শাওয়াল ১৪৩৭   ||   জুলাই ২০১৬

গণমাধ্যমের দুষ্ট প্রভাব : বাঁচবো কীভাবে

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

যার প্রভাব যত বেশি তার দুষ্টতা ও ভেজালপ্রবণতাও তত বেশি হওয়ার আশংকা প্রবল থাকে। এটি শুধু পণ্যের ক্ষেত্রে নয়, বোধ, চিন্তা ও চর্চার সব ক্ষেত্রেই প্রায় সমানভাবে প্রযোজ্য। এ জন্যই এ প্রভাব ও দুষ্টতার বৃত্তের বাইরে নয় গণমাধ্যমও। বরং কোনো কোনো সময় গণমাধ্যমের বিনাশী আচরণ অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক ও সর্বনাশাও হয়ে থাকে। গণমাধ্যমের প্রভাবের পাশাপাশি তার দুষ্টতা, ভেজাল ও বিপথগামিতা এখন কি কেবলই কোনো তাত্ত্বিক বিষয়? না কি এর প্রত্যক্ষ ও সরাসরি কোনো ফলাফল বিদ্যমান? সচেতন মহলের কাছে এটা প্রায় সর্বোতভাবে অনুচ্চারিতসত্য যে, বর্তমানে গণমাধ্যমের ভুলভাল প্রচার ও নির্দেশনা বহু ক্ষেত্রেই মানুষের চোখকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। কিংবা মানুষের ভেতরে তৈরি করে এক-পাক্ষিক, খণ্ডিত ও বিচ্যুত চিন্তার তীব্র প্রান্তিকতা। এতে সৃষ্টি হয় নানা বিভ্রান্তি ও বিপর্যয়। আর এই বিচ্যুতির সবচেয়ে নিরীহ ও কমন শিকার এখন ইসলাম, ইসলামী শিক্ষা, ইসলামী অনুশাসন ও ইসলাম-অনুসারী মানুষেরা। পৃথিবীর দেশে দেশে এটা ঘটছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে মাত্রায় একটু বেশি। এবং সঙ্গত কারণে এই বিকৃত শিকারবাজিতে আমাদের দেশের গণমাধ্যমও বিশেষ পিছিয়ে নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে এখানকার ইস্যু, ঝোঁক ও প্রবণতা আরো বেশি সম্প্রসারিত। ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, সংখ্যালঘু, নারী, মানবাধিকার, মুক্তচিন্তা- এরকম নানা আঙ্গিক থেকেই নিয়মিত তীর ও শর বিদ্ধ করা হয় ইসলামের পক্ষের অঙ্গনকে। বিভ্রান্তি ও বিকৃতি ইচ্ছাকৃত চাপিয়ে দেওয়া হয়। উল্টে দেওয়া হয় বিচারের বোধ ও জনমত। বিভিন্ন ঘটনায়, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রায় নিয়মিত। অনেকটা আরাধ্য মিশনের মতো।

প্রশ্ন হচ্ছে, গণমাধ্যমের বড় একটি অংশের এই বিচ্যুত শিকারবাজির বিষদুষ্টতা রুখতে কি কিছুই করণীয় নেই? বিষয়টির সঙ্গে দ্বীনী জীবনের সুস্থতা-অসুস্থতা, সমাজের শুদ্ধি-অশুদ্ধি এবং দ্বীনী দাওয়াহ্র একটি গভীর প্রেক্ষাপট যুক্ত রয়েছে বলেই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখার চেষ্টা করতে হয়। সেটি সবটুকু এজন্য নয় যে প্রভাবক কোনো কোনো গণমাধ্যমের বিকৃত প্রচারণা থেকে ইসলাম-ধর্মীয় চেতনাকে অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টায় নিয়োজিত হওয়ার দায়িত্ব বান্দাদের ওপর বর্তায়। বরং এর অন্যতম কারণ এটিও যে, জীবন ও চিন্তার বিচ্যুতি থেকে সমাজের মানুষের বেঁচে থাকার উপায় উন্মুক্ত থাকা দরকার। অন্যতম কারণ এটিও যে, বিকৃত তথ্য পরিবেশন ও ভুলভাল প্রচারণায় নিয়োজিত গণমাধ্যম এবং তার কর্মীদেরও আত্মবিনাশ থেকে রক্ষা করার জন্য কিছু না কিছু করা দরকার। সেজন্যই এই লেখায় দুষ্ট গণমাধ্যমের বিষফল ও বিকৃতির আবিলতা থেকে ইসলামী শিক্ষা, বোধ ও চেতনাকে মুক্ত রাখার জন্য একটি উপায়ের কিছু কর্মপ্রেরণা প্রস্তাব করার চেষ্টা থাকবে ইনশাআল্লাহ।

 

দুই।

দুষ্ট ও প্রভাবক গণমাধ্যমের বিষাক্ত প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্ত করার উপায়গুলোর প্রধানত দুটি পর্যায় হতে পারে। একটি পর্যায় হচ্ছে ইতিবাচক গণমাধ্যম নির্মাণ ও বিকাশের পদক্ষেপ গ্রহণ। ওই ময়দানে শুদ্ধতার বার্তা নিয়ে দ্বীনদার মানুষদের অবতরণ। এটিই দুষ্ট গণমাধ্যমের বিষদুষ্টতা থেকে বাঁচা ও বাঁচানোর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী, কার্যকর ও গঠনমূলক পদক্ষেপ। কিন্তু পদ্ধতি ও আর্থিক বিবেচনায় এটি হঠাৎ করেই আয়োজনের বিষয় নয়। এটি স্বতন্ত্র একটি বিষয় এবং আলোচনার জন্য দরকার স্বতন্ত্র পরিসর। এ পদক্ষেপ এখনই পুরোমাত্রায় বাস্তবায়নও হয়তো কঠিন। অপরদিকে যে কোনো প্রভাবক নেতিবাচকতা থেকে মুক্তির আরেকটি উপায় হচ্ছে ওই নেতিবাচকতাকে যৌক্তিকভাবে বিদ্যমান উপায়-উপকরণের মধ্যে অবস্থান করেই রদ করা। ওই নেতিবাচকতার মন্দ ও ক্ষতির নানা দিক নিয়ে নিজেরা পরিষ্কার হওয়া এবং জনসমক্ষে তা পরিষ্কার করা। একইসঙ্গে ওই অঙ্গনেও শাশ্বত দাওয়াতের কিছু কাজ হেকমতের সাথে চালু করার চেষ্টা করা। পাত্র, ক্ষেত্র, পরিস্থিতি, আগ্রহ, পরিণতি, উপযোগিতা এবং সম্পর্ক-সূত্র সামনে নিয়ে এসব দাওয়াতী কাজেও বহু সুফলের পথ রচিত হতে পারে। এই দ্বিতীয় উপায় বা ধারা নিয়েই আমরা এখানে কথা বলতে পারি।

একশ্রেণির গণমাধ্যমের বিষাক্ত প্রভাব থেকে বাঁচতে দ্বীনী চেতনা সম্পন্ন অগণিত মানুষের কাজের জায়গাটা কোথায় কোথায়? এক কথায় বলা যায়, বলা ও লেখা প্রকাশের সবগুলো উপযোগী ক্ষেত্রই তাদের ক্ষেত্র। আলেম সমাজের লেখার প্রধান ক্ষেত্র কিছু ইসলামী সাময়িকী  ও বইপত্র। অনেকটা স্বাধীনভাবে তারা এ দুটি অঙ্গনে নিজেদের কথা তুলে ধরতে পারেন। জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো, টিভি ও রেডিও চ্যানেলগুলো এখনো তাদের জামেবা পূর্ণাঙ্গ এবং শুদ্ধিবাদী চিন্তা ও নির্দেশনা গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত নয়। কিন্তু নিজস্ব ইসলামী সাময়িকী ও নিজস্ব ধারার প্রকাশনাগুলো থেকে প্রকাশিত বইপত্রে প্রয়োজনীয় বিষয় তারা উপস্থাপন অনেকাংশেই করতে পারেন। অবশ্য এখন পর্যন্ত তাদের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র ও অঙ্গন হচ্ছে মসজিদের মিম্বার-মিহরাব। মাহফিলের মঞ্চ এবং দাওয়াতী কাজে মুলাকাত ও মুকালামাত। বলার ক্ষেত্রগুলোই এখন আলেমদের জন্য, ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও দাঈদের জন্য সবচেয়ে বেশি উন্মুক্ত ও কার্যকর। এ জন্য বলার এ অঙ্গনগুলোকেই অত্যন্ত উপযোগী ও গ্রহণযোগ্য ভঙ্গিতে ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। গণমাধ্যমের ইসলাম ও মুসলিম বৈরিতার উপলক্ষ ও পদ্ধতিগুলো নিয়ে কথা বলার জন্য বিভিন্ন হেকমতপূর্ণ আলোচনার অবতারণা করা যেতে পারে। অন্যান্য ইসলামবিরোধী কর্মকা- সম্পর্কে সতর্কতা আনতে যেভাবে কথা বলা হয় সেই আঙ্গিক এক্ষেত্রেও বেছে নেওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রেই শিরোনামে কিংবা উপস্থাপনার টার্গেট হিসেবে গণমাধ্যমের (পত্র-পত্রিকা, টিভি, রেডিও ইত্যাদি) প্রসঙ্গ না এনে অন্য কোনো মূল শিরোনামের অধীনে বিষয়গুলোকে আনা যায় এবং মানুষকে সেসব বিষয়ে সতর্ক ও সজাগ করার পদক্ষেপ নেওয়া যায়। বিশেষত গণমাধ্যমে ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্কিত আঙ্গিকে মুদ্রিত কিংবা সম্প্রচারিত কোনো বিষয় মানেই যে সত্য ও গ্রহণযোগ্য- এই ভুল অবস্থান থেকে শ্রোতাদেরকে সরিয়ে আনা যেতে পারে।

এখানে একটি বিষয় লক্ষ করার মতো। আলেমদের বলার ক্ষেত্রগুলোর প্রতিও ইদানিং গণমাধ্যম, সুশীল ও সেকুলার রাজনীতিকদের শ্যান দৃষ্টি পড়েছে। জুমার দিন খতিবের বক্তব্য, মাহফিলে বক্তার আলোচনা এবং মসজিদের মাইকের সতর্কীকরণমূলক ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চাপিয়ে দেওয়া বিভিন্ন নিয়মেরকথা তারা তোলার চেষ্টা করছেন। এ জন্য দাওয়াতের এই উন্মুক্ত ক্ষেত্রটিকে দৃঢ়তা ও হেকমতের সঙ্গে রক্ষা করেই সমাজ ও জাতিকে সজাগ করার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ইচ্ছাকৃত অনুপযোগিতা, অসতর্ক অতি আবেগ কিংবা হঠকারিতা পরিহার করে চালিয়ে যেতে হবে দ্বীনী বিষয়ে অপপ্রচার ও বিচ্যুত দৃষ্টিভঙ্গি খণ্ডানোর ধারাবাহিক ধৈর্যপূর্ণ চেষ্টা । আমরা কমবেশি জানি যে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দ্বীনী বিষয়ের বিচ্যুতি ও বিকৃতিগুলো নিয়ে কথা বলা সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর। সচেতনতার অভাবে বহু রাজনীতিসংশ্লিষ্ট নামাযী মানুষও অনেক সময় চিন্তা ও আদর্শের ইসলামবিরোধীতার বিষয়টি বুঝতে চান না কিংবা বুঝেও মানতে চান না। নাযুক ও স্পর্শকাতর এই জায়গাটিকে সাফল্য ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই বরাবর অতিক্রম করার চেষ্টা করতে হয়। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে আকীদা, বোধ, সত্য এবং বিশুদ্ধতার পক্ষে পরিষ্কার কথাগুলো বলতেও হয় এবং একই সঙ্গে গ্রহণীয় পদ্ধতি ও হেকমতও অবলম্বন করতে হয়। ঠিক এভাবেই প্রতারক গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে শাশ্বত ইসলামের অমূল্য অনুশাসন এবং মুসলিম জীবন ও স্বার্থের বিরুদ্ধে যেসব কর্মকা- ও প্রচারণা চালানো হয়- তার বিরুদ্ধেও বলতে হবে। ধীরে ধীরে ও ধৈর্য্যরে সঙ্গে। গণমাধ্যমের বিষাক্ত প্রভাব সম্পর্কে সাধারণ মুসলমানকে সচেতন না করলে, গণমাধ্যমের প্রতি তাদের ঢালাও আস্থার ফাঁপা ও প্রতারিত অবয়বটা তাদের সামনে তুলে ধরতে না পারলে একশ্রেণির শক্তিমান গণমাধ্যমের ধর্মবিদ্বেষী ভূমিকাগুলোর বিনাশী ক্ষতির পরিমাণ কমানোর সুযোগ থাকবে না।

 

তিন।

গণমাধ্যমের বিচ্যুতি তুলে ধরার সময় ঢালাওভাবে তাদের সবকিছুর প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ না করাটাই হবে আবেদনের যুক্তিযুক্ত পন্থা। কিছু অবদান ও ইতিবাচকতার বিষয়কে- যা বিভিন্ন সময় ব্যক্তি ও নাগরিক স্বার্থের ক্ষেত্রে তারা করে থাকে- অভিনন্দনের সঙ্গে উচ্চারণ করা শোভন হবে। আর এরই পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়গুলোতে তাদের অনৈতিক হস্তক্ষেপমূলক নিউজ-ভিউজগুলোর দুয়েকটি প্রসঙ্গ সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা যায়। কখনো কিছু নজির-উপমাসহ। এভাবেই গণমাধ্যমের নেতিবাচকতার একচ্ছত্র প্রভাব ও আস্থার উল্টোপিঠটি সম্পর্কেও কথা বলতে শুরু করতে হবে। এতে সর্ব সাধারণের মাঝে সে প্রভাবের প্রতি সুস্থ প্রত্যাখ্যানবোধ জাগিয়ে তোলার বিষয়টি সহজ হতে পারে। এর তো অনেক উপায় ও প্রক্রিয়া থাকতেই পারে। সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে উপযোগিতা বিবেচনা করে ইতিবাচক পদ্ধতিতে সেসব উপায় প্রয়োগ করা যায়। এখানে উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় সামনে আনা হলো।

গণমাধ্যমের অশ্লীলতা একটি বড় বিষয়। লেখা, ছবি, ফিচার ও বিজ্ঞাপনে মুদ্রিত ও সম্প্রচারিত এসব অশ্লীলতার বিধ্বংসী ক্ষতি এবং তা থেকে সুরক্ষা সম্পর্কে কথা বলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী আবেদন হিসেবে বিবেচিত। ব্যক্তি-জীবন, সন্তানদের জীবন, ঘরে-বাইরের বিচিত্র জীবনে এসব অশ্লীলতার ক্ষতি এবং তা থেকে বাঁচার আহ্বান রাখতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে এসবের দায় ও দায়িত্বহীনতা নিয়ে আলোচিত গণমাধ্যমের কা-জ্ঞান নিয়েও কথা বলা যাবে, প্রশ্ন তোলা যাবে। এটি দু দিক থেকেই গণমাধ্যম বিষয়ে কথা বলার  প্রেক্ষাপটকে জোরালো করবে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে যারা নেতিবাচক কাজগুলো করেন, খবর, আলোচনা, অনুষ্ঠান ও নীতি-নির্ধারণে ভূমিকা রাখেন, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের বিভিন্নজনের নৈতিক, বিশ্বাসগত ও চিন্তাগত (রাজনৈতিক-তাত্ত্বিক) ধর্ম-বিচ্ছিন্নতার বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে ধরা যেতে পারে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম সরাসরি উচ্চারণ না করেই এসব বিষয়ে কথা বলা সঙ্গত হবে। যেমন : তাদের জীবনাচারে ধর্মকর্মের অনুপস্থিতি, তাদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য হবি, অভ্যাস, আচরণ এবং ইসলাম-ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে তাদের জীবনের দূরত্ব ও বৈপরিত্বের বিষয়গুলো সামনে আনা যায়। এবং এ প্রসঙ্গটা এজন্যই আসতে পারে যে, এতে করে এইসব নৈতিক ও চিন্তাগত স্খলিত ও বৈরি লোকদের হাত ধরেই কোন্ যুক্তিতে ইসলামী শিক্ষা ও অনুশাসনের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের উপাত্ত তৈরি করা হচ্ছে- সে প্রশ্নটাকে আরো শানিত করার যথার্থ যুক্তি সামনে আনা যায়। গণমাধ্যমের কারো কারো (রাজনীতি ও তত্ত্বের সঙ্গে) ধর্মবিচ্ছিন্নতা, ধর্মহীনতার যেসব বিষয় প্রকাশ্য রয়েছে- প্রয়োজনে সেগুলোও আলোচনায় সামনে আনা যায়। এতে এ বিষয়টি পরিষ্কার করার সুযোগ পাওয়া যায় যে বিদ্বেষী মনোভাব থেকেই ইসলামের বিভিন্ন অঙ্গনের দিকে তাদের মুখ ও কলমের উল্টো ব্যবহার ঘটছে। এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর নৈতিক-আর্থিক ভিত্তি নিয়েও কথা বলা যেতে পারে। বড় বড় বণিক প্রতিষ্ঠানের বিতর্কিত স্বার্থ এবং ধর্মবিচ্যুত গণমাধ্যম-সুশীলদের সমন্বয় সম্পর্কে মানুষের বোধ ও চিন্তার জগতকে কিছুটা স্বচ্ছ করার চেষ্টা এভাবে চলতেই পারে।

মূল বিষয় তো ইসলামী অনুশাসন ও মূল্যবোধের প্রতি একশ্রেণির গণমাধ্যমের বিরাগ, অনীহা ও বিদ্বেষের বিষয়গুলো পরিষ্কার করে সামনে আনা। এর জন্য একটি পদ্ধতি এটিও হতে পারে যে বিভিন্ন সময় পক্ষ-বিপক্ষের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে তাদের অসঙ্গতিপূর্ণ প্রচারণা, খবর গায়েব করা কিংবা তাদের দৃষ্টিতে অনুকূল হলে ছোট্ট খবর নিয়ে মাতামাতি করার ঘটনাগুলোর দু-চারটি আলোচনায় তুলে আনা। নারায়নগঞ্জের হিন্দু শিক্ষক (অভিযুক্ত ইসলাম অবমাননাকারী ও ছাত্রদের প্রতি অমানুষিক নির্যাতনকারী) শ্যামলকান্তির কানেধরা নিয়ে দেশব্যাপি হৈ চৈ  তৈরিতে গণমাধ্যমের উসকানি আর এই ২০ রমযানে রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর নালিশ ও তদবিরে পুলিশ কর্তৃক নবনির্মিত মসজিদে পিস্তল উঁচিয়ে হামলার খবরটি মাটিচাপা দেওয়া। আগেরটিকে দেশকাঁপানোঘটনা হিসেবে সাব্যস্ত করলেও পরেরটিকে কোনো ঘটনাই না’- এমন মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে তাদের কাজের অসঙ্গতি ও ন্যায়ভ্রষ ভারসাম্যহীনতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। এ রকম ঘটনায় ঢাকা থেকে মফস্বল, দেশ থেকে বিদেশ- সব ক্ষেত্রেই তারা ইসলাম ও মুসলমানের অঙ্গনটিকে অসহায় প্রতিকূলতা দান করলেও ইসলামবিরোধী শক্তি, ভিন্নধর্মী কিংবা ইসলামবিদ্বেষী কথিত সেকুলারদের পক্ষে খোলামেলা ভঙ্গিতেই প্রচারণায় ব্যস্ত হয়। আর এমনটি শুধু খবর বা রিপোর্টের ক্ষেত্রেই নয়, কলাম, মতামত, আলোচনা- সব ক্ষেত্রেই করা হয়ে থাকে। প্রতিমাস, প্রতি সপ্তাহ, এমনকি লক্ষ করলে প্রায় প্রতিদিনই এ ধরণের অসঙ্গতি ও ন্যায়হীন ভ্রষ্টাচারের নজির গণমাধ্যমে সহজেই মিলবে। এ সব বিষয় পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে তুলনা দিয়ে সামনে আনলেও বড় রকম স্পষ্টতা তৈরি হবে এতে তাদের এক-পাক্ষিক প্রচারবাদিতার বিষয়গুলো উন্মোচিত হতে আর বাকি থাকবে বলে মনে হয় না।

 

চার।

সব রকম অসঙ্গতির পাশাপাশি এটিও তো আলোচনায় আনার মতো একটি বিষয় যে ধর্মীয় বিষয়ে ভালোমন্দনির্ধারণ ও পক্ষ-বিপক্ষ মীমাংসার যোগ্যতা কি বর্তমান গণমাধ্যম-কর্তাদের রয়েছে? তারা একদিকে ইসলামী শিক্ষার একটি বিষয়কে খাটো করতে চান, আরেকদিকে ইসলামের আরেকটি অনুশাসনের প্রতি মানুষের মনকে সন্দিগ্ধ করে তুলতে চান। তো এ বিষয়গুলো বোঝার কি যোগ্যতা তাদের রয়েছে? তারা যে ইসলাম বিদ্বেষ ও দেশি-বিদেশী ধর্মবিদ্বেষী এজেন্ডা হাতে নিয়েই এসব করতে চান- যোগ্যতাহীন, সম্পর্কহীন তাদের এ জাতীয় বিষোদগার ও উন্নাসিকতা থেকেও সেটা বেশ ভালোভাবেই ফুটে ওঠে। সুতরাং এ কথাগুলোও বোঝাপড়ার সময় সামনে এলে ক্ষতি নেই।

এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় লক্ষ করবার মতো। সেটি হচ্ছে, বিদেশি এজেন্ডা কিংবা এ দেশীয় ইসলামবিরোধী চিন্তক মহলের একটি সূত্রকথাপ্রভাবশালী গণমাধ্যমের বড় অংশটি মাঝে মাঝেই আওড়ে থাকে। তারা ইসলাম-অনুসারীদের মাঝে মনস্তাত্তিক বিভেদ তৈরি এবং নিজেদের আক্রমণসফল করার জন্য অবোধ ভঙ্গিতেজোর গলায় বলার চেষ্টা করে থাকে-এদেশের মুসলমান ধর্মসচেতন। কিন্তু ধর্মোন্মাদ নয়। এদেশের মুসলমান মধ্যপন্থী, উদারপন্থী। এরা কট্টর নয়। সুতরাং কট্টরদের সাথে এদের সম্পর্ক নেই।যে কোনো আত্মরক্ষামূলক ইস্যু, প্রয়োজনীয় ধর্মীয় সচেতনতা কিংবা নিয়মতান্ত্রিক জাগরণের সময় মুসলিম সর্বসাধারণের সাথে ইসলামী মহলের সন্বন্ধসূত্র কেটে দেওয়ার জন্য তারা এই সূত্রকথাটিব্যবহার করে বেশি বেশি। বহু সরল মানুষ এই শ্লোগানে বিভ্রান্তও হন। তারা মনে করতে থাকেন-আমরাও তো ধর্মপ্রাণ। আমাদের কথা তো গণমাধ্যম বলেছে, আমাদের প্রশংসা করেছে। সমস্যা তো কট্টরদের। মসজিদ, মাদরাসা নিয়ে যারা থাকে, বোরকা, টুপি নিয়ে যারা থাকে তাদের। আমাদের কোনো সমস্যা নেই।এভাবেই মুসলমানদের মধ্যে বিভাজনের প্রাচীর তৈরি করে ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী এজেন্ডাকে সহজে সফল করে তোলর চেষ্টা চালিয়ে যায়। সময়ে সময়েই তাদের এ রকম সূত্রকথাও এজেন্ডা-সহায়ক তত্ত্বকথাতারা ময়দানে ছেড়ে দেয়। তাই এগুলো ধরে ধরে উল্টো করে কিছু জরুরি কথা ছেড়ে দেওয়ার কাজটিও এখন দাঈদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। গণমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম ও প্রচারমাধ্যম আসলে একই কথা। এদের বড় অংশের সবচেয়ে নিরীহ টার্গেট বর্তমানে দেশে দেশে দ্বীনদার মুসলমানরা। ব্যবসা, কূটনীতি, প্রতিরক্ষা এবং বিদ্বেষী রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে। সুতরাং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরও প্রচারমাধ্যমের ব্যাপারে সুরক্ষা-সহায়ক কর্মপন্থা বেছে নিতে হবে। কখনো তাদের পরিবেশিত ভূমিকা ভাগ ভাগ করে, কখনো তাদের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নৈতিকতা-অনৈতিকতা ভাগ ভাগ করে এসব প্রচারমাধ্যমের ভালোমন্দ উন্মোচিত করতে হবে। ভালো কাজের প্রশংসা করেই মন্দ কাজের ধ্বংসাত্মক প্রবণতার বিষয়টিও বলতে হবে। তত্ত্বগতভাবে গণমাধ্যম কারো শত্রু বা বন্ধু নয়। আমরা সবাই সেটা কমবেশি জানি। কিন্তু এ-তত্ত্বের ওপর গণমাধ্যম চলে না। বরং দেশে-বিদেশে এদের বেশিরভাগের ভূমিকা ও তৎপরতা এখন ইসলাম ও মুসলমানের বিভিন্ন ইস্যুকে আক্রমণ করছে বলেই এসব নিয়ে কথা বলার প্রাসঙ্গিকতা অত্যন্ত জরুরি। গণমাধ্যমের নিরঙ্কুশ প্রভাব ও আস্থার ফাঁপা বেলুনটাকে প্রশ্ন, তুলনা ও চ্যালেঞ্জের সুইয়ে ফুটো করার প্রয়োজনীয়তাটাও তাই খুব ছোট নয়। গণমাধ্যম কোনো ঐশী-বাণী নয়। গণমাধ্যম কোনো আদালতের রায়ও নয়। এমনকি গণমাধ্যম কোনো স্থির হয়ে থাকা ইতিহাসের সংখ্যাকিংবা ঘোষণাও নয়। এজন্যই গণমাধ্যমের ইসলাম ও মুসলিম ইস্যুর নেতিবাচকতা পুরোপুরি চ্যালেঞ্জযোগ্য। অনাস্থা, সংশয় ও অবিশ্বাস নিয়েই গণমাধ্যমের ইসলাম ও মুসলিম বিষয়ক নেতিবাচক পরিবেশনাকে দেখার অনুশীলন শুরু করতে হবে। এবং এ অনুশীলনটাকে দিন দিন অবারিত করতে হবে। চিনতে ও চেনাতে হবে যে, গণমাধ্যমেও কট্টর থাকে, দুষ্ট ও এজেন্ট থাকে, অগ্রহণীয় বিষয় ও উপাদান থাকে। ভালো গণমাধ্যম কিংবা গণমাধ্যমের ভালো বিষয় গ্রহণে কোনো বাধা নেই।

 

পাঁচ।

প্রভাবশালী গণমাধ্যমের দুষ্ট প্রভাব বন্ধের খ-নমূলক ও রদমূলক কর্মপন্থার অন্যতম বিষয় হতে পারে দাওয়াহ। সরাসরি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি । সে দাওয়াহ কখনো কখনো প্রাতিষ্ঠানিক এবং দলবদ্ধও হতে পারে। তাবলীগী মেহনতের মধ্যেই গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে নিয়ে সাধারণ সাংবাদিক পর্যন্ত দাওয়াতের টার্গেট করা যায়। এজন্য প্রতিষ্ঠানভিত্তিক মেহনত কিংবা যিনি যে মহল্লার বাসিন্দা তাকে সেখানে দাওয়াতের পরিকল্পনা করা যায়। দাওয়াতের পাত্র হতে পারে গণমাধ্যমের মালিকেরাও। নীতি নির্ধারণ ও পরিবর্তনে তাদের ক্ষমতাও কম নয়। দাওয়াতী কাজের এটি ভিন্ন একটি অঙ্গন হতে পারে। এ অঙ্গনের কাজের সুফল অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এখানে যে যে বিষয়গুলো প্রধানত লক্ষ করার সেটি হচ্ছে, গণমাধ্যমের লোকদের দাওয়াতের ক্ষেত্রে অধিকতর হেকমত, বুদ্ধিমত্তা এবং পূর্বপ্রস্তুতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এদের বেশিরভাগই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ইস্যু ও ঘটনা নিয়ে তাদের মতো একটি বোধ ও চিন্তার জগতে বাস করেন। অনেকের শিক্ষা ও বেড়ে ওঠার পরিমণ্ডল ছিল সম্পূর্ণ সেকুলার কিংবা ইসলামবিদ্বেষী। অনেকেই গণমাধ্যমের কাজের পাশাপাশি বর্তমানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রাপ্তি ও সুবিধার সঙ্গেও জড়িয়ে  রয়েছেন। পড়াশোনা, জানা ও দেখার বিচিত্র এক দুনিয়ায় তারা বিভোর থাকেন। সেখানেই শুদ্ধ দ্বীনের কথাগুলো বলা এবং তাদের দ্বীনের দিকে আহ্বান করার কাজটির গভীরতা ও স্পর্শকাতরতা অনেক বেশি। দেশি-বিদেশি ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গনের আকর্ষণীয় বইপত্রের একটি ভাণ্ডার, কিছু অনলাইন লিঙ্ক এবং দাওয়াতের কর্মী হিসেবে কয়েক শ্রেণির মানুষ সমন্বিত হয়ে এ অঙ্গনটিতে কদম রাখলে ইনশাআল্লাহ সুফল আসবে বলে আশা করা যায়। গণমাধ্যমের পরিশুদ্ধির বিষয়টি খুব সরল নয়। তিনজন সাংবাদিক দ্বীনদার হয়ে গেলেই তাদের গণমাধ্যমে তারা নিজেদের উদ্যোগে ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থে বিদ্বেষমুক্ত ভূমিকা রাখতে পারবেন- পরিস্থিতি এমন নয়। পলিসি বা নীতির একটা কেন্দ্রীয় পর্যায় থাকে। সেটা ব্যক্তির খেয়ালখুশি কিংবা সিদ্ধান্তে বদলানো যায় না। তবে লঘু ও সূক্ষ্ম উপায়ে অনেক কিছুই করা যায়। তবু শুরু তো করতে হবে এভাবেই। আমাদের দ্বারা যদি তিনজনকে দ্বীনের প্রতি দরদী করার মেহনত সম্ভব হয়- ওই তিনজনের দ্বারা তাদের জগতে প্রভাবশালী ত্রিশজনের ভেতর মেহনত সফল হতে পারে। এভাবেই তো এগিয়ে যেতে হবে। দাওয়াহ তো সম্ভাবনারই জগৎ। ইতিবাচকতারই ভুবন। কাজ করতে থাকা, বলতে থাকা, ডাকতে থাকা, তুলে ধরতে থাকা। কোনো ক্ষতি তো নেই। একজন আসবেন। দুজন আসবেন। আবার একজন-দুজন আসবেন না। দাওয়াহ চলবে। অন্তত গণমাধ্যমের জগতের দু-চারজন-দশজন দ্বীনের ছায়ায়, বোধ ও চিন্তায়, পুরোপুরি চলে এলে সে-ও তো এক বড় কামিয়াবি। তাদের দ্বারা গণমাধ্যমের জগতে পরবর্তী সময়ে সরাসরি কোনো সুফলের ছাপ পড়ক কিংবা না পড়ক। আর স্বতঃসিদ্ধ কথা যিনি যে জগতের, সে জগতে পূর্ব-অভিজ্ঞতার ফলে তার দ্বারা কিছু কাজ হওয়াই স্বাভাবিক।

একশ্রেণির গণমাধ্যমের দুষ্ট প্রভাব বন্ধে খ-নমূলক পদক্ষেপ যেমন চালু থাকতে পারে- তেমনি গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারক ও কর্মীদের মধ্যে দাওয়াতের কর্মপন্থাও সুফলদায়ক হতে পারে। হক্বের বিরোধীদের খণ্ডানো কিংবা বিরোধিতা করে যাওয়া তো হক্বের প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই। বিরোধিতার জেদের জন্য নয়। সেজন্যই রদ ও খ-নের পাশাপাশি দাওয়াতের কর্মপন্থাও সক্রিয় করা দরকার। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের কাজ করার তাওফীক দান করুন। আজকের প্রভাবশালী গণমাধ্যমের ইসলাম ও মুসলিম ইস্যুর প্রতি নেতিবাচকতার দুষ্টপ্রভাব থেকে সমাজ ও জাতিকে রক্ষা করুন।

রয়ে গেলো দুষ্ট গণমাধ্যমের বিপরীতে ইতিবাচক গণমাধ্যম নির্মাণের উদ্যোগ, বিকল্প গণমাধ্যম নির্মাণ এবং বিরাজমান পরিস্থিতির মধ্যেই গণমাধ্যমে ইতিবাচক কিছু করার সুযোগ গ্রহণ বিষয়ে কথকথা। ইনশাআল্লাহ ভিন্ন পরিসরে এ নিয়ে কথা হতে পারে। 

 

 

advertisement