মুহাররম ১৪৩৭   ||   নভেম্বর ২০১৫

কখনো ফকির কখনো বাদশাহ

ইবনে আযহার

ঈমান, ইহসান, তাকওয়া ও তাহারাতÑ এ জিনিসগুলো মানুষের মাঝে সবসময় একই মাত্রায় ও একই পরিমাণে উপস্থিত থাকে না। বাড়ে কমে, ওঠানামা করে। যখন বাড়তে থাকে তখন আমল-ইবাদত ও সব রকম নেক কাজের প্রতি আগ্রহ থাকে ঊর্ধ্বমুখী। আত্মিক প্রশান্তি ও কর্মোদ্দীপনাও বেড়ে যায় বহুগুণ। আর যখন এতে ভাটার টান শুরু হয় তখন ক্রমেই নির্জীব ও নিস্তেজ হতে থাকে হৃদয়। নেক কাজের প্রতি সেই উৎসাহ তখন হয়ে পড়ে নিম্মমূখী। গোনাহের প্রতি ঘৃণা ও গর্হিতকে বর্জন করার প্রেরণাও হয়ে পড়ে শিথিল। শয়তানী আক্রমণের সামনে মানুষ তখন হয়ে পড়ে অসহায়। গাফলত তখন তাকে কাবু করে সহজেই। অন্তর ভরে যায় অস্থিরতায়...। পিপাসাকাতর মন শুধু খুঁজে ফেরে সেই সুধা অমৃত, যা পান করে সে হবে জাগ্রত, উজ্জীবিত এবং প্রাণময়। কিন্তু সেই সঞ্জীবনী সুধাটি কী? কুরআন বলে তা হল আল্লাহর যিকির এবং তিলাওয়াতে কুরআন।

اَلَا بِذِكْرِ اللّٰهِ تَطْمَىِٕنُّ الْقُلُوْبُ

শোন, আল্লাহর যিকির ও তাঁর স্মরণে হৃদয়সমূহ প্রশান্ত হয়। Ñসূরা রাআদ (১৩) : ২৮

اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِیْنَ اِذَا ذُكِرَ اللّٰهُ وَ جِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَ اِذَا تُلِیَتْ عَلَیْهِمْ اٰیٰتُهٗ زَادَتْهُمْ اِیْمَانًا  .

মুমিনরা তো এমন, যখন আল্লাহর কথা বলা হয় এবং আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয় তখন তাদের অন্তর ভীত কম্পিত হয়। আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয় তখন তা বৃদ্ধি করে তাদের ঈমান। Ñসূরা আনফাল (৮) : ২

وَّ ذَكِّرْ فَاِنَّ الذِّكْرٰی تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِیْنَ

উপদেশ দিন, আলোচনা করুন। স্মরণ করাতে থাকুন। কেননা মুমিনদের এতে উপকার হয়।Ñ সূরা যারিয়াত (৫১) : ৫৫

 

শেষোক্ত আয়াতটি বলছে, নসীহতমূলক আলোচনা শোনা ও এজাতীয় মজলিসে বসা ঈমান বৃদ্ধি ও ঈমানী শক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়। প্রথম আয়াতটি আবার লক্ষ করি-আল্লাহর যিকিরে দিল নরম হয়, আত্মিক প্রশান্তি লাভ করা যায়। আসলে যিকিরই হচ্ছে সেই বারি-নির্ঝর, যা গোনাহের কারণে শক্ত হয়ে যাওয়া হৃদয়ের বিশুষ্ক মাটিকে সিক্ত ও সজীব করে তোলে। তাতে ঊর্বরতা ফেরায়। আর যিকরাবা নসীহতমূলক আলোচনার সাথে যিকিরের সম্পর্ক তেমন, যেমন বাতাসের সাথে সম্পর্ক মেঘের। বাতাস যেমন খণ্ডবিখণ্ড মেঘমালাকে একত্র করে ঘণবর্ষণের পরিবেশ সৃষ্টি করে। তেমনি দ্বীন-ঈমানের আলোচনা এবং আল্লাহর মাহাত্ম্য-বর্ণনা হৃদয়ের আকাশে বর্ষপূর্ব মেঘের আবহ তৈরি করে। মনের বিক্ষিপ্ত ভাব দূর করে তাকে আল্লাহর স্মরণে একাগ্র ও ধ্যানমগ্ন করে। আর তাতেই প্রথমে হালকা ও মাঝারি এবং তারপর শুরু হয় যিকিরের ভারি বর্ষণ, যা হৃদয়ের ভমি থেকে সমস্ত আবর্জনা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অন্তরাত্মাকে করে শীতল। মনকে করে কোমল। যেখানে ঈমানের বৃক্ষ আবার কুসুমিত পল্লবিত হয়ে শাখা-প্রশাখা ছেড়ে সমস্ত আকাশ ছেয়ে যায়...। আলোচনায় মুমিনের এমনই ফায়েদা হয়। তৃতীয় আয়াতটির সাথে দ্বিতীয় আয়াতকে মিলিয়ে দেখলেও একই রকম চিত্র পাওয়া যায়। মুমিনরা তো হল এমন, যখন আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয় তখন অন্তর ভয়ে কম্পিত হয়। যদি সে গাফেলহৃদয় হয় তবুও। আল্লাহর নাম শুনলে, আল্লাহর নাম নিয়ে তাকে কিছু বলা হলে, উপদেশ দেয়া হলে হঠাৎ সে কেঁপে ওঠে। হুঁশ হয়, সম্বিৎ ফিরে পায়। শত হোক, সে যে মুমিনহৃদয়! গাফলতের ঘোর তাই কেটে যায়। আল্লাহর ভয়ে পাপ থেকে ফিরে সে আবার যাত্রা করে তাকওয়া ও তাহারাতের পথে। পাপ-পঙ্কিলতাহীন স্বচ্ছ সুন্দর হৃদয়ে তখন আল্লাহর আয়াতসমূহ যতই অনুরণিত হয় ততই তার ঈমান ও ঈমানী চেতনা বৃদ্ধি পায়। আর যখন তাদের সামনে তিলাওয়াত করা হয় তাঁর আয়াত তখন তা বৃদ্ধি করে তাদের ঈমান। আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করে আবদিয়াত ও ঊবুদিয়ত তথা বন্দেগীর চরম শিখরে শুরু হয় তার আরোহন-চেষ্টা। ঊর্ধ্বারোহনের সেই পরম মুহূর্তে মুখে যখন উচ্চারিত হয় আল্লাহ, আল্লাহতখন যে অপার্থিব অসামান্য তৃপ্তি ও ভালোলাগা তার সমগ্র সত্তাকে আন্দোলিত উদ্বেলিত করতে থাকে আসলে সেটাই তার ঠিকানা। তার শান্তি ও স্বস্তির আসল জায়গা। তার প্রকৃত অবস্থান। যেটা হারালে সে হয়ে পড়ে ফকীর। আর ফিরে পেলে হয়ে ওঠে পৃথিবীর তাবৎ সুখের মালিক মুকুটহীন বাদশাহ...! 

 

 

advertisement