শাওয়াল ১৪৩৮   ||   জুলাই ২০১৭

নতুন শিক্ষাবর্ষের সূচনা : প্রয়োজন সঠিক বোধ ও একনিষ্ঠ নিমগ্নতা

অনেকেরই জানা আছে যে, কওমী মাদরাসায় শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় শাওয়াল থেকে আর সমাপ্ত হয় শা‘বানের মাঝামাঝিতে সালানা ইমতিহানের মাধ্যমে। শাওয়াল থেকে রমযান হচ্ছে কওমী মাদরাসার শিক্ষাবর্ষ। যদিও হিজরী ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মুহাররম আর শেষ মাস যিলহজ্ব, কিন্তু মাহে রমযানের বিশেষ ব্যস্ততা ও মগ্নতার কারণে কওমী মাদরাসার শিক্ষাবর্ষ শাওয়ালে শুরু হয়ে শা‘বানের মাঝামাঝিতে শেষ হয়। এ কারণে হিজরী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শিক্ষাবর্ষ নির্দেশ করতে দুটো বর্ষের উল্লেখ করা হয়। যেমন বর্তমান শিক্ষাবর্ষটি হচ্ছে ১৪৩৮-৩৯হি. শিক্ষাবর্ষ। অর্থাৎ আটত্রিশের শাওয়ালে শুরু আর ঊনচল্লিশের শা‘বানে শেষ।

কওমী মাদরাসায় নতুন শিক্ষাবর্ষের সূচনা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমাদের দ্বীনী ইলমের চর্চা ও পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একটি শিক্ষাবর্ষের শুরু অর্থ দ্বীনী ইলমের চর্চায় একটি প্রজন্মের এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া এবং পরবর্তী ধাপ অতিক্রমের চেষ্টায় নিয়োজিত হওয়া। কাজেই মাদরাসার তলাবা-আসাতিযার জন্য তো বটেই, এই দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগী-শুভাকাক্সক্ষীদের জন্যও তা বিশেষ আনন্দের ও উদ্দীপনার।

নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এতদঞ্চলে সহীহ দ্বীনী ইলমের বিস্তারে কওমী মাদরাসাগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। আর তাই এইসকল দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের স্থিতি ও সুরক্ষা এবং উন্নতি ও অগ্রগতি এই জাতির দ্বীন ও ঈমানের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ।

একটি শিক্ষাবর্ষের সূচনা সত্যিকারের তালিবে ইলমের জন্য অনেক কিছু। এই শিক্ষাবর্ষের যথার্থ মূল্যায়নের উপর নির্ভর করছে তার ইলমী ও দ্বীনী জীবনের আশু উন্নতি।

এ কারণে প্রতি শিক্ষাবর্ষের শুরুতে একজন তালিবে ইলমের কর্তব্য, বিগত বর্ষের মুহাসাবা আর বর্তমান শিক্ষাবর্ষের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিক উপলদ্ধি। অর্থাৎ বিগত শিক্ষাবর্ষে যতটুকু যোগ্যতা অর্জন কাম্য ছিল তা অর্জিত হয়েছে কি না আর বর্তমান শিক্ষাবর্ষে কী কী বিষয়ে কতটুকু যোগ্যতা তাকে অর্জন করতে হবে- এই চিন্তা-ভাবনা অতি প্রয়োজন।

কওমী মাদরাসার পড়াশোনার প্রধান উদ্দেশ্য, পঠিত বিষয়ে কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জিত হওয়া আর চিন্তা ও হৃদয়ের এবং স্বভাব ও আচরণের গঠন ও পরিশুদ্ধির পথে বাসীরাতের সাথে অগ্রসর হওয়া। বছরের শেষে যেমন এই সকল বিষয়ে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত মুহাসাবা প্রয়োজন তেমনি বছরের শুরুতে প্রয়োজন এই সকল ক্ষেত্রে নিজ অবস্থান চিহ্নিত করে অগ্রসরতার নতুন সংকল্প ও নব উদ্দীপনা। কুরআন মাজীদে রাত-দিনের গমনাগমন থেকে শিক্ষাগ্রহণের যে নির্দেশনা রয়েছে তা আমাদের শিক্ষাবর্ষের শুরু-শেষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ এই শুরু-শেষও তো রাতদিনের গমনাগমনেরই একটি স্মারক।

ভবিষ্যতের উন্নতির জন্য বর্তমানকে কাজে লাগানো অতি জরুরি। বর্তমানকে কাজে না লাগিয়ে ভবিষ্যতের উন্নতির চিন্তা অর্থহীন। এই কথাটা দিন, সপ্তাহ, মাসের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, বর্ষ ও শিক্ষাবর্ষের ক্ষেত্রেও সত্য। আমাদের গোটা জীবনের ক্ষেত্রেও সত্য। বর্তমানকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েই ভবিষ্যতের সফলতা আশা করা যায়।

তদ্রƒপ আল্লাহ তাআলার এক সাধারণ ব্যবস্থা এই যে, অর্জনযোগ্য বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে অর্জিত হয়। একটি পর্যায় অতিক্রম করলেই কেবল পরবর্তী পর্যায়ে উন্নীত হওয়া যায়। এদিক থেকেও বর্তমানের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া কাম্য। আর তাহলেই শুধু ভবিষ্যতের কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হবে।

সচেতন আলিমমাত্রই জানেন, আমাদের দ্বীনী কর্মের অঙ্গন কত বিস্তৃত। কত অঙ্গনে কত প্রকারের কাজ প্রয়োজন। আর বলাই বাহুল্য, কাজের জন্য প্রয়োজন যোগ্য কর্মীর। এই যোগ্যতা ঈমানী ও আমলী যোগ্যতা, ইলমী ও খুলুকী যোগ্যতা এবং ফিকরী ও কলবী যোগ্যতা। এই সকল যোগ্যতা ছাড়া দ্বীনী কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এ থেকে বোঝা যায়, ইলম অন্বেষণের সময়টা ইলমী মানহাজের কাজে কত বেশি নিমগ্নতা ও একনিষ্ঠতা দাবি করে।

বর্তমান শিক্ষাবর্ষটিও তালিবানে ইলমের সেই প্রস্তুতিকালেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একে পূর্ণ নিমগ্নতার সাথে কাজে লাগানো অতি জরুরি। তালাবা-আসাতিযা প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত-কর্তব্য সঠিকভাবে উপলদ্ধি করে আমানতদারির সাথে তা পালনে নিয়োজিত হওয়া দ্বীনী কাজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের এক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।

এই দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষকেও উপলদ্ধি করতে হবে যে, দ্বীনী ইলমের চর্চা ও পঠন-পাঠনে রত এই গোষ্ঠীটি এই জাতির অংশ। দ্বীনী শাস্ত্রসমূহে সুবিজ্ঞ এক জামাতের উপস্থিতি জাতির এক ফরয দায়িত্ব। পার্থিব নানা ব্যস্ততা ও হাতছানি উপেক্ষা করে যে জামাতটি দ্বীনী ইলমের চর্চায় মগ্ন হয়েছেন তারা শুধু নিজেদের কর্তব্যই পালন করছেন না, এই জাতির তরফ থেকে একটি ফরযে কিফায়া দায়িত্বও পালন করছেন। এরাঁ না করলে অন্যদের তা করতে হত। কাজেই এই জামাতটি যাতে এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে জাতিকে দায়মুক্ত করতে পারেন- এই চিন্তাটা এই জাতির থাকতে হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেন দ্বীনী ইলমে সুবিজ্ঞ একটি জামাত এবং দ্বীনী খিদমতের বিভিন্ন অঙ্গনে কাজের যোগ্যতাসম্পন্ন একটি কর্মী-বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হয় এজন্য আল্লাহর দরবারে দুআ ও রোনাযারি যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা। এটা তাদের অব্যাহত রাখতে হবে।

কওমী মাদরাসার একটি শিক্ষাবর্ষের সূচনা সত্যিকার অর্থেই জাতির দ্বীন ও ঈমানের হেফাযত ও তারাক্কির সাথে সংশ্লিষ্ট একটি ব্যাপার। শান্তি, শৃঙ্খলা, পবিত্রতা ও নির্মলতার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করা এবং সেই উপলব্ধির দাবি পূরণ করাও তাই অতি প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

advertisement