল্লাহ তাঁদের রূহে শান্তি বর্ষণ করুন। আমীন।

প্রায় ৭০০ বছর হয়ে গেল। হঠাৎ গর্জে উঠল চেপে থাকা সেই ইতিহাস। গর্জে উঠল আবু তাওয়ামার ইতিহাসের প্রতীক্ষায়। হযরত আবুল হাসান আলী মিয়া নদভী রাহ.। অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। মুসলিম উম্মাহ আজও তাকে স্মরণ করে শ্রদ্ধার সাথে।

ইতিহাসবেত্তা ও ইতিহাস বিশ্লেষক হওয়ায় ইতিহাস সংক্রান্ত বই অধ্যয়ন ছিল তাঁর অভ্যাস।  এ হিসেবে ইবনে বতুতার রেহালাও তার চোখের আড়ালে থাকেনি। শুরু করলেন অধ্যয়ন। হারিয়ে গেলেন সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যমলা বাংলার ভূমিতে। হঠাৎ তিনি যেন সন্ধান পেলেন এক অজানা ইতিহাসের। যা তাকে প্রতিষ্ঠিত করল একজন নুতন তালিবুল ইলম হিসেবে। তিনি খুঁজে পেলেন রেহালায় বর্ণিত ঐ মাদরাসার কথা। আর অন্তরে অনুভব করলেন তার কদর। হারিয়ে গেলেন এক অজানা আলোর ভুবনে। অতঃপর তিনি সোচ্চার হলেন। এগিয়ে এলেন অনুসন্ধানে। আবু তাওয়ামা রাহ. যেন তাঁকে আদর করে ডেকে পাঠালেন। আলী  নদভী রাহ. এলেন বাংলায়।

হিন্দুস্তান থেকে এলেন সোনারগাঁয়। তিনি এলেন ইতিহাসের টানে। ইলমের সন্ধানে। খুঁজে বের করলেন  সেই স্থান, যেখানে হয়েছে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম দরসুল হাদীস, যার ইতিহাস ঐতিহ্যের, যার ইতিহাস গৌরবের।

তিনি এলেন হযরতের কবরের পাশে। যিয়ারত শেষে দাঁড়ালেন মোনাজাতে। নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। ছেড়ে দিলেন চোখের জল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন হযরত নদভী রাহ.। দীর্ঘক্ষণ মোনাজাত করলেন। তাঁর অবেগ ও অবস্থার গভীরতা থেকে  তিনি যেন বলে উঠেলেন- হযরত! আমরা দুঃখিত। অমরা ব্যথিত। আপনি আমাদের ক্ষমা করুন। আমরা আপনার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারিনি। পারিনি দিতে আপনার কীমাত আর আযমাত। আমাদের ক্ষমা করবেন।

অতঃপর তিনি সেখানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করলেন। ৭০০ বছরের পুরানো সেই জীবন্ত মাদরাসারই একটি স্মারক। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন- আমি তো একদিন থাকব না। যেমন নেই শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা। নেই শায়খ ইবনে বতুতা। আল্লাহ তাদের রূহের উপর অসংখ্য রহমত বর্ষণ করুন। আল্লাহ তাআলা যেন আবু তাওয়ামা রাহ.-এর হাতে গড়া মাদরাসার স্থানটিতেই গড়ে তুলেন আরেকটি হাদীসের দরস। মৌমাছির মত ত্বলাবারা যেন সেখানেও ভীড় জমাতে থাকে। পুণ্যবাণীর গুঞ্জরণে মুখরিত হয় চারদিক। আলোকিত হয়, জীবন্ত হয়, সোনারগাঁর মৃত ভুবন। 

 

 

advertisement