শাবান-রমযান ১৪৩৭   ||   মে-জুন ২০১৬

তথ্য বয়ান : একক তথ্যের সেবা

খসরূ খান

তিনি পর পর দুটি বক্তব্য দিয়েছেন। দুটিই বেশ চমকপ্রদ ও দৃষ্টি-আকর্ষক। এমনিতেও তার বক্তব্য-বক্তৃতায় বরাবর আকর্ষণের কিছু উপাদান থাকেই। চটক, চমক এবং ধমকের সঙ্গে তিনি বেশ যান। দেশবাসী সেসব দেখেন, শুনেন এবং মনভরে উপভোগও করেন। এ বক্তব্য দুটিকেও সেরকমই বলা যায় একদিক থেকে। কিন্তু গোল বেঁধেছে অন্য জায়গায়। বক্তব্য দুটি মাটিতে পড়ার আগেই শুরু হয়েছে প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন, তাকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়া হোক। কেউ বলছেন, তাকে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। আমাদের অবশ্য সেরকম কোনো দাবি নেই। হাজার হোক, তিনি তো একজন মাননীয় মন্ত্রী। সরকারি দলের সঙ্গে জোট গড়ে একটি চেয়ার পেয়েছেন। সে চেয়ারের ধাক্কায় সম্প্রতি অবশ্য তার দলটিও ভেঙ্গে গেছে। তাতে কি! সম্মান না জানিয়ে তার আলোচনা করি কী করে!

তিনি প্রথম কথাটি প্রথমে বলেছেন ১১ এপ্রিল সোমবার। বাংলা নববর্ষের তিনদিন আগে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের একটি অনুষ্ঠানে। এরপর আরো কয়েকটি অনুষ্ঠানে বক্তব্যটি পুনঃউচ্চারণ করেছেন। বলেছেনÑবৈশাখবরণে ঈমান নষ্ট হয় না, মুসলমানিত্ব যায় না এবং তা বেলেল্লাপনাও নয়।একটি অনুষ্ঠানে এ-ও বলেছেনÑ বৈশাখবরণ ঈমানের অঙ্গ। মন্ত্রী মানুষ। কত কথাই মনে আসে। তার কিছু কিছু তো বলতেও হয়। তিনি হয়তো সেভাবেই বলেছেন। জীবনভর করেছেন বামরাজনীতি। সমাজতন্ত্রের সঙ্গেই তার উঠাবসা। কিন্তু তার এবারের বক্তব্যটা কেমন যেন ধর্মীয় ফরমানের মতো হয়ে গিয়েছিল। কীসে ঈমান থাকে এবং থাকে না, কীসে মুসলমানিত্ব যায় এবং আসেÑ এমন বক্তব্য দিয়ে এবার তিনি তাকই লাগিয়ে দিয়েছেন। দেশপ্রেমের সঙ্গে মিলিয়ে বৈশাখবরণকে ঈমানের অঙ্গ বলতেও ছাড়েননি। ধর্মীয় বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে দেশের আলেমসমাজের কাজ কি তিনি কিছুটা কমিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? হয়তো তাই। অথচ বিপত্তিটা বেঁধেছে সেখানেই। 

নিন্দুকের তো অভাব নেই। দেশের বাইরে থেকে প্রবাসী আইনজীবী ড. তুহিন মালিক হঠাৎ উল্টো একটি বক্তব্য দিয়ে বসেছেন। তিনি বলেছেন, ২০১১ সালের ১২ মে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেÑ একমাত্র স্বীকৃত আলেমরাই ফতোয়া দিতে পারবেন এবং ধর্মীয় স্বীকৃত আলেম ছাড়া অন্য কেউ কোনো ফতোয়া দিলে তা অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। তো সেই রায়ের অবমাননা করেই না কি মন্ত্রী সাহেব ফতোয়া জারি করেছেন। কী করলে ঈমান নষ্ট হবে না, মুসলমানিত্ব যাবে না এবং কোনটি ঈমানের অঙ্গÑ এসব বিষয়ে নিজ থেকে বক্তব্য দেওয়ার মানেই ফতোয়া জারি করা। আর মন্ত্রী সাহের তো রায়-অনুযায়ী ফতোয়া জারির উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নন। সুতরাং তার জন্য এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়েছে এবং সেজন্য তাকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়া উচিত। মন্ত্রী সাহেব যদিও বক্তব্য দেওয়ার সময় বলেননি যে তিনি কোনো ফতোয়া দিচ্ছেন, কিন্তু বাস্তবে এ-জাতীয় বক্তব্য অনেক সময় ফতোয়া হিসেবেই গণ্য হয়ে থাকে।

এক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যাপারটি যে কী ঘটেছে সেটা আমরাও জানি না। আমরা শুধু গণমাধ্যমে মন্ত্রী সাহেব ও আইনজীবী সাহেবের বক্তব্য পড়েছি। আর বুঝতে চেষ্টা করেছি। এছাড়া আমাদের আর কী করার আছে, বলুন! একজন মহান গর্বিত সমাজতন্ত্রী যদি হঠাৎ ফতোয়ার ভাষায় বক্তব্য দিতে শুরু করেন তখন তো দু-চারজন দুষ্ট লোকের মুখে কিছু কথা জুটতেই পারে! পাত্তা না দিলেই হলো। যেমন মন্ত্রী সাহেব মোটেও পাত্তা দেননি।

এই মাননীয় মন্ত্রীরই আরেকটি বক্তব্য দুদিন পর আবার হইচই ফেলে দিয়েছে। বাংলা নববর্ষের দিন নিজের বাসায় বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গিয়ে দেশে ৮হাজার প্রশিক্ষিত জঙ্গি থাকার একটি তথ্য তিনি সরবরাহ করেছেন। তার দেয়া তথ্যই দুদিন পর ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রতিবেদন আকারে ছাপা হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, আলকায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে অন্তত আট হাজার বাংলাদেশিকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেসব জঙ্গি পরে দেশে ফিরে আসে এবং এখন পর্যন্ত হুমকির ধারণা সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, সামরিক স্বৈরাচারী বাহিনী, দেশীয় সন্ত্রাসী ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের মধ্যে একটি শক্ত নেটওয়ার্ক রয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের অন্য কর্তারা অবশ্য একই সময়ে বলছেন অন্য কথা। ১৭ এপ্রিল ধানম-ির একটি অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেশে আইএস জঙ্গি নেই। তবে হোমমেড সন্ত্রাস রয়েছে। একই কথা এপ্রিলের শেষ নাগাদও বলে চলছেন তিনি এবং সরকারের অন্যরাও। কিন্তু ওই সমাজতন্ত্রী মন্ত্রী তবে দেশে ৮ হাজার প্রশিক্ষিত জঙ্গি অবস্থানের এই তথ্য কোত্থেকে পেলেনÑ এ প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রশ্নের জের ধরেই অ-সংসদীয় বিরোধীদল-বিএনপির একজন যুগ্মমহাসচিব বলেছেন, এটি একটি ভয়াবহ খবর। দেশ ও জাতির স্বার্থে এই খবরের সত্যতা যাচাই করা জরুরি। এজন্য মন্ত্রীকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করারও দাবি জানান তিনি। আমরা অবশ্য এমন অসম্মানকর কথা বলতে চাই না। তবে অন্য অনেক লোকের সঙ্গে আমাদেরও জানার বড় কৌতূহল, মন্ত্রী মহোদয় এ-রকম জ্বলন্ত তথ্য পেলেন কোত্থেকে? এমন একটি পিলে চমকানো বক্তব্য এ-দেশের গোয়েন্দা, পুলিশ, র‌্যাব ও প্রশাসন পেল নাÑ কিন্তু মন্ত্রী সাহেব পেয়ে গেলেন, সেটা কীভাবে  সম্ভব হলো? সেটা এতদিন ধরে গোপনই বা রাখলেন কেন? আর তিনি যখন পেলেনই, অন্যরা সে-তথ্য আমলে নিচ্ছেন না কেন?

তাহলে কি বিষয়টা এমন যে তার সরবরাহ করা তথ্যে কেউ-ই আস্থা রাখতে পারছেন না? এটা কী করে সম্ভব? তিনি কি তবে বানানো কিংবা শ্রুত কিংবা কল্পিত কোনো তথ্য উচ্চারণ করেছেন? কেউ কেউ অবশ্য বলেন, বিদেশে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার একটা রেওয়াজ মন্ত্রীর দলের মধ্যে (মুক্তিযুদ্ধ ৭১ -এর পর) আগে থেকেই ছিল। সত্তরের দশকে পিএলও-র হয়ে ফিলিস্তিনে তাদের অনেকেই যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। সেই ট্রেনিংপ্রাপ্তদের কেউ কেউ পরে এমপি পদেও আসীন হয়েছেন। প্রথমা প্রকাশিত জাসদ রাজনীতি বিষয়ক বইটিতে ছবিসহ সেসব ট্রেনিং ও ট্রেনিংপ্রাপ্তদের কিছু বিবরণও বিদ্যমান। বিদেশে সশস্ত্র ট্রেনিং নেওয়ার পূর্ব ধারণার কারণে তাই তিনি কিছু কথা বলতেই পারেন। নিঃসন্দেহে এটা তার বিশেষ যোগ্যতা। এ ব্যাপারে অন্যদের সঙ্গে তার তথ্য ও বক্তব্যের মিল হওয়াটা তাই জরুরি নয়। হয়তো সম্ভবও নয়।

আমাদের আর অন্য কিছু ভেবে কী লাভ! আমরা বেশ ভালই বুঝেছি। মন্ত্রী মহোদয়ের আন্তরিকতায় কমতি নেই। বর্ষবরণে মুসলমানিত্ব থাকা নাÑথাকা আর বিন লাদেন কর্তৃক ৮ হাজার প্রশিক্ষিত জঙ্গি দেশে বসবাস করার তথ্যটি মন্ত্রীর একক কৃতিত্ব ও অবদান। জাতির প্রয়োজনে সে অবদান বিদেশিদের সামনে পেশ না করে নীরব থাকা  কি তার পক্ষে সমীচীন হতো? 

 

 

advertisement