যিলহজ্ব ১৪৩০   ||   ডিসেম্বর ২০০৯

কওমী মাদরাসা এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ : কিছু কথকতা

অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

এ দেশের ঐতিহ্যবাহী কওমী মাদরাসার বিরুদ্ধে বিষোদগারের এক সুগভীর চক্রান্ত নতুনভাবে শুরু হয়েছে। এ চক্রান্তের নেটওয়ার্ক সুবিস্তৃত ও সুসংগঠিত। আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী অক্ষশক্তি হচ্ছে এ চক্রান্তের মূল। তাদের বৃত্তিভোগী এজেন্টরা সুকৌশলে কুর’আন ও হাদীসের শিক্ষার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছে। এসব এজেন্টরা সরকারের অভ্যন্তরে, বিরোধী দলে, প্রশাসনে, বেসরকারী সেবা সংস্থায়, সংবাদপত্রে ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমানভাবে সক্রিয় থেকে অভিন্ন ভাষায় কথা বলছেন এবং একই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন নানা অজুহাত খাড়া করে। এনজিও সমর্থিত বেশ ক‘টি সংবাদপত্র তিলকে তাল করে এবং তালগোল পাকিয়ে তথ্য সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে, যাতে জনমত বিভ্রান্ত হচ্ছে। বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট এনজিওগুলো প্রকৃত অর্থে কোনো সরকারেরই বন্ধু নয়; সরকারকে ব্যবহার করে নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাই হচ্ছে তাদের কর্মকৌশল। ভোলার গ্রীন ক্রিসেন্ট এনজিও প্রতিষ্ঠানকে কওমী মাদরাসা নামে প্রতিষ্ঠিত করার যে আয়োজন চলেছিল তা ছিল একই ষড়যন্ত্রের অংশ বিশেষ। ব্রিটেনের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত গ্রীন ক্রিসেন্ট এনজিও কার্যালয় যে আদৌ কোন কওমী মাদরাসা নয় এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। সরকার, সরকারী এজেন্সীসমূহ যে কোন দিন, যে কোন সময়, বাংলাদেশের যে কোন কওমী মাদরাসা পরিদর্শন করতে পারেন, তাদের সার্বিক কর্মকান্ডও মনিটর করতে পারেন। কেবল এক শ্রেণীর বিদ্বিষ্ট সংবাদপত্রের কল্পিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কওমী মাদ্রাসাকে টার্গেট করলে সরকার ও জনগণের মধ্যে অহেতুক দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যাবে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর পরই উত্তর ভারতের দেওবন্দ কেন্দ্রিক যে দ্বীনি শিক্ষাধারা চালু হয়েছিল এখন তা এ উপমহাদেশসহ গোটা দুনিয়ায় কওমী মাদরাসা শিক্ষা নামে বেশ সুখ্যাতি লাভ করে। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই এ শিক্ষা ধারার উদ্দেশ্য ছিল নিরক্ষরতা দূরীকরণ, ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার, জান্নাতমুখী জনগোষ্ঠী তৈরীকরণ, সামাজিক কুসংস্কার ও কুপমন্ডুকতা বিদূরিকরণ ও ব্যক্তি চরিত্র সংশোধন। প্রচলিত ও দলীয় রাজনীতির প্রভাব বলয় থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে কওমী মাদরাসার পরিচালক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ পবিত্র কুরআন, হাদীস, ফিক্হ, ভাষা-সাহিত্য, ক্লাসিক্যাল দর্শনের শিক্ষা ও খিদমত সুচারূরূপে আঞ্জাম দিয়ে আসছেন শত বছর ধরে। বাংলাদেশের বিগত ৩৮ বছরের ইতিহাসে কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী কোন কর্মকান্ডে বা সন্ত্রাসী কোন তৎপরতার সাথে জড়িত থাকার কোন প্রমাণ নেই। কওমী মাদরাসা শিক্ষার সুদীর্ঘ ইতিহাসে খুন-খারাবী, টেন্ডার বা চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের ন্যুনতম কোন নজির নেই। এসব মাদরাসায় রাজনীতিভিত্তিক কোন ছাত্র সংসদ নেই এবং ছাত্রদের দলীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততাও একপ্রকার নিষিদ্ধ। ফলে এখানে বিরাজ করে রাজনীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত সুষ্ঠু শিক্ষার শান্ত পরিবেশ। সুতরাং মাদরাসায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের পরিকল্পনার প্রশ্নই অবান্তর। আর সন্ত্রাসের আওতায় পড়ে এমন ঘটনা কোথাও ঘটলে তা নিশ্চিতভাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং এর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই দায়ী। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কেউ যদি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মতো অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে এবং অভিসন্ধি চরিতার্থ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের চেষ্টা চালায়, সে দায় কোন মাদরাসা নিতে পারে না। এ ক্ষেত্রে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে বা সব মাদরাসাকে ঢালাওভাবে দায়ী করাও যুক্তি সংগত নয়। সত্যিকারের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ অবদমনে সরকারকে সহযোগিতা করতে এ দেশের ওলামা-মাশায়েখগণ সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত বলেই বার বার প্রমাণিত। স্মর্তব্য যে, কওমী মাদরাসারসমূহ পরিচালিত হয় মূলত এ দেশের জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অর্থায়নে; সরকারী কোন অনুদান তাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে গ্রহণ করেন না। এদেশের কোটি কোটি জনগণের সাথে কওমী মাদরাসার প্রাণের সম্পর্ক বিদ্যমান। কওমী মাদরাসা থেকে পাশ করা ছাত্ররা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরাপের সরকারী-বেসরকারী পদে, মসজিদ, মাদরাসা পরিচালনায়, দাওয়াত-তাবলীগে, সমাজ সংস্কারে, নিরক্ষরতা দূরিকরণে এবং শিক্ষা বিস্তারে গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখে চলেছেন। কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা ঈমানী চেতনা, মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ও দেশপ্রেমের আদর্শে প্রবলভাবে উদ্দীপিত। দাওয়াতী মেযাজ সবার মধ্যে কমবেশী ক্রিয়াশীল। আমার ব্যক্তিগত প্রবল অনুমান যে, বর্তমান সরকার ও কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তৃতীয় একটি শক্তি সক্রিয়। প্রকাশ্য ও নেপথ্য চক্রান্তের মূল হোতা হচ্ছে এক শ্রেণীর এনজিও। তারা সমান্তরাল একটি সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় এবং বিনষ্ট করতে চায় সরকারের ভাবমূর্তি, কারণ এনজিওগুলো এদেশের এনজিও ব্যুরোতে নিবন্ধিত হলেও তাদের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে আন্তর্জাতিক ইহুদি-খ্রিষ্টান-সাম্রাজ্যবাদী অক্ষ শক্তি। এ দেশের মানুষ ভালভাবে জানেন যে, মাদরাসায় চরিত্রবান ও আদর্শ ছাত্র তৈরী হয়। মাদ্রাসায় শিক্ষার সাথে দীক্ষার (তারবিয়ত) ব্যবস্থা আছে, যা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। মাদরাসায় ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকায় কোন ছাত্রসংসদ নেই। ফলে সংগত কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে হানাহানিও নেই। রাজনৈতিক হাঙ্গামা বা সন্ত্রাসের কারণে এদেশের কোন মাদরাসা একদিনের জন্য বন্ধ হয়নি। অথচ এদেশের হাতেগোনা কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া কমবেশি সব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় মিনি ক্যান্টনমেন্টে রূপান্তরিত হয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন সময় বন্ধ থাকায় প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট সৃষ্টি এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হাজারো টগবগে মেধাবী তরুণ নৃশংসভাবে প্রাণ হারিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ধর্ষণ জাতির কপালে কলংকের তিলক রেখা অংকিত করেছে। সামপ্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে যেভাবে অস্ত্রের মহড়া চললো এবং প্রাণহানি ঘটলো তাতে পুরো জাতি উদ্বিগ্ন হয়েছে। এতদসত্ত্বেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের কোন দাবি কেউ উঠায়টি। তাই সাজানো কিছু নাটক, পাতানো কিছু খেলা ও কল্পিত তথ্যকে ভিত্তি করে কিংবা অতি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনার সূত্র ধরে মাদরাসা বন্ধের দাবি তোলা রীতিমত হাস্যকর ও উদ্ভট। এদেশে দ্বীনি শিক্ষার বিরুদ্ধে যে চক্রটি সক্রিয়, বিশেষত এনজিও গোষ্ঠী, তারা তাদের এজেন্টদের সহায়তায় এবং নিজস্ব সংবাদপত্রের মাধ্যমে সরকারকে প্ররোচিত করছে, যাতে সরকার মাদরাসার বিরুদ্ধে দমননীতি জোরদার করে এবং নেতিবাচক সিদ্ধান- গ্রহণ করে। সরকারের প্রশাসন যন্ত্রে বা নীতি নির্ধারক মহলে এনজিও সমর্থক যেমন আছেন, তেমনি দ্বীনি শিক্ষাকে মোহাব্বত করেন এমন ব্যক্তিরও আশা করি অভাব নেই। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার প্রকৃত সত্য অনুধাবন এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সেন্টিমেন্ট ও আবেগের দিকে লক্ষ্য রেখে দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষার পরিপন্থী কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না। কারণ এটা বুমেরাং হওয়ার আশংকা আছে। দ্বীনি শিক্ষার বিকাশধারায় সরকার যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন অবদান রাখতে পারেন, তাহলে এটা হবে তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু কায়েমী স্বার্থবাদীদেরকে মাদরাসার বিরুদ্ধে বিষোদগার অব্যাহত রাখার সুযোগ দিলে পরিস্থিতি আক্ষেপ, ক্ষোভ ও বেদনার মিলিত সংকট মোহনায় চলে যেতে পারে, এমন আশংকা অমূলক নয়। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ ইস্যুর মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীরা সরকারকে অকার্যকর এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করার খেলায় মেতে উঠেছে, এ কথাটি সরকারকে মাথায় রাখতে হবে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখণ্ডতার চেতনাকে দৃঢ়ভাবে লালনের মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষাই সত্যিকারের মানুষ গড়ে তোলার আদর্শ শিক্ষাঙ্গন। মাদরাসাগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ, সামাজিক দায়িত্ব পালন, ধর্মীয়, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়া হয়। নৈতিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে সুনাগরিক উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে কওমী মাদরাসাগুলোর রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। বর্তমানে কওমী মাদরাসার ওপর যে সব বহুমূখি বিষোদগার হচ্ছে তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন গোটা দেশ জুড়ে প্রতিনিধিত্বশীল কওমী মাদরাসার একটি অরাজনৈতিক সংগঠন, যে প্লাটফরমের মাধ্যমে নিয়মিত সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সংলাপ, কর্মশালা করে নিজেদের অবস্থান জনসমক্ষে তুলে ধরা যেতে পারে। এতে এ বিষয়ক অজ্ঞতা ও বিভ্রানি- যেমন দূর হবে তেমনি আন্তরিকতা বাড়বে। সামাজিক ও সেবামূলক বিভিন্ন প্রোগ্রামে মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের সংযুক্তি বাড়াতে হবে। স্থানীয় ছোট ছোট বৈধ উপলক্ষগুলোতেও মাদরাসার পক্ষ থেকে ইতিবাচক অংশগ্রহণ বজায় রাখার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। আধুনিক শিক্ষিত ও সাধারণ জনগণকে এ সংগঠনের মাধ্যমে অথবা ব্যক্তিগত যোগাযোগ দ্বারা কওমী মাদরাসার প্রতি আরো সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল করে গড়ে তোলা যাবে। সুচিন্তিত পন্থায় এসব প্রোগ্রামের সঙ্গে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করা গেলে মাদরাসার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন স্বার্থান্বেষী মহল রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হবে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সাথে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রকার যোগাযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং বাড়িয়ে তুলতে হবে। সাংবাদিকদের মধ্যে বহু দ্বীন দরদী ব্যক্তি আছেন যারা আলেম-উলামা ও মাদ্রাসাকে মুহাব্বত করেন; কিন্তু যোগাযোগের অভাবে গ্যাপ তৈরী হয়ে আছে। এ গ্যাপ যত তাড়াতাড়ি দূর করা সম্ভব হবে ততই মঙ্গল। ইতিবাচক সব কাজ ও লক্ষ্যের সঙ্গে মিডিয়াও কিছুটা অনূকুলে থাকলে আগ্রাসীদের অপতৎপরতা রুখে দেওয়া ইনশাআল্লাহ কোনো কঠিন ব্যাপার হবে না।

 

advertisement