যিলকদ ১৪৩৭   ||   আগস্ট ২০১৬

উম্মাহ : দুষ্কৃতির গোষ্ঠীসূত্র

খসরূ খান

তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের খবর এখন বাসি। কিন্তু সে অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার কারণ এবং পরবর্তী সময়ের সিদ্ধান্তগুলো এখনও আলোচনায় তাজা। দেশে দেশে টেবিলে টেবিলে সেই আলোচনাই ঘুরে ফিরে আসছে। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামরিক কর্তৃত্বে ওই দেশটি বাঁধা পড়ে গিয়েছিল। বিশেষত তুর্ক-গাদ্দার কামাল পাশার পর থেকে এটাই নাকি সেখানকার নিয়তি হয়ে গিয়েছিল। উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতা বা ইসলামবিমুখ আধুনিকতার পরিপন্থী কেউ ক্ষমতায় এলে কিছু দিনের মধ্যেই তাকে ফেলে দেয়া হতো। বৈধ সরকার-খেদানো সেই অন্ধকার অভিযানে সামনে থাকতো ওই দেশটির সামরিক বাহিনী। পেছনে থাকতো রাষ্ট্রের আরো কিছু খুঁটি এবং অঙ্গ। সবাই মিলে শুরু করতো একটি উল্টোযাত্রা। বড় বড় রাষ্ট্রের হাসিমুখ হাততালিতে সেই উল্টোযাত্রাকেই সফল করে তোলা হতো।

তবে এবার সব বিগড়ে গেল। ১৫ জুলাই শুক্রবার রাতের সামরিক অভিযান ব্যর্থ হলো। লাখ লাখ নিরস্ত্র জনগণ পথে নেমে সামরিক বাহিনীর অনিয়মতান্ত্রিক যাত্রা থামিয়ে দিল। বর্তমান সময়ের পৃথিবীতে এ এক দৃষ্টিকাড়া দৃষ্টান্ত। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পরও থমথমে ভাব কাটতে সময় লেগেছে প্রায় তিনদিন। এক অর্থে এখনো পুরো শান্ত অবস্থা তুরস্কে ফিরে আসেনি। ঘটনাচিত্রে তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকেই পরিস্থিতি উত্তরণে শুরু হয়েছে বিভিন্ন বাহিনী ও ক্ষেত্র থেকে অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত কয়েক হাজার লোককে বহিষ্কারের ঘটনা। এরইমধ্যে অনেককে গ্রেফতারও করা হয়েছে। পুলিশ ও সামরিক বাহিনী থেকে হাজার হাজার লোককে বরখাস্ত করা হয়েছে। আর এর সঙ্গেই এসেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনের ওপর সরকারি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রাসঙ্গিক ও শিক্ষণীয় খবর।

অভ্যুত্থান ঘটনার দুদিনের মাথায় কয়েক হাজার বিচারককে বরখাস্ত করে তাদের কয়েকশ জনকে গ্রেফতার করে তুরস্ক সরকার। তুরস্কের সরকারি গণমাধ্যম জানায়, অবৈধ অভ্যুত্থান চেষ্টাকারী সেনাকর্মকর্তাদের সঙ্গে এসব বিচারকদের আগে থেকেই যোগসাজশ ছিল। নির্বাচিত সরকার সরিয়ে দেয়ার এই অবৈধ সশস্ত্র অভ্যুত্থানকে বৈধতা দেওয়াসহ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছিল হাজার হাজার বিচারক। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় ব্যর্থ হয় বিচারকদের ষড়যন্ত্রও। তাই তাদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালায় এরদোগান সরকার। একই সঙ্গে তুরস্কের ২৪টি রেডিও ও টিভির লাইসেন্স বাতিল করে দয়া হয় ঘটনার চার দিনের মাথায়। তুরস্কের গণমাধ্যমের বড় এই অংশটিও সেনা অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে তথ্য পাওয়া যায়। প্রকাশ হয় যে, বন্দুকের নল সেনাবাহিনীর হাতে দিয়ে বিচার বিভাগ ও প্রভাবশালী গণমাধ্যম থেকে পুরোপুরি সমর্থন দেয়ার একটি শরিকানা চুক্তিকরা হয়েছিল তুরস্কে। সেনা-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় শরিকরাও তাই মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে। এর পাশাপাশি শিক্ষাখাতেও ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে তুরস্ক। শিক্ষাখাতের প্রায় ৩৬ হাজার কর্মীর (শিক্ষক, শিক্ষাপ্রশাসক ও শিক্ষানীতিবিদ) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, অবৈধ অভ্যুত্থানমুখি সেনাবাহিনীর বিপথগামী অংশটির পাশাপাশি অবৈধ বিপ্লবে যুক্ত বিচারক, গণমাধ্যমকর্মী ও শিক্ষাকর্মীদের বিরুদ্ধে তুরস্ক সরকার আরো দীর্ঘ ও বিস্তৃত পরিসরে পদক্ষেপ নেবে।

যদিও এ বিষয়টি সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয় যে, ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর এভাবে তড়িৎ ও ঢালাও ব্যবস্থাগ্রহণের ফলে কিছু মানুষ অহেতুক হয়রানির শিকার হয়ে যেতে পারেন। রাজনৈতিক বিরোধ কিংবা সন্দেহের শিকার হয়েও অনেকে বিপদে পড়তে পারেন। দূর থেকে আমরা এটাই চাইব যে এরকম দুর্ঘটনা কারো ক্ষেত্রেই না ঘটুক। একই সঙ্গে এ-জাতীয় ঘটনার ক্ষেত্রে অপরাধী চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার সময় আমরা সব দেশের সব কর্তৃপক্ষকেই বলবো, অভিযোগের ঢালাওকরণ এবং বাছবিচারহীনভাবে অপরাধী চিহ্নিতকরণের প্রবণতা মারাত্মক ক্ষতিকর। এ ক্ষতি ব্যক্তিরও, দেশেরও এর সঙ্গে এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি অত্যন্ত দৃষ্টি আকর্ষক হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে সেটি হচ্ছে, মুসলিম দেশে দেশে সেক্যুলার অভ্যুত্থানকামী সেনাশক্তির একটি বিচ্যুত গোষ্ঠীর সহায়ক হিসেবে বিচার, গণমাধ্যম ও শিক্ষাঙ্গনের চিহ্নিত একটি অংশের সম্পৃক্ততা। পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলেন, এটি বহু মুসলিম দেশের একটি সমন্বিত চিত্র। নতুন শতাব্দীতে মুসলিম দেশে দেশে ইসলামবিমুখ আধুনিকতাবাদী ও উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থী বিপথগামী সেনা, গণমাধ্যম, বিচার ও শিক্ষাকর্মীদের যুথবদ্ধ একটি বলয়ের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর এদের পেছনে থাকছে পশ্চিমা মোড়ল ও আঞ্চলিক ইসলাম-বিদ্বেষী শক্তি।  মদদপুষ্ট সময়এলে এরা একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। সফল করে তোলে তাদের অপরিণামদর্শী লোভ আর পরাশক্তির ছক। মিশর, ইরাকসহ আজকের পাকিস্তানেও এই যুথবদ্ধতার কিছু কিছু চিত্র বিদ্যমান।

আমাদের দেশ নিশ্চয়ই এ জাতীয় দুরাবস্থা থেকে মুক্ত। আমরা আমাদের শান্তির দেশটিকে বরাবর এ অভিশপ্ত যুথবদ্ধতার চেয়ে ভিন্ন অবস্থাতেই দেখতে চাইব। আর আমরা এ-ও বলব যে, এ চিত্রটি কেবল অবৈধ অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত নয়; বরং ইসলাম বিমুখ উগ্র আধুনিকতা টিকিয়ে রাখার সব রকম অনৈতিক ধারায় (ক্ষমতায় আসা - ক্ষমতা ধরে রাখা) এসব শ্রেণিকে একসঙ্গে দাঁড়াতে দেখা যায়। তাই বোধ, চিন্তা ও অবস্থানের সতর্কতা সবার জন্যই জরুরি। যদি নির্দোষ ব্যক্তিরা হয়রানির শিকার না হন তাহলে আমরা বলতে পারি যে, তুরস্ক সরকার ব্যর্থ অভ্যুত্থানের দুষ্কৃতিকারী চিহ্নিত করতে গিয়ে মুসলিম দেশে দেশে দেশীয় ষড়যন্ত্রের সাধারণ একটি শ্রেণি ও গোষ্ঠীগত সূত্র এবং যুথবদ্ধতার চিত্র সামনে তুলে এনেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এ সূত্রটির প্রয়োগ ঘটানো হচ্ছে বিভিন্ন দেশে বিচিত্র উপায়ে। এ থেকে তাই সব মুসলিম দেশেরই শেখার আছে অনেক কিছু। 

 

 

advertisement