রবিউল আখির ১৪৩১   ||   এপ্রিল ২০১০

বিচারপতি, আপনার বিচার করবে কে?

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

রংপুর থেকে আবু মাসরূর ফরীদীর একটি প্রশ্নঃ

গত ৯ মার্চ মঙ্গলবার দৈনিক আমাদের সময়ে জনাব গোলাম রব্বানী সাহেবের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। বলা হয়েছে যে, তিনি ফোনে সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন। শিরোনাম ছিল ‘কুরআনে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে।’ ভিতরে দেখা গেল, সাক্ষাৎকারদাতা মীরাছের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান হিস্যার কথা বলেছে! উপরন্তু এই অভিনব দাবির সপক্ষে কিছু ‘দলীল’ও উপস্থাপন করেছে! তন্মধ্যে একটি এই যে, কুরআনে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা ঘোষণা করা হয়েছে। অতএব মীরাছের ক্ষেত্রেও তাদেরকে পুরুষের সমান অংশীদার বলা হলে তা কুরআন-বিরোধী হবে না! আমার জানা ছিল না যে, কোনো বিচারপতি-সে যত বড় বেদ্বীনই হোক-এমন অনৈতিক কথা বলে। কারণ হায়া (লজ্জা) ও শরাফত (ভদ্রতা) বলেও তো কিছু বিষয় আছে! ওই পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী সে আরও বলেছে যে, শরীয়তে রদ-বদল হতে পারে। যুগের পরিবর্তনে এতেও পরিবর্তন করা যায়। মীরাছের আইন হচ্ছে সচল আইন, এতে রদ-বদলের অবকাশ আছে। (নাউযুবিল্লাহ)

এগুলো যে সম্পূর্ণ কুফরী কথাবার্তা তা সম্ভবত প্রত্যেক মুসলিমেরই জানা আছে। শরীয়ত যদি পরিবর্তনযোগ্যই হত তাহলে তা আল্লাহর পক্ষ হতে ওহীর মাধ্যমে আসার কী প্রয়োজন ছিল? তদ্রূপ মীরাছ-বণ্টনের বিধিবিধানও যদি পরিবর্তনযোগ্য হত তাহলে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে এর মৌলিক নীতিমালা ও সাধারণ বিধি-বিধান কেন ঘোষণা করেছেন? এই সহজ সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য তো অনেক বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। তবে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী যারা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র কারণে জেনে-বুঝেও অনেক সত্যকে অস্বীকার করে-এটা তাদের দুর্ভাগ্য ও হঠকারিতা। আমি আপনাকে তাকলীফ দিচ্ছি এজন্য যে, সাক্ষাৎকারটিতে এমন চারটি কথা বলা হয়েছে, যা পরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় কিতাবপত্র ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য সূত্র আমার কাছে নেই এবং সম্ভবত আমার মতো অনেক পাঠকের কাছেও নেই। এজন্য আশা করছি, সঠিক বিষয়টি উদঘাটন করবেন যে, বাস্তবিকই আলোচিত বিষয়ের সাথে ওইসব কথার কোনো সম্পর্ক আছে কি না।

আমি হযরত আবু বকর রা. ও হযরত ওমর রা.-এর উদ্ধৃতির বাস্তবতা সম্পর্কে এবং ড. ইকবাল ও তিউনিসিয়ার উত্তরাধিকার-আইনের উদ্ধৃতি সম্পর্কে জানতে চাই। আশা করি, প্রকৃত অবস্থা উদঘাটন করে উপকৃত করবেন। ওয়াস সালামু আলাইকুম

উত্তর: কুরআন হাকীমে ওয়ারিছদের হিস্যা সম্পর্কে যে, আয়াতগুলো আছে প্রথমে তার তরজমা দেওয়া হল ‘‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের সন্তান সম্বন্ধে নির্দেশ দিতেছেন: এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান; কিন্তু কেবল কন্যা দুই-এর অধিক থাকিলে তাহাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ, আর মাত্র এক কন্যা থাকিলে তাহার জন্য অর্ধাংশ। তাহার সন্তান থাকিলে তাহার পিতা-মাতা প্রত্যেকের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-ষষ্ঠাংশ; সে নিঃসন্তান হইলে এবং পিতা-মাতাই উত্তরাধিকারী হইলে তাহার মাতার জন্য এক-তৃতীয়াংশ; তাহার ভাই-বোন থাকিলে মাতার জন্য এক-ষষ্ঠাংশ; (এ সবই) সে যাহা ওসিয়াত করে তাহা দেওয়ার এবং ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও সন্তানদের মধ্যে উপকারে কে তোমাদের নিকটতর তাহা তোমরা অবগত নহ। নিশ্চয়ই ইহা আল্লাহর বিধান; আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। তোমাদের স্ত্রীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধাংশ তোমাদের জন্য, যদি তাহাদের কোন সন্তান না থাকে এবং তাহাদের সন্তান থাকিলে তোমাদের জন্য তাহাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ; ওসিয়াত পালন এবং ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের সন্তান না থাকিলে তাহাদের জন্য তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ, আর তোমাদের সন্তান থাকিলে তাহাদের জন্য তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-অষ্টমাংশ; তোমরা যাহা ওসিয়াত করিবে তাহা দেওয়ার পর এবং ঋণ পরিশোধের পর। যদি পিতা-মাতা ও সন্তানহীন কোন পুরুষ অথবা নারীর উত্তরাধিকারী থাকে তাহার (বৈপিত্রেয়) ভাই অথবা ভগ্নী, তবে প্রত্যেকের জন্য এক-ষষ্ঠাংশ। তাহারা ইহার অধিক হইলে সকলে সম অংশীদার হইবে এক-তৃতীয়াংশে; ইহা যাহা ওসিয়াত করা হয় তাহা দেওয়ার এবং ঋণ পরিশোধের পর, যদি কাহারও জন্য ক্ষতিকর না হয়। ইহা আল্লাহর নির্দেশ, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সহনশীল। এই সব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। কেহ আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করিলে আল্লাহ তাহাকে দাখিল করিবেন জান্নাতে, যাহার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তাহারা স্থায়ী হইবে এবং ইহা মহাসাফল্য।

আর কেহ আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের অবাধ্য হইলে এবং তাঁহার নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করিলে তিনি তাহাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করিবেন; সেখানে সে স্থায়ী হইবে এবং তাহার জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি রহিয়াছে।’’ - (সূরা নিসা: ১১-১৪)
‘‘লোকে তোমার নিকট জানিতে চায়। বল, ‘পিতা-মাতাহীন নিঃসন্তান ব্যক্তি সম্বন্ধে তোমাদিগকে আল্লাহ ব্যবস্থা জানাইতেছেন, কোন পুরুষ মারা গেলে সে যদি নিঃসন্তান হয় এবং তাহার এক ভগ্নি থাকে তবে তাহার জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধাংশ, এবং সে যদি সন্তানহীন হয় তবে তাহার ভাই তাহার উত্তরাধিকারী হইবে, আর দুই ভগ্নি থাকিলে তাহাদের জন্য তাহার পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ, আর যদি ভাই-বোন উভয়ে থাকে তবে এক পুরুষের অংশ দুই নারীর অংশের সমান।’ তোমরা পথভ্রষ্ট হইবে-এই আশংকায় আল্লাহ তোমাদিগকে পরিষ্কারভাবে জানাইতেছেন এবং আল্লাহ সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’’ - (সূরা নিসা : ১৭৬)
উপরোক্ত ফারাইযে তিন জায়গায় আছে تلك حدود الله ومن يطع الله ورسوله يدخله جنت تجرى من تحتها الانهار خلدين فيها وذلك الفوز العظيم ومن يعص الله ورسوله ويتعد حدوده يدخله نارا خالدا فيها وله عذاب مهين (তরজমা) এই সব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। কেহ আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করিলে আল্লাহ তাহাকে দাখিল করিবেন জান্নাতে, যাহার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তাহারা স্থায়ী হইবে এবং ইহা মহাসাফল্য।
আর কেহ আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের অবাধ্য হইলে এবং তাঁহার নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করিলে তিনি তাহাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করিবেন; সেখানে সে স্থায়ী হইবে এবং তাহার জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি রহিয়াছে। - (সূরা নিসা: ১৩-১৪)

এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার পরও যদি বলা হয় যে, কুরআন ও সুন্নাহ্য় উল্লেখিত মীরাছের আহকাম রদ-বদলযোগ্য তাহলে তা কি সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে বিদ্রোহ করা হয় না? আল্লাহর তাআলার ওসিয়ত (অটল নির্দেশ) কে বিলুপ্ত করার এবং যে বিধানকে আল্লাহ তাআলা ‘হদ’ (সীমা) বলে ঘোষণা করেছেন তা বদলে দেওয়ার অপচেষ্টা যে চরম সীমালঙ্ঘন তাতে তো সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তাদের জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করার শাস্তি স্বয়ং আল্লাহই ঘোষণা করেছেন-

يدخله نارا خالدا فيها (অগ্নিতে নিক্ষেপ করিবেন; সেখানে সে স্থায়ী হইবে।)

কুরআনে তাহরীফ ও বিকৃতির এই ইহুদীসুলভ কর্মকাণ্ডে সফল হওয়ার জন্য তারা একের পর এক নির্জলা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। কারণ বাতিলের পক্ষে মিথ্যা ও প্রতারণা এবং অপব্যাখ্যা ও তথ্যবিকৃতি ছাড়া ‘দলীল’ সংগ্রহ করা যে সম্পূর্ণ অসম্ভব! কিন্তু এদের এতই অধঃপতন ঘটেছে যে, খলীফায়ে রাসূল আবু বকর সিদ্দীক রা. এবং খলীফায়ে ছানী আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-সম্পর্কেও মিথ্যাচার করতে তাদের দ্বিধা হল না। তাদের বক্তব্য হুবহু তুলে দিচ্ছি : ‘‘উত্তরাধিকার প্রশ্নে খলীফাদের যুগেই শরীয়ার বিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে। খলীফা আবু বকরের সময় এক নারী তার নানী ও দাদীকে জীবিত রেখে মৃত্যুবরণ করেন, শরীয়া আইন অনুযায়ী নানী সম্পদের উত্তরাধিকারী হন না। কিন্তু আবু বকর ন্যায়বিচারের স্বার্থে নানী ও দাদী দুজনকে সম্পদ সমানভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন।’’

এখানে এক নিঃশ্বাসে কয়েকটি মিথ্যাচার করা হয়েছে। শরীয়ত সম্পর্কে অপবাদ দেওয়া হয়েছে যে, শরীয়তে নানীর কোনো অংশ নেই। অথচ মীরাছে নানীর হিস্যা সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত এবং এ বিষয়ে সাহাবা ও তাবেয়ীদের ইজমাও রয়েছে। দ্বিতীয় অপবাদ আরোপ করা হয়েছে আবু বকর রা.-এর উপর যে, তিনি শরীয়ার বিধান লঙ্ঘন করেছেন! অথচ তাঁর সম্পর্কে এমন ধারণা করাও অপরাধ। তৃতীয় মিথ্যাচার শরীয়ত সম্পর্কে করা হয়েছে যে, তাতে ন্যায়বিচার নেই। এজন্য তার মতে-ন্যায়বিচারের স্বার্থে আবু বকর রা.কে শরীয়তের বিধান বদলাতে হয়েছে। অথচ শরীয়ত নাযিলই হয়েছে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য।

ইরশাদ হয়েছে- لقد ارسلنا رسلنا بالبينت وانزلنا معهم الكتب والميزان ليقوم الناس بالقسط وانزلنا الحديد فيه بأس شديد ومنافع للناس وليعلم الله من ينصره رسله بالغيب ان الله قوى عزيز (তরজমা) নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে প্রেরণ করিয়াছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাহাদের সংগে দিয়াছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাহাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আমি লৌহও দিয়াছি যাহাতে রহিয়াছে প্রচণ্ড শক্তি ও রহিয়াছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ এবং এইজন্য যে, আল্লাহ প্রকাশ করিয়া দিবেন কে প্রত্যক্ষ না করিয়াও তাঁহাকে ও তাঁহার রাসূলকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। - (সূরা হাদীদ: ২৫)

প্রকৃত ঘটনা এই যে, জনৈক ‘জাদ্দা’ (আরবীতে জাদ্দা নানী ও দাদী উভয়কেই বোঝায়। কিন্তু আগত মহিলাটি ছিল মৃতের নানী, ইবনে মাজার বর্ণনা (২৭৫৬) থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়) তার দৌহিত্রের ইন্তেকালের পর আবু বকর রা.-এর নিকটে এলেন এবং বললেন যে, আমি শুনেছি, কিতাবুল্লাহ্য় আমার হক (ঘোষিত) রয়েছে। আবু বকর রা. বললেন, কিতাবুল্লাহ্য় তো মীরাছে তোমার কোনো হিস্যা উল্লেখিত হয়নি, তদ্রূপ সুন্নাহতেও তোমার হিস্যা আছে বলে আমার জানা নেই। অতএব আমি অন্যদেরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করব। তো আবু বকর রা. অন্যদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, ‘জাদ্দা’ (নানীর) মীরাছ পাওয়া প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো ফয়সালা কি তোমাদের কারো জানা আছে? মুগীরা ইবনে শো’বা রা. বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি ‘জাদ্দা’ কে মীরাছের ‘ছুদুস’ (ছয় ভাগের এক ভাগ) দিয়েছেন। আবু বকর রা. জিজ্ঞাসা করলেন, আরও কেউ কি তা জানেন? মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রা. দাঁড়িয়ে বললেন, আমিও শুনেছি। এরপর আবু বকর রা. সেই নারীকে ছয় ভাগের এক ভাগ প্রদান করেন।

হযরত উমর রা. এর খিলাফত-আমলে সেই মৃতেরই দ্বিতীয় ‘জাদ্দা’ (দাদী) এল এবং তার হিস্যা চাইল। উমর রা. বললেন, কিতাবুল্লাতে তোমার কোনো হিস্যা উল্লেখিত হয়নি। আর এক ষষ্ঠমাংশ প্রাপ্তির যে ফয়সালা (আবু বকর রা. এর আমলে সুন্নাহর ভিত্তিতে) হয়েছিল তা ছিল অন্য ‘জাদ্দা’ (নানী)র ক্ষেত্রে। আমি ফারাইযের বিধানে কোনো কিছু যোগ করতে পারি না। ‘জাদ্দা’র হক ছয় ভাগের এক ভাগ। অতএব ‘জাদ্দা’ দুজন হলে ছয় ভাগের এক ভাগ সম্পদ দু’জনে ভাগ করে নিবে। একজন হলে সম্পূর্ণ হিস্যা (ছয় ভাগের এক) সে একাই পাবে। উপরের রেখাঙ্কিত বাক্যটির পাঠ এই- وما أنا بزائد في الفرائض شيئا এই ঘটনা হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। কোথাও সংক্ষেপে, কোথাও বিশদভাবে। দেখুন : মুয়াত্তা মালিক (২:৫১৩); মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক (১০:২৭৪); মুসনাদে আহমদ হাদীস : ১৭৯৮০; সুনানে আবু দাউদ ২৮৯৪; জামে তিরমিযী হাদীস : ২১০০, ২১০১; ইবনে মাজাহ হাদীস : ২৭৭৫; আলইসতিযকার ইবনে আবদিল বার ১৫/৪৪৭-৪৭৮; সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস : ৬০৩১০। আরো দেখুন: আলমুহাল্লা ইবনে হাযম খণ্ড : ৯, পৃষ্ঠা : ২৭৪; আলতালখীসুল হাবীর খ. : ৪, পৃ. : ২০৩২ (১৭২৭)

আবু বকর রা.-এর আমলে এ ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। এক ব্যক্তির ইন্তেকালের পর তার দাদী ও নানী দু’জনই তার মীরাছের জন্য এল। (কিন্তু যেহেতু পূর্ববর্তী ঘটনাতেই জানা হয়ে গিয়েছিল যে, সুন্নাহতে ‘জাদ্দা’র হিস্যা হচ্ছে ‘সুদুস’ এবং ঘটনার বিবরণ থেকে ‘জাদ্দা’ বলতে মার মা (নানী) ই বোঝা যাচ্ছিল এজন্য) তিনি নানীকেই পূর্ণ হিস্যা দিতে চাইলেন। কিন্তু আবদুর রহমান ইবনে সাহ্ল ইবনে হারিছা রা., যিনি একজন বদরী সাহাবী ছিলেন, বললেন, (নানী ও দাদী দু’জনই তো ‘জাদ্দা’। উপরন্তু) নানীর মৃত্যুতে নাতী কিছু পায় না, পক্ষান্তরে দাদীর মৃত্যুতে নাতী মীরাছের হিস্যা পায় (এজন্য ‘জাদ্দা’র নির্ধারিত অংশ অর্থাৎ ছয় ভাগের এক ভাগ শুধু নানীকে দিয়ে দেওয়া মুনাসিব নয়) তখন আবু বকর রা. ‘সুদুস’ দু’জনের মধ্যে বণ্টন করে দেন।

এই ঘটনা মুয়াত্তা মালিক খ. ২, পৃ. ৫১৩-৫১৪ এবং সুনানে দারাকুতনী খ. ৪, পৃ. ৯০-৯১ উল্লেখিত আছে। প্রাসঙ্গিক অন্যান্য হাদীস, আছার ও রেওয়ায়েতের আলোচনায় না গিয়েও শুধু এই দুই ঘটনা থেকেই যে বিষয়গুলো সামনে আসে তা এই:

  • ১. শরীয়তের বিধান অনুযায়ী মীরাছে ‘জাদ্দা’র হিস্যা আছে। আর আরবী ভাষায় ‘জাদ্দা’ তে দাদী ও নানী দু’জনই শামিল।
  • ২. মীরাছের বিষয়ে আবু বকর রা. শরীয়তের হুকুমকেই অনুসরণ করেছেন।
  • ৩. মীরাছের বিষয়ে আবু বকর রা. ও উমর রা. দু’জনই কিতাব ও সুন্নাহর শরণাপন্ন হয়েছেন। ইজতিহাদ শুধু ওই ক্ষেত্রেই করেছেন যেখানে তাঁদের জানামতে কুরআন ও সুন্নাহয় কোনো সুস্পষ্ট বিধান ছিল না।

পরবর্তীতে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য হাদীস ও আছার একত্র করার পর প্রতীয়মান হয়েছে যে, তারা ইজতিহাদের ভিত্তিতে সেই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছেন যা সুন্নাহয় রয়েছে। স্বয়ং রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও দাদী ও নানীর ক্ষেত্রে এই ফয়সালাই করেছেন। অর্থাৎ দু’জন জীবিত থাকলে তাদের মাঝে ‘সুদুস’ (ছয়ভাগের এক ভাগ) বণ্টন করে দিয়েছেন। দেখুন: সুনানে দারাকুতনী খ. ৪, পৃ. ৯০-৯২; আস সুনানুল কুবরা বায়হাকী খ. ৬, পৃ. ২৩৪-২৩৫

এবার চিন্তা করুন তারা প্রকৃত ঘটনাকে কীভাবে বিকৃত করেছে। উমর রা. সম্পর্কে তাদের বক্তব্য-‘আর একবার এক ব্যক্তি মারা গেলে খলিফা ওমর তার সম্পত্তি বিপত্নিক, বৈমাত্রেয় ও আপন এই তিন জনকে সমানভাবে ভাগ করে দেন যদিও এর মধ্যে একজনের সম্পদের অধিকার নেই।’ এখানে যদিও বিষয়টি অত্যন্ত অস্পষ্ট রাখা হয়েছে, বৈমাত্রেয় ও আপন বলতে কাকে নির্দেশ করা হয়েছে এবং কতজন হলে এই বিধান কিছুই বলা হয়নি, তবুও কোনো সন্দেহ নেই যে, এটি উমর রা. সম্পর্কে একটি মিথ্যা অপবাদ। মাইয়েতের যদি সন্তান না থাকে তাহলে স্বামীর অংশ হল পরিত্যক্ত সম্পদের অর্ধেক। এটা কুরআন মজীদে নির্ধারিত। হযরত উমর রা. তার অংশ ‘অর্ধেক’ থেকে কমিয়ে দিবেন তা অসম্ভব। হাদীস, তাফসীর এবং ফতোয়ার কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবে এ ধরনের কোনো দৃষ্টান্ত আমরা দেখিনি। আপনি সাক্ষাৎকার প্রদানকারী এবং তা প্রকাশকারীকে বলুন এই তথ্যের উদ্ধৃতি দেওয়ার জন্য।

মীরাছের বিষয়ে উমর রা.-এর নীতি এই ছিল যে, যা ওহী (কুরআন ও সুন্নাহ) দ্বারা প্রমাণিত তাতে ইজতিহাদের ভিত্তিতে হ্রাস-বৃদ্ধির কোনো অবকাশ নেই। (দেখুন : সুনানে দারাকুতনী খ. ৪, পৃ. ৯৩-৯৪; তাফসীরে কুরতুবী ৫/৬৯) সারকথা এই যে, ওহীর নুসূস (কুরআন ও সুন্নাহয়) উল্লেখিত মীরাছের আহকামকে রদ-বদলের উপযুক্ত মনে করা সুস্পষ্ট কুফরী। আর সেই কুফরীর সমর্থনে শায়খাইন (আবু বকর ও উমর রা.) কে উদ্ধৃত করা যে কত বড় গর্হিত অপরাধ তা তো বলাই বাহুল্য। শায়খাইন সম্পর্কে সাক্ষাৎকার প্রদানকারী যেসব মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করেছে সে সম্পর্কে কোনো মুমিনেরই বিভ্রান্তি থাকার কথা নয়। কারণ ঈমানী যওকের দ্বারাই এসব উদ্ধৃতির অসারতা ও অবাস্তবতা অনুমান করা যায়। তবে বিস্তারিত জানার জন্য তাকে সংশ্লিষ্ট কিতাবপত্রের সহায়তা নিতে হবে।

আমি অত্যন্ত আশ্চর্য হচ্ছি যে, তারা এ প্রসঙ্গে একটি সমকালীন উদ্ধৃতিও প্রদান করেছে। এটুকু চিন্তাও করেনি যে, তথ্য ও প্রযুক্তির এই যুগে কম্পিউটার বা মোবাইলের সুইচ টিপে যে কারো পক্ষে এই উদ্ধৃতির অবাস্তবতা জেনে নেওয়া সম্ভব। তারা তিউনিসিয়ার উদ্ধৃতি দিয়েছে যে, সেখানে মীরাছের শরীয়া আইন পরিবর্তন করে নারী-পুরুষকে সমান হিস্যার হকদার সাব্যস্ত করা হয়েছে।

প্রথম কথা তো এই যে, তিউনিসিয়া কেন, গোটা পৃথিবীতে যদি আল্লাহর আইন পরিবর্তন করা হয় তবুও আল্লাহর আইনই সত্য ও শিরোধার্য। মুসলমানের ঈমান সেই আইনের উপরই থাকবে এবং তারা তা-ই অনুসরণ করবেন। ভু-পৃষ্ঠে যদি একজন মুসলিমও থাকে তাহলে সেও এ কথা বলবে যে, মুক্তি ও সফলতা আল্লাহর আইনেই রয়েছে, তা পরিবর্তন করার অধিকার কারো নেই। সে আইনের অনুসরণই প্রত্যেকের জন্য অপরিহার্য। তা পরিবর্তন করা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সঙ্গে বিদ্রোহ করার নামান্তর। যখন ভূ-পৃষ্ঠে এই আকীদার একজন মুমিনও থাকবে না তখন কিয়ামত হবে। শুধু বেদ্বীনরাই এমন কথা বলতে পারে যে, অমুক ব্যক্তি কুফরী করেছে তাই সেও কুফরী করবে।

দ্বিতীয় কথা এই যে, তিউনিসিয়ায় মীরাছের আইন পরিবর্তন হয়নি। যে কেউ ইন্টারনেটে তিউনিসিয়ার ‘মাজাল্লাতুল আহওয়ালিশ শাখছিয়্যাহ’ অধ্যয়ন করতে পারেন। তাতে ৫৮ নং অনুচ্ছেদ থেকে ১৮৫ নং অনুচ্ছেদ পর্যন্ত মীরাছের আইন-কানুন উল্লেখিত হয়েছে, যা কুরআন-সুন্নাহ ও ফিকহে ইসলামী ভিত্তিক। যেমন অনুচ্ছেদ ১০৩-এ আপন কন্যার ব্যাপারে বলা হয়েছে والإرث بتعصيب أخيهن لهن، للذكر مثل حظ الأنثيين অর্থাৎ কন্যার সাথে যদি মৃতের পুত্রও বিদ্যমান থাকে তাহলে-পুরুষের জন্য দুই নারীর সমান হিস্যা-নীতি অনুযায়ী সম্পদ বণ্টন হবে। তদ্রূপ অনুচ্ছেদ ১০৫-এ আপন বোনদের সম্পর্কে বলা হয়েছে- والتعصيب بالأخ الشقيق وبالجد للذكر مثل حظ الأنثيين অর্থাৎ বোনের সঙ্গে যদি মৃতের ভাইও বিদ্যমান থাকে তাহলে এক্ষেত্রেও-পুরুষের হিস্যা দুই নারীর সমপরিমাণ-নীতি অনুযায়ী সম্পদ বণ্টিত হবে। এরপরও - আল্লাহ না করুন - সমপ্রতি কোনো বেদ্বীন-মুলহিদ তার রাজনৈতিক বা আইনতগত ক্ষমতার অপব্যবহার করে কুরআনের বিধানের বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ করেছে কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা তিউনিসিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিউনিসিয়ার সংশ্লিষ্ট আইনের বিশেষজ্ঞ উকীল শায়খ মুহাম্মাদ আলহাদী ইবনে মুসতাফা আযযামযামী আমাদেরকে লিখেছেন- ‘সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট মীরাছে নারীকে পুরুষের সমান হিস্যা প্রদানে সফল হতে পারেনি। কিছু ধর্ম-বিরোধী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে এই আন্দোলন চলছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত তারা সফল হতে পারেনি।‘

আমি আপনাকে ‘কানূনুল আহওয়ালিশ শখছিয়্যাহ’ থেকে ‘কানূনুল মীরাছ’ অংশটি পাঠাচ্ছি ...।’ সেখানের আরেকজন বড় ইলমী ব্যক্তিত্ব শায়খ আলী ইবনে মাসউদ লেখেন, ‘তিউনিসিয়ায় নারীকে পুরুষের সমান মীরাছের হিস্যা দেওয়া হয়েছে’-এ কথা সত্য নয়। তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট তা করতে চেয়েছিল, কিন্তু এই দুরভিসন্ধি মাথায় নিয়েই তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে, তা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। কারণ, আপনি তো জানেন যে, এটি কিতাবুল্লাহর মুহকাম ও অটল বিধান। এজন্য সে তা পরিবর্তনে ব্যর্থ হয়েছে। ... এরপরও যদি ধরে নেওয়া হয় যে, সে বা অন্য কেউ এমন কাজ করল তাহলে আল্লাহর দ্বীনে ইলহাদ ও বেদ্বীনীর সূত্রপাত এবং শরীয়তের সঙ্গে ক্রীড়া-কৌতুকের বিষয়ে তার অনুসরণ কখনো বৈধ হবে না ...।’

যে কথাটি সবশেষে বলতে চাই তা এই যে, প্রকৃতপক্ষেই যদি এই শ্রেণীর লোকদের নারীর প্রতি সহানুভূতি থাকত তাহলে তারা নারী-উন্নয়নের নামে কুরআনের বিধান পরিবর্তন করার স্থলে কুরআন-প্রদত্ত প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখত। আমাদের সমাজে নারীরা কি মীরাছের শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত অংশ পেয়ে থাকেন? ওইসব বিচারক ও আইনজীবীদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখুন, তাদের কয়জন পিতার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে বোনের অংশ এবং দাদার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে ফুপীর অংশ (যতটুক কুরআন নির্ধারণ করেছে) পরিশোধ করেছে? তো নির্ধারিত অংশের প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইন প্রনয়ণ ও প্রয়োগের প্রসঙ্গে না গিয়ে নারী জাতির সঙ্গে নিষ্ঠুর প্রতারণা ও পাশ্চাত্যের প্রভুদের বাহবা পাওয়ার জন্য আল্লাহর আইন পরিবর্তনের শ্লোগান দেওয়া হচ্ছে!

বর্তমান পৃথিবীতে কোটি কোটি ঈমানদার নারী এমন রয়েছেন, যারা এইসব ভণ্ডদের আল্লাহ-বিরোধী কর্মকাণ্ডের উপর অভিসম্পাৎ করে থাকেন তদ্রূপ এমন দৃঢ়চেতা ঈমানদার নারীর সংখ্যাও কম নয়, যাদেরকে আল্লাহর বিধানের বিপরীতে গোটা পৃথিবীর সম্পদও যদি প্রদান করা হলে তারা তা অকুণ্ঠ চিত্তে প্রত্যাখ্যান করে দিবেন!

এই বর্ণচোরা গোষ্ঠী কি অন্তত এই আইন প্রনয়ণে সরকারকে বাধ্য করতে পারবে যে, নারীকে পণ্যের মডেল বানানো কিংবা পণ্যের বিজ্ঞাপনে তাদের ব্যবহার করা দণ্ডনীয় অপরাধ? পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’ নারীর উপর যত অবিচার করেছে (যা মানবেতিহাসের অন্ধকারতম যুগের অবিচারকেও হার মানিয়েছে) তন্মধ্যে এটি একেবারে প্রথম সাড়ির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। বলাবাহুল্য, এখানেই তাদের মেকি সহানুভূতি একেবারে উন্মুক্ত হয়ে পড়বে। কথা দীর্ঘ হয়ে গেল। আমি বলছিলাম যে, তিউনিসিয়ার আইন পরিবর্তনের বিষয়টি সম্পূর্ণ অবাস্তব। এটি সাক্ষাৎকার প্রদানকারীর ‘উর্বর’ মস্তিষ্কের কল্পনা! তার দায়িত্বহীনতা কিংবা অকুণ্ঠ মিথ্যাচারের আরেকটি নমুনা হচ্ছে তার শেষ কথাটি। আমাদের সময়ের রিপোর্ট অনুযায়ী তার কথা- ‘বর্তমান শরীয়া আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির পুত্র সন্তান না থাকলে তার সম্পদের উত্তরাধীকার হয় তার ভাই ও ভাইয়ের পুত্ররা। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো এক্ষেত্রে আমরা আবারো তিউনিসিয়ার উদাহরণকে সামনে আনতে পারি। তিউনিসিয়ায় এসব ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির মেয়েরা পিতার সম্পদের উত্তরাধিকার হয়।’

যেহেতু সে শরীয়তকে ছেলেখেলার বিষয় মনে করে এজন্য শরীয়ার সঙ্গে ‘বর্তমান’ শব্দটি প্রয়োগ করেছে, অথচ অতীত ও বর্তমানে সর্বযুগেই শরীয়তের আইন এই যে, মাইয়েতের পুত্রসন্তান না থাকলে, কন্যাসন্তান একজন হওয়ার ক্ষেত্রে সে মীরাছের অর্ধেক এবং দুই বা ততোধিক হওয়ার ক্ষেত্রে তারা মীরাছের দুই তৃতীয়াংশের অধিকারী হয়। এরপর অন্যান্য ‘আসহাবুল ফুরূয’ ও ‘আসাবাত’-এর অংশ। কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা

فان كن نساء فوق اثنتين فلهن ثلثا ما ترك وإن كانت واحدة فلها النصف ফিকহ-ফতোয়া ও ইলমুল ফারাইযের প্রাচীন ও সামপ্রতিক গ্রন্থে এ কথাই বলা আছে। এখন এ উপমহাদেশে ফতোয়া আলমগীরী ও ফতোয়া শামীর উদ্ধৃতি বেশি দেওয়া হয়। ফতোয়ায়ে আলমগীরী হচ্ছে হিজরী দ্বাদশ শতাব্দীর সংকলন, সেখান থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি: وأما النساء فالأولى البنت، ولها النصف إذا انفردت، وللبنتين فصاعدا الثلثان، كذا في الاختيار شرح المنار وإذا اختلط البنون والبنات عصب البنون البنات، فيكون للابن مثل حظ الانثيين كذا في التبيين (ফাতাওয়া আলমগীরী খ. ৬, পৃ. ৪৪৮)
ইসলামিক ফাউণ্ডেশন কর্তৃক সংকলিত ও প্রকাশিত ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ প্রথম খণ্ড, প্রথম ভাগ পৃষ্ঠা ১৭৬ দফা ৪১৯এ বলা হয়েছে: ‘‘কন্যার প্রাপ্য অংশ:
  • ক) মৃতের একজন মাত্র কন্যা বর্তমান থাকিলে সে সমস্ত ত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেক পাইবে;
  • খ) কন্যার সংখ্যা দুই বা ততোধিক হইলে তাহারা সকলে মিলিয়া মোট সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ পাইবে;
  • গ) মৃতের কন্যা ও পুত্রসন্তান বর্তমান থাকিলে ‘পুরুষ নারীর দ্বিগুণ অংশ’ পাওয়ার নীতি অনুযায়ী তাহাদের মধ্যে ত্যক্ত সম্পত্তি বণ্টিত হইবে।’’ আমি বুঝতে অক্ষম, এই আইনের জন্য তাকে তিউনিসিয়ায় চলে যেতে হল কেন?

ঈমান-ইয়াকীন এবং দ্বীন-দুনিয়ার উন্নতির জন্য যদি এরা শরীয়তের আহকামকে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এবং বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করতে আগ্রহী না হয় তাহলে যখন তা পরিবর্তনের কুফরী সংকল্প মাথায় সওয়ার হয়-আল্লাহ রক্ষা করুন- অন্তত তখন তো শরীয়তের হুকুম নির্ভুলভাবে জেনে নেওয়া উচিত। অন্যথায় তাদের ওই বদমতলবও তো ভেস্তে যেতে পারে। আলোচিত বিষয়ে কিন্তু তা-ই ঘটেছে। নানীর প্রাপ্য অংশের বিষয়ে শরীয়ার বিধান বদলাতে যেয়ে এমন কথা সে বলেছে, যা আগে থেকেই শরীয়ার বিধান! তদ্রূপ পুত্রের অবর্তমানে কন্যার প্রাপ্য অংশের বিষয় নতুন বিধান আবিষ্কার করতে গিয়েও শরীয়ার বিধানেরই পুনরাবৃত্তি করেছে!

আর শরীয়তের বিধান জানা থাকা সত্ত্বেও যদি এমন তামাশা করে থাকে তাহলে প্রশ্ন হয় যে, গোটা পাঠক-সমাজকে নির্বোধ ঠাওরানোও কি মানবাধিকারের এই যুগে (?) কোনো অপরাধ নয়? শরীয়ত নিয়ে ছেলেখেলার প্রসঙ্গ না হয় বাদই দিলাম। সবশেষে তার ওই দাবি সম্পর্কেও দু একটি কথা আরজ করছি, যা তার ভাষায়-‘একেক যুগের পরিবেশ ও চিন্তাধারার পরিপ্রেক্ষিতে কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা অনুযায়ী শরিয়া আইন তৈরি হয়েছে। আমরা সাধারণত মনে করি শরিয়া আইন স্থির ও নির্দিষ্ট একটি বিষয়। কিন্তু আদতে তা নয়। এটি পরিবর্তনশীল। শরিয়া আইন যুগে যুগে পরিবর্তিত হতে পারে। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ড. মো. ইকবালের অভিমত তাই। ড. ইকবাল তার ইসলাম ধর্ম পুনর্গঠন প্রবন্ধে এই মত দেন।’

এ প্রসঙ্গে আমার নিবেদন এই:
  • ১. ‘শরীয়া আইন’ একটি ব্যাপক শব্দ। এতে নিম্নোক্ত প্রকারগুলি অন্তর্ভুক্ত :
    • ক) কুরআন ও সুন্নাহয় পরিষ্কারভাবে ঘোষিত বিধিবিধান
    • খ) ইসলামের প্রথম যুগ থেকে অবিচ্ছিন্ন ধারা-পরম্পরায় বর্ণিত ইজমায়ী আহকাম।
    • গ) ওইসব আহকাম, যেগুলোকে শরীয়ত বিশেষ কোনো ‘ইল্লতের’ সঙ্গে যুক্ত করেছে-ইল্লত পাওয়া গেলে হুকুম আরোপিত হবে, ইল্লত পাওয়া না গেলে হুকুমও আরোপিত হবে না।
    • ঘ) মুজতাহাদ ফীহ আহকাম অর্থাৎ ওইসব বিধান যা ইজতিহাদের যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তি ইজতিহাদের সীমারেখার ভিতরে থেকে শরীয়তের দলীলসমূহের আলোকে উদঘাটন করেছেন।
    • ঙ) ব্যবস্থাপনাগত নিয়ম-কানূন, যা শরীয়তের মুবাহ শ্রেণীর বিষয়াদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যে সম্পর্কে শরীয়ত কিছু মৌলিক নীতি প্রদান করেছে এবং প্রায়োগিক খুঁটিনাটি বিচার-বিবেচনা ও অভিজ্ঞতার আলোকে সর্বসাধারণের কল্যাণকে সামনে রেখে নীতি নির্ধারণ করার হুকুম দিয়েছে। যেমন ট্রাফিক-ব্যবস্থা, ডাক-ব্যবস্থা এবং যেসব অপরাধের হুদূদ ও তা’যীর শরীয়তের পক্ষ হতে নির্ধারিত নয়, তার জন্য উপযুক্ত দণ্ডবিধি প্রনয়ণ ইত্যাদি।

    এই পঞ্চম বিষয়টি এমন, যাতে সময় ও পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে যৌক্তিক ও যথার্থ রদ-বদলের অবকাশ আছে। চতুর্থ বিষয়ে ইজতিহাদের যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তিদের বিভিন্ন মতামত হতে পারে এবং পুনরায় চিন্তা-ভাবনার পর এক মুজতাহিদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রেও ইজতিহাদের যোগ্যতাহীন কারো অনুপ্রবেশের অধিকার নেই। তাকে তাকলীদের নিয়ম-কানুন অনুযায়ী মুজতাহিদীনের তাকলীদ করতে হবে। তৃতীয় প্রকারটি যুক্ত ইল্লতের সাথে। অতএব তা শুধু সময় ও সমাজের পরিবর্তনে পরিবর্তিত হয় না। এটি পরিবর্তিত হওয়া নির্ভর করে ইল্লতের পরিবর্তনের উপর। একটি দৃষ্টান্ত : নারীর বিষয়ে শরীয়তের নির্দেশ হল গৃহের অভ্যন্তরে নিভৃত কোণে নামায আদায় করা। এটিই তার জন্য উত্তম। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে মসজিদে উপস্থিত হতে নিরুৎসাহিত করেছেন। এরপরও তিনি পুরুষদের লক্ষ্য করে বলেছেন যে, ‘আল্লাহর কোনো বাঁদী যদি তোমাদের কাছে মসজিদে আসার অনুমতি প্রার্থনা করে তাহলে তাদেরকে নিষেধ করো না।’ তদ্রূপ কেউ যদি আসতেই চায় তাহলে বিভিন্ন শর্তের সাথে আসার অনুমতি দিয়েছেন।

    সাহাবায়ে কেরাম তাঁর নির্দেশনা ও আচরণ থেকে উপলব্ধি করেছেন যে, বর্তমান তাকওয়া ও পরহেযগারীর পরিবেশে যেহেতু শর্তযুক্ত সীমিত অনুমতিতে অসুবিধা নেই, নারীরা আশঙ্কামুক্ত তাই এই অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল যে, একদিকে সে শর্ত-শরায়েত রক্ষিত হচ্ছে না অন্যদিকে তাকওয়া-পরহেযগারিতেও কমতি আসছে। তখন অনুমোদনের ইল্লতের (কারণ) বিদ্যমানতা সন্দেহযুক্ত হওয়ায় সাহাবায়ে কেরাম নিষেধ করতে লাগলেন। সে সময়ই আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রা. তাঁর ঐতিহাসিক উক্তিটি করেন- ولو ادرك رسول الله صلى الله عليه وسلم ما أحدث النساء لمنعهن كما منعت نساء بنى اسرائيل অর্থাৎ নারীগণ (আজ) যা আরম্ভ করেছে তা যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখতেন তাহলে তাদেরকে নিষেধ করে দিতেন যেভাবে বনী ইসরাইলের নারীদেরকে নিষেধ করা হয়েছি।’ সহীহ বুখারী হাদীস : ৮৬৯; সহীহ মুসলিম হাদীস : ৪৪৫) এ তো গেল তৃতীয় প্রকারের আলোচনা। প্রথম দুই প্রকারের বিষয়টি একদম স্পষ্ট। এতে রদ-বদলের কোনো সুযোগ নেই। এতে যে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের অর্থই হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখার পরিবর্তন এবং আল্লাহর কালাম ও তাঁর ওহীর বিকৃতিসাধন, যা সুস্পষ্ট কুফরী এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ। ইসলামের উপর যার ঈমান আছে তাকে এই কথা বোঝানোরও প্রয়োজন নেই। কারণ সে কেমন মুমিন ও মুসলিম, যে আল্লাহ ও তার রাসূলের উপরও আপত্তি করে? সাক্ষাৎকার প্রদানকারী যে বিষয়ে তার মতামত প্রকাশ করেছে তা কুরআন মজীদে ঘোষিত একটি সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বিষয়; যে বিষয়ে সকল যুগে গোটা উম্মতের ইজমা ছিল এবং যা ‘জরুরিয়াতে দ্বীনে’র মধ্যে শামিল। এতে রদ-বদলের প্রসঙ্গই অবান্তর এবং ছাফ বেদ্বীনী।

  • ২. এমন কোনো কথা বলা যে, পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে কুরআনের আয়াতের বিভিন্ন তাফসীর হয়েছে এবং সেসব তাফসীরের ভিত্তিতে শরীয়া আইন প্রস্তুত হয়েছে, এটি একটি অস্পষ্ট কথা এবং তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই অস্পষ্ট রাখা হয়েছে, যাতে শরীয়তের কতয়ী আহকাম তথা অকাট্য বিধানাবলির অপব্যাখ্যার জন্য তা ব্যবহার করা যায়। এই মুহূর্তে আমি শুধু একটি প্রশ্নই করছি। তা এই যে, মীরাছের আলোচিত মাসআলায় তাফসীর বা ফিকহী মাযহাবের কী মতভেদ আছে? এখানে তো না তাফসীরের কোনো মতভেদ আছে, না ফিকহী মাযহাবের। এটি তো একটি অটল ও অবিসংবাদিত বিধান। মতভেদের প্রসঙ্গই এখানে অবান্তর।
  • ৩. ড. ইকবাল তার বক্তৃতায় ইজতিহাদী ও ইনতিযামী বিষয়াদি সম্পর্কেই আলোচনা করেছেন। এই শ্রেণীর নব উদ্ভূত সমস্যাবলির সমাধান শরীয়তের নীতিমালার আলোকে প্রদান করা এবং কুরআন ও সুন্নাহর বিধি-বিধানকে বর্তমান যুগের বোধ, ভাষা ও উপস্থাপনার নিকটবর্তী করে সংকলন করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং এ প্রসঙ্গে অর্থহীন রক্ষণশীলতা পরিহার করার এবং প্রচলিত বিশ্ব-ব্যবস্থার তুলনায় শরীয়ার আইনের শ্রেষ্ঠত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি যেহেতু একজন কবি ও দার্শনিক ছিলেন, ফিকহ ও উসূলে ফিকহ তার বিষয় ছিল না, আর না আহলে ইলমের সোহবতে থেকে দ্বীনী ইলম অর্জনের সুযোগ তার হয়েছে তাই নিজের আলোচ্য বিষয়কে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। উপরন্তু যে প্রস্তাব তিনি পেশ করেছেন তা নতুন কিছু নয়, প্রতি যুগের দায়িত্বশীল ফকীহগণ এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। যাই হোক, তাঁর সদিচ্ছা সম্পর্কে সন্দেহের কারণ নেই এবং তার প্রস্তাবও মৌলিকভাবে সঠিক, তবে তার ভাষা ও উপস্থাপনায় কোথাও কোথাও অসম্পূর্ণতা ও অস্পষ্টতা রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুল বুঝাবুঝিরও অবকাশ রয়েছে। কিছু কথা এমনও আছে, যা সম্পূর্ণ ভুল। তবে তাঁর হৃদয়ে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জন্য দরদ ও কল্যাণকামিতা ছিল। পাশ্চাত্য সভ্যতার স্বরূপ ও হাকীকত সম্পর্কে উত্তমরূপে অবগত ছিলেন। এজন্য অত্যন্ত সফলভাবে পাশ্চাত্য সভ্যতার দোষত্রুটিগুলো তিনি চিহ্নিত করেছেন। বস্তুত এটিই তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান। আলোচ্য সাক্ষাৎকারের বিচারপতি তো ইকবালের উদ্ধৃতি দিয়েছেন কিন্তু মাঝের দূরত্ব সম্পর্কে চিন্তা করেননি। কোথায় ইকবালের মতো মর্দে মুমিন আর কোথায় তার মতো লোকের বেদ্বীনী কর্মকাণ্ড! তিনি কি পাশ্চাত্য সভ্যতার বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনায় ইকবালের সহগামী হতে পারবেন? নারীর বিষয়ে পংক্তির পর পংক্তিতে ইকবাল যেভাবে ইসলামী শিক্ষা ও নির্দেশনার প্রতিনিধিত্ব করেছেন তা কি তিনি স্বীকার করতে পারবেন? ‘আসরার ও রুমূয’-এ ইকবাল কী বলেন শুনুন- در اين معنى كه نظام ملت غير از آئين صورت نه بنود وآئين ملت محمديه قرآنن ست অর্থাৎ ‘আইন ছাড়া কোনো জাতির স্থিতি ও শৃঙ্খলা অস্তিত্ব লাভ করে না। আর মিল্লতে মুহাম্মদিয়ার আইন হচ্ছে কুরআন।’ এরপর সেই কবিতায় তিনি বলেছেন, কুরআন হচ্ছে আবাদী কিতাব ও শাশ্বত গ্রন্থ। এতে যেমন কোনো ধরনের সন্দেহ-সংশয় নেই, তেমনি কোনো ধরনের রদ-বদলেরও অবকাশ নেই।’ অন্য কবিতায় তিনি বলেন, ‘রাজ্যশাসন থেকে দ্বীন-ধর্ম ভিন্ন হয়ে গেলে সে হবে চেংগীজি শাসন। রাষ্ট্র ও ধর্ম যদি একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে সেখানে লালসাই হবে রাজা, লালসাই উযির। এই কথাগুলো কি বিচারপতি সাহেব স্বীকার করতে পারবেন?
  • ৪. আলোচিত বক্তৃতায় ইকবাল শরীয়তের দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে আইন প্রনয়ণের যে প্রস্তাব দিয়েছেন তাতে এ কথাও বলেছেন যে, আইন প্রনয়ণের কাজ আলিমদের তত্ত্বাবধানে হওয়া জরুরি। এতে আলিমগণের মৌলিক ও নীতিনির্ধারণী ভূমিকা থাকতে হবে। যাতে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেরা শরীয়তের আহকাম বর্ণনার ক্ষেত্রে ভুল না করে। রাব্বানী সাহেব কি এই প্রস্তাব সহ্য করতে পারবেন?
  • ৫. আমি আগেই বলেছি যে, উপরোক্ত বক্তৃতায় ইকবাল ঘুণাক্ষরেও বলেননি যে, কুরআন-সুন্নাহয় উল্লেখিত শরীয়তের অটল বিধানাবলিতে হস্তক্ষেপ করা যাবে; বরং তিনি ওইসব লোকের নিন্দা করেছেন, যারা কুরআনে উল্লেখিত বিধানসমূহের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন ও ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে। তিনি তুর্কি কবি যিয়ার ব্যাপারে শক্তিশালী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ সমালোচনা করেছেন, যে কুরআনের পারিবারিক আইন ও মীরাছের আহকামের স্থলে নতুন প্রস্তাব পেশ করেছিল। ইকবাল বলেন, ‘কবি জিয়ার দাবি সম্পর্কে আমার ধারণা এই যে, সম্ভবত তিনি ইসলামী পরিবার সম্পর্কিত আইন সম্যক অধ্যয়ন করেননি। কুরআনের উত্তরাধিকার ব্যবস্থার অর্থনৈতিক তাৎপর্যও মনে হয়, তাঁর কাছে যথাযথ রূপে সুপ্রকাশ নয়। ইসলামী বিধানে বিবাহ একটি দেওয়ানি চুক্তি। বিবাহের সময় স্ত্রী ইচ্ছা করলেই শর্তসাপেক্ষে স্বামীর তালাক দেবার অধিকার নিজের জন্যে অর্জন করে নিতে পারে। উত্তরাধিকারের বেলায়ও জিয়ার প্রস্তাবিত সংশোধন ভুল ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। আইনসম্মত অংশের অসমতার জন্যেই যে পুরুষ নারীর ওপর আইনগত আধিপত্যের অধিকার পেয়ে যায়, এ কথা মনে করা উচিত নয়। তা হলে এ ব্যবস্থা ইসলামের মূলনীতির বিরোধী হয়ে দাঁড়াত।
  • কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে: নারীর ওপর পুরুষের যেমন অধিকার, পুরুষের ওপর নারীরও তেমনি অধিকার। কন্যার সম্পত্তির অংশ নির্ধারিত হয় তাকে জন্মসূত্রে নিকৃষ্ট মনে করে নয়; বরং সমাজ সংস্থায় তার নির্বিঘ্ন স্থান ও সুযোগাদির বিবেচনায়। অধিকন্তু কবির নিজ সিদ্ধান্ত অনুসারেও উত্তরাধিকার ব্যবস্থাকে সম্পত্তি বিভাগ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে বিচার করলে চলবে না; বরং অন্যান্য আইন-কানুন এবং ব্যবস্থাপনার সাথে একযোগে বিচার করতে হবে। ইসলামী আইন অনুসারে, নারী বিবাহকালে পিতা ও স্বামীর কাছে যা পায় তাতে তার নিরঙ্কুশ অধিকার বর্তায়। (মহর এবং) যৌতুক (প্রচলিত যৌতুক নয়; বরং বিবাহের সময় মেয়েকে তার পিতা-মাতা স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে হাদিয়া-উপঢৌকন দিয়ে থাকেন) সম্পদের সে পূর্ণ অধিকারিণী হয়; তা নগদ বা পরে আদায় করা তারই ইচ্ছাধীন; এবং তা আদায়সাপেক্ষে সে স্বামীর সমগ্র সম্পত্তি আটক রাখতে পারে। এসব সত্ত্বেও নারীর সমগ্র জীবনব্যাপী ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর ওপর ন্যস্ত রয়েছে। এসব কথা স্মরণে রেখে ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের বিচার করলে স্বতঃই প্রতীত হবে যে, এতে পুত্র ও কন্যার আর্থিক সমতা সাধনের যথাযথ কার্যকরী ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং কবি জিয়া যা চেয়েছেন তা সরাসরি স্বীকৃত না হয়ে থাকলেও অন্যভাবে স্থির নিশ্চিত করা হয়েছে। ফন্ ক্রেমার কুরআনীয় আইনের উত্তরাধিকার প্রথাকে একটি বিশিষ্ট মৌলিক অবদান বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আসলে মুসলিম আইনজ্ঞরাই আজ পর্যন্ত এর প্রতি যথোপযুক্ত মনোযোগ দেননি।’ (ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন, পৃ. ১৪৫-১৪৬)

    আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যে বক্তৃতায় ইকবাল কুরআনের মীরাছ বণ্টনের বিধিবিধানকে কোনো ধরনের হ্রাস-বৃদ্ধি ছাড়া হুবহু অনুসরণের আহ্বান করেছেন সেই বক্তৃতার উদ্ধৃতি দিয়ে সেই বিধি বিধান পরিবর্তনযোগ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে! ইকবাল তার প্রবন্ধ ‘ইসলাম ও আহমদিয়্যাত’-এ লিখেছেন যে, কুরআনের মীরাছের আইন পরিত্যাগ করে সুইজারল্যান্ডের উত্তরাধিকার আইন গ্রহণ করা তুর্কীদের একটি মারাত্মক ভুল।’ - (হরফে ইকবাল)

  • ৬. ইকবালের এই বক্তৃতার ইংরেজি ‘The Principle of Movement in the Stucture of Islam’ -এর বাংলা অনুবাদ ইসলামিক ফাউণ্ডেশন ও আল্লামা ইকবাল সংসদ থেকে প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম ‘ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন।’ এই শিরোনাম ইংরেজি শিরোনামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইকবাল নিজেও এক প্রবন্ধে এ বক্তৃতার উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তাতে তার শিরোনাম ‘ইসলামী তাফাককুর কী তাশকীলে জাদীদ’ (ইসলাম আওর আহমদিয়্যত, হরফে ইকবাল, সংকলনে লতীফ আহমদ শেরওয়ানী এম.এ) এই সবগুলো শিরোনামই অস্পষ্ট। সঠিক শিরোনাম হবে, ‘ইজতিহাদ কী আহম্মিয়্যত আওর কানুনে শরীয়ত কী তাদবীনে জাদীদ কী জরুরত’ অর্থাৎ ইজতিহাদের গুরুত্ব ও শরীয়া আইনের যুগোপযোগী সংকলনের প্রয়োজনীয়তা।’ কারণ ইকবাল এ বিষয়েই তাঁর উপরোক্ত বক্তৃতায় তার জ্ঞান ও চিন্তা অনুযায়ী আলোকপাত করেছেন। কিন্তু রাব্বানী সাহেব নিজের পক্ষ থেকে শিরোনাম দিয়েছেন: ‘ইসলাম ধর্মের পুনর্গঠন।’ ইসলামের স্বরূপ ও হাকীকত যার জানা আছে সে ইসলামের সঙ্গে ‘পুনর্গঠন’ শব্দ ব্যবহার করতে পারে না। এটা তার পক্ষেই সম্ভব যে মনে করে যে, দ্বীন ইসলাম ও তার মৌলিক উৎসসমূহ মানবরচিত আইনকানুনের সমগোত্রীয় ও সমমর্যাদার। (নাউযুবিল্লাহ) আর বাস্তবতা এই যে, এই শ্রেণীর লোকেরা দ্বীনে ইসলাম, শরীয়তে ইসলাম ও কিতাবে ইসলাম (কুরআন কারীমকে) মানবরচিত আইন কানুনের চেয়েও তুচ্ছ মনে করে (নাউযুবিল্লাহ! ছুম্মা নাউযুবিল্লাহ) কারণ সাধারণ আইন-কানুনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য তাদের নিকটেও শর্ত-শরায়েত আছে। এতে যে কারো ব্যাখ্যা ও উপস্থাপনা গ্রহণযোগ্য হয় না। শুধু বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যই গ্রহণযোগ্য। পক্ষান্তরে তাদের দৃষ্টিতেই কুরআন-সুন্নাহ ও আহকামে শরীয়তের ব্যাখ্যা ও উপস্থাপনার বিষয়ে যে কেউ মত প্রকাশ করতে পারে, এমনকি তা দেশের আইনও হতে পারে! যদিও তার দ্বীনদারী ও আমানতদারী এবং ইলম ও আকলের অবস্থা তা-ই হয় যা উপরোক্ত সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত!

যাই হোক, যে ব্যক্তি ইকবালের ওই বক্তৃতার উপর ‘ইসলাম ধর্মের পুনর্গঠন’ শিরোনাম যুক্ত করেছে, সে একই সাথে দ্বীন ও শরীয়ত, কুরআন ও সুন্নাহ, সত্য ও বাস্তবতা, ন্যায় ও ইনসাফ, এমনকি খোদ ইকবালের উপরও জুলুম করেছে। আল্লাহ তাআলা তাকে হেদায়েত দান করুন। আরো জানতে হলে আলকাউসারের আগামী কোনো সংখ্যায় ‘ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা ও ইসলামী শরীয়তে রাজ্যশাসনের স্থান’ বিষয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধটির জন্য অপেক্ষা করুন। সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলাই উত্তম রক্ষাকারী।

حسبنا الله ونعم الوكيل

 

advertisement